যখন আমার ল্যাজট্যাজ গজায়নি, শিশুদশা কাটেনি, সে-সময় থেকেই বাড়িতে ‘রোববার’-এর আসা-যাওয়া। অতএব, হেবি প্রিভিলেজড আমি। ২০-২১ বছর বয়সে, বাবার পত্রপত্রিকার বাক্স থেকে খুঁজে পেয়েছিলাম ‘রোববার’-এর পুরনো কিছু সংখ্যা। একটির নাম, ‘বিভূতিভূষণ’। প্রচ্ছদে গভীর অরণ্য। বিস্মিত হয়েছিলাম। দ্বিতীয়টির নাম, ‘আলবেয়ার কামু’। তৃতীয়টি আরও দুর্দান্ত। ‘নাটবণিকের পালা’। রমাপ্রসাদ বণিকের স্মরণসংখ্যা। প্রচ্ছদে তাঁর আলগা মুখচ্ছবি। গোঁফটি প্রকট! কী যে বিমুগ্ধতা সেই সংখ্যাটি জুড়ে। এরপরে হাতে পাই, ‘অনুবাদক’। সেই সংখ্যাটিতেই প্রথম পড়েছিলুম মাহমুদ দরবেশের একটি কবিতা। গুয়াতেমালার কবি অটো রেনে কাস্তেইয়ো-র কবিতা। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্চর্য অনুবাদে। আঠেরো, পাঠেরও সিরিজের এই লেখা রোদ্দুর মিত্রর।
ভোকাট্টার পরে কাটাঘুড়ি যেভাবে অনন্ত সাঁতার দিয়েছিল মাঝ-আকাশে– চিলছাদে উঠে হারবার্ট যেভাবে তাকিয়েছিল বুকির দিকে– শেষ বলে উইকেট নিয়ে যেভাবে গলি-টুর্নামেন্টের ফাইনাল জিতেছিলাম– শিউলি ফুল যেভাবে হঠাৎ ঝরে পড়েছিল একটা ভীষণ ভাঙাচোরা উঠোনে– যেভাবে টাটকা আমোদী মাছ দেখে চঞ্চল হয়েছিল মন– সূর্যের আলোয় মাতাল হয়ে একটা বিড়াল যেভাবে ধুলোয় গড়াগড়ি খেয়েছিল– গলির মাঝপথে এসে যেভাবে হাত ছেড়েছিল প্রিয় বান্ধবী– যেভাবে জন ডেনভার একদিন গেয়েছিলেন ইউ ফিল আপ মাই সেন্সেস/ লাইক আ নাইট ইন আ ফরেস্ট– যেভাবে দু’পা ডুবিয়ে নদীর জলে বিলিয়েছিলাম দুঃখ– যেভাবে আব্বাস কিয়েরোস্তামি আহমেদের স্কুলের খাতায় রেখে দিয়েছিলেন একটা বুনোফুল– সেভাবে, ঠিক সেভাবেই, ‘রোববার’-কে চিনেছি আমি।
তারপর জীবন হুড়মুড়িয়ে বদলে যায়নি। তারপর ভূতের রাজা বর দেয়নি। একহাঁড়ি নলেনগুড়ের রসগোল্লাও কেউ অফার করেনি। কেউ বলেনি অ্যানা দে আর্মাস-এর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে। সর্বোপরি আমার জ্ঞানচক্ষু খুলে গেছে, এমন দাবি তো নৈব নৈব চঃ! তাহলে হয়েছেটা কী? ভাবতে শিখেছি একটু বেশি। কৌতূহল জন্মেছে, ‘‘অমুক বিষয়ে ‘রোববার’-এর আলো কোথায় কোথায় পড়ল?’’ আর এই যে সময়ের সঙ্গে ‘রোববার’-এর অন্তহীন কথোপকথন, একটা দীর্ঘ প্রসেস, তার মধ্যে কীভাবে যেন জুড়ে দিয়েছি নিজেকে। দিনের শেষে তো মশাই আমরা সেই বাঙালি কিনা!
যখন আমার ল্যাজট্যাজ গজায়নি, শিশুদশা কাটেনি, সে-সময় থেকেই বাড়িতে ‘রোববার’-এর আসা-যাওয়া। অতএব, হেবি প্রিভিলেজড আমি। ২০-২১ বছর বয়সে, বাবার পত্রপত্রিকার বাক্স থেকে খুঁজে পেয়েছিলাম ‘রোববার’-এর পুরনো কিছু সংখ্যা। একটির নাম, ‘বিভূতিভূষণ’। প্রচ্ছদে গভীর অরণ্য। বিস্মিত হয়েছিলাম। দ্বিতীয়টির নাম, ‘আলবেয়ার কামু’। তৃতীয়টি আরও দুর্দান্ত। ‘নাটবণিকের পালা’। রমাপ্রসাদ বণিকের স্মরণসংখ্যা। প্রচ্ছদে তাঁর আলগা মুখচ্ছবি। গোঁফটি প্রকট! কী যে বিমুগ্ধতা সেই সংখ্যাটি জুড়ে। এরপরে হাতে পাই, ‘অনুবাদক’। সেই সংখ্যাটিতেই প্রথম পড়েছিলুম মাহমুদ দরবেশের একটি কবিতা। গুয়াতেমালার কবি অটো রেনে কাস্তেইয়ো-র কবিতা। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্চর্য অনুবাদে। মনে পড়ে, আমার একদিকে ছিল গুচ্ছের পুরনো পত্রিকা। বারান্দায় সরস্বতী পুজোর রোদ। রোদের ভেতরে আদিম আদিম ধুলো। অন্যদিকে একটা পেটমোটা বাক্স। বাক্সের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছি আমি। আর বারে বারে আওড়াচ্ছি:
‘আমাদের কবিতাগুলো বর্ণহীন
শব্দহীন, নখদন্তহীন।
যদি তুমি বাড়ি-বাড়ি চেরাগ নিয়ে ঘোরো,
আর সাধারণ লোকে যদি তাদের অর্থ না-বোঝে
তা হলে সবচেয়ে ভালো হয় যদি আমরা তাদের ছড়িয়ে দিই
হাওয়ায়
আর চিরকাল বাস করি নীরবতায়…’
‘রোববার’ থেকে পেয়েছি বলতে এগুলোই। নানা সময়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কুড়িয়ে নিয়েছি। পরশপাথরের মতো। জীবন থেকে যেমন কুড়োই। এবং সেই ট্র্যাডিশান এখনও চলছে। সব সংখ্যাই সমানরকম উদ্বেলিত করে, তা নয়। কিছু সময় হতাশও হই। তবু এক-পা দু-পা করে ‘রোববার’-এর আঠেরোয় পা! সে প্রাপ্তবয়স্ক। প্রাপ্তমনস্ক সে বহুদিন। এখন বরং দায়িত্ববোধটা একটু বেশি। বাজার যেতে হবে। রেশন তুলতে হবে। মাসের ওষুধগুলো এনে দিতে হবে। বাড়ির ছেলেটা, মেয়েটা বড় হলে এটুকু তো করতেই হয়, তাই না?
শোনো ‘রোববার’, বড়ই মোক্ষম মুহূর্তে সাবালক হলে তুমি। প্যালেস্তাইনে ৩৫ হাজার শিশু এ-মুহূর্তে অনাথ। রাশিয়া বম্বিং থামাবে না ইউক্রেনে। আমেরিকা চাইছে, পৃথিবীর সব যুদ্ধগুলোই দীর্ঘজীবী হোক। বাংলাদেশের শ্রমিকনেতা কারারুদ্ধ। উমর খালিদ তিহার জেলে। সন্দীপ রেড্ডি ভাঙ্গা আরও আরও ‘অ্যানিমেল’ তৈরি করছেন। তৈরি হচ্ছে রামমন্দির। বিরোধীশূন্য লোকসভায় পাশ হয়েছে নয়া সংবাদমাধ্যম বিল। মণিপুরের কোনও খবর আমরা পাই না। কৃষকের আত্মহত্যা গা সয়ে গেছে। চাকরিপ্রার্থীরা গান্ধীমূর্তির পাদদেশে। সমস্ত পৃথিবীজুড়ে অগণিত রিফিউজি। হে প্রিয় ‘রোববার’, এই অদ্ভুত আঁধারে তুমি কিন্তু তুমি থেকো। টানটান। আগুনসম। উচ্ছৃঙ্খল। তোমায় দেখে শুনে পড়ে যেন অঞ্জন দত্ত গাইতে পারে, ‘আমার জানলা দিয়ে গোটা পৃথিবী…’
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved