স্বাধীনতার পর হঠাৎ সবকিছু বদলে গেল। বাঙালি জাতি হিসাবে ব্যবসার দিকে কোনওদিনই মনোনিবেশ করেনি, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, এইচ বোসের সময় থেকে পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সময় অবধি বাঙালি ব্যবসায়ীর সংখ্যা মুষ্টিমেয়। বরং ব্যবসাকে আর ব্যবসায়ীদের চিরকাল নিচু চোখে দেখা হয়েছে। যে মানুষটা জামশেদজি টাটারও আগে দেশে ব্রিটিশদের টক্কর দিয়েছিলেন ব্যবসায়, সেই দ্বারকানাথ ঠাকুরকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে বাঙালি। বাঙালি মসিজীবী, ব্যবহারজীবী, বুদ্ধিজীবী হিসাবেই বেশী স্বচ্ছন্দ– সাহেবদের সওদাগরি আপিসে কাজ করাকেই জীবনের মোক্ষ বলে জেনে এসেছে।
আজকের এই সোশাল মিডিয়ার যুগে ইশকুলের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। সেদিন এইরকম কিছু বন্ধুদের সঙ্গে হোয়াটসআপে আড্ডায় কলকাতার জীবনযাপন নিয়ে অবধারিতভাবে কথা উঠল। প্রায় ৫০ বছরের বন্ধুদের যে কোনও আড্ডা যেমন কয়েক হাতা নস্ট্যালজিয়ার সঙ্গে দুই চামচ আবেগ মিশিয়ে বয়, এতক্ষণ সেভাবেই কথা গড়াচ্ছিল– এবার হঠাৎ বাস্তববাদের ছাঁকনির মধ্যে পড়ে গেল সেই আড্ডা। বিদেশে থাকুক বা দেশের অন্য কোনও প্রান্তে, প্রায় সবাই কলকাতায় একখান করে বাড়ি বানিয়ে রেখেছে– ভবিষ্যতের জন্য। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তারা কলকাতায় এসে থাকবে, কারণ বেশ কম টাকায় এই শহরে জীবনযাপন করা যায়, তাই বৃদ্ধাবাস হিসাবে এই শহর আদর্শ। কিন্তু, তার আগে কলকাতায় নাকি থাকা অসম্ভব। যারা এই শহরে থেকে গিয়েছে, তাদের ছেলেমেয়েরাও পড়াশুনা আর জীবিকার তাগিদে মুম্বই, দিল্লি, বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা, তাদের কোনও রকম পরিকল্পনা নেই এই শহরে ফেরত আসার। তাই এই শহরের ভবিষ্যৎ নিয়ে সব আড্ডায় দেখি সবাই সন্দিহান, জীবিকা নির্বাহের জন্যে এই শহরের হাওয়া গায়ে লাগলেও নাকি বিপদ। বাঙালিদের সব আড্ডাতেই যেমন একসময়ে রাজনীতি ঘুরে-ফিরে আসবে, এই প্রসঙ্গে কথা হলেও গালিগালাজের বন্যা বয়ে চলে– আগের শাসকদল থেকে এখনকার শাসকদল, সবার গুষ্টির ষষ্টিপুজো হয় গলা ফাটিয়ে, মারামারিই শুধু বাকি থাকে– কিন্তু একটা মতে ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’– কলকাতার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
কিন্তু এটাই তো হওয়ার ছিল– হতাশ হওয়ার কোনও কারণ আছে কি? এটাই তো সর্বজনীন সত্য! ইতিহাসের পাতায় দেখা যায়, চিরকালই ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের আশপাশেই মানুষ ভিড় করে থাকে। ব্রেন ড্রেন থিয়োরি প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে চলে এসেছে সারা বিশ্বে, কলকাতা তো সামান্য একটা শহর মাত্র। দক্ষ শ্রমিকের দল, শিক্ষিত আর গুণী মানুষ গিয়ে ডেরা বাঁধেন সেই জায়গায় যেখানে তার গুণাবলি সমাদৃত হবে– যেমন এখন হয়েছে বেঙ্গালুরু, দিল্লি বা মুম্বই-তে। তাই এক সময়ে মানুষের ঢল নেমেছিল একসময়ে পাটলিপুত্রে। লক্ষ্মীলাভের আশায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন পেশার মানুষ আর গুণীজন ভিড় করেছিল মৌর্য আর গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজধানীতে। আজও যে সেদিনের পাটলিপুত্রের শাসন আর পরিচালন ব্যবস্থা নিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় ইতিহাসের ছাত্ররা, সপ্তম শতাব্দীতে ভারতবর্ষে এসে হিউয়েন সাং পাটলিপুত্রের ধ্বংসাবশেষ দেখেছেন– কারণ একটাই, তখন আর পাটলিপুত্র ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ছিল না। সুলতানি আমল থেকে ঔরঙ্গজেবের সময় অবধি দিল্লির যে চাকচিক্য ছিল, ঔরঙ্গজেবের পরে দিল্লির মসনদে বসা মোঘল বাদশাদের সময় দিল্লির কি সেই গুরত্ব থেকেছে? লখনউ-এর উত্থানের সঙ্গে সবাই ভিড় করেছে সেখানে। গালিবের বর্ণনায় যে দিল্লিকে পাওয়া যায়, সেটা একটা হতমান শহর ছাড়া আর কিছুই নয়।
১৭৭২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের প্রশাসনিক সুবিধের জন্যে ভারতবর্ষকে তিনটে রেসিডেন্সিতে ভাগ করেছিল– মাদ্রাজ রেসিডেন্সি, বোম্বে রেসিডেন্সি আর বেঙ্গল রেসিডেন্সি। এই তিন রেসিডেন্সির প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা– শাসনব্যবস্থা ছিল এখানেই। আর বেঙ্গল রেসিডেন্সির মধ্যে পড়ত অবিভক্ত ভারতবর্ষের কাশ্মীর, পাঞ্জাব, রাজপুতানা, উত্তর প্রদেশ, মধ্য ভারত, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, সমগ্র বাংলা, আসাম আর বর্মা (যদিও সেই বিশাল বঙ্গের অঙ্গহানি শুরু হয় সিপাহী বিদ্রোহের অব্যবিহত পরেই)। ইতিহাসের পাতায় কলকাতা শহরের গুরুত্ব কতটা, তলিয়ে দেখতে গেলে আগে দেখে নিতে হবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে অবধি বাংলার ভৌগলিক সীমা কতটা ছিল। রাজস্থানের এক ইস্কুলের প্রিন্সিপাল বা এক এয়ারলাইন্সের কলকাতা আধিকারিক যখন লাহোরের বাঙালি, খুব অবাক হয়েছিলাম। রাজনীতিক হেমবতী নন্দন বহুগুনা (যার আসল পদবি গঙ্গোপাধ্যায়), অভিনেতা অশোককুমার থেকে শুরু করে সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বা বনফুল– এঁদের সূত্রে ‘প্রবাসী বাঙালি’ শব্দটার সঙ্গে বাল্যকাল থেকেই সবার পরিচয়। প্রবাসী শব্দের অর্থ যদি বিদেশে বাস করা হয়, এঁদের কি ‘প্রবাসী বাঙালি’ বলা যায়? নাকি শুধুই বাঙালি– কারণ, এঁদের বাপ-ঠাকুর্দা ব্যবহারজীবী ছিলেন– পেশার তাগিদে বাংলার বাইরে গেলেও বেঙ্গল প্রভিন্সের মধ্যেই থেকেছেন! ১৯৩০-এর আগে জীবিকার সন্ধানে কোনও বাঙালি কি বোম্বই বা মাদ্রাজ পৌঁছেছিল? পৌঁছলেও ক’জন? মুষ্টিমেয় যে ক’জন পৌঁছেছিল, সেটা ব্যক্তিগত কারণে না জীবিকার জন্য? একটু ছানবিন করলেই সত্যিটা সামনে আসবে। গোপালকৃষ্ণ গোখলের ‘what Bengal thinks today, India thinks tomorrow’ উক্তি সেই সময়ের নিরিখে প্রাসঙ্গিক আর তাতে সারবত্তা ছিল, কারণ তাঁর দেখা বাংলার বিস্তৃতি ছিল অনেক দূর অবধি– আজকে তাঁর উক্তি মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলার কোনও মানে হয় না।
……………………………………..
ব্রিটিশ আমলে কলকাতা একাধারে পলিটিক্যাল রাজধানী আর কমার্শিয়াল রাজধানী থেকেছে, আজকের মতো তখন মুম্বই দেশের কমার্শিয়াল হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। দেশের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হবার পরও কলকাতার গুরুত্ব কিছুমাত্র কমেনি বাণিজ্যিক মহলে। ১৯১৮ সালেও ৪৫% থেকে ৫০% ভারতীয় কোম্পানি কলকাতা থেকে তাদের যাত্রা শুরু করত, সেখানে বোম্বে থেকে শুরু করত ১৩% থেকে ১৫% মাত্র।
……………………………………..
১৯১১ সালে দেশের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হলেও ভরকেন্দ্র কলকাতাই থেকে গিয়েছিল– কারণ, গতকালের দিল্লি ভগ্নপ্রায় আর আজকের দিল্লি নির্মীয়মাণ। সাহিত্যিক খুশবন্ত সিং ১৯১৫ সালে জন্মেছিলেন। তাঁর শৈশবে তিনি পরিবারের সঙ্গে দিল্লি চলে আসেন, কারণ ওঁর বাবা তখন নতুন দিল্লি তৈরির বরাত পেয়েছিলেন! সেই নির্মীয়মাণ শহরের কথা বিশদভাবে খুশবন্তের ছেলেবেলার কথায় পাওয়া যায়। অশোক মিত্র তাঁর ‘তিন-কুড়ি-দশ’ বইয়ে পাঁচের দশকের শেষ ভাগের দিল্লির বর্ণনা দিয়েছেন, লিখেছেন ১৯৫৮ সালে যখন তিনি দিল্লিতে বদলি হলেন, সেখানে প্রথমে বেশ অসুবিধে হয়েছিল কারণ, সেই সময় দিল্লি এক বড় সাইজের গ্রামের মতো ছিল, কলকাতার আর্বান লাইফ আর মানসিকতা ছিল না সেখানে।
ব্রিটিশ আমলে কলকাতা একাধারে পলিটিক্যাল রাজধানী আর কমার্শিয়াল রাজধানী থেকেছে, আজকের মতো তখন মুম্বই দেশের কমার্শিয়াল হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। দেশের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হবার পরও কলকাতার গুরুত্ব কিছুমাত্র কমেনি বাণিজ্যিক মহলে। ১৯১৮ সালেও ৪৫% থেকে ৫০% ভারতীয় কোম্পানি কলকাতা থেকে তাদের যাত্রা শুরু করত, সেখানে বোম্বে থেকে শুরু করত ১৩% থেকে ১৫% মাত্র। স্টার্লিং কোম্পানিদের ৭৩% ছিল কলকাতায় আর মাত্র ১৯% ছিল বোম্বেতে। ১৯১৩ সালে ক্লিয়ারিং হাউস লেনদেন ছিল ৬৫০,৩৫,০০,০০০/- যার মধ্যে কলকাতার ছিল ৫১% আর বোম্বের ৩৩.৭%। দিল্লিতে কিছু হত না বলা চলে।
সেখানে ১৯৬৫ সালে দেখা গেল, কলকাতার ক্লিয়ারিং হাউস লেনদেন কমে ২৮% হয়ে গিয়েছে আর বোম্বে সেখানে বেড়ে ৩৫% হয়েছে– দিল্লির অংশ তখন আর খুব কম নেই। এমনকী বন্দর থেকে বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও কলকাতা সেদিনের বোম্বের চেয়ে অনেক এগিয়েছিল। ১৯৩৯ সালেও কলকাতা বন্দর থেকে আমদানি-রপ্তানি বোম্বের থেকে প্রায় ২০% বেশি। সেখানে প্রথম ধাক্কা এল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের কলকাতা বন্দরের ওপরে বোমাবর্ষণে যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি হয়েছিল, ব্রিটিশ সরকার প্রেসের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে জনগণের কাছ থেকে ক্ষতির পরিমাণ গোপন করলেও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লুকোতে পারেনি। কলকাতা বন্দরের সুরক্ষা নিয়ে সারা বিশ্বের ব্যবসায়ীদের মনে এক প্রশ্ন তুলল, কলকাতার হল সর্বনাশ আর বোম্বের পৌষ মাস।
স্বাধীনতার পর হঠাৎ সবকিছু বদলে গেল। বাঙালি জাতি হিসাবে ব্যবসার দিকে কোনওদিনই মনোনিবেশ করেনি, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, এইচ বোসের সময় থেকে পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সময় অবধি বাঙালি ব্যবসায়ীর সংখ্যা মুষ্টিমেয়। বরং ব্যবসাকে আর ব্যবসায়ীদের চিরকাল নিচু চোখে দেখা হয়েছে। যে মানুষটা জামশেদজি টাটারও আগে দেশে ব্রিটিশদের টক্কর দিয়েছিলেন ব্যবসায়, সেই দ্বারকানাথ ঠাকুরকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে বাঙালি। বাঙালি মসিজীবী, ব্যবহারজীবী, বুদ্ধিজীবী হিসাবেই বেশী স্বচ্ছন্দ– সাহেবদের সওদাগরি আপিসে কাজ করাকেই জীবনের মোক্ষ বলে জেনে এসেছে। দেশ স্বাধীন হতে সাহেবরা নিজেদের দেশে ফেরত চলে যেতে তাদের তৈরি সব প্রতিষ্ঠান চলে এল এদেশের মানুষের হাতে। কিছু কোম্পানি সরকার অধিগ্রহণ করল, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মচারীরা হয়ে গেল সরকারী কর্মচারী। বাকিদের মালিক হয়ে বসল এদেশীয়রা। ঘটনাক্রমে, পশ্চিম ভারতীয় আর উত্তর ভারতীয়, যারা সাহেবদের কোম্পানিতে দিনরাত কাজ করে লক্ষ্মী-লাভ না করিয়ে নিজের ব্যবসা দাড় করানোর ব্যাপারে মনোনিবেশ করেছিল।
উপমহাদেশের সবচেয়ে বুদ্ধিমান জাত (স্বঘোষিত) এইসব ‘কমা লোকদের’ অধীনে কাজ করবে– সেটা হজম হতে না হতেই পূর্ব বাংলা থেকে লাখে লাখে মানুষ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল শহর কলকাতায়- পেটে আগুনে খিদে, সঙ্গে লাঞ্ছনা আর অপমানে ভরা অভিজ্ঞতা আর সংসারের দায়িত্ব, সব রকম কাজ করতে তারা তৈরি পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য। এতদিন যারা রাজনীতিতে লাঠি ঘুরিয়েছে, তারা এতদিন ভূস্বামী ছিল, তারা দিশাহারা– নিজের জমি সামলাবে নাকি দল! বিরোধী দল এই সুযোগে দেশচ্যুত মানুষকে তাতিয়ে দিল নিজেদের দলভারী করতে, তাদের শেখালো এক অস্ত্র– হরতাল!
নিজের দেশ ছাড়ার জন্যে বুকে জমে থাকা রাগ আর অভিমানকে লাগাম না দিয়ে তাতে আগুন ধরালেন নেতারা, নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দার জন্যে। এর ফল হল মারাত্মক। এই হরতাল আর অযৌক্তিক দাবির ওপরে নিজেদের কন্ট্রোল রাখতে তাদের অস্ত্রভাণ্ডার থেকে বার করল এক অস্ত্র- লকআউট, যে অস্ত্রের ব্যবহার এই দেশে মালিকদের এর আগে ব্যবহার করতে হয়নি বলা চলে। কলকাতার গুরুত্ব একদিকে দেশের নিরিখে ধাপে ধাপে কমে যাচ্ছে– ১৯১৫ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে যেখানে ১৯২টি ব্যাঙ্ক কলকাতায় বন্ধ হয় আর ১১৩টি ব্যাঙ্ক বোম্বেতে বন্ধ হয়, সেখানে ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে কলকাতায় বন্ধ হয় ১৬৮টি ব্যাঙ্ক আর সেখানে বোম্বেতে ১৩টা ব্যাঙ্ক মাত্র।
অন্যদিকে, ১৯৬৫-তে যেখানে পশ্চিমবঙ্গে ১৭৯ স্ট্রাইক আর ৪৯ লকআউট হয়েছিল। ১৯৭০ সালে সেটা বেড়ে ৬৭৮ স্ট্রাইক আর ১২৮ লকআউট হয়। আর এই আগুনে কলকাতা আর রাজ্যের সব ব্যবসাই কম-বেশি পুড়ল। পশ্চিম ভারতীয় ব্যবসায়ীর দল যারা এর আগে ২০০ বছর ধরে কলকাতায় থেকেছে, এখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যেতে লাগল, নোঙর ফেলতে শুরু করল এমন সব জায়গায়, যেখানে মনে সুখ রেখে নিরাপদে ব্যবসা করা যায়। শুধু দেশি ব্যবসায়ীরাই নয়, বিদেশি কোম্পানিও কলকাতা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নিল আর কলকাতা হয়ে উঠল এক ট্রেডিং করার জায়গা মাত্র।
ভারতীয়দের, বিশেষ করে বাঙালিদের সাদা চামড়ার প্রতি দুর্বলতা আড়াইশো বছর ধরে নাগাড়ে চলছে। ‘Bastard’ বা ‘bitch’ শব্দের মধ্যে আমরা আভিজাত্য খুঁজে পাই, কিন্তু ‘বেজন্মা’ বা ‘কুত্তি’ বললে ফোঁস করে উঠি। তাই সাতের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন গুন্টার গ্রাস কলকাতার বিষয়ে বললেন, ‘একটি বিষ্ঠার স্তূপ যা ঈশ্বর ফেলে দিয়েছেন’, সামান্য কয়েকজন এই মন্তব্যে বিরূপ হলেও বেশির ভাগ নাগরিকের বেশ স্ফূর্তি হয়েছিল কলকাতার নাম শ্বেতাঙ্গের দুনিয়ায় নতুন করে ‘ছড়ালো’ বলে! কিন্তু, আটের দশকের মাঝামাঝি রাজীব গান্ধী কলকাতাকে মৃত-প্রায় শহর বলাতে সারা শহর হৈহৈ করে উঠল– এইরকম অপমান মেনে নেওয়া যায় না বলে। কিন্তু এটাই তো সত্যি– ব্রেন-ড্রেথ তত্ত্ব তো এটাই শিখিয়েছে আমাদের বারবার– নিজেদের শহরের ব্যাপারে আমরা ভুলে যাই কি করে!
কলকাতা এইভাবেই চলবে, আমরা নিজেদের বুদ্ধিমান ভাবব, সন্তানেরা দেশের অন্য প্রান্তে গিয়ে চাকরি করবে, শহরের বাঙালিরা শহরতলিতে চলে যাবে, আর ভালোভাবে ট্রেডিং করার জন্যে অবাঙালিরা কলকাতার দখল নেবে, শৈশবের আর কৈশোরের জায়গাগুলো আশ্রয় নেবে স্বপ্নে। প্রাসাদ নগরী ইতিমধ্যে বদলে গিয়েছে স্মৃতির শহরে।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………