পথিকের মনের অন্দরে রাজার ভাবমূর্তি স্থায়ী রাখার কাজ সম্ভবত সম্রাট অশোকের কীর্তি। পথে প্রান্তরে স্তম্ভ শীর্ষে মূর্তি বসানোর যুগ শুরু তাঁর হাতেই। দুই রাজার গল্প একসঙ্গে বুনে দিলেন শিল্পীরা। এখানে এক সাম্রাজ্য বিস্তারী রাজা সন্ধি করলেন এক সাম্রাজ্য ত্যাগী রাজার সঙ্গে। অশোক মিশে গেলেন বুদ্ধের সঙ্গে। অশোক বললেন, তিনি সিংহের মতো পরাক্রমশালী, আর বুদ্ধ বললেন– তাঁর নাম শাক্যসিংহ।
১২.
পথে পথে মূর্তি বসিয়ে ভাবমূর্তি প্রচারের ধারণা আজ আর নেই। এই কিছুকাল আগেও কলকাতার বুকে মূর্তি উন্মোচনের অনেক কাহিনি পাওয়া গেলেও এখন আর তেমন শোনা যায় না। আসলে মূর্তি বসিয়ে পথ চলতি পথিকের মনে রাজার স্থায়ী আসন পাওয়ার বাসনায় এখন হাত বসিয়েছে ডিজিটাল যুগের নানা শিল্প-নির্মাণ। তবু একটি চিন্তা সেই যুগ থেকে আজও বহমান। সেই যুগ থেকেই মানুষ একটা বিষয়কে নির্ধারণ করতে পেরেছিল যে, বিষয়ের সঙ্গে জনমানসের একটা সর্বক্ষণের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ তৈরি করতে হবে। এই যে যোগাযোগ ছিন্ন না হতে দেওয়া, সেটাই কিন্তু আবার আজকের ডিজিটাল যুগের অন্যতম চরিত্র। মোবাইলে গাড়ি ডাকা হল কিন্তু গাড়ি পাওয়ার আগে পর্যন্ত চলাচল করা অ্যানিমেটেড গাড়ির ছবিটি অ্যাপ কোম্পানির সাথে গাড়ি ডাকার মানুষটির ক্রমাগত সংযোগ রক্ষা করে চলল। আসলে মাইন্ড এনগেজমেন্ট থিওরি কাজ করল এখানে।
সেই তত্ত্বই তৈরি হয়েছিল মূর্তি নির্মাতাদের শৈলীতে। আর এই মাইন্ড এনগেজমেন্ট জারি রাখার জন্যে মূর্তি নির্মাতারা তৈরি করেছিল কতগুলি সংকেত। যেমন গান্ধী মানেই হল মুণ্ডিত মস্তক, হাঁটু পেড়িয়ে খাদির ধুতি, গোল চশমা, চপ্পল আর সাধু-সন্তদের কায়দায় জনসংযোগ। সব মিলিয়ে ‘আইন অমান্য’ হোক অথবা ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ গান্ধীই জননায়ক। ভারতবর্ষ আজও চলছে সেই গান্ধীর পিছু পিছু। ইংরেজ বিদায় লগ্নে দাঙ্গার বিরুদ্ধে নিঃসঙ্গ গান্ধী নোয়াখালি, বিহার, কলকাতা কোথায় না যাচ্ছেন একা একাই। তাই হয়তো মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন গান্ধী হলেন ‘ওয়ান ম্যান বাউন্ডারি ফোর্স’। তাঁর এই একলা পথিক চলার ভঙ্গী ধরা রইল গান্ধীর মূর্তিতে। আবার ধরা রইল ক্লান্ত অবসন্ন নিরাশ এক মানুষের নতমস্তক হেঁটে চলা। অথচ চলার ভঙ্গীতে অক্লান্ত। হতাশা তাঁকে ক্লান্ত করেনি। ভূমিপুত্র যেন ভূমির দিকে তাকিয়েই এবার পথ চলছে। পিছু ফেরার সময় নেই তাঁর। এভাবেই সংকেত জুড়তে থাকে মূর্তির শরীরে। আর সেই সংকেত মাইন্ড এনগেজমেন্টের কাজ করে চুপি চুপি। আর ঠিক তখনই ভাবমূর্তি শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। মূর্তি ভাব পায়, মূর্তি ভাবায়, মূর্তি মানস ভাবনায় বাসা বাঁধে।
এটা শুধু ইংরেজ আমল বা এই আমলের কথা নয়। পথিকের মনের অন্দরে রাজার ভাবমূর্তি স্থায়ী রাখার কাজ সম্ভবত সম্রাট অশোকের কীর্তি। পথে প্রান্তরে স্তম্ভ শীর্ষে মূর্তি বসানোর যুগ শুরু তাঁর হাতেই। দুই রাজার গল্প একসঙ্গে বুনে দিলেন শিল্পীরা। এখানে এক সাম্রাজ্য বিস্তারী রাজা সন্ধি করলেন এক সাম্রাজ্য ত্যাগী রাজার সঙ্গে। অশোক মিশে গেলেন বুদ্ধের সঙ্গে। অশোক বললেন, তিনি সিংহের মতো পরাক্রমশালী, আর বুদ্ধ বললেন– তাঁর নাম শাক্যসিংহ। অশোক বললেন, তিনি বৃষের মতো পেশিশক্তির অধিকারী আর বুদ্ধ বললেন, তাঁর জন্ম থেকেই বৃষ রাশি। অশোক বললেন, ঘোড়া তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তারের কথা বলে আর বুদ্ধ বললেন, এই ঘোড়ায় চড়েই তিনি তো সংসার ত্যাগ করেছেন। শেষে অশোক বললেন, তিনি হস্তীর মতো স্থিতধী আর শক্তির আধার তখন বুদ্ধ জানালেন, জন্মের আগে এই হস্তী স্বপ্নে তাঁর মায়ের গর্ভে প্রবেশ করেছিল। এভাবেই অশোক স্তম্ভের আড়ালে লুকিয়ে রইল দুই রাজার সন্ধি আর ভাবমূর্তির কাহিনি।
…. শেষ …
… ভাবমূর্তি-র অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ১১। এই একুশ শতকেও কলকাতার বাড়ির দেওয়ালে রয়েছে রানি ভিক্টোরিয়ার মুখমণ্ডল
পর্ব ১০। অ্যাথেনার মন জয় ভিক্টোরিয়ার মূর্তিতে
পর্ব ৯। মূর্তি দিয়েই লর্ড বেন্টিঙ্ককে প্রতিষ্ঠা করা হল সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদকারী হিসেবে
পর্ব ৮। কলকাতায় ইংরেজ স্থাপত্যের অভিনব জলের ফোয়ারা, কিন্তু সিংহের আদল কেন?
পর্ব ৭। আরেকটু হলেই নিলামে উঠতেন ভাইসরয় মেয়োর মূর্তি!
পর্ব ৬। হাইকোর্টের থামের নকশায় প্রতিফলিত ইংরেজের ভাবমূর্তি
পর্ব ৫। ইংরেজ ভাবনার জীর্ণ স্মৃতি নিয়ে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের রোমান ‘মিনার্ভা’
পর্ব ৪। ত্রিবেণী টোলের পণ্ডিত উজ্জ্বল করলেন হেস্টিংসের ভাবমূর্তি
পর্ব ৩। বঙ্গভঙ্গের ছায়া মুছতে অঙ্গমূর্তির পরিকল্পনা করেছিলেন লর্ড কার্জন
পর্ব ২। হেস্টিংসের মূর্তি আসলে অত্যাচারীরই নতুন ভাবমূর্তি
পর্ব ১। শাসককে দেবতা বানানোর অভিপ্রায়েই কলকাতায় পথে-প্রান্তরে ইংরেজরা বসিয়েছিল মূর্তি
‘মহুয়া’র প্রচ্ছদের নেপথ্যে নন্দলালের আঁকা সহজ পাঠের ছবি রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই প্রাণিত করেছিল। সহজ পাঠের আগে আমরা দেখেছি, ১৯২২ সালের শেষে আন্দ্রে কারপেলেস প্যারিস থেকে এনেছিলেন একগুচ্ছ কাঠখোদাই। এমনকী, বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ যে কয়েকবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন, সেখানে জার্মানিতে ও ফ্রান্সে তাঁর রীতিমত চেনাজানা ঘটেছিল কাঠখোদাই মাধ্যমটির সঙ্গে।