‘উল্টোরথ’-এর ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায় এক অত্যাশ্চর্য জিনিস লক্ষ করা যায়। ‘অভিজাত-নগরী কলকাতা’ শিরোনামে সেখানে একটি সচিত্র ফিচার প্রকাশিত হচ্ছে, যার পাতায় পাতায় চিত্রতারকাদের আসল মুখ দিয়ে ক্যারিকেচারীয় নানা ছবি। সুচিত্রা সেনের তেমন ক্যারিকেচারের প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে ফুটপাথ, সেখানে হকারি রাজত্ব। ফুটপাথকে ‘মার্কেটিং পাথ’ নাম দেওয়ার শ্লেষাত্মক দাবি সেখানে, এবং অভিযোগ, কলকাতার ফুটপাথে পথচারীরা মোটেই হাঁটতেচলতে পারেন না। কিন্তু কলকাতার ফুটপাথের যতই দৈন্যদশা হোক, তাতে যে সুচিত্রা সেনের হাসিমুখে পথ চলার একখানা ছবি থাকতে পারে, সেখানেই ছিল সম্পাদকীয় বাজিমাত!
ছয়ের দশকের শেষে, কৃষক আন্দোলনে নকশালবাড়ি উত্তাল হয়ে ওঠার বছরে, বুদ্ধদেব বসুর ‘‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’’ নিয়ে সাহিত্যজগতে একটা ছোটখাট ঝড় উঠল। ‘নিষিদ্ধ’ সেই উপন্যাস নিয়ে মামলাও চলল। তার আশপাশেই ‘প্রজাপতি’ নিয়েও উতরোল হয়েছে। কিন্তু আদালত যাই-ই বলুক, বাঙালির আন্ডারগ্রাউন্ড পাঠের ঠিকানা দীর্ঘদিন ধরেই কিন্তু ছিল বিবিধ সিনে-পত্রিকার অন্তরালে। হাতের কাছে যে খবর হয় না, তার জন্য একসময় দিল্লি-লাহোর যেতে হত না বাঙালিকে, সেসব খবর থাকত ‘প্রসাদ’, ‘উল্টোরথ’-এ।
পড়ার বইয়ের ফাঁকে ‘উল্টোরথ’ পড়তে গিয়ে কতবার ধরা পড়েছে কতজন! তাতে মহাভারত উল্টে না গেলেও, ‘উল্টোরথ’ নামটা যেমন এখন সংরক্ষণযোগ্য ইতিহাস হয়ে উঠছে, তখন তা ছিল গোপন ইস্তেহারের মতো। ১৯৫২ সাল, স্বাধীনতা-দেশভাগের পরের বাংলায়, যখন টকিজ আস্তে আস্তে হয়ে উঠছে বাঙালির স্বপ্নের ভাষ্য, তখন ‘উল্টোরথ’-এর আত্মপ্রকাশ, মনোজ দত্ত-র হাত ধরে। সেই বছর মুক্তি পাচ্ছে ‘বসু পরিবার’, যা বাংলা সিনেমাকে নতুন এক নায়ক উপহার দিল, যার নাম উত্তমকুমার। ধীরাজ ভট্টাচার্য-অহীন্দ্র চৌধুরীদের গাম্ভীর্যের পাশে সেই প্রথম এক মানুষের নায়কের উত্থান বাংলায়। ‘উল্টোরথ’ তাই অবধারিতভাবে বাংলা সিনেমার সেই নতুন যুগের বার্তাবাহক হয়ে উঠেছিল, অচিরেই।
‘উল্টোরথ’ কেবলই ছায়াছবির খবর দিত না। অন্দরমহলে পাঠের যাবতীয় উপকরণ জমা থাকত সেই পত্রিকায়। ‘ফিল্মফেয়ার’, ‘স্টারডাস্ট’ বা ‘সিনে ব্লিতজ’ জাতীয় পত্রিকার সঙ্গে ‘উল্টোরথ’-এর তফাত ছিল এখানেই। সাজানো ড্রয়িংরুমে তা শোভা পায়নি। তা সোজা ঢুকে পড়েছে ভেতরঘরে। ‘ভারতী’ পত্রিকা ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্য বহরে নিয়েও সিনেমার খবর ছাপিয়েছে। ‘বিজলী’, ‘দীপালী’, ‘সচিত্র শিশির’ পেরিয়ে ‘সিনেমা জগৎ’, ‘প্রসাদ’ বা ‘উল্টোরথ’-এ পৌঁছতে পৌঁছতে বাংলা সিনেমা তার গোত্র বদলে ফেলেছে। তাই ‘উল্টোরথ’ সিনেমার খবরের পাশে পাশেই স্থান দিল দর্শকের মনকে। ‘উল্টোরথ’-এর অবভাসে রইল সিনেমার ঝলমলে দূরের রাজত্ব, অন্তরে রইল গেরস্থালি।
‘উল্টোরথ’-এর ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায় এক অত্যাশ্চর্য জিনিস লক্ষ করা যায়। ‘অভিজাত-নগরী কলকাতা’ শিরোনামে সেখানে একটি সচিত্র ফিচার প্রকাশিত হচ্ছে, যার পাতায় পাতায় চিত্রতারকাদের আসল মুখ দিয়ে ক্যারিকেচারীয় নানা ছবি। সুচিত্রা সেনের তেমন ক্যারিকেচারের প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে ফুটপাথ, সেখানে হকারি রাজত্ব। ফুটপাথকে ‘মার্কেটিং পাথ’ নাম দেওয়ার শ্লেষাত্মক দাবি সেখানে, এবং অভিযোগ, কলকাতার ফুটপাথে পথচারীরা মোটেই হাঁটতেচলতে পারেন না। কিন্তু কলকাতার ফুটপাথের যতই দৈন্যদশা হোক, তাতে যে সুচিত্রা সেনের হাসিমুখে পথ চলার একখানা ছবি থাকতে পারে, সেখানেই ছিল সম্পাদকীয় বাজিমাত! হাঁটাচলা শ্বাস নেওয়ার পরিসর কমার অভিযোগ নিয়ে গুনগুন ওই একটি পাতাতেই যেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের গান হয়ে ওঠে। যেমন, আবর্জনাক্লিষ্ট কলকাতা নিয়ে আপত্তি তোলা হচ্ছে যেখানে, সেখানে উপস্থিত ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় পর্দায় সাধারণ্যের এমন বহু আপত্তিই তো তুলে এনেছেন বারবার, যমালয়ও ছাড় পায়নি সেখানে। ‘পরশপাথর’-এর শুরুতে ছিল চাকুরিজীবীদের দুরবস্থা নিয়ে খেদ, এই সংখ্যার এক পাতায়, জহর রায় রাস্তা পেরচ্ছেন, তার মুখ কিন্তু পাঠকদের দিকে। অনুযোগ, প্রাণ হাতে করে যাতায়াত করতে হয় মসীজীবীদের। কলকাতার কেরানিকুলের এই চিরন্তন সমস্যায় জহর রায়ের মুখের চেয়ে বড় পরশপাথর আর কী হতে পারে?
কখনও মেগাফোন রেকর্ডে সুচিত্রার গান, কখনও তরু মুখোপাধ্যায়ের অল্প আলোচিত, সংলাপহীন ছবি ‘ইংগিত’-এর বিজ্ঞাপন, আবার কখনও ‘বিপাশা’, ‘নেকলেস’, ‘রাজদ্রোহী’-র মতো ছবিতে নানা ছাঁদের উত্তমকুমার, কখনও ‘সুভাষচন্দ্র’ ছবির পোস্টারে ঘোষণা ‘তোমার আসন শূন্য আজি’- প্রচ্ছদে ধরা ছিল বাংলা ছবির রংবাহার। আর ভেতরে হরেক কিসিমের বিনোদন। তার মধ্যে যেমন ‘মেলব্যাগ’ নামে একটি কলাম ছিল। যেখানে পাঠকের নানা প্রশ্নের উত্তর আসত ‘মিসেস প্রসাদ সিংহ’ নামে। এই অতিরেকটুকু, ‘মিসেস’, এর মধ্যেই ধরা রয়েছে, মহিলামহল কীভাবে তার ভাষা খুঁজে নিয়েছে এইসব পত্রপত্রিকায়। বিচিত্র প্রশ্ন ও তার অভূতপূর্ব উত্তরগুলো চমকপ্রদ। এক পাঠকের জিজ্ঞাস্য, রাশিয়াতে ক্রিকেট খেলা হয় না কেন? উত্তর, ‘কারণ রাশিয়ার লোকেরা রাশি-রাশি কাজ করে, অফিস পালাতে জানে না।’ আবার একজনের প্রশ্ন,
‘হিন্দী ছবিতে যে ধরনের নাচ হয়, ঐ ধরনের নাচ আমি শিখতে চাই। যেমন হেলেনের নাচ। ঐ ধরনের নাচ কোথায় শেখানো হয় জানাবেন কি?’ উত্তর, ‘‘ও! হেলেনের নাচ শিখতে চান? অর্থাৎ Hell-এ ‘in’ করতে চান, তাই না? Hell-এর ঠিকানা আমার জানা নেই।’’
‘গল্প হলেও সত্যি’-তে যখন দুপুরে বাড়ির মেয়ে গোপন প্রেমের বিদ্রোহ করছে, সেই বিদ্রোহের শত্রু যে বাড়ির মা-কাকিমারা, তারা শোওয়ার ঘরে জড়ো হয়েছিলেন সেই অবিশ্বাস্য স্বপ্নের ভৃত্য ধনঞ্জয়ের পাঠে উত্তমকুমারের গল্প শুনতে। যে পত্রিকা থেকে ধনঞ্জয়-রূপী রবি ঘোষ পড়ে শোনাচ্ছিলেন সেই কিসসা, দর্শক খেয়াল করলে দেখতে পাবে, পত্রিকাটির নাম ‘উল্টোরথ’।
একজন বিজ্ঞানী জীবন বিপন্ন করে কর্পোরেট চালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। দেশের গোয়েন্দা বাহিনী তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল, তারা দেশাইকে ফেরায়নি। না ফেরানোর জন্য জবাবদিহি করেনি। এবং নানা কারণের সংযোগে আজ ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য কেন্দ্র আজ সাগর জলে।