Robbar

পোকামাকড়ের থেকে আমরা কী কী শিখি?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 6, 2025 6:46 pm
  • Updated:September 7, 2025 7:30 pm  
Learning harmony of life from neighboring insects

মণীন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন– ‘বয়স দুটো জিনিস দেয়: বার্ধক্য এবং অভিজ্ঞতা’। প্রজাতি হিসেবে মানুষ ‘বুড়ো’ হয়েছে। অভিজ্ঞতা তাকে স্পর্শ করেনি। শরণার্থী মৌমাছি শিবিরের যৌথ বাস্তুসন্ধানের ছন্দ তাকে কৌতূহলী করেছে; পড়শি পিঁপড়ে কলোনির যৌথ প্রতিরক্ষার শৃঙ্খলা তাকে বিস্মিত করেছে; ক্ষুধার্ত উই-দঙ্গলের যৌথ খাদ্য সমাচার তাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু তার যাত্রার অভিমুখ ‘জীবন’-এর যৌথতা থেকে ক্রমশ ‘আয়ু’-র ব্যক্তিসীমার দিকে।

আলোকচিত্র: গৌরবকেতন লাহিড়ী

গৌরবকেতন লাহিড়ী

১.

জীবন এত ছোট কেনে?

মাত্র একবছর ঘাসফড়িং-এর আয়ু। তার মধ্যে মোটামুটি ১০টা মাসই কেটে যায় ডিমের ভেতর, ভ্রূণ অবস্থায়। গরমের মাঝামাঝি থেকে শেষপর্যন্ত এদের ডিম পাড়বার সময়। আর শীত একটু পড়ে এলেই ডিম ফুটে বেরতে শুরু করে ছানারা। ডানাহীন, জননযন্ত্রহীন ন্যাড়া ছানাদের দঙ্গল। মায়ের আশেপাশেই থাকে, তবে খুব-একটা মা-ন্যাওটা নয়। উড়তে পারে না, লাফাতেও পারে না তেমন– আত্মরক্ষার একমাত্র সম্বল রং আর খুব ছোট আকার। পাতার সবুজের সঙ্গে একবার মিশে যেতে পারলে আর ধরা পড়ার ভয় নেই। এভাবে আন্ডারগ্রাউন্ড অবস্থায় চলে বেশ কিছুদিন। তারপর ডানা গজায়, লায়েক হয়ে ওঠে। বছরে এই সামান্য ক’টা দিনই ‘নিম্ফ’ অর্থাৎ ছানা-ঘাসফড়িংদের দেখা মেলে।

ডানাহীন, জননযন্ত্রহীন ছানা-ঘাসফড়িং

প্রায় এই সময়টাতেই উত্তরবঙ্গের ঠান্ডা জলের স্রোতে চোখ রাখলে দেখতে পাওয়া যাবে মে-ফ্লাইদের। এরা প্রাগৈতিহাসিক। পুরুষদের আয়ু মাত্র একদিন। স্ত্রীদের মিনিট পাঁচেক। তার আগেই মাছেদের খাবার কিংবা মানুষের মাছ ধরার টোপ হিসেবে মারা পড়ে বেশিরভাগ। তবু যতক্ষণ প্রাণ, ততক্ষণ প্রাণ সৃষ্টির দায়। তাই সামান্য এই জীবৎকালের মধ্যেও স্ত্রী মে-ফ্লাই রেখে যায় কয়েক হাজার ডিম। ভবিষ্যৎ।

একটি লোকগল্প শুনেছিলাম– শিব আর দুর্গা পাশা খেলছেন। হঠাৎ বিকট শব্দ! দুর্গা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও কী হল?’ শিব বললেন, ‘তেমন কিছু না, রাবণ জন্মাল’। খেলা চলছে। দু’-একটি দানের পর আবার তেমন আওয়াজ। দুর্গার ত্রস্ত চাহনির উত্তরে এবার শিব বললেন, ‘রাবণ মরল।’

জীবন আয়ুর চেয়ে অনেক বড়

আয়ুর কথা বলতে গিয়ে এই চমৎকার গল্পটি মনে পড়ল। কারণ ‘কাল’ এক আশ্চর্য এলিমেন্ট; মনে পড়ল, কারণ ‘শত শরদ’ আয়ু নিয়ে একমাত্র মানুষই আক্ষেপ করতে পারে– ‘হায়, জীবন এত ছোট কেনে?’ সেই ট্রায়াসিক যুগ থেকে, দুটো মাস-এক্সটিংশন পেরিয়ে, ২৫-৩০ কোটি বছর ধরে পৃথিবীর বুকে পথ হেঁটে চলেছে যারা– তাদের অভিজ্ঞার সামনে এ আসলে মানুষের ক্ষমতার পরাহত অহং। উত্তর হিমাচলের মায়াবী শীতল জলের ঝরোখার নিচে মে-ফ্লাইদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা-বঞ্চিত নিরলস গর্ভস্পৃহা আমাকে শিখিয়েছিল– ‘জীবন’, ‘আয়ু’র চেয়ে অনেক বড়। 

জীবন আসলে কালেকটিভ, যৌথ। কোটি কোটি বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে চলা সপ্রাণ পৃথিবীর আণবিক চোরাকুঠুরিতে সঞ্চিত জেনেটিক স্মৃতি ও শিক্ষার ভিক্ষালব্ধ ধান্য। জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী আপাত সরলরেখায় তাকে মাপা যায় না। মণীন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন– ‘বয়স দুটো জিনিস দেয়: বার্ধক্য এবং অভিজ্ঞতা’। প্রজাতি হিসেবে মানুষ ‘বুড়ো’ হয়েছে। অভিজ্ঞতা তাকে স্পর্শ করেনি। শরণার্থী মৌমাছি শিবিরের যৌথ বাস্তুসন্ধানের ছন্দ তাকে কৌতূহলী করেছে; পড়শি পিঁপড়ে কলোনির যৌথ প্রতিরক্ষার শৃঙ্খলা তাকে বিস্মিত করেছে; ক্ষুধার্ত উই-দঙ্গলের যৌথ খাদ্য সমাচার তাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু তার যাত্রার অভিমুখ ‘জীবন’-এর যৌথতা থেকে ক্রমশ ‘আয়ু’-র ব্যক্তিসীমার দিকে।

পড়শি পিঁপড়ে কলোনির যৌথ প্রতিরক্ষার শৃঙ্খলা

কেবল যৌথতা তো নয়, যৌথতার মধ্যে শৃঙ্খলা। ‘অর্ডার ইন ক্যাওস’। শব্দের অর্ডার, গন্ধের অর্ডার, বর্ণের অর্ডার, স্পন্দনের অর্ডার, দেহভঙ্গির অর্ডার। এবং সব অর্ডারই আসলে সংকেত। সুগন্ধি নেকটারের মায়াবী হাতছানি থেকে যুদ্ধাহত সৈনিকের হাহাকার; মিলন-প্রত্যাশী প্রেমিকের আহ্বান থেকে শিকারির নিশিডাক। সংকেত, ভাষা। চোখ-কান-মগজের জানলা খোলা রাখলেই ‘শিক্ষে’ হয়। প্রাক-সভ্যতা পর্ব থেকেই আরণ্যক মানুষের অনুসন্ধিৎসু প্রকৃতিপাঠের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল পশুপাখি, পোকামাকড়ের কাছে। কত আশ্চর্য সপ্রাণ সাহিত্য ছিল আমাদের। ছবিতে, কবিতায়, কর্মসংগীত থেকে লোককথা, বাগধারার গায়ে লেগে ছিল গাছের সবুজ, জীবজগতের কলতান। নদীর কাছে, বৃক্ষের কাছে সুখদুঃখের কথা মন খুলে বলতে পারত মানুষ। তারপর ঈশ্বর বললেন– ফলন্ত হও, বংশবৃদ্ধি কর, জনসংখ্যায় ভরে ফেল পৃথিবীকে। জলে, স্থলে অন্তরীক্ষে– যা কিছু চড়ে বেড়ায় পৃথিবীর বুকে তাদের সবার ওপর প্রভুত্ব করো।

পাতার ছায়ায় খাদ্যসন্ধান

একবার ড্যুরারের আঁকা যিশু কোলে মেরির ছবিতে একখানা অপূর্ব মথ দেখে ঘোর হয়েছিল। আরেকবার এক জাপানি কাহিনির নামগোত্রহীন অসহায় কৃষকের মৃত্যুর পর তার শিয়রে এসে বসেছিল সাদা প্রজাপতি। সেই নান্দনিকতার শোক আমায় আমায় ঠেলে দিয়েছিল আপাতসরল ঝোপঝাড় থেকে জঙ্গলের দিকে। জঙ্গল আমায় ধৈর্যের পাঠ দিয়েছে। শিখিয়েছে পাতার আড়াল থেকে কীভাবে খুঁজে নিতে হবে মনার্ক প্রজাপতির ডিম। সামান্য ধূসর হলে বুঝতে হবে আশেপাশের গাছে পাওয়া যেতে পারে সদ্যোজাত শূককীট। মূলত বড় পাতার নিচের দিকে, আরেকটু বড় হলে কাণ্ড বরাবর কিংবা চক্রাকারে, পাতার ছায়ায়। একবার ক্রিসালিস থেকে প্রজাপতি বের হওয়ার ছবি তোলার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৪-১৫ দিন। সেই একপক্ষকাল– বাইরে চরাচরব্যাপী প্রাণের প্রবাহ। পিউপার মধ্যে স্থির হয়ে আছে সময়। জীবন অনিত্য, মৃত্যু অনিত্য, দেহ অনিত্য, সত্তা অনিত্য। কেবল অপেক্ষা। অপেক্ষা, যা আসলে ধ্যান– হয়ে ওঠার, আত্মমগ্নতার। এনলাইটেনমেন্ট। পুনর্জন্মের গোপন প্রস্তুতি। সেই থেকে প্রজাপতি আমার জেন গুরু, আমি তার চেলা।

প্রজাপতি আমার জেন গুরু, আমি তার চেলা

প্রায় গোটা গরমকালটাই চিঁচপোকার মৈথুনঋতু। এ সময়টায় ঝোপঝাড়ে, ত্রিধারা, পুটুস ইত্যাদি ছোটফুলের গাছগুলোয় চোখ রাখলেই চিঁচপোকার যুগলমিলনের দৃশ্য চোখে পড়ে। উষ্ণ কুসুমশয়নে দীর্ঘ, ক্লান্তিকর মিলন৷ কখনও-কখনও টানা তিন দিন পর্যন্ত চলে। তবে আশ্চর্য এদের যৌন-নির্বাচন! আকারে বড়, পৃথুলা রমণী পছন্দ করে পুরুষরা। কারণ, যত বড় আয়তন, তত বেশি ডিম ধারণের ক্ষমতা, তত বেশি বংশবৃদ্ধি, অভিযোজন। আরও একটা কারণ অবশ্য আছে। সঙ্গমরত অবস্থায় চলাফেরা করার আশ্চর্য ‘ফেটিশ’ রয়েছে এদের। এবং সেই চলাচল একান্তই একমুখী– আকার ও ওজনে বড় স্ত্রী-টি টানতে-টানতে নিয়ে চলে পুরুষটিকে। উল্টোদিকে পুরুষটি থাকে নির্বিকার, নিস্পৃহ। সঙ্গমকালে ‘প্রকৃতি’ই পথ দেখাবেন কি না, ‘পুরুষ’ তো সেখানে নিমিত্তমাত্র। তেমনই তো যুগলসাধনার নিয়ম।

গোটা গরমকালটাই চিঁচপোকার মৈথুনঋতু

কিন্তু যদি কোনও কারণে সেই স্বাভাবিক চলায় ছেদ ঘটে? তেমনই একখানা পরীক্ষা করেছিলেন বিজ্ঞানী ওয়েই-জং-জিয়াং। জিয়াং যেন একবিংশ শতাব্দীর নিষাদ– তমসা নদীর তীরে মৈথুনরত ক্রৌঞ্চদম্পতির নিহন্তা। সঙ্গম চলাকালীন, ৯৫-টি স্ত্রী-কে হত্যা করে তিনি দেখেছিলেন– একমাত্র তখনই পুরুষটি চলতে শুরু করেছে উজানে, সতীদেহ বহন করে, বিপরীত অভিমুখে। আরও আশ্চর্য এই যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই চলা শেষ হয় পুরুষটির মৃত্যুতে, যদি-না বাহ্যিক কোনও হেতু এসে পৃথক করে দেয় দু’জনকে।

সঙ্গমরত অবস্থায় চলাফেরা করার আশ্চর্য ‘ফেটিশ’ রয়েছে চিঁচপোকাদের

এ-যুগের বাল্মিকী অবশ্য অভিশাপ দিয়েছেন সামান্য এই পোকাগুলোকেই, দাগিয়ে দিয়েছেন ‘পেস্ট অব কমার্শিয়াল ক্রপ’ বলে। ফলে এদের একেবারে ঝাড়েবংশে নির্মূল করার জন্য বেরিয়েছে বহু পদ্ধতি। ‘মানবিক’ সাম্রাজ্যবাদের এইসব প্রকরণ, কৌশল সরিয়ে রেখে, চিঁচপোকার এই শেষযাত্রাটুকু আমায় ফ্যাসিনেট করে। মনে করায় পদ্মপুরাণ– বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি। যদিও আরোপিত ‘সতীত্বের’ কোনও ধারণা সেখানে নেই। রয়েছে প্রকৃতির নিজস্ব করণ: থিংস উই ডু ফর লাভ!

বাগানের ক্ষিপ্র শিকারি লিংক্স স্পাইডার

‘লাভ’ শব্দটিকে এখানে বাংলায় ধরে নিলে সুবিধে হয়। এবং সেই ‘লাভ’-এরও ব্যঞ্জনা পৃথক। মানুষের সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত ব্যক্তিক বা আর্থিক লাভের জটিল বিধেয়কে অতিক্রম করে, এই লাভ আরও সহজ, আরও বৈশ্বিক– প্রজাতিগত ও প্রাকৃতিক।

লাভের কথায় মনে পড়ল: ঝিঁঝির ডাক, যা কি না ডানার সঙ্গে ডানার ঘষা লেগে তৈরি অতি ক্ষণস্থায়ী স্পন্দনের বিন্যাস, তা যে আসলে গোষ্ঠের গোপন সংকেত– কে জানত! ৬০ মিলিসেকেন্ড। অর্থাৎ, এক সেকেন্ডের হাজার ভাগের মাত্র ৬০ ভাগ। প্রেমপ্রস্তাবে সাড়া দেওয়ার জন্য মাত্র এটুকু সময়ই বরাদ্দ করেছে তারা। তার মধ্যে দু’বার প্রস্তাব জানাবে পুরুষটি, সাড়া না-এলে চলে যাবে অন্য প্রণয়িনীর খোঁজে। আর যদি সম্মতি থাকে, স্ত্রী-টি দেবে দীর্ঘ সাড়া, অনেকক্ষণ একটানে ডেকে। তার আবার পাঠান্তরও আছে। সঙ্গিনীর উদ্দেশ্যে যে ডাক, তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষটিকে দেওয়া হুঁশিয়ারির ফারাক রয়েছে। কিন্তু দুই ভিন্ন বিন্যাস মিশে গেলে চলবে না। তাহলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হবে গানের পসরা। এই যে স্পন্দনের বিন্যাস তার সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে মানুষের বাক্-শ্রুতি পদ্ধতি, এমনকী সংগীতেরও। বর্তমানে এ বিষয়টি চোখে পড়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের। তাঁরা এখন ঝিঁঝিপোকাদের ‘গুরু’ পাকড়েছেন। তাতে অবশ্য তাঁদেরই লাভ অর্থাৎ ‘প্রফিট’। 

ঝিঁঝির যে আসলে গোষ্ঠের গোপন সংকেত– কে জানত!

ভোরের দিকে বৃষ্টি হলে কিশোর সূর্যের আলো এসে বাগান-মাকড়সার জাল রং করে দিয়ে যায়। চকিত বাতাসের দোলায় সেই জাল চলমান রংধনুকের ম্যাজিক দেখায়। এ বাগানে কিছু উলফ স্পাইডার, আর বেশ কয়েক প্রজাতির লিংক্স স্পাইডারকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। কাঁঠালগাছের পাতায় একখানা বড় সাদা টেলামোনিয়াকে বসে থাকতে দেখেছি বহুবার। এরা প্রত্যেকেই লাফাড়ু। জাল বানায় না। বানায় কয়েক প্রজাতির অর্ব-উইভার মাকড়সা। গত দু’ দিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমে যে জাল বুনে চলেছে স্ত্রী মাকড়সাটি, আজ তার এক প্রান্ত ছেঁড়া দেখে মায়া হল। চোখে পড়ল জালের মালকিন এক পাশে বসে, একটি পা জালে ছুঁইয়ে রয়েছেন আলতো করে। স্পন্দনের সংকেত বুঝছেন। নিয়মমাফিক রোজনামচা। হয়তো খানিক পরেই জালের ক্ষত মেরামত করতে বসবেন। ছেলেবেলায় পড়া রবার্ট ব্রুসের গল্প মনে পড়ে।

বাগানে জাল পেতে বসে রয়েছে আর্ব-উইভার মাকড়সা

এ বাগানে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায় না। কারণ সমস্ত বাগান জুড়ে দোরঙা পিঁপড়ের রাজত্ব। এরা মূলত গাছে বাসা করে থাকে। কিন্তু খাবারের সন্ধানে বাগানের মাটি চষে ফেলে। মারকুটে, সামান্য বিব্রত হলেই আক্রমণ করবে। নারকোল পাড়তে উঠে অনেকেই এদের কামড়ে অতিষ্ঠ হয়েছেন। ছবি তুলতে গিয়ে অসাবধানে আমিও বেশ কয়েকবার সেই যন্ত্রণা ভোগ করেছি। পৃথিবীর আদিমতম বোঝাপড়ার সম্পর্ক বোধহয় গাছ আর পোকামাকড়ের। একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে ক্রমাগত। অথচ সুপ্রাচীন সেই যুদ্ধ কেবল শত্রুভাবে কামনা। লড়তে লড়তে কখন যে তারা বন্ধুতায় জড়িয়ে পড়েছে একে অপরের সঙ্গে! এই পিঁপড়েগুলো যেমন– গাছের ছাল কেটে, কাঠ ফুটো করে, পচা কাঠের গোড়া ঝাঁঝরা করে দিয়ে বাসা বানায়। তবু সারা দেহ জুড়ে ক্ষতচিহ্নের উল্কি নিয়েও গাছ এদের আশ্রয় দেয় নিরাপত্তার খাতিরে, সর্বক্ষণের প্রহরী হিসেবে। পরাগমিলনের ভবিষ্যত-সম্ভাবনার কথা ভেবে এমন কত গাছ সুসময়ে খাদ্য দেয়, আশ্রয় দেয়; আবার প্রলোভনে আকৃষ্ট করে নিজের কাজটুকুও করিয়ে নেয়। মানব সভ্যতা মুছে গেলেও দেওয়া-নেওয়ার এই খেলা বন্ধ হবে না।

দোরঙা পিঁপড়ে, মারকুটে এবং অক্লান্ত প্রহরী

বাগান ছাড়িয়ে দু’ পা হেঁটে গেলেই পুরাতন ইশকুলবাড়ির পেছনের উঁচু গাছগুলোয় তাঁতি-পিঁপড়েদের কোয়ার্টার। ইংরেজিতে বলে উইভার অ্যান্ট। এরাও বৃক্ষবাসী। লার্ভার আঠালো সিল্ক দিয়ে পাতা জুড়ে জুড়ে বাসা বানায় বলে অমন নাম। একবার একখানা পরিত্যক্ত বাসা ঘরে এনে তার পেল্লায় গম্বুজাকৃতি কুঠুরি দেখে বিস্ময় জেগেছিল। ছুটেছিলাম সেই সমগ্র পদ্ধতির ছবি তুলব বলে। নিরাশ করেনি তারা। মুখে করে টেনে এনে একটির পর একটি পাতা সেলাই করা দেখতে দেখতে আমার মনে পড়েছিল শান্তিপুরের ছোট্ট তাঁতঘর। শানা আর দক্তির যৌথ কর্মশব্দ। ঘাম। আর জেদি পাতার নমনীয়তাকে বাগে আনতে না পেরে, যখন একটির পর একটি পিঁপড়ের সারিবদ্ধ আত্মদানে তৈরি হচ্ছিল জীবন্ত সেতু– সেই সৌরদ্যুতিময় কারনেলিয়ন পাথরের ব্রেসলেট দেখে প্রণত হওয়া ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা ছিল না।

পাতা ভাঁজ করতে উদ্যত উইভার অ্যান্ট

এই আমার প্রতিবেশ। এই আমার পাঠশালা। সমস্ত পৃথিবীকে ধনধান্যপুষ্পে ভরিয়ে চলেছে আমার পড়শিরা। এ ফুল থেকে সে ফুল ঘুরে ঘুরে অক্সিজেন পৌঁছে দিচ্ছে পৃথিবীর ধমনীতে। নাড়িতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান। নিস্তরঙ্গ দুপুরে হাওয়া লেগে চলকে ওঠা মজা পুকুরের জলে খেলে বেড়ায় মশার ছানারা। খেলে বেড়ায় অতিক্ষুদ্র শৈবাল থেকে প্ল্যাঙ্কটন। একই আধারে খাদ্য ও খাদক। আশ্চর্য বিবর্তনের মায়ায় বিলুপ্তির চোখে ধুলো দিয়ে ঘরের আনাচে কানাচে ঘুরে চলে আরশোলা। মৃত ব্যাঙের দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে একটি করে কণা বাসায় নিয়ে ফেরে ডেঁয়ো পিঁপড়ের দল। গোবরের ডেলা ঠেলে মাটির গহ্বরে বয়ে নিয়ে যায় গোবরের পোকা। আমি দেখি এই নিরন্তর যাওয়া আসা। দেখি পরিপার্শ্ব উদাসীন সিকাডার প্রবৃত্তিতাড়িত সঙ্গিনীসন্ধান। দেখি মুখে করে সুতোর ডেলা নিয়ে বসে একরত্তি মাকড়সার দীর্ঘ যান্ত্রিক জ্যামিতিচর্চা। দেখা ফুরোয় না আমার। দেখি বৈচিত্র। প্রাণের সার। দেখি এ অভাগা গ্রহের এক ও অভিন্ন কাচের মতো সত্তাটিকে। দেখি আর শিখি– সেই পরম সত্তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে, ‘আমি’-র খোলস ছেড়ে ফেলে, জগতের আনন্দযজ্ঞে ‘যৌথ’ অংশগ্রহণ করতে না পারলে বৃথা আয়ু, বৃথা এ জীবন। 

‘আমি’-র মুক্তি যিনি ঘটাতে পারেন তিনিই তো প্রকৃত শিক্ষক!

…………………….

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন

…………………….