আসলে বাঙালির ঝুলন মানবজাতির এক ঐক্যবদ্ধ মহামিলনের কেন্দ্র। পরম্পরাগত ঝুলন মূলত শ্রীকৃষ্ণের লীলামাহাত্ম্য রামায়ণ-মহাভারতের দৃশ্যাবলি, পৌরাণিক ঘটনাবলির মধ্যেই আবদ্ধ থাকে। কিন্তু কিশোর-কিশোরীদের ঝুলন যাত্রা হয়ে ওঠে সমাজ-চিন্তানির্ভর। যদিও তার মূলে থাকেন রাধা-কৃষ্ণ। রাধা-কৃষ্ণ হয়ে ওঠেন মানবজাতির অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রতীক। আজকের এই সংকটের সময় এই অকৃত্রিম ভালোবাসাটাই বড় প্রয়োজন। তাই বড় প্রয়োজন বাংলার এই ঝুলনযাত্রাকে বাঁচিয়ে রাখা। যাতে শিশু-মনে ঘৃণা জন্মাতে না পারে।
ইতিহাসের প্রতি অদ্ভুত এক মায়া কাজ করে শ্রীরামপুরের চাতরার মৃৎশিল্পী রবি পালের মধ্যে। যা চলে গিয়েছে, তা কোনওদিন ফিরবে না। আর সেই না-ফেরা সময়ের অতলে তলিয়ে যাওয়া জীবনবৈচিত্র তাকে এখনও ভাবিয়ে তোলে। তার ইতিহাস-ভাবনার মধ্যে কোনও রাজা-সম্রাট-নবাব-বাদশা নেই। রয়েছে সাধারণ মানুষের ঐকান্তিক জীবনসংগ্রাম। আর সেই ভাবনা থেকেই এ-বছর শ্রীকৃষ্ণের ঝুলনযাত্রা উপলক্ষে ‘রানার’ পুতুল তৈরি করেছেন তিনি।
মাথায় লাল পাগড়ি। গায়ে জড়ানো সাদা ফতুয়া ও হাঁটু পর্যন্ত পরা ধুতিতে সজ্জিত হয়েছে রবি পালের রানার। কাঁধের মধ্যে ঝুলে রয়েছে বস্তা। ডান হাতে লণ্ঠন ও বর্শা। মুখের অভিব্যক্তি ভাবলেশহীন। যেন শোষিত হয়ে যাওয়াটাই নিয়তি। আর সেই শোষণকে মেনেই নির্মেদ শরীরে ছুটে চলার ভঙ্গিমায় গড়ে উঠেছে পুতুলটি। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কালজয়ী কবিতা ‘রানার’ শ্রমজীবী মানুষের প্রেরণার উৎসস্থল। মানব ইতিহাসের প্রতিটি শতাব্দীতে সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির শ্রমজীবীরা যে শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত, নির্যাতিত সেটাই কবি সুকান্ত তাঁর কবিতার মাধ্যমে প্রস্ফুটিত করেছিলেন। তাই ইতিহাসের পাতায় চলে গিয়েও রানার আজও ভাবিয়ে তোলে রবি পালের মতো শিল্পীদের। তারই নির্যাস হয়ে জন্ম নেয় রানার পুতুল। কিন্তু আজকের এই একুশ শতকে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা বাইকে ও সাইকেলে যে সকল শ্রমজীবী মানুষ রোদে পুড়ে বৃষ্টির জলে ভিজে আমার আপনার ঘরে খাবার বা অন্য কোনও পণ্য যখন পৌঁছে দেয়– তখন তারাও আধুনিক রানারের প্রতিরূপ হয়ে দেখা দেয়। রানার যেমন দস্যুর থেকেও সূর্য ওঠাকে ভয় পেত। তেমনই নির্দিষ্ট ডেলিভারি টাইম পেরিয়ে যাওয়ার ভয় পান আজকের শ্রমজীবী রানাররা। তাই জীবনকে বাজি রেখে তাঁরা এগিয়ে যান। আসলে ইতিহাস শেষ হয়ে যায় না, তা অন্যরূপে অন্যভাবে নিজেকে নিয়ে আসে। শোষণ চলতে থাকে। শুধু তার নাম পরিবর্তিত হতে থাকে।
ঝুলনের পুতুল নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলার মৃৎশিল্পীরা সমাজের সকল স্তরের মানুষের কথা ভেবেছেন। আর সেই ভাবনা থেকেই শ্রেণিহীন সমাজের আদর্শ তাদের পুতুল নির্মাণের বিষয় হয়ে উঠেছে। তারই প্রতিচ্ছবি দেখা যায় রবি পালের তৈরি অন্যান্য পুতুলের মধ্যে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সাপের খেলা দেখানো সাপুড়ে। মাটির পাটাতনের ওপর উদ্যত ফণা তোলা সাপের ঠিক পিছনেই বসে রয়েছে সে। মুখ ভরা দাড়ি-গোঁফ, মাথায় লাল রঙের কাপড়ের পাগড়ি। কপালে লাল টিকা। গায়ের রং বাদামি। হাতের মধ্যে বিন। সাপের খেলা দেখানো সাপুড়েদেরও নিজস্ব গান রয়েছে। সেই সুর-লয়-তাল সমাজের উচ্চস্তর পর্যন্ত পৌঁছয় না। একুশ শতকেও তারা প্রান্তিক। কিন্তু শিল্পী রবি পাল তাদের প্রান্তিক করে রাখেননি। নিজের মরমী ভাবনায় সাপুড়ের শরীরে লালিত্য মাখিয়ে দিয়েছেন। আজও বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলগুলিতে মনসা পুজোর ঝাঁপানে বেদে সম্প্রদায়ের অন্তর্গত সাপুড়েদের গান শুনতে পাওয়া যায়।
আমরা বাঙালিরা কলকাতায় হাতে-টানা রিকশা দেখলেই স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ি। যদিও সেখানেও শোষণ জড়িয়ে রয়েছে। শিল্পী রবি পালও স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েছেন বলেই তিনি হাতে-টানা রিকশা পুতুলও তৈরি করেছেন। শিল্পীর কথায় হাতে-টানা রিকশা পুরোপুরি বিলুপ্ত না হলেও আগামীতে তা শেষ হয়ে যাবে। এই পুতুল নির্মাণের মাধ্যমে তাকে ধরে রাখার চেষ্টা। শিল্পীর কথায় এই ধরনের পুতুল নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিশ্রম অনেক বেশি। মাটি দিয়ে রিকশার গঠন তৈরি করতে হয়। এতে সময় ও পরিশ্রম– দুটোই বেশি লাগে।
নদীমাতৃক দেশ এই বাংলায় কৃষি হচ্ছে সমাজের ভিত্তি। তাই কৃষক পুতুলও শিল্পী গুরুত্ব সহকারে নির্মাণ করেছেন। খেতে লাঙল টানা থেকে শুরু করে সন্ধেবেলায় কাঁধে লাঙল নিয়ে বাড়ি ফেরার দৃশ্যাবলিকে পুতুলের রূপ দিয়েছেন। তার তৈরি কৃষক পুতুলের শরীর সুঠাম ও পেশিবহুল। শরীরের উর্ধাঙ্গ অনাবৃত। শরীর জুড়ে কোমর থেকে হাটু পর্যন্ত ধুতিটুকু রয়েছে। মুখের অভিব্যক্তিতে পরিশ্রমীভাব স্পষ্ট। মাথায় টুপি। মাটির তৈরি গরুর গাড়ি পুতুলে শিল্পীর কৃষি নির্ভর পল্লিসমাজের ভাবনা লক্ষ করা যায়। এছাড়াও ছাতা সারাই, জুতো সেলাই, পোস্টম্যান, ডাব বিক্রেতা, ব্যান্ডপার্টি, মাথায় সবজি নিয়ে বাজারে যাওয়া পুতুলের দেখা পাওয়া যায়।
১৯৭১ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের স্মৃতি এখনও শিল্পীকে ভাবিয়ে তোলে। তাই আজও মিলিটারি পুতুল তৈরি করেন তিনি। ছয় এবং সাতের দশকে ভারতীয় সেনাবাহিনী যে অলিভ গ্রিন রঙের উর্দি পরত সেটার দেখাই পাওয়া যায় রবি পালের তৈরি মিলিটারি পুতুলে। সাতের দশকের শেষের দিকে ‘বাবা তারকনাথ’ ছবি পল্লি বাংলার মনের মধ্যে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। সেই প্রভাব এখনও যে কাটেনি তারি পরিচয় পাওয়া যায়, সন্ধ্যা রায় পুতুলের মধ্যে। মাটির তৈরি শিবলিঙ্গের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি নারী মূর্তি। প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে শিল্পী জানিয়েছেন, উক্ত পুতুলটি ‘বাবা তারকনাথ’ ছবি দেখেই বানিয়েছেন তিনি। এর পাশাপাশি শকুন্তলা, পুরোহিত পুতুলের দেখাও পাওয়া যায়।
রামায়ণ-মহাভারতের প্রভাব শিল্পীর পুতুল নির্মাণে লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষ লগ্নে দুর্যোধন ও ভীমের গদাযুদ্ধ। দুর্যোধনের অভিব্যক্তিতে বাংলার তথাকথিত জমিদারি বাবুয়ানার ছাপ। শ্রীরামপুরের ঝুলনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চারদিন শ্রীকৃষ্ণের চারটি রূপকে আলাদা করে পুজো করা হয়। এইগুলো হল নৌকা বিহার, রাজবেশ, রাখালবেশ, ঘোড়বেশ। ‘রাজবেশ’ বলতে সিংহাসনে বসা দ্বারকার রাজা শ্রীকৃষ্ণ। আবার ‘নৌকাবিহার’-এ মাঝি হয়ে দাঁড় টানছেন তিনি। তার সঙ্গে রাধিকা। ‘রাখালবেশ’-এ শ্রীকৃষ্ণের চিরাচরিত রূপ দেখা যায়। হাতে বাঁশি সঙ্গে গরু। আবার শ্রীকৃষ্ণ ঘোড়ায় চড়ে যখন এগিয়ে চলেন তখন সেটি হয়ে যায় ‘ঘোড়বেশ’। শ্রীরামপুরের অন্যান্য মৃৎশিল্পীর মতোই এই চারটি বেশের মূর্তি তৈরি করেন শিল্পী।
শ্রীরামপুরের চাতরা কুমোরপাড়া বললেই কাঠামোর বিশালাকায় দেবীপ্রতিমার কথা সকলের মনে আসে। কলকাতার কুমোরটুলির পর এই বাংলায় প্রথম সারির যে ক’টি কুমোরপাড়া রয়েছে তার মধ্যে সর্বাগ্রে থাকবে চাতরা কুমোরপাড়া। আর সেখানেই আজও ছাঁচের কাঁচা মাটির পুতুল তৈরি করে যান শিল্পী রবি পাল। তার কথায় একটা সময় ছিল যখন ঝুলনের প্রাক্কালে বহু স্থানীয় শিল্পী বিপুল পরিমাণে মাটির পুতুল তৈরি করতেন। কিন্তু সে সকল ঘটনা স্মৃতি হয়ে থেকে গিয়েছে। তবু এখনও পুতুল তৈরি করা ছাড়েননি তিনি ও তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণা পাল। সামাজিক ভাবনা তাকে আজও ভাবিয়ে যায়। সেখানে যে রকম মানুষের সংগ্রামের দৃশ্য লক্ষ করা যায় তেমনই দেখা যায় অরাজক পরিস্থিতির দৃশ্যাবলিও। তার তৈরি ডাকাত পুতুল সেই অরাজকতার প্রমাণ বহন করে চলে। আসলে বাঙালির ঝুলন মানবজাতির এক ঐক্যবদ্ধ মহামিলনের কেন্দ্র। পরম্পরাগত ঝুলন মূলত শ্রীকৃষ্ণের লীলামাহাত্ম্য রামায়ণ-মহাভারতের দৃশ্যাবলি, পৌরাণিক ঘটনাবলির মধ্যেই আবদ্ধ থাকে। কিন্তু কিশোর-কিশোরীদের ঝুলন যাত্রা হয়ে ওঠে সমাজ-চিন্তানির্ভর। যদিও তার মূলে থাকেন রাধা-কৃষ্ণ। রাধা-কৃষ্ণ হয়ে ওঠেন মানবজাতির অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রতীক। আজকের এই সংকটের সময় এই অকৃত্রিম ভালোবাসাটাই বড় প্রয়োজন। তাই বড় প্রয়োজন বাংলার এই ঝুলনযাত্রাকে বাঁচিয়ে রাখা। যাতে শিশু-মনে ঘৃণা জন্মাতে না পারে।
শিল্পের আধুনিকতার এই ইতিহাস সকলেরই জানা। যেমন বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি অনুসন্ধিৎসু পাঠক জানেন আরণ্যকের সত্যচরণকে। এই লেখা, বলা যেতে পারে এক বাঙালি পাঠকের সমান্তরাল পাঠ প্রক্রিয়ার ফসল, যেখানে গগ্যাঁর দেওয়া তাহিতির বর্ণনায় অবধারিতভাবেই বারবার ফিরে ফিরে আসেন বিভূতিভূষণ।