হাতের ওপর হাত রাখা খুব সহজ নয়, লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। সেই হাতের দর্শনও কি সহজ? কী ভাবে মানুষ হাত নিয়ে? হাতের নানা ভঙ্গি মানুষ ব্যবহার করেছে নানা সময়। তার কী অর্থ? ইতিহাস থেকে হাত ছেনে একটা হাতের দর্শন খাড়া করা হল এই নিবন্ধে।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
মানুষ ‘হাত’-কে শুধুমাত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় একটি অঙ্গ হিসাবেই দেখে এসেছে। কিন্তু ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ‘হাত’ আসলেই গভীর চিন্তার দাবি রাখে। অস্তিত্বতত্ত্ব, নীতি-দর্শন, ধর্মতত্ত্ব– সমস্ত পর্যায়েই হাত হয়ে উঠেছে নিশ্চয়তার স্মারক, মানুষের নির্মাণের মাধ্যম, ঘনিষ্ঠতার স্বরূপ এবং গন্তব্যের চাবিকাঠি । কিন্তু বাস্তবে ‘হাত’-এর দার্শনিক ভিত্তি তথা নির্মাণের ইতিহাসের মধ্যে স্পষ্ট হবে মানব জাতির হাজার হাজার বছরের বিবর্তন এবং মানব-অস্তিত্বের গভীর সত্য।
সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র প্রাণী মানুষ, যার সুসংবদ্ধ হাত আছে, এবং সেই হাতের গঠনশৈলীও বিশেষভাবে বিজ্ঞানসম্মত। মানব বিবর্তনের ইতিহাসে আদিম মানুষ যখনই সোজা হয়ে হাঁটতে শিখবে, তখন চলাফেরার নিরিখে হাতের কাজ সেই অর্থে শেষ হতে শুরু করবে। তাই ধীরে ধীরে বিবর্তনের ধারায় হাতের দৈর্ঘ্যও ছোট হতে শুরু হবে। মানব-বিবর্তনের ইতিহাস লক্ষ করলে স্পষ্ট হবে– মানব-শরীরের অন্যান্য বিলুপ্ত অঙ্গের মধ্যে হাতও পড়তে পারত। কিন্তু মানুষ হাতকে কাজে লাগাল হাতিয়ার রূপে, হাতিয়ার ব্যবহারের আলম্ব রূপে। অ্যারিস্টটল হাতকে বলেছিলেন ‘tool of tools’, কারণ হাতই হল মানুষের অন্যান্য হাতিয়ার ব্যবহারের ও সৃষ্টির ক্ষমতার উৎস। যন্ত্রসভ্যতার একেবারে শুরুর দিকে মানুষ হিংস্র প্রাণীদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে এবং শিকার করার উদ্দেশ্যে হাতের ব্যবহারোপযোগী হাতিয়ার নির্মাণ করতে শুরু করবে, যেমন– বর্শা। বর্শা প্রথম নির্মাণ করা হল প্রাগৈতিহাসিক যুগে। আদিম মানুষ কাঠের লাঠির সঙ্গে ধারালো পাথর বা ছুঁচলো হাড় যুক্ত করে বর্শা নির্মাণ শুরু করে। তারপর প্রস্তর যুগে এসে বর্শার ফলা আরও উন্নত হবে, যখন মানুষ পাথরকে নির্দিষ্ট আকারে কেটে বর্শার ফলা তৈরি করতে শিখবে, তখন বর্শা শিকার এবং যুদ্ধের জন্য একটি প্রধান হাতিয়ারও হয়ে উঠবে। ধাতু যুগে এসে মানুষ ধাতুর ব্যবহারিক কৌশল রপ্ত করার পর বর্শা নির্মাণে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ব্রোঞ্জ এবং লোহার ব্যবহারে বর্শার ফলা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, হাতের গঠনশৈলী ও বিবর্তনের ধারায় মানুষের হাতিয়ার নির্মাণ এবং সভ্যতার সংস্কৃতি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
এ তো গেল প্রাচীন ইতিহাসে আদিম মানুষ থেকে মানবসভ্যতার সভ্য বিবর্তনের প্রসঙ্গ। এবার আসা যাক আধুনিক সময়ের দিকে। ১৯৩৯ সালে প্রখ্যাত দার্শনিক জি. ই. মোরে এক বক্তৃতায় শ্রোতাদের সামনে নিজের মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত তুলে বলেছিলেন: ‘Here is one hand, and here is another’। এই সহজ ইঙ্গিতের উদ্দেশ্য ছিল র্যাডিক্যাল স্কেপটিসিজমের বিরুদ্ধে সপাট স্পর্ধা দেখানো। আর পাশাপাশি তাঁর এই ইঙ্গিতেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তিতে বহির্বিশ্বের অস্তিত্বে প্রামাণ্য স্বরূপ নির্মাণ করা। ফলত, হাত হয়ে ওঠে এক ধরনের দার্শনিক নিশ্চয়তা; এমন একটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা– যা কোনওভাবেই স্কেপটিসিজম দ্বারা মুছে ফেলা যায় না। তিনি কেবল ‘হাত’ দেখাননি; তিনি দেখিয়েছিলেন মানুষের অনিবার্য উপস্থিতি। স্কেপটিসিজমরা যতই প্রশ্ন তুলুক, হাতে ভাঁজ করা আঙুলের দৃঢ়তা যেন ঘোষণা করে– জগৎ আছে, আমিও আছি। হাত এখানে হয়ে উঠবে জীবনের প্রথম প্রামাণ্য দলিল।
মার্লো-পোঁতির ফেনোমেনোলজিক্যাল দর্শনে ‘হাত’ স্পর্শের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর দার্শনিক তত্ত্বে স্পষ্ট হবে– হাত কেবল বস্তু নিয়ন্ত্রণ করে না, পাশাপাশি ছোঁয়া, বয়ন কিংবা প্রতিরোধের মাধ্যমে তা জগৎকে অনুভব করে। মাটির খসখসে রূপরেখা, বরফের শীতলতা, কিংবা অন্যের হাতের উষ্ণতা– সবই হাতের স্পর্শে সজীব হয়ে ওঠে। হাত যেমন স্পর্শ করতে পারে, আবার স্পর্শিত হতে পারে– এই দ্বৈত অভিজ্ঞতাই মানুষকে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। ফলে হাত শুধু জগতের সঙ্গে নয়, আত্ম-র সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক স্থাপন করে। হাত তাই শুধুই শরীরের অঙ্গ নয়, আত্মার জানালাও।
হাতকে শ্রমের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়। দার্শনিক তত্ত্বে শারীরিক শ্রম ও মানসিক শ্রমকে আলাদা করে স্পষ্ট করা হয়েছে, যেখানে মানসিক শ্রমকে সার্বিক শ্রম হিসাবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কার্ল মার্কস দরাজে বলছেন– হাতের শ্রমও সমান মর্যাদাপূর্ণ। শ্রমের মধ্য দিয়ে হাত শুধু প্রকৃতিকে বদলায় না, মানুষকেও বদলে দেয়। হাতে কাজ করা মানেই মানুষ হওয়ার মর্যাদা রক্ষা করা। হাতের দ্বারা কাজের মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃতিকে সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করে এবং নিজের স্বাধীনসত্তাকে প্রকাশ করে।
শ্রম ছাড়াও হাত নৈতিক ও আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের প্রতীক। সম্প্রদানে বাড়ানো হাত, প্রত্যাখ্যান গুটিয়ে নেওয়া হাত, কিংবা সংহতিতে মুষ্টিবদ্ধ হাত– এই সমস্ত সম্পর্ককে দৃঢ় করতেও হাত প্রধান হয়ে ওঠে। একদিকে করমর্দন যেমন স্বীকৃতি দেয়, আবার মুষ্টিবদ্ধ হাতও প্রতিরোধের আখ্যান লিখে যায়। হাত তাই এক ধরনের নৈতিক ভাষাও বটে।
মানুষের সমস্ত নির্মাণ, যেমন– লেখা, চিত্র, স্থাপত্য– সবই হাতের বুননে জন্ম নেয়। মার্টিন হাইডেগারও বলছেন– হাত কেবল একটি অঙ্গ নয়, বরং বিশ্ব প্রকাশের মাধ্যম। লেখা, নির্মাণ, অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে হাত মানুষের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জগৎকে জানায়। মানুষের হাত তাই নিছক কাজের যন্ত্র নয়; এটি কল্পনার, ভাষার কিংবা সভ্যতার আয়নাও। প্রেম তথা প্রণয়ের মাধ্যমও হাত। আমরা হাতের মধ্য দিয়ে একে অন্যের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হতে পারি। একের হাত অন্যের হৃদয়ও ছুঁয়ে যেতে পারে, জগৎকে হাতের মধ্যে এনে দিতে পারে। এসবের উদাহরণও ভারতীয় সাহিত্যে আনাচে কানাচে ভরপুর। হিন্দি সাহিত্যে কেদারনাথ সিং ‘প্রতিনিধি কবিতায়েঁ’-র ‘হাত’ কবিতায় লিখছেন–
‘উসকা হাথ
আপনে হাথ মেঁ লেতে হুয়ে ম্যাঁয়নে সোচা
দুনিয়া কো
হাথ কী তরহ্ গর্ম অউর সুন্দর্ হোনা চাহিয়ে।’
অর্থাৎ, এক প্রেমিক তার প্রেমিকার হাত নিজের হাতে টেনে নিয়ে সেই হাতের উষ্ণতম প্রস্রবণে বিশ্বকে কল্পনা করছেন। প্রেমিকার উষ্ণ হাতের মতো যদি এই বিশ্ব মোলায়েম উষ্ণতায় ভরে থাকত! এ যেন ভয়ানক এক টুকরো কল্পবিশ্ব, যা সেই প্রেমিকার হাতের মধ্যে আবদ্ধ। আবার অন্যদিকে এ হাত শুধুই প্রেমিকার হাত নয়, যেন এক মুষ্টিমেয় জগৎ।
আবার শুধুমাত্র একটা বিমূর্ত হাত এক কবির গন্তব্যও হতে পারে। কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর একের পর এক কবিতায় একটা হাতকে শুধু কল্পনা করে গেছেন। ক্লান্ত কবি স্বপ্ন দেখছেন এক হাতের, যে কল্পনার লিখিত দলিলও নির্মাণ করছেন হাত দিয়েই তাঁর “ধূসর পাণ্ডুলিপি” কাব্যগ্রন্থের ‘স্বপ্নের হাত’ কবিতায়–
“পৃথিবীর বাধা–এই দেহের ব্যাঘাতে
হৃদয়ে বেদনা জমে– স্বপনের হাতে
আমি তাই
আমারে তুলিয়া দিতে চাই!
আবারও জীবনানন্দ “মহাপৃথিবী” কাব্যগ্রন্থের ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতায় লিখছেন–
“পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ,
রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ!
তোমার নগ্ন নির্জন হাত;
তোমার নগ্ন নির্জন হাত।”
এ কোন হাতের কল্পনা করছেন কবি? কবির কল্পনায় হাত বারবার ফিরে আসছে কেন? প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে একক কবির শ্রেষ্ঠ নির্মাণে, ‘বনলতা সেন’ কবিতায়। কবি ততদিনে ‘পৃথিবীর পথে’ হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত। ‘চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন’ অনেক দেখেছেন– এবার ঘরে ফেরার পালা, গন্তব্যে ফেরার পালা, শ্রান্তির নিবৃত্তিতে শান্তির নীড়ে ফেরার পালা।
“পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে– সব নদী, ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”
কবির কল্পিত ‘স্বপ্নের হাত’ কিংবা ‘নগ্ন নির্জন হাত’-এর কল্পনায় যেন কোথাও মিশে রয়েছে তাঁর প্রেমিকার শান্ত কোল। এ হাত যেন তাঁর সৃষ্ট বনলতা সেনের পরিপূরক কোনো প্রেমিকার হাত, কিংবা বাস্তবে বনলতা সেনেরই হাত, কিংবা কবির সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য– মৃত্যু! আবার কবি পাণ্ডুলিপির অনাবিল ডাকে নির্মাণের কোলে ঢলে পড়তে চাইছেন। যে নির্মাণ আসবে অন্তর থেকে হাতের শৈলী হয়ে পাণ্ডুলিপির পাতায়। অর্থাৎ, হাত যেন কবির আশ্রয় হয়ে উঠছে, সে হাত যতই স্বপ্নে পাওয়া আদেশ হোক কিংবা নগ্ন হোক। কবি সেই বাড়িয়ে থাকা হাতটাকেই ধরতে চাইছেন। কিংবা হাত বাড়িয়ে রয়েছেন একটা বিমূর্ত হাতের উদ্দেশে।
অন্যদিকে নিঃসঙ্গ কবি জীবনানন্দ দাশের বাড়িয়ে থাকা হাতের আর্তি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন ভারতীয় কবি হোশাং মার্চেন্ট। তিনি জীবনানন্দ দাশকে উৎসর্গ করে “My Sunset Marriage” কাব্যগ্রন্থের ‘Thousands of Years are Merely Play’ কবিতায় লিখবেন–
“I have come home to the same bed
with the mosquito-nets
I lie alone and think of a hand
advancing towards me in the darkness
Thousands of years have become this play.”
এক কবির বাড়িয়ে থাকা হাত, আরেক কবি জাপটে ধরতে চাইছেন। যদিও দুই কবির ভালোবাসার আগ্রহ ভিন্ন, তবুও তাঁদের আধ্যাত্মিক প্রেম সমস্ত বাধাকে ছিন্ন করছে হাত দিয়েই। একদিকে জীবনানন্দ আশ্রয়ের হাত বাড়িয়েছেন বনলতা সেনের দিকে, অন্যদিকে সমকামী কবি হোশাং মার্চেন্ট তাঁর হাতটাকে বাড়িয়ে ধরতে চাইছেন জীবনানন্দের বাড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ হাতটাকেই। এই দুই কবির প্রণয়ে পাঠককে বারবার প্রশ্নের মুখে পড়তেই হবে– প্রেমের জন্য হাত, নাকি হাতের জন্য প্রেম; নাকি দুই-ই পরিপূরক!
তাই, পরিশেষে বলা যাবে, হাত কেবল শারীরিক অঙ্গ নয়; এটি এমন এক দার্শনিক স্বরূপ যা মানব-অস্তিত্বকে উন্মোচন করে। হাত আমাদেরকে নিশ্চয়তা দেয়; হাত আমাদের জগৎ-অভিজ্ঞতার ভিত্তি; হাত মানব-সংস্কৃতির দরজা উন্মোচন করে; আবার হাত শ্রম ও নৈতিক সম্পর্কের প্রতীক। ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে ধর্মীয় ঐতিহ্যেও এই হাত পবিত্র বিশ্বাসের বাহক। প্রযুক্তির যুগেও হাত প্রশ্ন করবে– মানব হওয়ার অর্থ কী? তাই বলা যায়, হাত দিয়ে আমরা শুধু পৃথিবীকে জাপটে ধরি না, হাত দিয়েই আমরা মানব-অস্তিত্বকে তথা মানব অনুভূতিকে ব্যক্ত করি। এমনকী; মানুষের পরিসমাপ্তির পথকেও স্পষ্ট করা সম্ভব এই হাত দিয়েই।
……………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
……………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved