
কোত্থাও শিশুরা ১০০ শতাংশ নিরাপদ নয়। এবং এখানে ‘শিশু’ মানে কোনও অর্থেই শুধুমাত্র ‘মেয়ে শিশু’-দের কথা বলা হচ্ছে না। জানি, এই পর্যন্ত পড়েই অনেকে মনে করছেন এসব নিছক ‘বাড়াবাড়ি’, আমাদের সমাজটা মোটেই শিশু-ধর্ষণকারী পিডোফিলিক লোকজনে বোঝাই নয়। তাদের জন্য দুটো মারাত্মক তথ্য– এক. খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতের ৫৩ শতাংশ শিশু (মানে, অর্ধেকেরও বেশি) কোনও-না-কোনওভাবে যৌন-নিপীড়নের শিকার এবং দুই. এই শিশুদের মধ্যে ছেলে এবং মেয়ের অনুপাত এক্কেবারে সমান-সমান।
প্রচ্ছদ দীপঙ্কর ভৌমিক
ইস্যুটা একেবারেই ‘রাজনীতির’ নয়। কিন্তু মুশকিল হল, আত্মহত্যাকারী স্বয়ং তার সুইসাইড নোটে একটি রাজনৈতিক সংগঠনকেই তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করে গিয়েছে। বিরোধীপক্ষের এই সুযোগ ছাড়ার কথা নয়। কাজেই বিষয়টা নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে, হবেই।
তাকে খুব ছোটবেলায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন শারীরিক নির্যাতন এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। পরবর্তীকালে সে আরএসএস ছেড়ে দেয়, কিন্তু শৈশবের সেই ‘ট্রমা’ তাকে ছাড়েনি। এবং এক সময় তা কঠিন এক মানসিক রোগে দাঁড়িয়ে যায়। সেই অসুস্থতার চাপ নিতে না পেরেই এক সময় আত্মহত্যা করে সে। গত ৯ অক্টোবর, তিরুঅনন্তপুরমের একটি লজে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। সংবাদপত্র এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে কেরালার এই যুবকটির কথা এখন মোটামুটি সকলেরই জানা।

…………………………..
পড়ুন সেবন্তী ঘোষের লেখা: শারীরিক প্রহারই একমাত্র শাস্তি, এটা মাথায় গেঁথে বসলেই মানুষ খেপে ওঠে
…………………………..
রাজনীতির কথা থাক। আমরা যারা শিশুদের ওপর সংঘটিত যৌন নিপীড়ন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চর্চা এবং কাজকর্ম করছি, তারা জানি, শুধু আরএসএস নয়, আমাদের সমাজের কোনও রাজনৈতিক সংগঠনে, সামাজিক গোষ্ঠীতে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে, নাট্যদলে, স্কুলে, প্রাইভেট কোচিংয়ে, ছবির আঁকার-গানের-নাচের ক্লাসে, এমনকী, নিজের পরিবারে কোথাও– কোত্থাও শিশুরা ১০০ শতাংশ নিরাপদ নয়। এবং এখানে ‘শিশু’ মানে কোনও অর্থেই শুধুমাত্র ‘মেয়ে শিশু’-দের কথা বলা হচ্ছে না। জানি, এই পর্যন্ত পড়েই অনেকে মনে করছেন এসব নিছক ‘বাড়াবাড়ি’, আমাদের সমাজটা মোটেই শিশু-ধর্ষণকারী পিডোফিলিক লোকজনে বোঝাই নয়। তাদের জন্য দুটো মারাত্মক তথ্য– এক. খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতের ৫৩ শতাংশ শিশু (মানে, অর্ধেকেরও বেশি) কোনও-না-কোনওভাবে যৌন-নিপীড়নের শিকার এবং দুই. এই শিশুদের মধ্যে ছেলে এবং মেয়ের অনুপাত এক্কেবারে সমান-সমান।
…………………………..
পড়ুন অভীক মজুমদারের লেখা: তোমার হিংসা আমার জয়
…………………………..
এবং ওই যে দ্বিতীয় তথ্যটি– ছেলেরাও মেয়েদের সমান অনুপাতে যৌন লাঞ্ছনার শিকার হয়– এটিকে আমরা যে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না। এই অবিশ্বাসের মূলে আছে যৌনলাঞ্ছনা সম্পর্কে আমাদের ধ্যান-ধারণার সীমাবদ্ধতা এবং কিছু ক্লিশে হয়ে যাওয়া ভাবনা-চিন্তা। আমরা যেকোনও যৌন নির্যাতনকেই ‘ধর্ষণ’ বলে ভেবে নিতে অভ্যস্ত। আসলে কিন্তু যৌনলাঞ্ছনা অনেক রকম হতে পারে– অশ্লীল কথা বলা, ছবি বা ভিডিও দেখানো, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দেওয়া, যৌনাঙ্গে হাত বা মুখ দিতে বাধ্য করা, এমনকী, কখনও কখনও শাস্তি দেওয়ার অজুহাতে শরীরের বিশেষ বিশেষ অংশে বারবার আঘাত করাও যৌন-বিকৃতির প্রকাশ হতে পারে। একটি শিশু অনেক সময় বুঝতেই পারে না যে, সে কারওর যৌন-লালসার শিকার হচ্ছে। এই বোধ বা উপলব্ধি তার যতদিনে হয়, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়। কেরালার যুবকটি আত্মহত্যা করল ২৩ বছর বয়সে এসে। মৃত্যুর আগে শেষ রেকর্ড করা ভিডিও-তে বলেছে, ‘ছোটবেলায় আমার ওপর যে আসলে যৌন নির্যাতন হয়েছিল, সেটা আমি বুঝতে পেরেছি গত বছর। এটাই হল সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার। একজন রেপিস্ট দিব্য আনন্দে বেঁচে থাকে আর আমরা আমৃত্যু যন্ত্রণা পেতে থাকি।’ আমাদের সমাজে শিশুদের ওপর এই রকম যৌন-উৎপীড়নের ঘটনা খুব কমই প্রকাশ্যে আসে। বেশিরভাগটাই থেকে যায় শিশুদের মনে, এক বীভৎস ট্রমা বা মানসিক যন্ত্রণার স্মৃতি হয়ে, যেমন থেকে গিয়েছিল কেরালার ওই যুবকটির অবচেতনে। কেউ কেউ হয়তো কোনওভাবে পরবর্তী জীবনে সেই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেন। তখন তাঁদের অনেকেই এই বিষয়ে খোলখুলি কথা বলতে পারেন। যেমন পেরেছেন জনপ্রিয় ভারতীয় লেখক চেতন ভগত। তাঁর সাম্প্রতিক বই ‘ইলেভেন রুলস ফর লাইফ’-এ তিনি শৈশবে প্রতিবেশী এক যুবকের হাতে এই রকম নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতির কথা লিখেছেন। কিছুদিন আগে ‘হ্যাশট্যাগ মি-টু’ আন্দোলনের সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই শৈশবে তাঁদের ওপর হওয়া যৌনলাঞ্ছনা নিয়ে খোলাখুলি সোচ্চার হয়েছিলেন।

…………………………..
পড়ুন যশোধরা রায়চৌধুরীর লেখা: হিংসার অভিমুখ শেষমেশ নারী নির্যাতনের দিকে
…………………………..
পরবর্তী প্রশ্ন হল, এত যে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন হয়, এগুলি করে কারা? এবারে আসতে হবে এই ব্যাপারে আমাদের অজ্ঞতার দ্বিতীয় স্তরে। যখন এরকম কোনও ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আসে, তখন অবধারিতভাবেই দেখা যায় অভিযুক্ত আমাদের খুবই পরিচিত নিকটাত্মীয় কেউ অথবা তুলনামূলক বিখ্যাত বা চর্চিত কোনও নাম। এই সময় আমাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কতকটা এই রকম হয় যে, ‘যা! এই লোকটাকে তো কবে থেকে চিনি। ইনি এমন হতেই পারেন না!’ এই প্রতিক্রিয়া থেকেই আসে ভিক্টিমের প্রতি অবিশ্বাস। কখনও আমরা শিশুটিকে অত্যধিক কল্পনাপ্রবণ বলে দাগিয়ে দিই, কখনও বা মনে করি– এসব শিশুটির মা-বাবার চক্রান্ত বা কোনও প্রতিহিংসামূলক আচরণ। মনে পড়ে, আমাদের পাড়ার নাচের স্কুলের শিক্ষকটি এরকম একটি ঘটনায় জেলে গিয়েছিলেন। মাস তিনেক পর তিনি জামিনে ছাড়া পেলে তাঁকে সসম্মান শিক্ষকতার কাজে পুনর্বহাল করে স্কুল-কর্তৃপক্ষ। তাঁদের এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে পরিষ্কার উত্তর আসে, ‘উনি আমাদের স্কুলে পাঁচ বছর ধরে নাচ শেখাচ্ছেন, ওঁকে আমরা খুব ভাল করে চিনি। ওঁর পক্ষে এমন কিছু করা সম্ভব বলে আমরা বিশ্বাস করি না।’
আসল মজাটা এখানেই। সস্তা বলিউডি হিন্দি ফিলিম দেখতে দেখতে এই ধারণা আমাদের একেবারে মজ্জায় মজ্জায় গেঁথে গিয়েছে যে, ধর্ষক মাত্রই খুব কুৎসিত দর্শন, ভিলেন টাইপের লোক, যারা পান-খাওয়া নোংরা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে মেয়েদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। (যেমন রূপকথার গল্পের রাক্ষস মানেই তাদের মুলোর মতো দাঁত আর কুলোর মতো কান)। আজ্ঞে না, শিশুদের ওপর যারা যৌন-লাঞ্ছনা চালায়, তারা আমরাদেরই মতো ছাপোষা লোকজন, আমাদেরই বাবা-দাদা-কাকা-বন্ধুবান্ধব, আমাদেরই শিক্ষক, প্রতিবেশী, পুলকারের ড্রাইভার, ডাক্তার, পুলিশ…। এককথায়, এরা প্রত্যেকে আমাদেরই মতো সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ। এতটাই গোপনে এবং নিঃশব্দে এরা কাজ সারে যে, তাদের একজন পাশাপাশি থাকা মানুষজনও তা টের পায় না! শিশুদের এরা কখনও ভয় দেখিয়ে, কখনও চকোলেট ইত্যাদির লোভ দেখিয়ে, কখনও বা অন্য কোনও উপায়ে চুপ করিয়ে রাখে। একটু বড় শিশু হলে, যাদের বয়স দশের বেশি এবং প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই যৌনতা সম্পর্কে যাদের মনে কৌতূহল তৈর হয়েছে, পিডোফিলিকরা অনেক সময়ই যৌনতার প্রাথমিক পাঠ দেওয়ার নাম করে তাদের থেকে কৌশলে সম্মতি আদায় করা হয়।

তার থেকেও বড় কথা কী জানেন, শিশুরাও বাবা-মায়ের কাছে এসব ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়ে জানিয়ে খুব কম ক্ষেত্রেই সুরাহা পায়। কারণ, নীরেন চক্কোত্তির ভাষায় বলতে হয়, ‘কারো মনে সংস্কার, কারো ভয়/ কেউ বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক রেখেছে/ কেউ পরান্নভোজী, কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক।’ প্রতিকার তো অনেক পরের ব্যাপার, আমার ঘরের শিশুটির সঙ্গে আমারই পরিচিত কেউ এমন কিছু করছে, এটা বিশ্বাস করার জন্যও এক রকমের মানসিক জোর লাগে, অধিকাংশ অভিভাবকেরই সেই জোরটা থাকে না। মধ্যবিত্তের দুনিয়াটা সব সময়ই খুব পূত-পবিত্র গোছের হয়ে থাকে, অন্তত বহিরঙ্গে। সেখানে এই সব যৌন-বিকৃতির একেবারেই কোনও স্থান নেই।
……………………………………….
পড়ুন রণিতা চট্টোপাধ্যায়ের লেখা: ছোটদের মুখে হিংসার বুলি ছড়িয়ে যাচ্ছে হাজারে হাজারে
……………………………………….
এমনিতে কিন্তু শিশুদের ওপর যৌন-নির্যাতন প্রতিরোধে তৈরি ‘পকসো’ আইনটি বেশ শক্তপোক্ত! এই আইনে একবার অভিযুক্ত হলে এর ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন। ধর্ষণের শিকার কোনও মেয়ে যেমন আদালতে নানা আইনি-জেরায় ক্ষতবিক্ষত হয়, সেরকম ‘সেকেন্ডারি ভিক্টিমাইজেশন’-এর অবকাশও এই আইনে প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু, ক’টা অভিযোগই বা অতদূর পৌঁছতে পারে?

কেরালার যুবকটি আত্মহত্যা করে বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশের ক্ষেত্রেই এ জ্বালার উপশম গোটা জীবনেও হয় না। আমরা মানি বা না মানি, আমাদের মস্তিষ্কটাও তো শরীরেরই একটা অংশ। তাই অনেক সময়ই কোনও মানসিক সমস্যার সঠিক সময়ে যথাযথ চিকিৎসা না-হলে পরে তা গুরুতর শারীরিক রোগে পরিণত হয়। বেশিরভাগ বয়স্ক মানুষের অ্যাকিউট ওসিডি (অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার), নানা রকম জটিল নার্ভের রোগ, হৃদরোগ ইত্যাদির কারণই হল শৈশবের এমন কোনও ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি, যা মনের অবচেতনে জমে থেকে তাকে কুরে কুরে খায়।
তাই মাঝে মাঝে মনে হয়, অনেক হয়েছে। এবার অন্তত যৌনতা নিয়ে আমাদের অকারণ ট্যাবুগুলোকে ছাড়তেই হবে। গোটা সমাজের শরীরে ঘায়ের মতো ছড়িয়ে পড়া, ক্যানসারের মতো বিষিয়ে যাওয়া এই বিকৃত যৌনতাকে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ, সনাতন ঐতিহ্যের সুগন্ধী দিয়ে আর ঢাকা যাচ্ছে না। আর কিছু পারি বা না-পারি, নিজের ঘরের শিশুটিকে আরেকটু নিবিড়ভাবে আগলে রাখার কাজটুকু তো নিষ্ঠাভরে করাই যায়, তাই না? তাকে একটু চোখে চোখে রাখা, তার যে কোনও রকম অস্বাভাবিক রকমের আচরণকে সিরিয়াসলি নেওয়া, কোনও নিকটাত্মীয় সম্পর্কে সে এমন কোনও অভিযোগ করলে সামাজিক সম্মানের ওপরে শিশুটির বিপন্নতাকে স্থান দেওয়া– এগুলোই কিন্তু অভিভাবক হিসেবে আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য। শুধু ‘গুড টাচ আর ব্যাড টাচ’-এর ক্লিশে হয়ে যাওয়া বুলি আউড়ে কিন্তু এ সমস্যার সমাধান হওয়ার নয়।
আর তারও আগে দরকার নিজেদের অন্তরে অপরাধীকে ‘অবিশ্বাস’ করার শক্তি অর্জন করা। প্রয়োজনে যেকোনও পরিচিত বা প্রভাবশালী এমনকী, নিকটাত্মীয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আপন শিশুটিকে রক্ষা করার দৃঢ়তা অর্জন করতে না পারলে এই সামাজিক ক্যানসার নির্মূল হবে না। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ানরা প্রায়ই একটা স্লোগান ব্যবহার করে, ‘রেসপেক্ট অল, সাসপেক্ট অল’। আমাদের মনে হয়, আমাদের শিশুদের যৌন-সুরক্ষার ব্যাপারেও এই সাবধানবাণীটা মেনে চলা খুবই কার্যকর উপায় হতে পারে।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved