কোচির মেডিকেল ট্রাস্ট হাসপাতালে অবসাদগ্রস্থ, আত্মহত্যাপ্রবণ রোগীদের কাছে চেকুট্টি জীবনের জিয়নকাঠি। হারা যুদ্ধ জিতে আসার বাজি। মনোবিদরা তাঁদের বলেন, বন্যার ময়লা মাটি থেকে যদি এমন আদুরে পুতুলের জন্ম হতে পারে– তাহলে চেষ্টা করলেই মনের আঁধার কাটিয়ে নতুন মানুষের জন্ম সম্ভব। চেকুট্টিকে নিয়ে বই লিখেছেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিক এ সেতুমাধবন ওরফে সেতু। বই পড়ে কেঁদে ফেলেছিলেন পুতুল-জননী লক্ষ্মী।
চারপাশে ঘোলাটে জলের তোড়। টিনের ঘর ভেঙে চোখের নিমেষে ভেসে গেল রুটি-রুজির অবলম্বন, টোটোটা! মারণ স্রোতে ডুবেছে ঘরবাড়ি, মানুষ গবাদি পশু। জল আর জল। হাহাকার আর কান্না।
এই তো সব ছিল! এখন কিছু নেই! বানভাসি উত্তর। বিসর্জনের জলে ভেসে গিয়েছে স্বপ্ন-আশা-আশ্রয়।
এই ভাঙন আর কান্নার রং সর্বত্র এক। কিন্তু দক্ষিণের এমন বানভাসি ভূমিতেই ফুটেছিল এক আশার কুসুম। তাকে ফিনিক্স বলেও ডাকা যেতে পারে। নাম তার চেকুট্টি। হাজার মানুষের চোখের জলে যার জন্ম। মালায়ালাম ভাষায় ‘চেরু’ মানে কাদামাটি। ‘কুট্টি’ শিশু। চেকুট্টি– কাদামাটি থেকে জন্ম যে শিশুর। অন্ধকার দিন পেরিয়ে আজও সে সমান আদরিনী। একরত্তি এক পুতুল কন্যা।
২০১৮ সাল। মধ্য আগস্ট। ক’দিন পরেই ওনাম। উৎসবের প্রস্তুতি চলছে কেরালা জুড়ে। তাঁতের শাড়ি আর ধুতির জন্য বিখ্যাত চেন্দমঙ্গলম। রাজধানী কোচি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রাম।
ওনামের সময় সেখানকার তাঁতিরা নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায়। গ্রামে তৈরি হ্যান্ডলুম শাড়ি, ‘মুন্ডু’ অর্থাৎ দক্ষিণী ধুতির চাহিদা থাকে তুঙ্গে। তাই অনেক আগে থেকেই ঘরে ঘরে বাড়তে থাকে কাঁচামালের মজুত। সে বছরও ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু প্রকৃতির রোষে রাতারাতি বদলে গেল ছবিটা।
১৬ আগস্ট, ওনামের ঠিক এক সপ্তাহ আগে প্রবল বৃষ্টিতে ডুবল কেরালা। বৃষ্টিপ্রবণ দক্ষিণী রাজ্যটি গত ৯০ বছরে এমন ভারী বর্ষণ দেখেনি। বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতির সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছিল চার হাজারের বেশি মানুষ। পাঁচ লক্ষ ঘরছাড়া।
বিধ্বংসী বন্যায় ভেসে গিয়েছিল চেন্দমঙ্গলমও। জল ঢুকে কাঁচামাল তছনছ। লট-কে-লট কাপড় কাদামাটিতে মাখামাখি। কিছুই অক্ষত নেই! প্রতি ইউনিটে ক্ষতির অঙ্ক ২১ লক্ষ টাকা!
১ সপ্তাহ ধরে ত্রাণ শিবিরে রাত কাটানোর পর গ্রামের মানুষ যখন ঘরে ফিরল, তখন অবস্থা দেখে চমকে গেল তারা। তাঁত মেশিনে থকথকে কাদা। আর কখনও কাজে ফেরা যাবে বলে মনে হয় না!
চেনা চেন্দমঙ্গলমের এমন অবস্থা দেখে ১০০-র বেশি ডিজাইনার বন্ধুকে নিয়ে জোট বাঁধলেন কোচির জনপ্রিয় ফ্যাশন ডিজাইনার শালিনী জেমস। সেটাই ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর প্রথম ধাপ।
তাঁতিদের নষ্ট হয়ে যাওয়া কাপড়ের আর কোনও বাজার মূল্য ছিল না। কিন্তু কাপড় পুড়িয়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারছিলেন না লক্ষ্মী মেনন ও গোপীনাথ পারাইল। লক্ষ্মী শালিনীর বন্ধু। লক্ষ্মী এম মেনন পেশায় ডিজাইনার, সোশ্যাল অন্ত্রেপ্রেনিওর। ওয়েস্ট মেটিরিয়াল আপ সাইক্লিং করার কাজে কেরালার পরিচিত মুখ। গোপীনাথ পারাইল স্থানীয় উদ্যোগী। ট্রাভেল নিয়ে তাঁর কাজ।
চেন্দমঙ্গলমের অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। কাঁচামাল, কাপড় ভেসে গিয়েছে সে একরকম, কিন্তু যা রয়ে গিয়েছে তা সব কাদাজলে চুবচুবে। কোনওটার রঙ চেনা যায় না। বন্যার জল নামলেও যে তার দাপট কমে না, সেটা এখানকার তাঁতিরা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলেন তাঁতে হাত দিয়েই। জল ঢুকে সব অকেজো, পচে গিয়েছে। বিপুল বাতিল কাপড় নিয়ে তাঁরা এবার কী করবেন!
পাওয়ার লুমের দাপটে এমনিতেই বিপদে ছিল তাঁতিরা, তার ওপর প্রকৃতির কোপে এবার গ্রাসাচ্ছাদন বিপন্ন হওয়ার জোগাড়।
তরুণী লক্ষ্মীর দর্শন– জীবনে পথ বলে কিছু হয় না, সবটাই নির্ভর করছে দেখার ওপর। সেই কাদামাখা কাপড় আর সব হারানো তাঁতিদের আলো দেখালেন তিনি। সহজ পথে।
নতুন ভাবনা। নতুন স্বপ্ন। সেই পথেই জন্ম নিল এক কন্যে। চেন্দমঙ্গলম গ্রামের বানভাসি মানুষরা নাম দিলেন– চে কুট্টি। টানা টানা চোখ। হাসি হাসি মুখ। গায়ে মেটে কাপড়ের জামা। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘রাগ ডল’।
কীভাবে জন্ম নিল চেকুট্টি?
চেন্দমঙ্গলমের তাঁতিদের লক্ষ্মী বলেন, সমস্ত কাদা মাখা কাপড় ধুয়ে শুকনো করতে। মাটিমলিন এই সব কাপড় দেখে তাঁর বানভাসি মালয়ালি মানুষের মুখের প্রতিচ্ছবি মনে হত। দুঃখ, হতাশায় ম্লান। সে মুখে ভাগ্য বিপর্যয়ের অজস্ৰ কাটাকুটি। দাগ রেখে গিয়েছে কান্নার নোনাজল।
ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন চেন্দমঙ্গলমের মানুষ। চুলের থেকেও পাতলা বুনন এই গ্রামের ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যকে শত কষ্টেও হারিয়ে যেতে দেননি তাঁরা। কাপড়ই চেকুট্টির প্রধান উপকরণ।
ছোট্ট কাঠের গোলককে কাপড়ের টুকরোয় মুড়িয়ে সুতো দিয়ে বেঁধে তৈরি হয় চেকুট্টির শরীর। মুখে ভেসে ওঠে মালয়ালি কন্যার অনাবিল হাসি। ক্ষতিগ্রস্থ শাড়ি সংগ্রহ করে পুতুল তৈরির দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেখানকার মানুষরাই– হ্যান্ডলুম ওয়েভার্স কর্পোরেশন সোসাইটি। শুরুতে পাঁচটা বাতিল শাড়ি কিনেছিলেন লক্ষ্মী। যদি কিছু করা যায় এই ভেবে। একটা ৬ মিটারের শাড়ি থেকে ৩৬০টা পুতুল তৈরি হয়। প্রতি পিস ভারতীয় মুদ্রায় ২৫ টাকা।
লক্ষ্মীর পুতুল বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পৃথিবীর ৯ দেশের ৫০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক হাত লাগিয়েছিল চেকুট্টি গড়ার কাজে। রাতারাতি গ্লোবাল ফেনোমেনন চেকুট্টি। বিশেষ করে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী মালয়ালিদের কাছে। বন্যা বিপর্যস্ত কেরালার পাশে থাকতে সোশ্যাল মিডিয়ায় চেকুট্টি কেনার আবেদন জানানো হয়েছিল। পাশাপাশি ছিল পুতুল গড়ার নিমন্ত্রণও।
বহু মানুষ সাড়া দিয়েছিলেন। ২৬০টা স্কুলও ছিল তার মধ্যে।
মানুষের কাছে পুতুল গড়ার মানে হয়ে দাঁড়ায় নতুন কেরালা গড়ে তোলা। চেকুট্টি নতুন জীবন, নতুন আশার চিহ্ন। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে আন্দোলন। কম করে ৬৬টি দেশে জনপ্রিয় এই পুতুল। ২০২০ সালে জেনেভায় জাতি সংঘের ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন কনফারেন্স-এ অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের উপহার দেওয়া হয়েছিল চেকুট্টি। বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ের গ্লোবাল ম্যাসকট।
স্টিভ জোবসের হার্ডকোর ফ্যান লক্ষ্মীর কাছে চেকুট্টি প্রথম সন্তানের মতো। তিনি বলেন, আমার সন্তান এখন গোটা পৃথিবীর আদর পাচ্ছে। লক্ষ্মীর বাবা তাঁকে বলেছিলেন, ‘সমস্যার সমাধান যে বের করতে পারে না, সে নিজেই একদিন সমস্যা হয়ে যায়।’ বহু মানুষকে চেকুট্টি আলোয় ফেরার পথ দেখিয়েছে।
কোচির মেডিকেল ট্রাস্ট হাসপাতালে অবসাদগ্রস্থ, আত্মহত্যাপ্রবণ রোগীদের কাছে চেকুট্টি জীবনের জিয়নকাঠি। হারা যুদ্ধ জিতে আসার বাজি। মনোবিদরা তাঁদের বলেন, বন্যার ময়লা মাটি থেকে যদি এমন আদুরে পুতুলের জন্ম হতে পারে– তাহলে চেষ্টা করলেই মনের আঁধার কাটিয়ে নতুন মানুষের জন্ম সম্ভব। চেকুট্টিকে নিয়ে বই লিখেছেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিক এ সেতুমাধবন ওরফে সেতু। বই পড়ে কেঁদে ফেলেছিলেন পুতুল-জননী লক্ষ্মী।
আশাই সবচেয়ে জোরালো শব্দ, শক্তিশালী আবেগ। মানুষকে মানুষের সঙ্গে বেঁধে রাখে। বাঁচিয়েও রাখে। গোটা কেরালা ঋণী এই এক-আঙুল পুতুলের কাছে। সে মানুষকে শিখিয়েছে বিপদের দিনে একে অপরের পাশে দাঁড়াতে হয়। আলোর দিনেও সেই-ই সঙ্গী।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved