ফেলুদা, ব্যোমকেশ কিংবা মিতিন মাসি– প্রত্যেককে অন্তত ১০ গোল দেবেন পরীক্ষার হলের গার্ডরা। লালবাজার গোয়েন্দা দফতরে গেলে মাসিক পদোন্নতিরও ব্যবস্থা থাকত নির্ঘাত। হায় বাংলা সিনেমা, কেনই বা পাশে দাঁড়াব, যদি গোয়েন্দা গার্ড নিয়ে আপনারা একটা বড় দেখে সিনেমা না নামান! যাই হোক মাধ্যমিক চলছে, পরীক্ষা চলছে, মাইক্রোজেরক্সও চলছে। এবং সবথেকে জরুরি কথা, গার্ডেরা কিন্তু সব দেখছেন!
প্রচ্ছদ ভাবনা: অর্ঘ্য চৌধুরী। মডেল: শুভদীপ রায়
পরীক্ষার দিনগুলোতে বুঝতে পারতাম যেভাবেই আমরা সকাল দেখি না কেন, সূর্য আসলে নানা ধরনের এবং তাদের মধ্যে শতকরা নিরানব্বুই ভাগের দিকেই রোদচশমা, কখনওসখনও এক্স-রে প্লেট– এসব ছাড়া তাকানো বারণ। বাকি একভাগের জন্য ছাত্রদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। না, ভুল বললাম। বাকি একভাগের জন্য আমাদের মতো ছাত্রদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। সেই সমস্ত ছাত্র– যাদের পাশ করা না করা অনেকটাই নির্ভর করত সেদিন কে গার্ড, পড়েছে তার ওপর।
আমি ইলেভেন থেকে টুয়েলভে উঠতেই পেরেছি ফিজিক্স পরীক্ষার দিন আশীষদা গার্ড দিতে এসেছিলেন বলে। কচির (ভালো নামটা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না) খাতার দু’-খানা পাতা আমার কাছে, আমি প্রাণপণ টুকছি। যদিও আমার মতো ছাত্রদের তো শুধু টোকার জন্য নিজের খাতাটা দিয়ে দিলেই হয় না, সঙ্গে গাইডও করে যেতে হয়। আমি হয়তো দেখে দেখেও লিখেছি , “রাশি দু’-প্রকার স্কেলার আর ভিক্টর”। কচি তাই দেখে বলছে, ‘তোকে লাঠিই মারা উচিত!’ আর এই সব কিছুর মধ্যে কখন যেন আশীষদা এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের সামনে। হাসিহাসি মুখ, ‘কী করছ?’, ‘দাদা ও পাশ করতে পারবে না!’– বলে উঠল কচি। আর আশীষদা সেই হাসি মুখেই সেখান থেকে সরে গেলেন। কিন্তু কেমিস্ট্রি পরীক্ষার দিন সেই ডেয়ারডেভিল বালকই আমায় বলেছিল, ‘একটায় ফেল করলে তুলে দেয়, চাপ নিস না’, কারণ সেদিন সোমনাথদা গার্ড দিতে এসেছিলেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
স্মরণজিতের গল্পে নায়িকাদের যেমন বর্ণনা থাকে, ঠিক তেমন অবাস্তব ঘরানার সুন্দরী। উনি হলে ঢুকতেই হল শান্ত হয়ে গেল। কেমন যেন নিঝুম। ঘোর লাগা। মায়া মায়া। আর সেই ঘোরের মধ্যেই ভেসে এল বিশুর গমগমে গলা, ‘ডাকাপ!’ ম্যাম বোধহয় ইংরেজি পড়াতেন, কারণ ও অ্যাকসেন্টে ‘হোয়াট ডিড ইউ জাস্ট সে?’ অন্তত আমাদের জেলায় আমি কাউকে বলতে শুনিনি। বিশুর সামনে গিয়ে ওভাবে এ-প্রশ্ন করায় বিশু বিহ্বল হয়ে বলে ফেলল, ‘ডানা কাটা পরি!’, আবারও একবার সকাল হয়ে গেল যেন ম্যামের মুক্তোখচিত হাসিতে। কিন্তু তার ঠিক দশ মিনিট পর থেকেই আমরা বুঝতে পারলাম– এ সুন্দর ভয়ংকর সুন্দর!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সোমনাথদা অসামান্য বাগ্মী। আমরা ওঁর ফ্যান। কী হাসিখুশি, উইটি মানুষ রে বাবা! কিন্তু সাধারণ দিনে তারে জমিন পরের আমির খান সোমনাথদা পরীক্ষার দিনে কেমন যেন প্রফেসর স্নেপ হয়ে উঠতেন। না, উনি চিৎকার-চেঁচামেচি করতেন না। বকতেন না। খালি তাকিয়ে থাকতেন। কোন সাধনায় উনি এই কোয়ান্টাম তাকানো রপ্ত করেছিলেন, সেটা আমরা জানতাম না। কিন্তু গোটা হলে যে ছাত্র যখনই সোমনাথদার দিকে তাকাত, তখনই তার মনে হত সোমনাথদা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। শুধু তাকিয়েই নেই, যেন বুঝতেও পারছে ও অপরাধী। ভেতরটা শুকিয়ে যেত। অপরেশদার মুখটা মনে পড়ত। সাধারণ মানুষ বলে থাকে– অমুকে খুব ভালোমানুষ, আর ভালোমানুষ বলে– অমুকে খুব অপরেশদা। ইলেভেনের টেস্টেই বোধহয়, প্রাণপণ টুকছি সৌমিলের খাতা দেখে, আর অপরেশদা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছেন, ‘পরেরবার যেন এটা না করতে হয় হ্যাঁ বাবা!’ ‘বাবা!’– এটা শুনে আর কারওর টুকত ইচ্ছে করে! তাও টুকেছিলাম কারণ আমি এবং আমরা পাষণ্ড– আর পঙ্কজদা, অরিন্দমদা, অমিতদার মতো শিক্ষকরা সেটা বুঝতেন। অরিন্দমদা প্রবীর স্যর, আমরা অপরাধী এসব হলে মিটে যেত। ফাইট দেওয়া যেত। কিন্তু মুশকিলটা হল এখানে অপরাধীরা অফিসারকে উন্মাদের মতো ভালোবাসে। তাছাড়া এখনও অমিতদার সামনে দাঁড়ালে মনে হয় নিশ্চয়ই কোনও ভুল করেছি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: টুকলিপত্রে হাতের লেখা যতটা ভালো, উত্তরপত্রে হাতের লেখা ততটাই খারাপ
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
তবে পঙ্কজদা! আবীর চট্টোপাধ্যায় একমাত্র যে গোয়েন্দার ভূমিকায় এখনও অভিনয় করেননি। ছাত্রের পায়ের শব্দ শুনে বলে দিতে পারতেন কোন দোকান থেকে মাইক্রোজেরক্স করে আনিয়েছে। অবশ্য এই ট্যালেন্ট আমাদের ছাত্রজীবনে অনেক শিক্ষকের মধ্যেই দেখেছি। হলে ঢুকেই, ছাত্রদের নাম ধরে ডেকে বলতে শুনেছি, ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওগুলো টেবিলের ওপর রেখে যা, না হলে খাতা ক্যানসেল করে দেব’, তবুও এগুলোর সঙ্গে একটা দ্বৈরথে যাওয়া যায়, তবুও লড়ে নেওয়া যায়, কিন্তু কয়েকজন ছিলেন যাঁরা গিল্ট দিতেন। নাইন থেকে টেনে ওঠার পরীক্ষায় কে.বি ম্যাডাম আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটা আশা করিনি সৌমিত!’ টেনের টেস্ট পরীক্ষায় সোমনাথ (ফার্স্ট বয়) খাতাটা আলতো বাড়িয়ে দিয়েছে যাতে টুকতে পারি। তখনই গার্ড সেঁজুতি ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ছিঃ!’ বলে চলে গেলেন। এভাবে নিজের মায়ের কাছেও ধিক্কৃত হইনি কখনও! এম.পি ম্যাডাম, ডি.পি স্যর, পি.সি স্যর– এঁরাও ছিলেন নিজের নিজের জঁরে একেকজন কিংবদন্তি গার্ড! একবার পরীক্ষার হলে ঢুকে দেখলাম, গোবিন্দ টুকলির পাতা দিয়ে প্লেন বানাচ্ছে। ও ঘটনায় আমি অবাক হওয়ায় বলল, ‘কে.কে.ডি আসছে ভাই।’
টেরর! এই যে তিনঘণ্টা আমি সার্ভেলেন্সে। আমার প্রতি শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকেও যেন নজর রাখছে যেন কেউ। এই রে, সব জেনে ফেলল! সব বুঝে ফেলল! ‘গানের ওপারে’ সিরিয়ালের দীপঙ্কর দে বলতেন, ‘পুপে, জীবন নেবে পরীক্ষা…’ কিন্তু এটা বলেননি যে, পরীক্ষা মানেই গার্ডও থাকবে। চৌকিদারও থাকবে। মনে মনে ‘আহা, চড়কের মেলায় হরির লুটের বাতাসাগুলো খেতে কী দারুণ হত’ ভাবলেই সঙ্গে সঙ্গে ইন্সটাগ্রামে– ‘ওর্গ্যানিক দেশি ক্যান্ডিস’: মোড়কে বাতাসা কেনার বিজ্ঞাপন চলে আসবে। আর আমরা এই সমস্ত কিছুতে গ্যালগ্যালে অভ্যস্ত হয়ে যাব। যেমন কলেজে উঠে পাখা গজানোর পর গিয়েছিলাম। না আমরা পরীক্ষাকে পাত্তা দিতাম, আর না গার্ড আমাদের পাত্তা দিত। পারস্পরিক অসম্মান মাখামাখি সেসব খুবই চমৎকার এক সময়! তাই আরেকটা চমৎকার ঘটনার কথা বলি।
আসলে নিজেদের কলেজে মোটামুটি একটা চেনা ছক থাকলেও অন্য জায়গার সিট পড়লে আমাদের প্রায় তদন্ত লেভেলে চলে যেতে হত। সেখানকার ছাত্রদের খুঁজে বের করে তাদের থেকে ডিটেলে জোগাড় করতে হত কোন টাইপের গার্ড বেশি। সেকেন্ড ইয়ারের অঙ্ক পরীক্ষা। অন্য কলেজে সিট পড়েছে। গার্ড দিতে এলেন এক ম্যাম। স্মরণজিতের গল্পে নায়িকাদের যেমন বর্ণনা থাকে, ঠিক তেমন অবাস্তব ঘরানার সুন্দরী। উনি হলে ঢুকতেই হল শান্ত হয়ে গেল। কেমন যেন নিঝুম। ঘোর লাগা। মায়া মায়া। আর সেই ঘোরের মধ্যেই ভেসে এল বিশুর গমগমে গলা, ‘ডাকাপ!’ ম্যাম বোধহয় ইংরেজি পড়াতেন, কারণ ও অ্যাকসেন্টে ‘হোয়াট ডিড ইউ জাস্ট সে?’ অন্তত আমাদের জেলায় আমি কাউকে বলতে শুনিনি। বিশুর সামনে গিয়ে ওভাবে এ-প্রশ্ন করায় বিশু বিহ্বল হয়ে বলে ফেলল, ‘ডানা কাটা পরি!’, আবারও একবার সকাল হয়ে গেল যেন ম্যামের মুক্তোখচিত হাসিতে। কিন্তু তার ঠিক দশ মিনিট পর থেকেই আমরা বুঝতে পারলাম– এ সুন্দর ভয়ংকর সুন্দর! কাউকে ঘাড় ঘোরতে দিলেন না মহিলা গোটা সময়টা। মিতিন মাসির সুচারুতায় পাঁচটা টুকলি ধরলেন। ছ’-জনকে ১৫ মিনিট করে বসিয়ে রাখলেন। শেষে বেল পড়তেই খাতা কেড়ে নিলেন। সবার।
পরে জেনেছিলাম ওঁকে ওঁর ছাত্ররা ‘ছ্যাঁকা’ বলে ডাকে। নামটা সমস্ত দিক থেকে সংগত বলেই মনে হয়েছিল আমাদের। ওঁকে নিয়ে আরেকটু লিখতাম তবে, বেল পড়ে গেছে…