Robbar

অনলাইন অফারে ব্যস্ত ক্রেতা, অসম প্রতিযোগিতায় খুচরো বিপণি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:June 17, 2024 5:59 pm
  • Updated:June 17, 2024 6:03 pm  

পাড়ার যে মুদি দোকানদার উদয়স্ত অমানুষিক পরিশ্রম করে সংসার চালাচ্ছেন, ফ্লিপকার্ট-ব্লিঙ্কইট-ডিলশেয়ারের সঙ্গে লড়াইয়ে তারা কীভাবে এঁটে উঠবেন? তাঁদের পরিশ্রম দাম পাচ্ছে না। মুখ চেনা, প্রতিবেশী দোকানদারের কাছ থেকে সম্পর্কের খাতিরে জিনিস কিনলেও এক সময় সংসারে দু’পয়সা সাশ্রয়ের চিন্তাও মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে বড় হয়ে দাঁড়ায়। তারাও শেষ পর্যন্ত চোখ রাখেন হাতের মুঠোফোনে অনলাইন সাইটে ‘অফার’ খুঁজতে।

অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়

বেশ কয়েক বছর ধরেই ফোনে বা হোয়াটসঅ্যাপে মাসকাবারি বাজারের ‘অর্ডার’ দেওয়া অভ্যাস করে ফেলেছেন শহর-শহরতলির মানুষ। বাড়িতে বসে এখন কাঁচা-সবজি, মুদি দোকানের পণ্য থেকে শুরু করে মিষ্টি, ফল, মাছ-মাংস মায় ওষুধ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। এসে যাচ্ছে রসনা তৃপ্তির নানা সামগ্রী, হোটেল-রেস্তরাঁর নানা লোভনীয় পদ। কালে কালে গঙ্গোত্রীর গঙ্গাজল থেকে শুরু করে বিভিন্ন মন্দিরের প্রসাদ পর্যন্ত এখন অনলাইনেই মিলছে! বাকি বোধহয় ‌‘বাঘের দুধ’! কোনও দিন হয়তো সেটাও বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দাবি করবে অলনাইনে পরিষেবা দেওয়া কোনও সংস্থা। কিন্তু এই অসম লড়াইয়ে যে বহু ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়ী ঝাঁপ বন্ধ করছেন, সেই সত্যটা কি চাপা পড়ে যাচ্ছে না?

বাড়ি বয়ে পরিষেবা দেওয়া কিন্তু নতুন নয়। যদি রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’, ‘কাবুলিওয়ালা’-র কথা মনে করা যায়, তাহলে পাড়ায় দই বা অন্য পণ্য ফেরি করার প্রথা মনে আসতে বাধ্য। বাড়ি বাড়ি মেওয়া-পেস্তা-কাজু বিক্রি করতে আসতেন কাবুল থেকে আসা মানুষজন। পরবর্তী সময়ে বাড়িতে এসেই শাল-সোয়েটার বিক্রি করতে শুরু করেন কাশ্মীরি শালওয়ালারা। এর বাইরেও দুয়ারে পরিষেবার বহু পুরনো চালচিত্র রয়েছে শহর কলকাতা, গ্রাম বাংলায়। ময়লা কাপড় নিয়ে কেচে-ইস্ত্রি করে বাড়ি দিয়ে যেতেন ধোপারা। যাদের বাড়ি গরু ছিল না, তারা ‘খাঁটি’ দুধের জন্য ঘটি-লোটা হাতে গয়লাবাড়ি যেতেন অনেকে। কিন্তু যাদের সেই সময় ছিল না, তাদের বাড়ি এসে দুধ দিয়ে যেতেন গোয়ালারা। পরে বিভিন্ন জায়গায় মাদার ডেয়ারির বুথ তৈরি হলেও বাড়িতে এসে ‘দুধের বোতল’ পৌঁছে দেওয়ার রীতিমতো সুবন্দোবস্ত ছিল। কালের নিয়মে অবশ্য বোতলের জায়গা নেয় প্লাস্টিকের পাউচ।

No photo description available.

সাতের দশক থেকে বাড়ি বাড়ি সাবান, প্রসাধনীর ফেরি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। আজ যে সুইগি, জোম্যাটোর মতো ফুড ডেলিভারি অ্যাপ নিয়ে এত কথা হচ্ছে। কিন্তু মুম্বইয়ের ডাব্বাওয়ালাদের কাজ কি কিছুটা তেমন নয়? এই বাংলাতেও যখন বেশ কিছু কলকারখানা চালু ছিল, বাড়ি থেকে টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবসা চালু ছিল তখন রমরম করে। আবার পাড়ার কোনও কোনও মুদি দোকানও অনেক সময় মাসকাবারি বাজার বাড়িতে পৌঁছে দিত ক্রেতাকে তুষ্ট করতে। বাজার থেকে ঝাঁকা মুটের মাথায় ধামা চাপিয়ে সবজি বাড়িতে পৌঁছে দিতেন কিছু বিক্রেতা। সবটাই ছিল ব্যবসায়িক কৌশলের অঙ্গ। ক্রেতাকে হাতে রাখার চেষ্টা।

Roar বাংলা - মুম্বাইয়ের ডাব্বাওয়ালা
মুম্বইয়ের ডাব্বাওয়ালা

১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের গেইটসহেড নামের ছোট শহরে জেন স্নোবল নামে এক বৃদ্ধা টিভি দেখতে দেখতে রিমোট কন্ট্রোল ব্যবহার করে মাখন, কর্নফ্লেক্স আর ডিমের অর্ডার দিয়েছিলেন। তিনি যে প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলেন, সেই ‘ভিডিওটেক্স’ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন মাইকেল অলড্রিচ নামে এক ব্যক্তি। টিভির পর্দায় তৈরি ফর্দ পৌঁছে যায় স্থানীয় সুপারমার্কেটে। ১৯৯৪ সালে ড্যানিয়েল এম কোহেন নামে ২১ বছরের এক উৎসাহী তরুণ ‘নেটমার্কেট’ নামে অনলাইন বাজার গড়ে তোলেন। সে বছর থেকে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করে ‘পিৎজাহাট’। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাজারে আসে ‘অ্যামাজন’। তখন অবশ্য তারা শুধুই বই বিক্রি করত। পরের বছর এল ‘ইবে’, জাপানে শুরু হল বৃহত্তম ই-বাণিজ্যিক সাইট ‘রাকুতেন’। ১৯৯৯-এ চিনের ‘আলিবাবা’। কিন্তু দু’দশক আগে অনলাইনে কেনাকাটা ছিল ‘ব্যতিক্রমী’ ব্যবস্থা। ২০০৬ সালে ব্রিটেনে অনলাইনে কেনাকাটা করতেন ৩ শতাংশ মানুষ। ২০২০-র গোড়ায় তা পৌঁছেছিল ২০ শতাংশে। আর কোভিড মহামারী এসে পুরো ব্যবস্থাই পাল্টে দিয়েছে। এখন অনলাইনে বাজার করেন ৩০ শতাংশ। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট সহজলভ্য হচ্ছে। ভারতেও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অনলাইনে কেনাকাটা।

……………………………………………………………………………………………..

সাতের দশক থেকে বাড়ি বাড়ি সাবান, প্রসাধনীর ফেরি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। আজ যে সুইগি, জোম্যাটোর মতো ফুড ডেলিভারি অ্যাপ নিয়ে এত কথা হচ্ছে। কিন্তু মুম্বইয়ের ডাব্বাওয়ালাদের কাজ কি কিছুটা তেমন নয়? এই বাংলাতেও যখন বেশ কিছু কলকারখানা চালু ছিল, বাড়ি থেকে টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবসা চালু ছিল তখন রমরম করে। আবার পাড়ার কোনও কোনও মুদি দোকানও অনেক সময় মাসকাবারি বাজার বাড়িতে পৌঁছে দিত ক্রেতাকে তুষ্ট করতে।

……………………………………………………………………………………………..

কিন্তু তাতে সমস্যা কোথায়?

আছে অনেকেই। প্রথমত, মুঠোফোন নির্ভর মানুষ প্রযুক্তিতে বেশি আস্থা রেখে হয়ে পড়েছেন আরামপ্রিয়। রোদে-গরমে-বৃষ্টিতে ভিজে দোকানে বা বাজারের ভিড় ঠেলে কেনাকাটা করতে তাদের অনেকেরই অনীহা। তাই প্রতারণার শিকার হয়ে আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা, পণ্যের গুণগত মান নিয়ে সংশয়, জিনিস ফেরত ও বদলের অসুবিধা, দীর্ঘসূত্রতা মেনে নিয়েও তারা অনলাইন শপিংয়ে ঝুঁকছেন। এবং সমস্যা বেড়েছে খুচরো পণ্যের কেনাকাটায় বৃহৎ, কর্পোরেট পুঁজির প্রবেশে।

5 Grocery Stores In Delhi For Exclusive Shopping Experience - NDTV Food

এখন প্রায় সমস্ত বড় সংস্থাই অনলাইনে হাজির। এবং তাদের কার্যত লক্ষ্য, মাঝারি ও ছোট মাপের খুচরো বিক্রেতাদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সেই বাজারটা ‘দখল’ করা। তাদের ঝুলিতে প্রভূত অর্থ। তাই ইচ্ছে হলেই ‘দেওয়ালি ধামাকা’ বা ‘বিগ বিলিয়ন ডে’র নামে প্রচুর ছাড় দিয়ে পণ্য বিক্রি করতে পারে। সেই ‘লোভ’ সামলানো কতটা সম্ভব? আর ন্যূনতম মুনাফা রেখে এই সমস্ত সংস্থা যে ছাড় দিতে পারে, কোনও ছোট-মাঝারি বিক্রেতার পক্ষে তা দেওয়া কার্যত অসম্ভব। বুদ্ধি খাটিয়ে, মেধা কাজে লাগিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে নতুন কৌশল অবলম্বন করেও তাই তারা হেরে চলেছেন।

পাড়ার যে মুদি দোকানদার উদয়স্ত অমানুষিক পরিশ্রম করে সংসার চালাচ্ছেন, ফ্লিপকার্ট-ব্লিঙ্কইট-ডিলশেয়ারের সঙ্গে লড়াইয়ে তারা কীভাবে এঁটে উঠবেন? তাঁদের পরিশ্রম দাম পাচ্ছে না। মুখ চেনা, প্রতিবেশী দোকানদারের কাছ থেকে সম্পর্কের খাতিরে জিনিস কিনলেও এক সময় সংসারে দু’পয়সা সাশ্রয়ের চিন্তাও মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে বড় হয়ে দাঁড়ায়। তারাও শেষপর্যন্ত চোখ রাখেন হাতের মুঠোফোনে অনলাইন সাইটে ‘অফার’ খুঁজতে। সুখে-দুঃখে দীর্ঘদিন পাশে থাকা প্রতিবেশী-বন্ধুরাও হয়ে যান ‘দূরের মানুষ’।

শঙ্কর মুদির চোখ আড়ালে হাজারো শঙ্করের গল্প বলল অনিকেতের ছবি
‘শঙ্কর মুদি’ সিনেমার দৃশ্য

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

আরও পড়ুন অম্লানকুসুম চক্রবর্তী-র লেখা: এআই তোর মুন্ডুটা দেখি!

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

এই অসম, অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আপাতত আশার আলো চোখে পড়ছে না। কিছু ছোট দোকানদারও অনলাইনের মাধ্যমে, হোম ডেলিভারি করে পাল্টা লড়াইয়ের চেষ্টা করছেন। কতটা পারবেন, সময়ই বলবে। যাঁরা পারবেন না, বিকল্প রুজির চেষ্টায় নামবেন। বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে গিলে খায়, তেমনই ছোট ব্যবসায়ীদের গিলে খাবে বৃহৎ পুঁজি।

তারপর? বৃহৎ পুঁজি, কর্পোরেট সংস্থার মধ্যে শুরু হবে লড়াই। ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’ তো বৈজ্ঞানিক সত্য। অস্তিত্বের যুদ্ধে জিতে নয়া কোনও বাণিজ্যিক মডেল সামনে আসে, তারই অপেক্ষায় থাকবে মানব সভ্যতা।