
গাড়ুর ডাল রান্নার মূল বিশেষত্ব হল, কোনওরকম তেল-হলুদ এতে ব্যবহার করা হয় না। পাশাপাশি এতে সম্বার দেওয়াও নিষেধ। তা সত্ত্বেও, এর স্বাদের কোনও তুলনা হয় না। এর মূল উপকরণ হল নানা প্রকার সবজি। মুলো, শাপলা, তেঁতুল, থোর, শিম, রাঙা আলু, শালুক, নানা ধরনের কচু, কুমড়ো, কাঁচকলা ও জলপাই। ডাল হিসেবে অড়হর কিংবা মটর ডাল দিয়েই রান্না হয়। এত প্রকার ডাল ও সবজি মেশানোয় ডালটি হয়ে ওঠে ভীষণ ঘন ও গাঢ়। এই গাঢ়ত্বের জন্যেই লোকমুখে প্রথমে ‘গাঢ়’ ডাল ও পরে ধীরে ধীরে তা ‘গাড়ুর ডাল’ রূপে প্রচারিত হয়।
‘আশ্বিনে রাঁধে কার্তিকে খায়,
যাহা বর মাগে, সে বর পায়।’
বাংলার পরিধি বিপুল। তেমন বিশাল তার সংস্কৃতিও। যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। কোনও জাতির সংস্কৃতির সঙ্গে অবশ্যই তার খাদ্যাভ্যাসও অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। উক্ত সমাজে কী খাদ্য, কবে ও কীভাবে গ্রহণ করা হয়– সবটাই সেই সমাজের জীবনযাত্রা ও আচার-অনুষ্ঠানকে প্রতিফলিত করে। আশ্বিনের দুর্গোৎসব আপামর বাঙালির প্রাণের উৎসব হলেও, তা প্রধানত সমাজের উচ্চবর্গীয় ও মধ্যবিত্তদের গণ্ডিতেই বহুলাংশে সীমাবদ্ধ। তাতে প্রবলভাবে উপেক্ষিত হয় স্থানীয় প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষেরা। তাই তাঁরা তাঁদের মতো করে নানা লোকাচার পালন করে থাকেন। আর যে কোনও লোকসংস্কৃতির শীর্ষে থাকে কৃষিভাবনা।
পূর্ববঙ্গীয় (আজকের বাংলাদেশ) সংস্কৃতিতে আশ্বিন মাসের সংক্রান্তিতে একটি বিশেষ ধরনের ডাল রান্না করে খাওয়ার প্রচলন আছে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরপর সেই বিশেষ রীতিটি এপার বাংলায়ও চলে এসেছে শরণার্থী অনুপ্রবেশের মাধ্যমে। পরবর্তীতে বাঙালরাই এই সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখে। স্থানবিশেষে এই ডাল রন্ধনের ভিন্নতা নজরে আসে।

এই ডাল রান্নার মূল বিশেষত্ব হল, কোনওরকম তেল-হলুদ এতে ব্যবহার করা হয় না। পাশাপাশি এতে সম্বার দেওয়াও নিষেধ। তা সত্ত্বেও, এর স্বাদের কোনও তুলনা হয় না। এর মূল উপকরণ হল নানা প্রকার সবজি। মুলো, শাপলা, তেঁতুল, থোর, শিম, রাঙা আলু, শালুক, নানা ধরনের কচু, কুমড়ো, কাঁচকলা ও জলপাই। ডাল হিসেবে অড়হর কিংবা মটর ডাল দিয়েই রান্না হয়। এত প্রকার ডাল ও সবজি মেশানোয় ডালটি হয়ে ওঠে ভীষণ ঘন ও গাঢ়। এই গাঢ়ত্বের জন্যেই লোকমুখে প্রথমে ‘গাঢ় ডাল’ ও পরে ধীরে ধীরে তা ‘গাড়ুর ডাল’ রূপে প্রচারিত হয়। ঢাকা-সহ বিস্তীর্ণ অংশে ‘গারু সংক্রান্তি’ পালিত হয়। বিভিন্ন পণ্ডিতদের মতে, এটি এক ধরনের প্রকৃতিপুজো। লোকমুখে কথিত, এই ডাল আশ্বিন সংক্রান্তিতে রেঁধে কার্তিক মাসের প্রথম তারিখে গ্রহণ করলে, মনের ইচ্ছাপূর্ণ হয়।
‘বুরা গিয়া ভালা আ,
অলক্ষ্মীকে তাড়াইয়া লক্ষ্মী আ।’

শুধু পূর্ববঙ্গীয় (বাঙাল)-দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, উত্তরবঙ্গেও আশ্বিন সংক্রান্তিতে বিশেষ ব্রতপালনের নজির রয়েছে। কোচবিহারে গার্সী ব্রতপালনের কথা আমরা জানতে পারি। এটি প্রধানত দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা। বিবাহিত মহিলারাই এদিন এ ব্রত পালন করে থাকেন ও লক্ষ্মীর ব্রতকথা পাঠ করারও বিধান রয়েছে। এদিন তেঁতুল দাঁতে মেখে মুখ ধোয়া, ও কাঁচা হলুদ গায়ে মেখে স্নান করার নিয়মও রয়েছে। উদ্দেশ্য, মূলত চর্মরোগ থেকে বাঁচা। আবার অনেকেই পাটকাঠির ডগায় আগুন সহযোগে সিগারেটের মতো ধোঁয়া ছাড়েন। প্রধানত, সর্দি-কাশি থেকে নিরাময়ই এর লক্ষ্য। পাশাপাশি কার্তিক মাসে শিশির পড়ার সূচনা, তাতে চাষের ক্ষতি। ঋতু-পরিবর্তনে নানা জরা-ব্যাধি থেকে রক্ষা পেতেও এই ব্রত করা হত বলে অনুমান।
‘আশ্বিন যায়, কার্ত্তিক আসে,
মা লক্ষ্মী গর্ভে বসে।’
আশ্বিন সংক্রান্তিতে গোটা বাংলা জুড়ে এমনই নানা আচার-রীতিনীতি পালন করা হয়ে থাকে। কৃষিজীবী সমাজও তার ব্যতিক্রম নয়। এই সময়কাল ধান পাকা হওয়ার সময়। ধান গাছের গর্ভে শীষের উৎপত্তি হয়।
‘আশ্বিন যায়, কার্ত্তিক আসে,
মা লক্ষ্মী গর্ভে বসে।’
এই সময় গোটা ধানখেত সবুজ ধানে পরিপূর্ণ হয়ে যায়, শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে প্রকৃতি। কৃষক সমাজের কাছে যা মা লক্ষ্মীর আগমন বার্তা। চাষির ছেলেমেয়েরা এই সময় ধানখেতে দুধ ঢেলে দেয়, যাতে দুধ ধানের গোড়া আরও মজবুত করতে পারে। এছাড়াও, বাতাসা ছড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে সেই ধানের স্বাদ সুমিষ্ট হয়। এই গোটা কর্মকাণ্ডে চাষিরা তাদের খেতকে কন্যারূপে কল্পনা করেন। একজন গর্ভবতী নারীকে যেভাবে তার আত্মীয়-পরিজনেরা সাধ খাওয়ায়, সেই কল্পনা করেই ধানখেতকে সাধভক্ষণ করানো হয়।

রাঢ়বাংলার বিস্তীর্ণ অংশ যেমন– বীরভূম, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়াতেও আশ্বিন সংক্রান্তিতে নানা লোকাচার পালন করা হয়। বীরভূমে মহিলারা ধানখেতের সামনে পুজো করেন। পুরুলিয়া, বাঁকুড়ায় আশ্বিন সংক্রান্তি ‘ডাক-সংস্কৃতি’ বলে পালিত হয়। মেদিনীপুরে কোড়া উপজাতির মানুষজনরা এদিন ‘গর্ভিনী সংক্রান্তি’ পালন করে থাকেন। আবার ঝাড়গ্রাম সংলগ্ন সাঁওতাল পরগণায় আশ্বিনের সংক্রান্তিই ‘জিহুড় উৎসব’। কৃষিজীবী কুড়মি সম্প্রদায়ের মানুষজনেরাই এই উৎসবে শামিল হন। ‘জিউ’ শব্দের অর্থ মানুষ, ‘হুড়’ শব্দের অর্থ বাঁচা। অর্থাৎ, দীর্ঘ জীবনলাভের উদ্দেশ্যেই এই উৎসব করা।
এমনই হরেক লোকসংস্কৃতি ঐতিহ্য আজ বয়ে চলেছে বাংলা জুড়ে। যা অনেক সময় উচ্চবর্ণের উৎসবের ভিড়ে ম্লান হয়ে আসে।
……………………..
রোববার.ইন-এ পড়ুন অভিজিৎ চক্রবর্তী-র অন্যান্য লেখা
……………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved