Robbar

ছোটদের পূজাবার্ষিকী কোমল চিত্তকে কলুষিত না করার অভিপ্রায়ে ‘অ-মানুষিক’ হয়ে উঠছে?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 26, 2025 5:10 pm
  • Updated:September 26, 2025 7:54 pm  
Debasis Gupta discusses the evolution of children's literature in Pujabarsiki

কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে এই ধরনের ‘বিশেষ’ সংখ্যাগুলিতে মোট প্রকাশিত লেখার আট আনা থেকে বারো আনাই হয় ভূতের গল্প অথবা রহস্য-রোমাঞ্চমূলক গল্প-উপন‌্যাস। বাকি যেটুকু পড়ে থাকে, তা ‘ছবিতে গল্প’ বা ‘হাসির গল্প’ দিয়ে ভরে নেওয়া হয়। পাঠকের সবুজ হৃদয়ে যাকে বলে ‘অবুঝ ব্যথা’ যাতে কোনওভাবেই না লাগে তার জন্য কর্তৃপক্ষ যারপরনাই সচেষ্ট! শিশু বা কিশোর-হৃদয়ের সঙ্গোপনে যে আরও অজস্র ভাব-ভঙ্গিমা-আবেগ খেলা করে, ছোটদের জন‌্য ইদানীংকার লেখায় সেই অবশ‌্যম্ভাবী উপাদানগুলি কি চিরকালের মতো তিরোহিত হল?

প্রচ্ছদচিত্র: দীপঙ্কর ভৌমিক

দেবাশিস গুপ্ত

শরৎকালের মাঝামাঝি সময় এসে গেল। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে একটি-দু’টি করে শারদীয়া পত্রিকাগুলি আবির্ভূত হচ্ছে। মহালয়ার আগে-পরে স্রোতের মতো তাদের উপস্থিতি। পত্রপত্রিকার দোকানগুলি বর্ণময় উদ্ভাসে সমুজ্জ্বল।

বস্তুত, একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়– এইসব শারদ পত্রিকার চারিত্র-বৈশিষ্ট্য চারটি বা পাঁচটি উপবিভাগে বিন‌্যস্ত। সাধারণত সাহিত‌্য পত্রিকা– কয়েকটি উপন‌্যাস, ইদানীং সং‌খ্যায় ক্রমশ হ্রাসপ্রাপ্ত কিছু গল্প-কবিতা এবং সামান‌্য কয়েকটি প্রবন্ধ নিয়ে গ্রথিত। বাংলা পূজাবার্ষিকীর আদিকাল থেকে এই চরিত্র বজায় রয়েছে– কালের প্রভাবে সামান‌্য কিছু ব‌্যতিক্রম সত্ত্বেও। সিনেমা বা নাটককেন্দ্রিক সংখ‌্যাও প্রকাশিত হয় কয়েকটি। ভৌতিক-গোয়েন্দা-রহস‌্যকাহিনির প্রতি সম্পূর্ণ উৎসর্গীকৃত পত্রিকার সংখ‌্যা ক্রমবর্ধমান। পাঠকের রুচি এবং চাহিদা নিশ্চয়ই এই খাতেই বহমান। আর তাছাড়া গত শতাব্দীর পাঁচ-ছয়-সাতের দশকেও এই ধরনের পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে অসংখ‌্য। সেখানে বহু প্রথম সারির গল্প-উপন‌্যাসও প্রকাশিত হয়েছে– পরবর্তীকালে এই ধরনের সংকলন বা সম্পাদিত গ্রন্থে সেগুলিকে এখনও প্রায়শই পুনর্মুদ্রিত হতে দেখা যায়। এই ঝোঁক, সুতরাং, নতুন কিছু নয়।

শিশুসাথী

এছাড়া শিশু-কিশোরভোগ্য পত্রপত্রিকার বিশেষ শারদীয়া সংখ‌্যা তো আছেই– সবথেকে প্রথমে দেখা পাওয়া যায় সেগুলিরই। এবং কেবল পত্রিকার বিশেষ শারদ সংখ‌্যাই নয়, আরও বেশ কিছু বার্ষিকী প্রকাশিত হয় কেবল এই শারদোৎসব উপলক্ষে‌ই– বছরে একটিবারই দেখা যায় তাদের।

এখানেই চমক! কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে এই ধরনের ‘বিশেষ’ সংখ‌্যাগুলিতে মোট প্রকাশিত লেখার আট আনা থেকে বারো আনাই হয় ভূতের গল্প অথবা রহস‌্য-রোমাঞ্চমূলক গল্প-উপন‌্যাস। বাকি যেটুকু পড়ে থাকে, তা ‘ছবিতে গল্প’ বা ‘হাসির গল্প’ দিয়ে ভরে দেওয়া হয়। পাঠকের ‘সবুজ হৃদয়ে’, যাকে বলে, ‘অবুঝ ব‌্যথা’ যাতে কোনওভাবেই না লাগে তার জন‌্য কর্তৃপক্ষ যারপরনাই সচেষ্ট!

দেব সাহিত্য কুটীর

এমন নয় যে, এইসব লেখা বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে আগে হয়নি, ইদানীংই পাঠকদের সুকোমল চিত্তকে কলুষিত করার উদ্দেশ‌্য নিয়ে তারা পত্রিকার পৃষ্ঠায় অবতীর্ণ হচ্ছে। তা নয়! ভূত-গোয়েন্দা-অভিযান, ছবিতে গল্প, হাসির গল্প– বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ‌্য অঙ্গ। আমাদের শ্রেষ্ঠ লেখক-শিল্পীরা এই ধরনের লেখায় তাঁদের অবদান রেখে গিয়েছেন। কিন্তু কেবলই এইসব লেখা দিয়ে একটি শারদ সংখ‌্যার সম্পূর্ণটাই ভরে দেওয়া কয়েক দশক আগে পর্যন্ত অকল্পনীয় ছিল! শিশু বা কিশোর-হৃদয়ের সঙ্গোপনে যে আরও অজস্র ভাব-ভঙ্গিমা-আবেগ খেলা করে, ছোটদের জন‌্য ইদানীংকার লেখায় সেই অবশ‌্যম্ভাবী উপাদানগুলি কি চিরকালের মতো তিরোহিত হল?

তাই পুরনো বার্ষিকীগুলি নিয়ে মাঝেমধ্যে ফিরে ফিরেই বসতে ইচ্ছে করে– পুজো ফুরিয়ে গেলেও তাদের প্রতি অনাবিল ভালোবাসা ফুরিয়ে যায় না। সারা জীবন ধরে তারা আনন্দগান গেয়ে যায়। সুতরাং, বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত‌্য একদা কী ছিল– তা নিয়ে হা-হুতাশ করে লাভ নেই। ‘পার্ব্বণী’ ইত‌্যাদি আদিযুগের বার্ষিকীগুলিতে মহাপ্রতিভাধর লেখকরা ছোটদের লেখার দিকে তাঁদের সৃষ্টি প্রসারিত করেছেন, সেসব লেখার চিরস্থায়িত্ব সম্বন্ধে বাঙালি পাঠক বহুদিনই নিঃসংশয়! রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, সুনির্মল বসু, মণিলাল গঙ্গোপাধ‌্যায়ের রচনা বাংলা সাহিত্যের অক্ষয় সোনার মোহর। তবে রচনা-বৈচিত্র এবং একইসঙ্গে নানা লেখকের বিভিন্ন রসের গল্প-উপন‌্যাস-কবিতা-প্রবন্ধের সমারোহ অনুধাবন করার জন‌্য এবং সেই সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে বাংলা ছোটদের সাহিত্যের ক্রমপরিবর্তমান অভিমুখ হৃদয়ঙ্গম করতে গত শতাব্দীর তিনের দশক থেকে প্রকাশিত বার্ষিকীগুলির, বিশেষ করে দেব সাহিত‌্য কুটীরের সুবিখ‌্যাত পূজাবার্ষিকীগুলি ধারাবাহিকভাবে অবধান করাই প্রধান উপায়। এছাড়া ‘মৌচাক’, ‘রংমশাল’, ‘রামধনু’ ইত‌্যাদি কিশোরপাঠ‌্য পত্রিকাগুলির নানা সংখ‌্যাও এই ধারাকে বোঝার জন‌্য মস্ত নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে।

শিশুসাথী

ক্রমান্বয়ে প্রতি বছর একটি করে বার্ষিক সংখ‌্যা নিয়মিতভাবে প্রকাশের প্রাথমিক কৃতিত্ব দাবি করতে পারে অধুনালুপ্ত আশুতোষ লাইব্রেরি। কলকাতা এবং ঢাকা থেকে একযোগে প্রকাশিত বার্ষিক শিশুসাথী-র প্রথম সংখ‌্যাটি প্রকাশিত হয় আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী আগে– বাংলা ১৩৩৩ (১৯২৬) সালে। সম্পাদক ছিলেন সুখ‌্যাত ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার। অথচ কী আশ্চর্য, পরের বছরই সেই ‘শিশুসাথী’র বার্ষিক সংখ‌্যার (১৩৩৪) সম্পাদক সম্পূর্ণ বিপরীত জগতের প্রকৃতিবিদ জগদানন্দ রায়। পরবর্তী বছরগুলিতে সম্পাদনার দায়িত্ব যাঁরা নেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন কার্তিকচন্দ্র দাশগুপ্ত (১৩৩৭), নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য (১৩৪০), সুবিনয় রায়চৌধুরী (১৩৪২) এবং বিজনবিহারী ভট্টাচার্য (১৩৪৪)। বার্ষিক ‘শিশুসাথী’র প্রকাশ স্রোত অক্ষুণ্ণ ছিল প্রায় পাঁচ দশক, যদিও স্বাভাবিকভাবেই শেষের দিকে সেই স্রোত কিছু ক্ষীণতনু এবং আবিল হয়ে পড়ে। এখানে লেখকগোষ্ঠীর মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন সময়ে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য‌, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ‌্যায়, শশীভূষণ দাশগুপ্ত, কার্তিকচন্দ্র দাশগুপ্ত, আশাপূর্ণা দেবী, পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী, বীতপাল, ধীরেন বল, ফণীভূষণ গুপ্ত প্রমুখ।

এহ বাহ‌্য। বার্ষিক শিশুসাথী প্রায় প্রকাশের ঠিক পাঁচ বছর পরে ‘দেব সাহিত‌্য কুটীর’ প্রকাশ করে তাদের প্রথম পূজাবার্ষিকী। সুনির্মল বসু এবং গিরিজাকুমার বসু সম্পাদিত ‘ছোটদের চয়নিকা’ (১৩৩৮/১৯৩১) প্রকাশিত হওয়ার পর সেই বছরেই শরৎ থেকে বসন্ত ঋতুর মধ্যে তিনবার পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল এবং আবার তিন বছর পরে চতুর্থবার। কাপড়ে বাঁধাই এবং প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ‌্যায় অঙ্কিত প্রচ্ছদ-সমন্বিত এই গ্রন্থ হাতে নিলে এখনও খুশিতে মন ভরে ওঠে। বইটিতে পুরোটাই কবিতা।

প্রথম ১৫ বছরে প্রকাশিত ১৪টি বার্ষিকী সম্পাদনা করেছিলেন সেকালের সুখ‌্যাত কথাসাহিত্যিকরা, একক বা যৌথভাবে। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ শিশু-কিশোর সাহিত্যের নির্ধারিত গণ্ডির মধ্যেই আজীবন সঞ্চারমান ছিলেন। বুদ্ধদেব বসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ‌্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র বা নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ‌্যায়ের মতো অনেকে আবার বয়স্কপাঠ‌্য এবং কিশোরসেব‌্য সাহিত্যে সমান স্বচ্ছন্দ।

দেব সাহিত্য কুটীর

 

এখানেই পার্থক‌্য। লেখকরা এমন গল্প-উপন‌্যাস নির্দ্বিধায় লিখছেন, যেখানে বয়স্কদের জটিল ধোঁয়াটে জগতের স্বাদ মোটেই অমিল নয়। আর পাঠের আকর্ষণ তো আছেই, তাছাড়া বইয়ের রং-রূপ-গন্ধ-স্পর্শ যে অনির্বচনীয়তার স্বাদ এনে দেয়, পুরনো বইয়ের কীটদষ্ট ভঙ্গুর পৃষ্ঠার মধ্যে লুকিয়ে থাকে হারিয়ে যাওয়া সময়ের যে মায়াময় সুবাস, নীরস বিবরণে তার ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশও অনুভব করা যাবে না। এইসঙ্গে বাংলা দেশের শ্রেষ্ঠ বর্ণশিল্পীরা সযত্নে সাজিয়ে তুলেছিলেন দেব সাহিত‌্য কুটীর প্রকাশিত ৫০ বছরেরও অধিক সময়ের অনুপম বার্ষিকীগুলি।

দেব সাহিত্য কুটীর

‘ছোটদের চয়নিকা’র কবিতাগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল পুনর্মুদ্রিত। পরের বছর ১৩৩৯ (১৯৩২)-এ প্রকাশিত হয় একই সম্পাদকদ্বয় সম্পাদিত ‘ছোটদের গল্প সঞ্চয়ন’। রবীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, মণিলাল গঙ্গোপাধ‌্যায়, সুকুমার রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমেন্দ্রকুমার রায়, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত‌্যকুমার সেনগুপ্ত প্রমুখ লেখকের গল্পের সংকলন এই বই এবং এখানেও কয়েকটি পুনর্মুদ্রণ স্থান পেয়েছে– রবীন্দ্রনাথের ‘ইচ্ছাপূরণ’, মণিলাল গঙ্গোপাধ‌্যায়ের ‘খোট্টাই সরবত’ বা সুকুমার রায়ের ‘পাগলা দাশু’ ছাড়াও, এখানেই প্রকাশিত হয়েছে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের বহুখ‌্যাত গল্প ‘কঙ্কাল সারথি’ এবং তখন ২৪ বছরের যুবক বুদ্ধদেব বসুর ছোটদের জন‌্য লেখা প্রথম গল্প ‘প্রাইজ’।

শিশুসাথী

প্রথম দু’টি বার্ষিকী প্রকাশিত হওয়ার পর এক বছরের ব‌্যবধান। এরপর বাংলা ১৩৪১ (১৯৩৪) সালে প্রকাশিত হল সুনির্মল বসু সম্পাদিত ‘ঝলমল’। এবারে আর কোনও পুনর্মুদ্রণ নয়, আগাগোড়া নতুন লেখায় ভরা এই সংখ‌্যা। পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন ছোটদের জন‌্য নিবেদিত পুজোবার্ষিকীর যে ছাঁচ অনুসরণ করা হয়েছে, এই বইটিতে তা প্রথম পূর্ণাঙ্গ রূপ পেল। হাসির গল্প, গোয়েন্দা গল্প, অলৌকিক রসের কাহিনি, রূপকথা ইত‌্যাদি তো আছেই, এছাড়া এমন কিছু গল্প প্রতি বছর বার্ষিকীগুলোর বিভিন্ন সংখ‌্যায় প্রকাশিত হত যাদের সামাজিক কাহিনি হিসাবে আখ‌্যায়িত করা যেতে পারে। বছরের পর বছর ধরে ক্রমপরিবর্তমান এইসব সামাজিক আখ‌্যানের পাতায় পাতায় ধরা আছে মধ‌্যবিত্ত নিম্নবিত্ত বাঙালির হাসি-কান্না-মূল‌্যবোধ-ক্ষোভ-ক্রোধ-শঠতা-ঘৃণার রূপান্তরণের ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ‌্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ‌্যায়, নজরুল ইসলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ‌্যায়, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত‌্যকুমার সেনগুপ্ত, শৈলজানন্দ মুখোপাধ‌্যায়, আশাপূর্ণা দেবী, প্রেমেন্দ্র মিত্র থেকে পরবর্তীকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ‌্যায়, সুধীন্দ্রনাথ রাহা, বিমল মিত্র, মনোজ বসু হয়ে আশুতোষ মুখোপাধ‌্যায়, প্রফুল্ল রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ‌্যায়, শ‌্যামল গঙ্গোপাধ‌্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, শীর্ষেন্দু মুখোপ‌াধ‌্যায় পর্যন্ত তিন প্রজন্মের লেখকদের পরিবর্তমান দৃষ্টিভঙ্গির রঙিন কাচে প্রতিফলিত হয়েছে সেই রূপান্তর। মুদ্রিত অলংকরণগুলিতেও তারই উজ্জ্বল স্বাক্ষর।

দেব সাহিত্য কুটীর

অর্ধশতাব্দী ধরে প্রকাশিত এই বার্ষিকীগুলির মধ্যে সমসময়ের ছায়া পড়েছে নির্ভুলভাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, ক্রমান্বয়ে পরিবর্তমান সামাজিক ধারণা– এই সমস্ত মর্মান্তিক ঘটনা একের পর এক গল্প-কবিতা-নাটকে বারবার ছায়া ফেলে গিয়েছে। কোমলমতি বালকবালিকাদের হৃদয়ে আঘাত লাগবে ভেবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ‌্যায় ‘পথ চেয়ে’ (পরবর্তীকালে ‘তালনবমী’ নামে পরিচিত), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ‌্যায় ‘জটায়ু’, বুদ্ধদেব বসু ‘মা-ভাই-বোন’ বা ‘হৃদয়রঞ্জনের সর্বনাশ’ অথবা আশাপূর্ণা দেবী ‘কী করে বুঝবো’ বা ‘নীতিবতী ভুলুর জেঠি’ লেখা থেকে বিরত থাকেননি। এবং থাকেননি বলেই বাংলা কিশোরসাহিত‌্য তার অধুনা ঝালমশলায় রগরগে রূপ সত্ত্বেও একেবারে বর্ণহীন হয়ে যায়নি।

দেব সাহিত্য কুটীর

প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ঘনাদা’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ‌্যায়ের ‘টেনিদা’, শিবরাম চক্রবর্তীর ‘বর্ধন’ ভ্রাতৃদ্বয়– যুগপৎ ‘হর্ষ’ এবং ‘গোবর’, বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘অমরেশ’, কুমারেশ ঘোষের ‘নন্তেদা’, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ‌্যায়ের ‘শামু’ ইত‌্যাদি যেসব মহাপুরুষ দীর্ঘদিন ধরে বাংলায় ছোটদের জন্য লেখার প্রেক্ষাপট আলোয় আলোকময় করে রেখেছিলেন, তাঁদের প্রধানতম লেখাগুলির প্রকাশও এইসব বার্ষিকীতেই– এই তথ‌্য বর্তমান নিবন্ধকারের মতো অনেকেই সকৃতজ্ঞ আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করবেন। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলা ১৩৯১ (১৯৮৪) সালে প্রকাশিত ‘আরাধনা’-য় এই সুদীর্ঘ আনন্দযজ্ঞের অবসান ঘটে।

ইতিমধ্যে বাংলা ১৩৫২ (১৯৪৫) থেকে ১৩৬১ (১৯৫৪) পর্যন্ত শরৎ-সাহিত‌্য-ভবন থেকে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ১০টি বার্ষিকী– আকার এবং চরিত্র বৈশিষ্ট্যে যেগুলি দেব সাহিত‌্য কুটীর প্রকাশিত গ্রন্থরাজিরই অনুরূপ। প্রথম বার্ষিকী ‘কলরব’-এ সম্পাদক জানাচ্ছেন, ‘‘শরৎ-সাহিত‌্য-ভবন’ এবার থেকে প্রতিবৎসরই পূজাবার্ষিকী প্রকাশ করবেন। তাঁদের ভবিষ‌্যতের কাজ যাতে আরও বিচিত্র, আরও অপূর্ব, আরও চমৎকার হয়ে ওঠে, সে বিষয়ে আমার দৃষ্টিকে সজাগ রাখবার চেষ্টা করব। ইতি– তোমাদের বন্ধু, হেমেন্দ্রকুমার রায়।’’

দেব সাহিত্য কুটীর

প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিগুলি যে সবই যথাযথভাবে রক্ষিত হয়েছিল, তা একের পর এক বার্ষিকীতে সম্পাদক প্রমাণ করে দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের প্রধান লেখকরা সেখানে গল্প-কবিতা-উপন‌্যাস লিখেছেন। এছাড়া পাঁচকড়ি দে (‘গোয়েন্দাকাহিনীর কথা’), উদয়শঙ্কর (‘নাচ’), নলিনীকান্ত সরকার (‘শব্দ সন্ধান’), পরিমল গোস্বামী (‘ক‌্যামেরার ছবি’), কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ‌্যায় (‘বাংলার মাটির ফল’), যদুনাথ সরকার (‘নূরজাহানের জন্ম ও বিবাহ’) প্রমুখ রচিত অসংখ‌্য বিচিত্র রসের প্রবন্ধ বিভিন্ন সংখ‌্যায় প্রকাশিত হয়েছে– যা এখনও সুখপাঠ‌্য এবং কৌতূহলোদ্দীপক।

‘কমলিনী সাহিত‌্য মন্দির’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘ছোটদের আহরিকা’ (১৩৪২), নিউ বেঙ্গল প্রেস প্রকাশ করেছেন ‘ছোটদের মাধুকরী’ (১৩৪৫), কমলা বুক ডিপো থেকে বেরিয়েছে প্রেমেন্দ্র মিত্রের সম্পাদনায় ‘গল্পের মণিমালা’ (১৩৪৪), পাল প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে অন্তত দু’টি খণ্ড ‘মণিকাঞ্চন’ (১৩৫৩, ১৩৫৪), বিশ্বপতি চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘ঝিকিমিকি’– এইরকম আরও নানান ক্ষণজীবী বার্ষিকী একের পর এক প্রকাশিত হয়ে মধুর রসে কিশোর পাঠকদের মন ভরিয়েছে এবং হয়তো বা তাদের অভিভাবকদেরও সেইসঙ্গে!

দেব সাহিত্য কুটীর

একটু বয়স্ক পাঠকেরা ধারাবাহিক বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবেন, ‘আরাধনা’য় পরবর্তী চার দশক ধরে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত‌্য চরিত্রগতভাবে দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে এবং সে পরিবর্তনের ধারা এখনও অক্ষুণ্ণ। কোনও অজ্ঞাত কারণে পাঠকের মনোলোকের এবং রুচি-চাহিদার অনপনেয় রূপান্তর সম্ভবত এই পরিবর্তনের চালিকাশক্তি– তাদেরই চাহিদা আগাম অনুধাবন করে লেখকরা অগণন ভয়াল রসের কাহিনি আর গোয়েন্দাগল্পে ভরিয়ে দিচ্ছেন শিশু-কিশোর সাহিত্যের সম্ভার। ‘মানুষের’ গল্প তাই সসংকোচে দূরে সরে যাচ্ছে। একটি চূড়ান্ত যবনিকা।

কৃতজ্ঞতা: দেব সাহিত্য কুটির। শরৎ-সাহিত্য-ভবন। আশুতোষ লাইব্রেরি। দেবাঙ্গন বসু।