বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে আইন আছে। কিন্তু তা বেশিরভাগ সময়েই নাবালিকার নাগালের বাইরে। এই কাজগুলো বিভিন্ন স্তরে চলছিল স্যাকরার ঠুকঠাকের মতো, কিন্তু কামারের এক ঘা দিয়ে বিশ্বের দরবারে নিয়ে এলেন রোশনি পরভিন। বিহার বাংলা সীমানার পঞ্চাশটিরও বেশি নাবালিকার বিয়ে ঠেকিয়েছেন তিনি। তাঁর এই কাজের কৃতি হিসেবে ১৬ নভেম্বর জেনিভায় রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ইয়াং অ্যাক্টিভিস্টস সামিট’-এ তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
ভবানীপুর নিবাসী রায়বাহাদুর দুর্গাচরণ মিত্র প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন পড়তেন যাঁর সঙ্গে, তাঁর নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমকে তিনি বলেছিলেন, কিছু সামাজিক কুপ্রথা নিয়ে কয়েকটি নভেল লিখতে, যেমন– বরপণ, যেমন বাঙালির চা-পানের বিলাসিতা কিংবা যৌথ কারবার কী করে সফলভাবে চালানো যেতে পারে। তা না, বঙ্কিমের উপন্যাসে খালি লভ আর লড়াই!
সমাজের উন্নতিকল্পে রায়বাহাদুর নিজেই ‘সামাজিক সমস্যা সমাধান’ নামে একটি কেতাব লিখে ফেললেন। তাতে ছিল বাল্যবিবাহ বলে একটি পরিচ্ছেদ। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, ‘বাল্যবিবাহ খুব ভাল জিনিস। আমাদের সমাজে এই একান্নবর্তী পরিবার প্রথা যতদিন প্রচলিত থাকবে, ততদিন বাল্যবিবাহ ভিন্ন উপায় নেই। কেবলমাত্র স্বামীটিই স্ত্রীলোকের পরিজন নয়, তার শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাসুর, দেওর, ননদ, ভাজ– এসব নিয়ে ঘরকন্না করতে হবে। সুতরাং ছোটবেলা থেকেই বউকে সেই পরিবার ভুক্ত হতে হবে।’
তবে বিপর্যয় ঠেকাতে, ডাক্তারি শাস্ত্র অনুসারী একটি দাওয়াই দেন দুর্গাচরণ। সেটা হল বাল্যবিবাহ হবে বটে, কিন্তু একটু বয়স না হলে স্বামী-স্ত্রীর দেখাসাক্ষাৎ হবে না। মেয়েদের বেলা তা ১৬ আর ছেলেদের ২৪।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘নিষিদ্ধ ফল’ গল্পের রায়বাহাদুরকে যদিও এই বয়স কেটে ১৪ আর ২২ করতে হয়েছিল পুত্র আর পুত্রবধূর নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের মরিয়া অভিযান দেখে। সে অন্য প্রসঙ্গ।
কথা হচ্ছে, ফাল্গুন ১৩২২ সালে লেখা এই গল্পের পর ১০৮ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু কলকাতা তথা ভারতের তিমির কিঞ্চিৎ ফিকে হলেও অবসিত হয়নি মোটেই। ভবানীপুর থেকে কিসানগঞ্জের ভাষিক, সাংস্কৃতিক, এবং কালগত দূরত্ব যাই হোক না কেন, বাল্য বিবাহের ছবিটা বেশি বদলায়নি।
জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার হিসেবে, সারা পৃথিবীর মোট বাল্য বিবাহের ৪০ শতাংশ হয় ভারতে। এর মধ্যে এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার আর ত্রিপুরা, আর সবথেকে কম কেরলে। বাল্যবিবাহের কারণ হিসেবে যা উঠে আসে, তা হল রীতি এবং ঐতিহ্য, যার মধ্যে একটি বরপণ। মেয়ের বয়স যত বেশি হবে, তত বাড়বে পণের পরিমাণ। এই জন্যেই পরিবার সাত তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে চায়। আর একটি কারণ অবশ্যই দারিদ্র এবং অশিক্ষা। বিয়ের নামে মেয়েকে বেচে অর্থ উপার্জন করে অনেক দরিদ্র পরিবার। এছাড়া মেয়ের যৌন নিরাপত্তা এবং পরিবারের সুনাম অক্ষুন্ন রাখা। এর আরেকটি চরম রূপ দেখি অনার কিলিং। অর্থাৎ, মেয়ের যৌন ইচ্ছা পরিবারের সম্পত্তি। লিঙ্গ বৈষম্য অবশ্যই একটা বড় কারণ। এবং অনেক পরিবার মনে করে বিয়েটাই মেয়েদের একমাত্র কেরিয়ার। তাই যত আগে বিয়ে দেওয়া যায়, তত ভালো। মেয়েদের পড়াশোনা শেখানো অনর্থক। বহু বছর আগে শরৎকুমারী চৌধুরানীর ‘শুভ বিবাহ’ উপন্যাসে একটি চরিত্র বলেছিল মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করে কেবল পয়সা নষ্ট। ওই টাকায় বিয়ের সময় দুটো গয়না বেশি দেওয়া যাবে। এর সঙ্গে অবশ্যই রয়েছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে ধর্ষণের সংখ্যা বাড়া এবং ধর্ষকরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে বিনা শাস্তিতে। তাই বাবা মা ভাবেন, যত তাড়াতাড়ি এই গলার কাঁটা উপড়ে ফেলা যায় ততই মঙ্গল।
বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে আইন আছে। কিন্তু তা বেশিরভাগ সময়েই নাবালিকার নাগালের বাইরে। আছে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প, অভিযান। যেমন পশ্চিম মেদিনীপুরকে বাল্যবিবাহ মুক্ত জেলা হিসেবে গড়ে তুলতে ছেলেদের স্কুলে স্কুলে বয়ঃসন্ধিজনিত বিষয়ে আলোচনার জন্য ‘বন্ধুমহল’ নামে ক্লাব খোলার প্রচেষ্টা। বড় পদক্ষেপ নিয়েছে হরিয়ানা সরকার। তারা ১৯৯৪ সালে চালু করেছে ‘অপনি বেটি, অপনা ধন’ প্রকল্প। যদি আঠেরো বছর পর্যন্ত মেয়ে অবিবাহিত থাকে, তবে সরকার মেয়ের নামে মা-বাবাকে টাকা দেবে। আছে ‘নওবত বাজা’ প্রকল্প, যেখানে একটি হেল্প লাইনে ফোন করে বাল্য বিবাহ রোখা যেতে পারে।
আরও পড়ুন: নার্গেস মহম্মদির নোবেল প্রাপ্তি এক নতুন বসন্তের স্বপ্ন
এই কাজগুলো বিভিন্ন স্তরে চলছিল স্যাকরার ঠুকঠাকের মতো, কিন্তু কামারের এক ঘা দিয়ে বিশ্বের দরবারে নিয়ে এলেন রোশনি পরভিন। বিহারের কিসানগঞ্জের শিমুলবাড়ি গ্রামের রোশনি পরভিন। বিহার বাংলা সীমানার পঞ্চাশটিরও বেশি নাবালিকার বিয়ে ঠেকিয়েছেন তিনি। তাঁর এই কাজের কৃতি হিসেবে ১৬ নভেম্বর জেনিভায় রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ইয়াং অ্যাক্টিভিস্টস সামিট’-এ তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি বলবেন ‘ভারত ও সীমান্তবর্তী এলাকায় বাল্য বিবাহের কুফল ও বর্তমান অবস্থা’ এই বিষয়ে।
কিসানগঞ্জ। ঠিক বিহারের আর পাঁচটা ধুলো পড়া ছোট শহরের মতো নয়। ইতিমধ্যেই পেয়েছে ‘ক্লিনেস্ট সিটি অফ বিহার’-এর তকমা। যে ছোট ছোট শহরগুলো আজকাল হিন্দি সিনেমায় উঠে আসছে ‘লোকাল ইজ গ্লোবাল’ জয়ধ্বনি দিতে দিতে, সেইরকম একটি জাগরণমুখী শহর কিসানগঞ্জ, যেখানে এসে গেছে ইন্টারনেট এবং অ্যান্ড্রয়েড ফোন, তরুণ-তরুণীরা নিজেদের স্বপ্ন সেঁকে নিতে চাইছে বিশ্বায়নের আঁচে। তবু রোশনির লড়াইটা সহজ ছিল না। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় অটো চালক বাবা তাঁর বিয়ে দিয়ে দিলেন, বিয়ের পর পড়তে চেয়ে অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার রোশনি শেষ পর্যন্ত এক বছরের শিশুপুত্র নিয়ে ফিরে এলেন বাবা-মার কাছে। দুরন্ত জেদ সম্বল করে পড়া শুরু করলেন আবার। ২০১৯ সালে যোগ দিলেন ‘ইউনেস্কো’-র প্রোজেক্ট কোঅর্ডিনেটর পদে।
কিসানগঞ্জ একসময় মিথিলার অংশ ছিল। সেই মিথিলা, যেখানে রাজা জনকের সভায় প্রবাদপ্রতিম ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্ন করার সাহস দেখিয়েছিল অর্বাচীন গার্গী। এই মিথিলার মেয়ে বৈদেহী অপমানজনক শর্তে রামচন্দ্রের স্ত্রী হয়ে থাকার থেকে বেছে নিয়েছিলেন বসুন্ধরার কোল। রোশনিকে দেখে মনে হল, আজকের কিসানগঞ্জে কোথায় যেন লুকিয়ে আছে সেই মিথিলা। যে দেশে আগামী দিনে ১০ কোটি মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হতে চলেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেখানে ৫০ সংখ্যাটি আদৌ যথেষ্ট নয়। মনে রাখতে হবে, এরা সেইসব মেয়ে, যারা কোনও রকমে ভ্রুণহত্যা এড়িয়ে পৃথিবীর আলো দেখেছে, তাদের আবার অকালে বিয়ে দিয়ে ঠেলে দেওয়া হবে নিঃসীম অন্ধকারে। কিসানগঞ্জ থেকে খুব দূরে নয়, বিহারেরই একটি গ্রামে একবার এমন এক অসহায় বালিকাকে দেখেছিলেন শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত।
‘তাহার মুখখানি আমি আজও মনে করিতে পারি! তাহার কারণ এই যে, দশ-এগারো বছরের মেয়ের চোখে এমন করুণ, এমন মলিন-উদাস চাহনি, আমি আর কখনও দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। তাহার মুখে, তাহার ঠোঁটে, তাহার চোখে, তাহার সর্ব্বাঙ্গ দিয়া দুঃখ এবং হতাশা যেন ফাটিয়া পড়িতেছিল।… মেয়েটি হাত দিয়া চোখের জল মুছিয়া বলিল, হাঁ। আমার বাবার নাম গৌরী তেওয়ারী, তুমি চেনো? আমি তিনমাস শ্বশুরবাড়ী এসেছি– একখানি চিঠিও পাইনে। বাবা, দাদা, মা, গিরিবালা, খোকা কেমন আছে, কিছু জানিনে। ঐ যে অশ্বত্থ গাছ– ওর তলায় আমার দিদির শ্বশুরবাড়ী। ও-সোমবারে দিদি গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে– এরা বলে, না– সে কলেরায় মরেছে।… দিদি রাজপুরে যাবার জন্য দিনরাত কাঁদ্ত, খেত না, শুত না। তাই তার চুল আড়ায় বেঁধে তাকে সারা দিনরাত দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। তাই দিদি গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে।… আমি এদের কথা কিছু বুঝ্তে পারিনে, তাদের রান্না মুখে দিতে পারিনে– আমি দিন-রাত কাঁদি; কিন্তু বাবা আমাকে চিঠিও লেখে না, নিয়েও যায় না।
জিজ্ঞাসা করিলাম, আচ্ছা, তোমার বাবা এতদূরে তোমার বিয়ে দিলেন কেন? মেয়েটি কহিল, আমরা যে তেওয়ারী। আমাদের ঘর ও-দেশে ত পাওয়া যায় না।
তোমাকে কি এরা মার-ধোর করে?
করে না? এই দেখ না, বলিয়া মেয়েটি বাহুতে, পিঠের উপরে, গালের উপর দাগ দেখাইয়া উচ্ছ্বসিত হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল, আমিও দিদির মত গলায় দড়ি দিয়ে মর্ব।’
আরও পড়ুন: শিল্পী হিসেবে পুরুষ যতটা স্বাধীন, সেই স্বাধীনতার থেকে মেয়েরা এখনও বহু দূরে
গৌরী তেওয়ারির বাড়িতে চিঠি লিখেছিলেন শ্রীকান্ত। কিন্তু আদৌ সে চিঠি পৌঁছেছিল কি ওর বাবার কাছে, বা পৌঁছলেও ওর বাবা এত সামান্য ব্যাপারে ছুটে আসার কথা ভাবেননি নিশ্চয়ই। কারণ বাল্যবিবাহের একটি প্রধান কারণই তো গলগ্রহ কন্যাসন্তানকে ধর্মের দোহাই দিয়ে দ্রুত ঘাড় থেকে নামিয়ে দেওয়া।
‘মেয়ের নাম ফেলি/ পরে নিলেও গেলি/ যমে নিলেও গেলি’।
আজকে হলে হয়তো রোশনি পরভিন বাঁচাতে পারতেন গৌরী তেওয়ারির মেয়েটিকে, আলোয় ফেরাতে পারতেন গৌরীদানের অনেক গৌরীকেই।