আমাদের অনেকের কাছেই মায়ের ছবি বলতে মনে পড়ে, জানলার ধারে বসে সেলাই করছেন উল বুনছেন, বই পড়ছেন, কিংবা স্রেফ বসে আছেন, কিছুই করছেন না। জানলা মানে যে এই ছোট গৃহকোণের সঙ্গে বিশ্বের সংলাপ, চোখের সামনে উড়ে যাওয়া মেঘ, পাখির সঙ্গে একাত্ম ক্ষণিক স্বাধীনতার মধুর স্বাদটুকু। ওই জানালার কাছে বসে আছে করতলে রাখি মাথা, তার কোলে ফুল পড়ে রয়েছে সে যে ভুলে গেছে মালা গাঁথা। ওই জানালার কাছে বসে আছে।
যে সুবর্ণ বাড়িতে মেয়েদের সেমিজ পরা, খবরের কাগজ আনার আমদানি করেছিল, সে নিজে একতলার বাতিল জিনিসের ঘরে বসে বই পড়ত। গলির দিকের ঘর। জানলা দিয়ে বই জোগান দিত দুলো। সে আনত মল্লিকবাবুর কাছ থেকে। বাড়ির বউ এত বই পড়ে শুনে তাকে একবার চোখের দেখা দেখতে চেয়েছিলেন মল্লিকবাবু। তাতে অশান্তি চরমে উঠেছিল…
‘একদিন আবিষ্কার করি আমার শোবার ঘরে কোন জানলা নেই। একদিন আবিষ্কার করি ওটা আমার শোবার ঘরই নয়। ১৮ বাই ৩০ ফিটের এই ঘরটি বহুবিধ উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এটা কখনো ঠাকুরঘর, কখন ননদের পড়ার ঘর, কখন প্রসাধনের ,কারণ ঠাকুরের সিংহাসন , পড়ার টেবিল চেয়ার এবং ড্রেসিং টেবিল পর পর রাখা আছে, ঘরটা খুব বড় বলে তাদের মধ্যে অবশ্য যথেষ্ট দূরত্ব, এছাড়া একটা ৩০ বছরের সংসার যত বাড়তি জিনিস জমাতে পারে, তার সবকিছুই এখানে জায়গা পেয়েছে। তার মানে এটি এমন একটি ঘর, যেটি প্রায় মানুষের জাগরণের প্রতিটি মুহূর্তে কারো না কারো দরকার হচ্ছে। কেউ পুজো করতে আসছে, কেউ পড়তে আসছে, কেউ সাজতে, কেউ ঘর মোছার পুরনো কাপড় বা শীতের লেপ বার করতে। আর এ সবের মধ্যেই এক কোণে আমার বিয়ের নতুন খাট সসঙ্কোচে পড়ে। সেখানে বসে আমি একদিন আবিস্কার করি এই ঘরে জানলা নেই একটাও…’
জানলা, টিস্যু পেপারে পানসি, লেখক
রঘুর পুত্র রাজা অজ বিয়ের পর যখন স্ত্রী ইন্দুমতীকে নিয়ে রাজপথ দিয়ে স্বয়ংবর সভা থেকে প্রাসাদের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন পুরসুন্দরীরা অন্য সব কাজ ফেলে সোনার গবাক্ষে এসে হুড়োহুড়ি করতে লাগলেন। কারো চুলের বাঁধন খুলে পড়ল। কবরীর ফুলের মালা খসে পড়ল। কেউ আলতা পরতে পরতে, কেউ বা এক চোখে কাজল দিয়ে ,কেউ মেখলার সুতো ধরে দৌড়ে এলেন। তাদের শরীরের আসব গন্ধে চঞ্চল ভ্রমরের মতো চোখে বাতায়নগুলি ভরে উঠল, মনে হল বাতায়নগুলি সহস্র পদ্মফুলে সজ্জিত হয়েছে।
রঘুবংশ মহাকাব্যের সপ্তম সর্গ
বাতায়নে মেয়েরা এসে দাঁড়িয়েছে, মনে হচ্ছে যেন বাতায়নগুলি হাজার পদ্মফুলে সেজে উঠছে– এমন কে আর লিখবেন কালিদাস ছাড়া? তাঁর শব্দের ছটায় ভুলে পাঠক যে জিনিসটা হয়তো খেয়ালই করে না, সেটা হচ্ছে এই জানলা, বাতায়ন বা গবাক্ষ, ঝরোখা বা খিড়কি– যাই বলা হোক না কেন, যুগ যুগ ধরে নারীর কৌতূহল, প্রেম, বিদ্রোহ উসকে দিয়েছে, এই গবাক্ষ পথেই তাকিয়ে থেকেছে কত প্রোষিতভর্তৃকা যক্ষের স্ত্রীর মতো।
পাদানিন্দরোমৃতশিশিরান জালমার্গপ্রবিষ্টান
পূর্বপ্রীত্যা গতমভিমুখং সন্নিবৃত্তং তথৈব
চক্ষুঃ খেদাৎ সলিলগুরুভিঃ পক্ষভিশ্ছাদয়ন্তীম
সাভ্রেহহ্নীব স্থলকমলিনীং ন প্রবুদ্ধাং ন সুপ্তাম।
পূর্ব প্রীতির জন্যে তার চক্ষু গবাক্ষ পথে প্রবিষ্ট অমৃত তুল্য শীতল ইন্দু কিরণের দিকে যাচ্ছে, কিন্তু তখনি ফিরে আসছে। খেদের জন্যে অশ্রু ভারাক্রান্ত পক্ষ্ণে তার চক্ষু আবৃত হচ্ছে, যেন মেঘাচ্ছন্ন দিনে অর্ধ বিকশিত অর্ধমুদ্রিত স্থলকমলিনী।
মেঘদূত, উত্তর মেঘ, ৯৬ নং শ্লোক
এখানে জানলার আর একটি প্রতিশব্দ পাচ্ছি কিন্তু, তা হচ্ছে জাল। জালমার্গ মানে জানলা পথ বা গবাক্ষ পথ। জানলা দিয়ে কিন্তু শুধু মেয়েরাই বিশ্ব দেখেনি, বিশ্বও মেয়েদের দেখেছে। রবীন্দ্রনাথের ‘পুকুর ধারে’ কবিতায় আছে–
দোতলার জানলা থেকে চোখে পড়ে
…আরো দূরে গাছপালার মধ্যে একটা কোঠাবাড়ির ছাদ,
উপর থেকে শাড়ি ঝুলছে।
… মুগ্ধ সরল তার কালো চোখের দৃষ্টি।
তার সাদা শাড়ির রাঙা চওড়া পাড়
দুটি পা ঘিরে ঢেকে পড়েছে;
সে আঙিনাতে আসন বিছিয়ে দেয়,
সে আঁচল দিয়ে ধুলো দেয় মুছিয়ে;
সে আম-কাঁঠালের ছায়ায় ছায়ায় জল তুলে আনে,…
আবার কবি নাগার্জুনের মৈথিলী কবিতায় আধুনিকা স্কুটারবাহিনীর জন্যে হানটান অপেক্ষা বাঁকেবিহারীর–
‘বব করা চুল– বেশ ছাঁটা কৃষ্ণকুন্তল দাম
ভ্রূ বেশ ধারালো
মর্মভেদী বাণের মতন কাজল দেওয়া আঁখিপল্লব
অনাবৃত খোলা পেট, আবর্ত-দারুণ নাভি
রঙ করা বিশটা নখের উজ্জ্বল পিঠ
সবুজ রসনা আজকালের রাধিকা
দেবী স্কুটার বাহিনী
ঘুরে আসুন সন্ধ্যাবেলা
কোন হোটেলের মধ্যে পথের দিকে চেয়ে আছেন বাঁকে বিহারীলাল’
‘একদিন অপু দুপুরবেলা কলেজ হইতে বাসায় ফিরিয়া আসিয়া গায়ের জামা খুলিতেছে, এমন সময় পাশের বাড়ির জানালাটার দিকে হঠাত্ চোখ পড়িতে সে আর চোখ ফিরাইয়া লইতে পারিল না৷ জানলাটার গায়ে খড়ি দিয়া মাঝারি অক্ষরে মেয়েলি ছাঁদে লেখা আছে- হেমলতা আপনাকে বিবাহ করিবে৷’
অপরাজিত: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
জানলার পাল্লায় যে চিঠিও পাঠাতে পারে মেয়েরা, এই উদ্ভাবন আমাদের কি আশ্চর্য করে না?
যখন গুহা থেকে দেওয়াল আর ছাদ গেঁথে বাড়ি বানাতে শুরু করল মানুষ, তখন তাতে জানলা রাখার কথাটা প্রথম কে ভেবেছিল? মানুষ না মানুষী? তার ইতিহাস কি কেউ লিখে রেখেছে? হয়তো মেয়েরাই বলেছিল একটা জানলা দরকার। কারণ সারাদিনের কাজের পর যেটুকু অবসর, সেইটুকু মেয়েরাই জানলার ধারেই কাটায় বেশি।
আমাদের অনেকের কাছেই মায়ের ছবি বলতে মনে পড়ে, জানলার ধারে বসে সেলাই করছেন উল বুনছেন, বই পড়ছেন, কিংবা স্রেফ বসে আছেন, কিছুই করছেন না। জানলা মানে যে এই ছোট গৃহকোণের সঙ্গে বিশ্বের সংলাপ, চোখের সামনে উড়ে যাওয়া মেঘ, পাখির সঙ্গে একাত্ম ক্ষণিক স্বাধীনতার মধুর স্বাদটুকু।
ওই জানালার কাছে বসে আছে করতলে রাখি মাথা, তার কোলে ফুল পড়ে রয়েছে সে যে ভুলে গেছে মালা গাঁথা। ওই জানালার কাছে বসে আছে।
শুধু ঝুরু ঝুরু বায়ু বহে যায় তার কানে কানে কী যে কহে যায়, শুধু ঝুরু ঝুরু বায়ু বহে যায় তার কানে কানে কী যে কহে যায়… শুধু বাড়ির নয়, বাসের জানলা দিয়ে শহরকে দেখতেও অন্যরকম লাগে।
‘দোতলা বাসের জানলা থেকে কলকাতাকে দেখতে বেশ অদ্ভুত লাগছিল। ঠাসাঠাসি বাড়ি, ছায়াছায়া রাস্তা, রাস্তার ভিড়, গাড়ির শব্দ–অথচ নিজেকে এসবের অনেক উঁচুতে এমন ভাবতে পারার মজা হচ্ছিল।‘
সাতকাহন, সমরেশ মজুমদার
জানলা মেয়েদের জীবনে এত কিছু বলেই বোধ হয়, মেয়েরাই কুকুরের নাম রাখতে পারে জানলা। বাংলা সাহিত্যে গবাক্ষবাবু বলে চরিত্র আছে (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) কিন্তু কুকুরের নাম জানলা? এমন ভাবনা আর কে ভাববেন গ্রেট তারাপদ রায় ছাড়া?
ম্যানেজার বারান্দায় বেরিয়ে এলেন, কুকুরটার নাম হল জানলা।
জানলা? আমি বিস্মিত বোধ করলাম।
হ্যাঁ, ম্যানেজার জানালেন, মনে করুন এমন একজন কেউ মহারাজকুমারীর কাছে এসেছে, যাঁকে মহারাজকুমারী সহ্য করতে পারেন না আবার বলতেও পারেন না চলে যান। সেক্ষেত্রে তিনি কী করবেন? নিজের প্রশ্নেরই উত্তর দিলেন ম্যানেজারবাবু, মহারাজকুমারী কাউকে চেঁচিয়ে বলবেন– এই, জানলা খুলে দে– অতিথি কিছু বুঝতে পারবেন না কিন্তু এদিকে কুকুরটা শেকল থেকে ছাড়া পেয়ে মহারাজকুমারীর কাছে ছুটে আসবে। আর ওই রকম একটা বিশ্রী নেড়ি কুকুরকে সহ্য করবে এমন অতিথি রাজবাড়িতে আসে না।
নিরুদ্দেশ জানলা, তারাপদ রায়
জানলা কখন আবার হয়ে ওঠে প্রযুক্তিচালিত এক প্রতিরক্ষা , যার ব্যবহারে দক্ষ সেকালের মেয়েরাও। দুর্গেশনন্দিনীর বিমলা এইভাবে জানলা দিয়ে ঢুকে বর্শা নিয়ে আসে রাজপুত্রের জন্য।
এই বলিয়া বিমলা ঝটিতি দুর্গমূলে গেলেন। যে কক্ষে বসিয়া সেই রাত্রি-প্রদোষে, কেশবিন্যাস করিয়াছিলেন, তার নীচের কক্ষের একটি গবাক্ষ আম্রকাননের দিকে ছিল। বিমলা অঞ্চল হইতে একটি চাবি বাহির করিয়া ঐ কলে ফিরাইলেন; পশ্চাৎ জানালার গরাদে ধরিয়া দেয়ালের দিকে টান দিলেন; শিল্প-কৌশলের গুণে জানালার কবাট, চৌকাঠ, গরাদে সকল সমেত দেয়ালের মধ্যে এক রন্ধ্রে প্রবেশ করিল; বিমলার কক্ষমধ্যে প্রবেশজন্য পথ মুক্ত হইল। বিমলা কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়া দেয়ালের মধ্য হইতে জানালার চৌকাঠ ধরিয়া টানিলেন; জানালা বাহির হইয়া পুনর্ব্বার পূর্ব্বস্থানে স্থিত হইল; কবাটের ভিতরদিকে পূর্ব্ববৎ গা-চাবির কল ছিল, বিমলা অঞ্চলে চাবি লইয়া ঐ কলে লাগাইলেন। জানালা নিজস্থানে দৃঢ়রূপে সংস্থাপিত হইল, বাহির হইতে উদ্ঘাটিত হইবার সম্ভাবনা রহিল না।
দুর্গেশনন্দিনী, বংকিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
হাওয়াকলের চাকাগুলো জানলা দিয়ে মেয়েদের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে বলে হাওয়াকলের মালিক ওয়াটসন সাহেবের নামেই মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন গোকুল ঘোষাল। সে তো খুব বেশিদিনের কথা নয়। জানলা যে কত বিপজ্জনক, তা যুগে যুগে পিতৃতন্ত্র বুঝেছে বইকি। জানলা মানেই যে রোমিও জুলিয়েট, র্যাপুঞ্জেলের চুল বেয়ে উঠে আসা উচক্কা যুবক, জানলা মানেই জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকা ছোট্ট মেয়েটা– তোত্তো চান, জানলা মানেই চারুলতা পাখি খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে রাস্তা দেখছে, তার হাতে দূরবীন, জানলা মানেই সাইকেল থেকে ছুঁড়ে দেওয়া হাত চিঠি, কিংবা বিদ্রোহের ঊনপঞ্চাশ হাওয়া। তাই তো সমাজ নামক অচলায়তনের উত্তরের জানলা খোলা বারণ বরাবর, মেয়েদের জন্যে তো আরও বেশি।
সুভদ্র। হাঁ, উত্তর দিকের জানলা খুলে—
পঞ্চক। জানলা খুলে কী করলি?
সুভদ্র। বাইরেটা দেখে ফেলেছি!
পঞ্চক। দেখে ফেলেছিস? শুনে লোভ হচ্ছে যে!
সুভদ্র। হাঁ পঞ্চকদাদা। কিন্তু বেশিক্ষণ না—একবার দেখেই তখনই বন্ধ করে ফেলেছি। কোন্ প্রায়শ্চিত্ত করলে আমার পাপ যাবে?
অচলায়তন
জানলা খুললে যে মেয়েদের আব্রু থাকে না তা বুঝিয়ে দিয়েছেন ইসমত চুঘতাই তাঁর ‘বিচ্ছুপিসি’ গল্পে-
‘… এই জানলাটা হল আমাদের উঠোনের উল্টোদিকে। ওটা সাধারণত বন্ধই থাকত, তা নাহলে ও বাড়ির পর্দানশীন মেয়েদের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল।’
তাই তো মুঘল আমলে হিন্দু রাজাদের আদর্শে আকবর যে ঝরোখা দর্শনের চল করেছিলেন, তা নিষিদ্ধ করেছিলেন আওরংজেব, যদিও শেষ দিকে তিনি তা আবার শুরু করেন, তবে মনে রাখতে হবে এই ঝরোখা দর্শনে মেয়েদের কোন জায়গা ছিল না। মুঘল নারীরা অনেকেই খুব শক্তিময়ী ছিলেন, তবে তাঁদের রাজনীতির খেলা চিক বা চিলমনের আড়াল থেকেই খেলতে হত।
হালে, আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালিবানের সুপ্রিম নেতা ঘরে এমন জায়গায় জানালা তৈরি নিষিদ্ধ করেছেন যা দিয়ে ভিতরে কাজ করা মহিলাদের দেখা যায়। তাদের আশঙ্কা, এতে ‘অশ্লীল কাজ’ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পৌর কর্মকর্তাদের এই আদেশ পালন নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যদি কোনো বাড়িতে আগে থেকেই এমন জানালা থাকে তবে তা বন্ধ করতে হবে। তবে মেয়েদের জীবনে দেওয়ালে কাটা চতুষ্কোণ শুধু নয়, কোন একজন মানুষও হয়ে উঠতে পারে জানলা।
পাঞ্জাবি লেখিকা অজিত কৌরের গল্পে পাই গুলনানুর কথা ‘ঘরের চার দেওয়ালে গুলবানুর অভ্যেস হয়ে গেছিল, ওরা যেন তার গায়ের চামড়া।‘ তার স্বামী খুশাদিল গার্ড তাকে মেয়েদের সঙ্গেও মিশতে দিত না। তারা যখন তার আঙ্গিনায় ঢোল বাজিয়ে গান গেয়ে আনন্দ করত, তখনো গুলবানুকে বন্দি থাকতে হত। সেই গুলবানুকে দেখে ফেলল দুধওলা চন্দন, আর অমনি গুলবানুর জীবনে একটা বন্ধ জানলা খুলে গেল যেন। একদিকে চন্দন, যার বুকের দরজা গুলবানুর এক ঝলকে খুলে গেছে, আর ভেতরে ঢুকে পড়েছে গোটা পৃথিবী…যখন চন্দন তার দুধের কলসি থেকে গুলবানুর ঘটিতে দুধ ঢালছিল, তখন দরজার আড়াল থেকে একপলক তাকে দেখল গুলবানু। তার মনে হল চন্দনের গাগরি থেকে ঝরা দুধের একটি ধারা যেন তার শরীরে মিশে গেল। সেদিন থেকে চলতে ফিরতে গুলবানুর পা দুটি নেচে নেচে ওঠে। ওর জীবন যেন গান হয়ে উঠেছে। গানের কলি আপনাআপনি তার ঠোঁটে গুনগুন করে। আনন্দে চোখ বুজে ও কতক্ষণ ধরে নিজের বুকের তলায় কুলুকুলু বয়ে চলা নদীর জলে ডুবে থাকে।
গুলবানু
এই মুক্তির স্বাদ যদিও গুলবানুর জন্যে ভাল হয়নি, খুশাদিল খুন করেছিল তার বউকে, মৃত গুলবানুর মুখ সে ঢেকে দিয়েছিল, যাতে কেউ দেখতে না পায়, কিন্তু স্বাধীনতা এমন এক জিনিস, তার ছোট একটা বীজ হাজার বছরের ভিত নড়িয়ে দিতে পারে, সুবর্ণলতাদের জন্যে তাই জানলা নয়, দেওয়ালের একটা খোপই ছিল যথেষ্ট। সেই খোপ দিয়ে পড়শি মেয়েদের সঙ্গে আদান প্রদান হত বই, খুলে যেত পৃথিবীর জানলা। এই সুবর্ণলতার যখন নিজেদের বাড়ি হল, তার স্বামী তার একমাত্র আবদার– একটা বারান্দা, সেটাও রাখতে দেয়নি।
আর এখন তো মেয়েদের জন্যে সমাজ মাধ্যমের জানলাই হাট করে খুলে গেছে। সাইবার পথে ঢুকে আসছে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড! ধুলো বালি, পোকা কিছু আসছে অবিশ্যি ওই পথেই, তবে এই জানলায় বসে মেয়েরা এত যুগ পর সরাসরি যুক্ত হতে পারছে তাদের বিশ্বজোড়া ভগিনীদের সঙ্গে, সেই প্রাপ্তির কোন তুলনা নেই।