Robbar

আমি বিশ্বাস করি সই ছবিরই অংশ

Published by: Robbar Digital
  • Posted:February 27, 2025 9:46 pm
  • Updated:February 27, 2025 11:46 pm  

২৩ ফেব্রুয়ারি, রবিবার সকাল। সাউথ সিটি কমপ্লেক্স। দরজা খুলতেই অন্য একটি ঘর থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন যোগেন চৌধুরী। চারপাশে ছড়ানো-ছিটনো ছবি, বইপত্তর। বইয়ের তাকে চোখ রাখলে ‘পড়ুয়া’ যোগেন চৌধুরীর পুস্তক-স্বাদ টের পাওয়া যায়।  কথাবার্তা ঘুরে এলো তাঁর ছোটবেলা থেকে, আর্ট কলেজ হয়ে শান্তিনিকেতনের দিনগুলোকে ছুঁয়ে। কবিতা, ছবি, রবীন্দ্রনাথ, শিল্পচিন্তার নানা টুকরো-টাকরা নিয়ে আজ যোগেন চৌধুরীর সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্বিত বসু, সাক্ষী থাকলেন শিল্পমুগ্ধ অরিঞ্জয় বোস। ফোটোগ্রাফি ব্রতীন কুণ্ডুর।

সম্বিত বসু

পুরনো কথা দিয়েই শুরু করি। আপনি তো ফরিদপুরের। কিশোর বয়সে ভাড়াবাড়ি ছাড়তে হলেও, একরকম দুঃখ পেয়ে বসে, মনখারাপ থাকে। আপনি তো দেশ ছেড়ে এলেন। কীরকম ছিল ওই ৮-৯ বছর বয়সের দেশছাড়া কিশোর?

ওই বয়সটায়, আমার এক রকমের বাস্তববোধ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ধরেই নিয়েছিলাম, দেশ ছাড়তে হচ্ছে। ছোট থেকেই আমি কল্পনাপ্রবণ, কিন্তু তাই বলে ‘রিয়ালিটি সেন্স’ বিচ্ছিন্ন নই। বাস্তব আর কল্পনা– দু’জনেই সেই বয়স থেকেই আমার বন্ধু। আমি যা কিছু করি, তার সঙ্গে এই বাস্তববোধের যোগাযোগ রয়েছে। আমি চলে এলেও, বাবা আসতে চায়নি। বাবার নিজের মাটির প্রতি টান ছিল প্রবল। বাবা আর ঠাকুরমা থেকে গিয়েছিলেন। বাবা আসেন দু’বছর পর। ওঁদের দেশভাগটা অনেক তীব্রভাবে বোধ হয়েছিল। আমার কাছে তা ছিল নিতান্তই একটা ঘটনা। তাই কিশোরটির মনে হয়েছিল– যেতে হচ্ছে, তাই যাচ্ছি।

বাংলাদেশের স্মৃতির ক্যানভাস। শিল্পী: যোগেন চৌধুরী

মনোহরপুকুর রোড, যেখানে এসে আপনারা থাকলেন, সেই বাড়ির দেওয়ালে লাল-নীল পেনসিল দিয়ে আপনি একটা ময়ূর এঁকেছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ওটাই আপনার প্রথম আঁকা। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, ফরিদপুরের বাড়িতে আপনার বাবার আঁকা কৃষ্ণর কালীয়দমনের ছবি। আবার পরে, গড়িয়াহাটের রাস্তায় ময়ূর-চাঁদ মেশানো সস পেন্টিং দেখছেন। ময়ূর কি আপনাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে?

এভাবে ভাবিনি কখনও। গড়িয়াহাটের রাস্তায় আসলে পপুলার টেকনিকে আঁকা বেশ কিছু ছবি বিক্রি হত তখন। তখন ছোট ছোট কার্ডের ওপরে আঁকতাম। আমার দাদা নগেন্দ্রনাথ চৌধুরী কমিউনিস্ট পার্টি করত। কার্ড আসত রাশিয়া থেকে। সেই কার্ডে ছবি আঁকতাম। তখন কলোনিতে এসে পড়েছি। আর্ট কলেজের ছেলেরাও ছবি আঁকত, দেখতাম।

নানা সময়ের আত্মপ্রতিকৃতি

আজ ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ম্যাচ। আপনি তো ক্রিকেটও খেলেছেন ছেলেবেলায়, মনে পড়ে?
আমার কাকাবাবু ছিলেন পুলিশ অফিসার। গোখেল রোডে শিফট করেন কাকারা। গোখেল রোডের পিছনটা তখন খুব সুন্দর, আজকের মতো না। তখনও সাহেবরা ও পাড়া ছেড়ে যায়নি। গোখেল রোডের ৯ নং, ১০ নং বাড়িতে থাকতেন সাহেবরা। সেই ব্রিটিশ ছেলেপুলের সঙ্গে খেলতাম ক্রিকেট। দু’জনের নাম মনে আছে। টাইগার আর টনি। আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। ক্রিকেট ব্যাটটা কীরকম ছিল, সত্যিকারের ক্রিকেট ব্যাটের মতো, না কাঠ দিয়ে বানিয়ে নেওয়া হয়েছিল– তা আজ আর মনে নেই। তবে বলটা; ক্যাম্বিস বল ছিল, মনে আছে।

নিজেকে নিজের দেখা। শিল্পী: যোগেন চৌধুরী

আপনার গন্ধের ব্যাপারে একটা টান রয়েছে। ছোটবেলায় কাকার বাড়ির আড্ডার চায়ের গন্ধ। বালিগঞ্জ স্টেশনে পেট্রোলের গন্ধ। রংয়ের গন্ধ। গন্ধ কি আপনার চেতনায় প্রভাব ফেলেছে?

গন্ধ একটা ‘সেন্স’। নানা জায়গার নানা গন্ধ। কারও এই সেন্স কম থাকে, কারও বেশি। আমাদের দেশের বাড়িতে, চারুচন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে চায়ের আড্ডা হত বিরাট করে। বৈঠকখানায় তাস খেলাও হত। সেই চায়ের গন্ধ অপূর্ব! আজকের মতো ভেজাল চা নয়। সেই চায়ের গন্ধ আর পাইনি। যখন শান্তিনিকেতনে ছিলাম, গোটা ডালহৌসি স্কোয়ার ঘুরে বেড়িয়েছি ভালো চা কিনব বলে। সে যত দামিই হোক। অনেক চা একটু একটু করে কিনে দেখেছি। কিন্তু সেই চায়ের গন্ধটা ফিরে পাইনি।

Jogen Chowdhury | An eminent Indian painter | DAG
পুরনো দিনের ছবি। সূত্র: ইন্টারনেট

আপনার কাছে একটা খাতা ছিল, যেখানে আপনার একেবারে ছেলেবেলার সময়কার কাগজে বেরনো গগন ঠাকুরের আঁকা ছবি, পিকাসোর আঁকা ছবি আপনি সাঁটিয়ে রাখতেন। ক’দিন আগে চারুবাসনা প্রদর্শশালায় আপনার ১৯৫৬ সালের ছবিও দেখা গেছে। এই যে সংরক্ষণের বোধ আপনার, সেই ছেলেবেলা থেকেই কীভাবে পেলেন?
আমি স্বীকার করি একথা। কীভাবে যেন এসে পড়েছে এই বোধ। আমার আর্কাইভ করতে ভালো লাগে। চিরকালই তাই সংরক্ষণ করে এসেছি। শুধু নিজের কাজ না, অন্যান্য নানা জনের শিল্পও। অনেকে আসলে শুধু বর্তমান নিয়েই মাথা ঘামায়, কিন্তু আমি ইতিহাসটা নিয়েও ভাবি। পিকাসো বা গগন ঠাকুরের যে ছবি পত্রিকা থেকে কেটে খাতায় সাঁটিয়ে রাখতাম, তখন আমার বয়স ৯-১০ কি ১১। মনোহরপুকুর রোডের বাড়িতে শুরু করেছিলাম এই কাজ। সেই খাতাটা এখনও আছে।

সংরক্ষণে সচেতন যোগেন চৌধুরী

এই ছবি সংরক্ষণ প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল রাধাপ্রসাদ গুপ্তর কথা। ওঁর ছবির প্রতি তুলনাহীন যত্নের কথা নানা জায়গায় শুনেছি, পড়েছি। আপনার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল?
ওঁর বাড়ি গিয়েছিলাম। লম্বা, টানা ঘর। ঘরভর্তি বই-পত্রিকা-ছবি। কী কাজে গিয়েছিলাম মনে পড়ছে না এখন আর। ওঁর পুরনো ছবির প্রতি আগ্রহের জন্যই গিয়েছিলাম, অনেক দিন ধরে দেখা করার ইচ্ছে ছিল– এইটুকুই মনে আছে।

Radhaprasad Gupta birth Centenary
রাধাপ্রসাদ গুপ্ত

আপনি তো অধ্যাপক ছিলেন, শিল্পের পড়ুয়াদের কি আপনি এই সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন করেছিলেন?
সে ব্যাপারে নানা সময় কথা বলেছি। অন্য শিল্পীদের সঙ্গেও। কিন্তু ভেবে দেখুন, আমাদের আর্ট মিউজিয়াম নেই কোনও। নিউটাউনেই ‘কলকাতা মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট’ বলে একটা সংস্থা শুরু করেছি। এখন সেখানকার চেয়ারম্যান পদে আছি। মাথায় রয়েছে, মিউজিয়াম করার কথা। কিছু বছর আগে একটি মিটিংয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এসেছিলেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছে। বিল্ডিংগুলো তৈরিও হয়ে গিয়েছে।

Kolkata Museum of Modern Art / Herzog & de Meuron | ArchDaily
কলকাতা মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট

এছাড়া শান্তিনিকেতনেও তো?
হ্যাঁ। ‘শান্তিনেকতন সোসাইটি অফ ভিস্যুয়াল আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন’, ছোট করে ‘স্বাদ’। দু’বিঘা জমির ওপর বিরাট স্ট্রাকচার। অনেক দিন ধরেই আমাদের শিল্পী বন্ধুবান্ধবদের এইরকম একটা কিছু করার ইচ্ছে ছিল। জমিজমা কেনা হল। কিন্তু কী করে এত বড় একটা শিল্পের কাজ হবে? পকেট থেকে পয়সা খরচ করে প্রায় ৭০-৭৫ জন ভারতীয় শিল্পীকে চিঠি পাঠালাম। বক্তব্য এই যে, একটা করে ছবি পাঠান। এটা করতে পেরেছিলাম, কারণ রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকাকালীন অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গিয়েছিল। ফলে অনেকের কাছ থেকেই প্রত্যুত্তরে চিঠি পেলাম। তাঁদের ছবি নিয়ে একটা পোর্টফোলিও করেছিলাম। সেগুলো বিক্রি হয়েছিল ৫ লাখ টাকা করে। তবে সাধারণ পোর্টফোলিও ছিল না সেগুলো। প্রতিটাতেই ছিল শিল্পীর সই করা। আমিই পোর্টফোলিও নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম সারা দেশে, নানা শিল্পীর কাছে, সই করাতে। মনে আছে, প্রায় এককোটি টাকার মতো উঠেছিল। তাই দিয়েই জমি কেনা, বিল্ডিং তৈরি করা। কেউ কেউ অবশ্য ডোনেশনও দিয়েছিলেন। আর্কিটেক্ট মিলন দত্তকে দিয়ে বাড়ির ডিজাইন করানো হয়েছিল। পরে আরও জমি কেনা হয়েছে, একটা কাচের ঘরও করা হয়েছে। শিল্প সংক্রান্ত নানারকম কাণ্ডকারখানা ঘটে চলে। এই ২২-২৩ মার্চেই ওখানে আর্টফেয়ার হবে।

The Art Daily: Santiniketan Society, Rutuja Padwal, FICA Fellowship and more

আপনি ফরিদপুরে যখন তখন বন-জঙ্গলের মধ্যে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন, গাছ থেকে পড়ে একবার জ্ঞানও হারিয়েছেন। তারপর সেই বন-জঙ্গল সবুজকে কি কলকাতায় পেলেন, নাকি অনেক পরে শান্তিনিকতনে ফিরে পেলেন কিশোরবয়সি সবুজকে?
আসলে আমি যা হারিয়ে এসেছি, তা নিয়ে কখনও কান্নাকাটি করিনি। ফরিদপুরের ওই সবুজ আমি যদিও ফিরে পেয়েছিলাম শান্তিনিকেতনে। আমি দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবন ছেড়ে এসেছিলাম শান্তিনিকেতনে। তার কারণ অবশ্য রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ আমাকে ছেলেবেলা থেকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছেন। আমার ভাবনা-চিন্তাতেও ছাপ ফেলেছিলেন তখন থেকেই। ওঁর ছড়া, কবিতা বিশেষ করে সেসময়।

Jogen Chowdhury on how he sketched Rashtrapati Bhavan in ten minutes | Lifestyle News - The Indian Express
রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে স্কেচ করছেন যোগেন চৌধুরী। সূত্র: ইন্টারনেট

রবীন্দ্রনাথের ছবিও কি দেখছেন সেসময়?
দেখেছি। অলংকরণের মতো করে যে ছবিগুলো ছিল বইয়ে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখা, সত্যিকারের ঢুকে পড়ে দেখা যাকে বলে, তা হল শান্তিনিকেতনে এসে। ১৯৮৭ সালে। তখন বিশ্বভারতী কলাভবনের কিউরেটর সুশোভন অধিকারী। তাঁকে বললাম, ছবিগুলো দেখতে চাই। তখন রবীন্দ্রনাথের ছবি আজকের মতো সহজে দেখা যেত না। আড়াল করে রাখা ছিল দীর্ঘদিন। সুশোভন আমাকে অন্ধকার থেকে বের করে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু ছবি দেখায়। বোধহয়, গোটা তিরিশেক অরিজিনাল ছবি ছিল।

The Paintings of Rabindranath Tagore
শিল্পী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ নিয়ে, ওঁর ছবি নিয়ে, আপনার বেশ কিছু লেখাও তো রয়েছে।
হ্যাঁ, তা রয়েছে। তবে ১৯৬১ সালে, রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীতে পোস্টার তৈরি করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথের জীবনী তৈরি করে একটা প্রদর্শনী করেছিলাম। সেই পোস্টার এখনও আছে আমার কাছে। ‘চারুবাসনা’র দেওয়ালে এখন লাগানো আছে সে পোস্টারের একটি। সবক’টা পোস্টার এখনও আছে। শুধু কোণগুলো ক্ষয়ে গিয়েছে সামান্য।

রবীন্দ্রনাথের ছবি আপনাকে কেন টানে?
রবীন্দ্রনাথের ছবির মধ্যে একটা ‘সেন্স অফ ইনফিনিটি’ রয়েছে। এটাই রবীন্দ্রনাথের ছবির আত্মা। ভালো ছবি হোক বা গান– সময়কে অতিক্রম করে যায়। আমি প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথের ছবিকে এভাবেই দেখি। আমার এই সামনের দেওয়ালে, একমাত্র রবীন্দ্রনাথের ছবিই রয়েছে। আর কারও ছবিই নেই কিন্তু! রবীন্দ্রনাথের প্রতি এই টান শান্তিনিকেতনে গিয়ে আরও বেড়ে গিয়েছিল।

Rabindranath Tagore | Untitled (Birds) (1930) | Artsy
শিল্পী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের আদ্যক্ষর র-ঠ নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে ক্রমে তা ছবিতে পরিণত করছেন। আপনাকে দেখছি, পদবি নয়, নামের আদ্যক্ষর ‘যো’ নিয়ে এমনটাই করছেন, যা আসলে ছবিই হয়ে উঠেছে।
অনেক সময় ছবিতে পুরো নাম লিখতে গেলে ছবিটার মধ্যে একটা ডিসটার্বেন্স তৈরি হয়। সে জন্যই ছোট করে ‘যো’।

Jogen Chowdhury Paintings & Artwork for Sale | Jogen Chowdhury Art Value Price Guide
তিনরকম সই ধরা পড়েছে এই ছবিতে

আপনি শান্তিনিকেতনে কে.জি সুব্রহ্মণ্যমকে পেয়েছিলেন, তাঁর মত ছিল– সই আসলে ছবিরই একটা অংশ, আপনি যখন সই করছেন, অনেকবারই দেখেছি তা ছড়িয়ে দিয়েছেন নানা জায়গায়, নানাভাবে, যা আমার ‘ছবির অংশ’ বলেই মনে হয়। কে.জি-র কথা কি প্রভাব ফেলেছে এই ব্যাপারে?

মানিদার সমান্তরালে আমিও বিশ্বাস করি সই ছবিরই অংশ। এই বিশ্বাসটা বোধহয় আলাদা আলাদা করে দু’জনের কাছে এসেছে। ছবি আঁকার পরে, ছবিটাই দেখিয়ে দেয় সই করার জায়গা। তার কোনও নির্দিষ্ট স্থান না-ই হতে পারে। ছবি অনুযায়ী বদলে বদলে যেতে পারে সইয়ের জায়গা। পুরোটাই আসলে ছবির সাম্য বজায় রাখার কৌশল। তবে সবসময় যে ‘যো’ ব্যবহার করেছি, তা নয়। পুরো ‘যোগেন চৌধুরী’ও লিখেছি অনেক জায়গায়। সই করেছি ইংরেজি হরফেও।

Jogen Chowdhury
সাম্প্রতিক ছবিতেও দু’রকম সই

আর্ট কলেজে গোপাল ঘোষের ক্লাস নিয়ে আপনি বলেছেন নানা সাক্ষাৎকারে, কিন্তু চিন্তামণি করের কথা তেমন পাইনি। আপনি যখন আর্ট কলেজে, তিনি তো তখন প্রিন্সিপাল হিসেবে এলেন। তাঁর কথা একটু জানতে চাইব।
’৫৫-’৬০– এই পাঁচ বছরের কোর্স ছিল আমার। ’৫৬ সালের মাঝামাঝি আসেন চিন্তামণি কর। সাহেব সাহেব হাবভাব। ঠোঁট প্রায়শই উল্টে রাখতেন। নজর ছিল সবদিকে। বিরক্ত হলে তা প্রকাশ করতে দেখেছি। অনেক রকমের কাজ করেছেন। লেডি রাণু মুখার্জির সঙ্গে ভালো পরিচয় ছিল ওঁর। একাদেমি অফ ফাইন আর্টসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন পরে। আমরা যখন পাশ করি, সেসময় একাদেমি অফ ফাইন আর্টস কমপ্লিট হয়। যেহেতু রেজাল্ট ভালো করেছিলাম, লেডি মুখার্জি আমায় স্কেচক্লাবে বিনিপয়সায় সদস্য করে দিয়েছিলেন। স্কেচক্লাবে বসে কাজ করা যায়, হয়তো এখনও আছে, নিশ্চিত নই। প্রথম বছরে আমি দুটো অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিলাম। ‘বেস্ট অ্যাওয়ার্ড ইন ওয়াটার কালার’ আরেকটা ‘ওয়াটার কালার গ্রুপ অ্যাওয়ার্ড’।

Chintamoni Kar
চিন্তামণি কর

আপনি পুরস্কার পাচ্ছেন যে শিল্প আঙ্গিকে, সেখান থেকে সরে এসে সাদা-কালোর পথ ধরলেন। এবং তাই হয়ে উঠল যোগেন চৌধুরীর নিজস্ব ভঙ্গিমা। সাদা-কালোই কেন?
আমাদের জীবনযাত্রার মধ্যে একটা ডিপ্রেশন তো ছিলই। পার্টিশন, দেশ ছেড়ে আসা, এখানে এসে বাসস্থানের সমস্যা– সব মিলিয়ে একটা অন্ধকারের জায়গা ছিল। এই সবই সাদা-কালো হয়ে ধরা দিয়েছে।

শান্তিনিকেতন আপনার মনের কী পরিবর্তন ঘটাল?
রাষ্ট্রপতি ভবনে ১৫ বছর কাজ করছিলাম। অথচ ছেড়ে এলাম। অনেকে উপদেশ দিয়েছিল না ছাড়তে কাজটা। টাকাপয়সা, নানা সুযোগসুবিধা, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ– অনেক বড় পরিসর ছিল সেই কাজের। কিন্তু এসবের থেকে আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ বড়। আমার ছেলের ইশকুলেরও সমস্যা হয়েছিল। ছবির ক্ষেত্রে প্রতিটি মুহূর্তই জরুরি। যে কোনও অবস্থা, পরিস্থিতি একজন শিল্পীর মনের ভেতর বোধের সঞ্চার ঘটাতে পারে। শান্তিনিকেতন হোক বা দিল্লি, আমাকে স্থান নয়– মুহূর্তই ছবি আঁকিয়েছে।

রোববার.ইন-এর আড্ডায় স্বগৃহে যোগেন চৌধুরী। ছবি: ব্রতীন কুণ্ডু

সেই সময়কার শান্তিনিকেতন, আর আজকে, ২০২৫-এর শান্তিনিকেতনের কী ফারাক?
মুশকিল হয়েছে যে, সকলেই এখন শান্তিনিকেতনে থাকতে চায়। ধানখেত যেখানে ছিল, সেখানে একের পর এক বাড়ি। মন-মানসিকতারও বদল ঘটে গিয়েছে। শান্তিনিকেতনে মানুষ শুধু বাড়ি বানিয়ে থাকছে, এমনও না, অবসর সময়ে একটা চূড়ান্ত হইহল্লা হচ্ছে। সোনাঝুরির হাটের দিকে তাকালেও বোঝা যায় ব্যাপারটা। শান্তিনিকেতনের উন্নতির দিকটা, কীভাবে এই সমস্যাগুলো ঠিক করা যায়– সে নিয়ে চিন্তিত হতে দেখছি না। বিশ্বভারতীর ভি.সি. কিছু করছেন না। আগের ভি.সি বিদ্যুৎ চক্রবর্তী কোনও নজরই দেননি। কলাভবনের পুরস্কারগুলোও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এ নিয়ে ভেবেছি চিঠিও দেব প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি তো বিশ্বভারতীর আচার্য।

কফিহাউসের আড্ডা দেওয়ার কথা মনে পড়ে?
আমরা যখন আর্ট কলেজের শেষের দিকে, ’৬০ সালে, তখন পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় এসে ভর্তি হল আর্ট কলেজে। ও-ই টেনে নিয়ে গেল আমাদের কফিহাউসে। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও ওখানেই আলাপ। সুনীল-শক্তির সঙ্গেও ক্রমে বন্ধুত্ব হয়। নিজে যেহেতু ছোট থেকে একটু লেখালিখির দিকেও ঝুঁকে ছিলাম, তাই বন্ধুত্ব আরও সহজে গড়ে উঠেছিল। নির্দিষ্ট কোনও বিষয় ছিল না আড্ডার, সবই নানা কথার ছররা।

Society | "Shakti-Sunil" | Facebook
শক্তি-সুনীল যুগলবন্দি

পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় আপনাকে কফিহাউসেই চাকরির অফার করেছিলেন না?
হ্যাঁ, পৃথ্বীশ ছিল আপাদমস্তক বিজ্ঞাপনের লোক। তখন শিক্ষকতা করতাম হাওড়া জেলা স্কুলে। আমাকে ১৫০০ টাকার একটা চাকরির বরাত দেয় ও, কিন্তু যাইনি। বলেছিলাম, বিজ্ঞাপনে যাব না। ছবি আঁকার ক্ষতি হবে। একই রকম লাইন আঁকতে আঁকতে ছবির ক্ষতি আমার সইবে না। হাওড়া জেলা স্কুলে যদিও মাইনে ছিল ২৫০ টাকা!

হাওড়া জেলা স্কুলের চাকরি কীভাবে পেয়েছিলেন?
দেশপ্রিয় পার্কের রাস্তায় হাঁটছিলাম। একদিন দেখি, অনিল ভট্টাচার্য, আমাদের আর্ট কলেজের স্যর দাঁড়িয়ে। ওঁকে বললাম যে, একটা স্কুলের চাকরি খুঁজছি। ক’দিন পরে, দেখি কলেজে অনিলবাবু এক দাড়িওয়ালা ভদ্রলোককে নিয়ে হাজির। তিনি হাওড়া জেলা স্কুলের হেডমাস্টার। ইন্টারভিউ হল। চাকরিও পেলাম। আমাকে একটা ছোট্ট টেবিল দেওয়া হয়েছিল। মনে আছে, সেলোটেপ দিয়ে সেখানে রবীন্দ্রনাথের একটা ছবি আমি সাঁটিয়ে রেখেছিলাম। এখনও সেই ছবি আমার কাছে আছে। প্যারিসে যখন স্কলারশিপ পাই, তখনও স্টুডিওর দেওয়ালে ওই ছবিটা রেখেছিলাম। আসল ছবিটা এখন শান্তিনিকেতনে। একসময় ইলাস্ট্রেটেড উইকলিতে ছাপা হয়েছিল।

প্রীতীশ নন্দীর সঙ্গে আপনার সখ্য ছিল?
যোগাযোগ হয়েছিল। বোম্বেতে যেতাম। তখন দেখাসাক্ষাৎ হত। অলংকরণের জন্য বলেছিল। কলকাতার ওপরে একটা লেখা ছিল। তার সঙ্গে এঁকেছিলাম আমি। মনে আছে, ছবি বড় বড় করে যত্ন নিয়ে ছেপেছিল প্রীতীশ। সে সংখ্যাও বোধহয় শান্তিনিকেতনেই আছে।

তুষার রায়

তুষার রায়ের সঙ্গেও তো বন্ধুত্ব ছিল আপনার!
তুষার রায়ের সঙ্গে বন্ধুত্বটা সত্যিই জমে উঠেছিল। ওর সঙ্গেই প্রথম খালাসিটোলায় যাই। সুনীল-শক্তি আড্ডা মারতেন সেখানে প্রায়শই। শালপাতায় রাখা ছোলা আর মদ। কোনও দিনই দেখিনি খুব একটা খাবার খেতে। পয়সা-টয়সাও তখন কমই ছিল। অনেক সময় খালাসিটোলা থেকে বেরিয়ে ধর্মতলার দিকে হাঁটতাম আমরা। শক্তি-সুনীলকে দেখেছি, ধর্মতলায় এসে ওঁরা আবার অন্য শুঁড়িখানায়  ঢুকে গেলেন।

ওটাই কি প্রথম মদ্যপান আপনার?
হিম্মত শাহ আমাকে প্রথম মদ খাইয়েছিলেন। আমি তখন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে ‘অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডলুম বোর্ড’-এ ডিজাইনার। হিম্মত অন্য জায়গা থেকে ট্রান্সফার হয়ে আমাদের শাখায় এসেছেন। তখন আমরা চাংগুয়াতে যাই। সেখানে বিয়ার পান করি দু’জনে। তাও আবার অফিস টাইমে! পরে ওদের একটা ছবি এঁকেও দিয়েছিলাম– ল্যান্ডস্কেপ।

ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত (বাঁদিকে)। এ. রামচন্দ্রন

 

কফিহাউসের বাইরে আপনার আড্ডা কোথায় ছিল?
ধর্মতলায়, জি সি লাহার উল্টোদিকে একটা শিল্পী সংঘ ছিল। এখন নেই। সেখানে দারুণ আড্ডা হত! নানা জায়গায় শিল্পীরা এসে বসতেন। শান্তিনিকেতন থেকে আসতেন এ. রামচন্দ্রন। আসতেন ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত। হাওড়া জেলা স্কুলে তখন শিল্প শিক্ষক ছিলাম আমি, সেখান থেকেই আসতাম।

বইমেলার কথা বললেন, মনে পড়ছে, ১৯৯৩ সালের ‘কৌরব’-এ আপনি বই কেনার বাতিক ও বই না-পড়ার অসুখ নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন। এখন আপনার কী মত?
এখনও মত একই। এ জিনিস আমার ক্ষেত্রেও ঘটে। ধারাবাহিকভাবে পড়া হয় না। ইশকুলের পড়ুয়াদের মতো হয় না আর। এখন সময়টাকে ঠিকঠাক করে ব্যবহার করতে চাই। বই পড়া কাজ, ছবি আঁকাও কাজ, শিল্পের জন্য চিন্তা করাও কাজ। নানারকমের কাজের জন্য সময়টা ভাগ করে নিতে চাই। তার মধ্যে অবশ্যই কিছু বই পড়া হয়। কিছু বই পড়ে থাকে।

বহু বইয়ের তাকের একটি

ছেলেবেলা থেকে কবিতা পড়ছেন, লিখছেন। কবিতা কি আপনাকে ছবির বিশ্বে ঢুকে পড়তে সাহায্য করে?
কবিতা এবং ছবি– এরা নিবিড়ভাবে নিজেদের স্পর্শ করে আছে। ছবির মধ্যে যেসব গুণ, সেসব গুণ থাকে কবিতার মধ্যেও। ছোটবেলায় দেওয়াল পত্রিকা করার সময় থেকেই ছড়া লিখতাম, কবিতাও তখন থেকেই আমাকে আকর্ষণ করেছিল। তবে এরকম না যে, কবিতা পড়লাম আর ছবি এঁকে ফেললাম– ব্যাপারটা এমন না। একটা রূপান্তর ঘটে।

কাদের কবিতা আপনার ভালো লাগে?
ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে আসত ‘পরিচয়’, ‘এক্ষণ’ও। সেখানে কবিতা প্রকাশিত হলে পড়তাম। রবীন্দ্রনাথ তো পড়ছিলাম, তার পাশাপাশি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, সুকান্ত ভট্টাচার্য। জীবনানন্দ আমার অত্যন্ত প্রিয়। শুধু কবিতা নয়, জীবনানন্দর সমস্ত গদ্য আমার রয়েছে। জীবননান্দর গদ্যও আমাকে বিস্মিত করে!

………………………………………….

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

………………………………………….