Robbar

অন্নদা মুন্সীর হাতেই তৈরি হয়েছিলেন সত্যজিৎ

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 27, 2025 11:48 am
  • Updated:November 27, 2025 11:52 am  

ডি জে কিমারে সত্যজিতের কাছে কী কাজ দেওয়া হবে, তা অন্নদা মুন্সীই ঠিক করে দিতেন। সিগনেট প্রেস খোলার পরেও অনেক কাজ মুন্সীকেই দেখিয়ে দিতে হয়েছে। যদিও বিজ্ঞাপনের কাজের মতো খুব শিগগিরই সত্যজিৎ এসব কাজে বিশিষ্টতার ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। সত্যজিৎ খুবই ভালো ছবি আঁকতে পারতেন ঠিকই, কিন্তু বিজ্ঞাপনের লে-আউট ব্যাপারটা তিনি বুঝতেন না। ছবি আঁকা বা পেইন্টিং এক, আর বিজ্ঞাপনের ক্যাপশন, কপি, ইলাস্ট্রেশন, লোগো একেবারে অন্যরকমের শিক্ষার ব্যাপার। সত্যজিৎ নিজেই লিখেছেন, ‘সাগ্রহে আমি অন্নদা মুন্সীর শিক্ষানবিশি করতে থাকি।’ 

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়

শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে ১৯৪৩-এর এপ্রিল মাসে সত্যজিৎ রায় ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনী সংস্থা, ডি জে কিমারে যোগ দেন। তখন কিমারের আর্ট ডিরেক্টর ছিলেন অন্নদা মুন্সী। সংস্থায় যোগ দেওয়ার আগেই সত্যজিৎ বুঝতে পেরেছিলেন, সেই সময়ের কাগজে প্রকাশিত অন্যান্য বিজ্ঞাপনের তুলনায় কিছু কিছু বিজ্ঞাপনের মধ্যে একটা মিল রয়েছে। একই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যর মধ্যে যেরকম মিল দেখা যায়, তেমন মিল। পরে সত্যজিৎ আবিষ্কার করেন বিজ্ঞাপনগুলি একই প্রতিষ্ঠানের তৈরি এবং বিজ্ঞাপনগুলি যে একজন বাঙালি শিল্পীর হাতের কাজ, সেটাও বের করে ফেলেছিলেন। তিনি অন্নদা মুন্সী।

অন্নদা মুন্সী

মুন্সী যেমন কৃতি ছাত্র ছিলেন, তেমনই বিজ্ঞাপন জগতে যোগ দেওয়ার পর তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে ছিল ভারত জুড়ে। আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ যখন পারসি ব্রাউন, মুন্সী সেই সময় কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজের ছাত্র ছিলেন। কর্মসূত্রে এক সময় বোম্বেতে ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন বিভাগে কাজ করতেন। তারপর ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি সময় যোগ যোগ দেন ডি জে কিমার অ্যান্ড কোম্পানিতে। এবং প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিল্পীর পদ অলংকৃত করেন। ১৯৩৫ থেকে ’৪৭– ১২ বছর প্রধান শিল্পী হিসেবেই তিনি কিমারে ছিলেন। বিজ্ঞাপন বিষয়ক প্রচারচিত্রে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না। সৃজনশীলতা, স্বাধীনতা এবং বৌদ্ধিক আদান-প্রদান প্রচলিত ছিল সেই আপিসে। ওই আপিস থেকে প্রচারিত অনেক বিজ্ঞাপনের কাজ বা গ্রাফিক নকশা বাঙালির স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকত। তখন বেশিরভাগ বিজ্ঞাপন কোম্পানিগুলি চালাতেন সাহেবরা, ফলে সেসব বিজ্ঞাপনের চেহারাটা ছিল বড্ড বেশি রকমের বিদেশি ঘেঁষা। এদেশি শিল্পীদের হাতের কাজও কখনও কখনও অন্ধ অনুকরণের পর্যায়ে চলে যেত। তিনিই প্রথম স্বদেশি পণ্যের বিদেশি শিল্পীদের করা বিদেশি মনোভাবাপন্ন বিজ্ঞাপনের পরিবর্তে দেশীয় ভাবনা ও চরিত্রানুযায়ী বিজ্ঞাপন শুরু করেন।

বিজ্ঞাপনে দেশীয় ভাবনার প্রকাশ ঘটে অন্নদা মুন্সীর হাত ধরে। বিজ্ঞাপনকে সাধারণ বিজ্ঞাপন চিত্রের চেয়ে ‘ভিজ্যুয়াল আর্ট’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। এই কারণেই তাঁর কাজ সময়ের অনেক আগে এক ধরনের আধুনিকতা নিয়ে এসেছিল। এছাড়া, মুন্সীর মাধ্যমে বিজ্ঞাপনে দেশীয় ভাবনা অর্থাৎ স্বাদেশিকতা, আঞ্চলিক শিল্পশৈলী ও বাঙালি সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি ছাপ ফেলেছিল। ওই আপিসে দেওয়া হত অবাধ স্বাধীনতা। মুন্সীর মতো আর্ট ডিরেক্টরদের নির্দেশনায় তরুণ সত্যজিৎ গ্রাফিক্স, টাইপোগ্রাফি ও বিজ্ঞাপনী কনসেপ্টে নতুন ধারার জন্ম দেয়। যা পরবর্তী সময়ে ভারতীয় কমার্শিয়াল আর্টকে অনেকটা বদলে দিয়েছিল। তাঁর কাজ বিজ্ঞাপনকে শুধুই বিক্রয় বা প্রচারের বাইরে নিয়ে গিয়ে অন্য মাত্রা দিতে সক্ষম হয়। যেখানে শিল্পের ছোঁয়া, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবনা ও আধুনিকতা– সবই দেখা গিয়েছিল। তাঁর তৈরি টি-বোর্ড বা রেলওয়ে সিরিজের বিজ্ঞাপনগুলি এসব কথাই প্রমাণ করেছিল।

অন্নদা মুন্সীর করা টি বোর্ডের বিজ্ঞাপন

সত্যজিৎ খুবই ভালো ছবি আঁকতে পারতেন ঠিকই, কিন্তু বিজ্ঞাপনের লে-আউট ব্যাপারটা তিনি বুঝতেন না। সত্যি বলতে ছবি আঁকা বা পেইন্টিং এক, আর বিজ্ঞাপনের ক্যাপশন, কপি, ইলাস্ট্রেশন, লোগো একেবারে অন্যরকমের শিক্ষার ব্যাপার। সত্যজিৎ নিজেই লিখেছেন, ‘সাগ্রহে আমি অন্নদা মুন্সীর শিক্ষানবিশি করতে থাকি।’

সত্যজিৎ রায়। স্কেচ: অন্নদা মুন্সী

তিনি জানিয়েছিলেন, ‘পেইন্টিংয়ের কম্পোজিশনের যে রীতি, এ-ক্ষেত্রেও যে সেটাই অনুসৃত হবে তার কোনও মানে নেই।’ অন্নদা মুন্সীর চরিত্রায়ণ করতে গিয়ে সত্যজিৎ লিখেছেন, ‘মুন্সী ছিলেন পানাসক্ত মানুষ। সকালে যখন আসতেন, তখন জিন অ্যান্ড লাইমের গন্ধ পাওয়া যেত। কিন্তু কাজে ছিলেন দারুণ দক্ষ। বস্তুত এই কারণেই আপিসের ব্রিটিশ ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিস্টার ব্রুম তাঁর দোষের দিকটা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না।’

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে অন্নদা মুন্সী

মুন্সীর শিক্ষানবিশে অচিরেই সত্যজিৎ তাঁর নিজের প্রতিভা দেখাতে সক্ষম হয়ে উঠেছিলেন। ডি জে কিমারের আর এক বস ছিলেন ডি. কে. গুপ্ত– দিলীপকুমার গুপ্ত। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠানের কলকাতা আপিসের ম্যানেজার। সত্যজিৎ কিমারে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরেই ডি. কে. এবং নীলিমা গুহ ঠাকুরতা দু’জনে মিলে ‘সিগনেট প্রেস’ নাম দিয়ে একটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পত্তন করেন।

১৯৪৫-’৪৬। ডি জে কিমারের গ্রুপ ফোটো। শেষ সারির ডানদিকে অন্নদা মুন্সী। দ্বিতীয় সারির তৃতীয় অবস্থানে সত্যজিৎ রায়। বাঁ-দিক থেকে দ্বিতীয় জন নীলিমা গুহঠাকুরতা

প্রথম দিকে তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলা লুপ্ত সম্পদের উদ্ধার। সুকুমার রায় ও অবনীন্দ্রনাথের কোনও বই সেই সময়ে বাজারে পাওয়া যেত না। তখন এঁরাই সেই সব বই আবার যত্ন করে ছাপিয়ে বাঙালি পাঠকদের উপহার দেন। প্রথমেই সত্যজিৎকে বইয়ের প্রচ্ছদের ভার দেওয়া হয়। মুশকিল হল, সত্যজিৎ তখনও বইয়ের প্রচ্ছদ বা লে-আউটের বিষয়ে খুব একটা পোক্ত ছিলেন না।

আবোল তাবোলের অন্নদা মুন্সীর করা লে আউট

হাতের লেখার ছাঁদে গ্রন্থ নাম, তুলি কিংবা কলমে আঁকা ছবি, প্রচ্ছদে বিশুদ্ধ বঙ্গীয় মোটিফের অলংকৃত প্রচ্ছদ বিশুদ্ধ বঙ্গ মোটিফের অলংকৃত প্রচ্ছদ, বাংলা বইয়ের জগতে বেশ একটা বিপ্লব এনে দিয়েছিল। এসবই কিন্তু করেছিলেন অন্নদা মুন্সীর ছত্রছায়ায়। প্রথমে যখন ‘আবোল তাবোল’ প্রকাশিত হয়, সুকুমার রায়ের ছবি ছাড়াও বেশ কিছু ছবি সত্যজিৎ আঁকলেও গোটা বইটা লে-আউট করে দিয়েছিলেন অন্নদা মুন্সী।

‘পাগলা দাশু’ বই বেরল। সত্যজিতের অসাধারণ ইলাস্ট্রেশন। একটি বাছাই ইলাস্ট্রেশন দিয়ে বইয়ের প্রচ্ছদ করেছিলেন অন্নদা মুন্সী। বইয়ের বিষয় অনুযায়ী লে-আউট বা প্রচ্ছদ কেমন হবে, তা হাতে ধরে শিখিয়েছেন অন্নদা মুন্সী।

ডি জে কিমারে সত্যজিতের কাছে কী কাজ দেওয়া হবে, তা মুন্সী ঠিক করে দিতেন। সিগনেট প্রেস খোলার পরেও অনেক কাজ মুন্সীকেই দেখিয়ে দিতে হয়েছে। যদিও বিজ্ঞাপনের কাজের মতো খুব শিগগিরই সত্যজিৎ এসব কাজে বিশিষ্টতার ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে সত্যজিতের প্রতি অন্নদা মুন্সীর আলাদা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল তাঁর পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীত জ্ঞানের কারণে। নিজে চমৎকার বেহালা বাজাতেন। যদিও প্রায় সবটাই ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক। এ এক আশ্চর্য কম্বিনেশন! কৃষ্ণের ভক্ত, কীর্তনের প্রতি অগাধ প্রেম, অথচ চর্চা করেন পাশ্চাত্য সংগীত। সত্যজিতের সঙ্গে আলোচনা তো হতই, তার সঙ্গে ছিল বিদেশি সংগীত রেকর্ডের পারস্পারিক আদানপ্রদান। অন্নদা মুন্সী মনে করতেন, ইউরোপের খ্যাতনামা সংগীত প্রতিভা বেঠোভেন এ যুগে সত্যজিৎ রায় হয়ে জন্মেছিলেন।

বিজ্ঞাপনে অন্নদা মুন্সীর সৃষ্টিকর্ম

শুধু বলা নয়, লিখেওছেন! ১৯৭৪ সালে ‘মহানগর’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে তিনি লেখেন, ‘‘সত্যকে জয় করিবে বলিয়াই তাহার নাম সত্যজিৎ। আমার জীবনের কয়েকটি বৎসর আমি সত্যজিতের সহিত অন্তরঙ্গভাবে কাটাইয়াছি এবং তাহাকে ইউরোপের বিরাট সংগীতপ্রতিভা বেঠোভেন রূপে দেখিয়াছি, এখনও দেখি। কারণ শাস্ত্রে পাঠ করিয়াছি আত্মার বিনাশ নাই, এবং আত্মাই মানুষের প্রয়োজনবোধে মনুষ্যদেহ ধারণ করেন। বেঠোভেন যখন জার্মানিতে দেহধারণ করেন, তখন তিনি শ্রবণশক্তিকে হারাইয়াও যে অপূর্ব সংগীত লহরী সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন, তাহা তাঁহার পরবর্তী জীবনে শ্রবণের জন্য একটি নরদেহ ধারণ করিয়া বাংলাদেশে সত্যজিৎ রায় রূপে তাঁহার প্রতিভার বিকাশ করেন। ভারতবর্ষে এক জুবিন মেহটা ছাড়া দ্বিতীয় কেহ নাই যিনি সত্যজিতের ন্যায় বেঠোভেন সংগীত সম্বন্ধে সম্পূর্ণ জ্ঞাত। অতএব সত্যজিৎই সেই বিশ্ববিশ্রুত বেঠোভেনের নবরূপ! অবতার! বাংলাদেশের রক্ত কলঙ্কিত রূপ হইতে স্বর্গের শ্রেষ্ঠতম আসনে বসাইয়া দিবার জন্যই তিনি অবতীর্ণ! বাংলাদেশ বলিতে দ্বিখণ্ডিত বাংলার উভয় অংশই বোঝায়। নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে তাঁহাকে বলিল ‘মায়েস্ত্রো’! বেঠোভেনকেও তাঁহারা বলে ‘মায়েস্ত্রো’! বর্তমান ভারতবর্ষে ‘মায়েস্ত্রো’ বলিয়া আর দ্বিতীয় ব্যক্তি নাই! সুতরাং সত্যজিৎ এক এবং অদ্বিতীয়।’’

এই কথাগুলো দেখলেই বোঝা যায়, সত্যজিতের প্রতি অন্নদা মুন্সীর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা তো বটেই, গুণের কদর করতেও এতটুকু দ্বিধা করেননি।

…………………..

রোববার.ইন-এ পড়ুন দেবাশিস মুখোপাধ্যায়-এর অন্যান্য লেখা

…………………..