সেকুলার মানে তাঁরা, যাঁরা ধর্মে বিশ্বাস রাখতেও পারেন, না-ও পারেন, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় ও যাপনে ধর্মটা কোনও আবশ্যিক ব্যাপার নয়– সেইটা বিশ্বাস করেন। সেটাই তো হওয়া উচিত! বলুক ওরা সেকু, বলুক দেশদ্রোহী, বলুক গান্ডে-পিন্ডে দেশের খাচ্ছি, বলুক নজরুল ভুল, বলুক কীসের কুসুম, তবু আমরা ওদের থামাব। থামাতেই হবে ওদের রক্তপিপাসা আর যুদ্ধজিগিরের মৌলবাদী উসকানি। না হলে ইতিহাসের আয়নায় মুখ দেখাতে পারব না যে!
সমাজবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল বেল বলেছিলেন, জাতি-রাষ্ট্রের সংগঠনগুলো আমাদের ছোট ছোট সমস্যার জন্য খুব বড় আর বড় বড় সমস্যার পক্ষে খুব ছোট বা সংকীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে। সারমর্ম করলে দাঁড়ায়– সমস্যার গড় অনুপাতে জাতির কলজে আর রাষ্ট্রের ইচ্ছেশক্তি মাঝারি মাপের থাকছে। তাঁদের সামনে দরিদ্রের টালির চালের ছ্যাঁদা আর ওজন স্তরে ছ্যাঁদার সমস্যা যুগপৎ হাজির, এবং তাঁরা কোনওটাই সমাধান করার যোগ্যতা রাখেন না। জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, নারীর সতীত্ব, পুরুষের মর্দাঙ্গি, শিশুর সংখ্যা, জাতপাতের মতো গুরুতর বিষয়ে খবরদারির বহর এত লম্বা যে, দরিদ্রের টালির চালের ছ্যাঁদা সারানো বা পেটের ছ্যাঁদা দুটো গরম ভাতে ভরানোর মতো ছেঁদো-খুচরো বিষয় দেখভালের পক্ষে জাতি-রাষ্ট্রের শরীর বেশ বড়। আবার ওজন স্তরের ছ্যাঁদা মেরামতের মতো বড় কাণ্ডের পক্ষে তাঁদের সাধ্যের পরিসর তেমন সম্মানজনক নয়। ফলে তাঁদের চিন্তা-চেতনার মাঝারি মাপের শরীরটাই অতীত-বর্তমান-ভবিতব্য হয়ে বিদ্যমান। সেই শরীরের সামনে দরিদ্র শীতে কাঁপুক আর বর্ষায় ভিজুক, তাঁদের কিছু করার নেই। ছোট হয়ে ভাবার নমনীয়তা তাঁদের নেই। আবার ওজন স্তরের ছ্যাঁদাজনিত বিপদের ক্ষেত্রেও তাঁদের উটপাখি হয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। কারণ এক্ষেত্রে যতটা বড় করতে হয় সাধনার মাঠটাকে, ইচ্ছেশক্তি ততটা কুলিয়ে উঠছে না। আর এর ফলে নাগরিকের গেরো বেড়েই চলেছে। ছোট সমস্যাগুলো সমাধানের অপেক্ষায় পাহাড় নির্মাণ করে চলেছে। আর বড় সমস্যাগুলোর মারে আমরা কাহিল। প্রকৃতি আর বহিঃশত্রুর বড় বড় আঘাতে সারা পৃথিবীর নাগরিক বহুকাল থেকে দিশাহারা। অন্যদিকে স্থানীয় সমস্যাগুলো এমন গোঁজের মতো চাগিয়ে চাগিয়ে উঠছে বা গজিয়ে ছড়িয়ে আছে যে, আমরা মাথা ঢাকব না পাছা– সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। আর এর ফলে যে বিপদটা বেশি বেশি করে শরীর পেয়েছে, তা হল মানব বিশ্বাসের আধিভৌতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমে শক্তিশালী হয়েছে। রাস্তার নুড়িতে মুহুর্মুহু দেবতা জন্ম নিয়েছেন, পৃথিবীর চারপাশে সূর্যকে ঘোরানো হয়েছে, চাঁদকে পৃথিবীর থেকে বড় আকার দেওয়া হয়েছে, এমনই আরও কত কী! এইসব আধিবিদ্যক বিশ্বাসগুলোর চোখে চোখ রেখে লড়াই করার জন্য বিজ্ঞানবুদ্ধি ও যুক্তিতন্ত্রের যে প্যাটার্নে শ্রীবৃদ্ধি হওয়া উচিত ছিল, রাষ্ট্র ও জাতি সংগঠনগুলো বলপূর্বক সেসব হতে দেয়নি। নিজেদের স্থিতাবস্থা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যেই রাষ্ট্র ও জাতি সংগঠনের নেতারা নানা বিশ্বাসনির্ভর মেটাফিজিক্যাল ধারণার জন্ম দিয়েছেন। সেগুলোই কালক্রমে জাতি ও ধর্মকেন্দ্রিক মৌলবাদের জন্ম দিয়েছে, দিয়ে চলেছে।
…………………………………….
তবে শব্দ বা তত্ত্ব হিসেবে ‘মৌলবাদ’ পাশ্চাত্যের বিষয়, বিশেষ করে বললে খ্রিস্টধর্মের বিষয়। ভাবতেই অবাক লাগে, দুনিয়া জুড়ে লিবারাল ঢাক পেটানো এর-ওর গায়ে মৌলবাদী তকমা সাঁটা সাহেবরাই তাত্ত্বিক মৌলবাদের বাপ-কাকা। ‘তাত্ত্বিক’ বললাম, এই কারণে যে চর্চার জায়গায় মৌলবাদের অবস্থান হাজার বছর পেরলেও তাত্ত্বিক শব্দবন্ধ হিসেবে মৌলবাদের জার্নি শুরু হয়েছে মোটে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে।
…………………………………….
মৌলবাদ এমনিতে খারাপ হওয়ার কথা ছিল না। মন থেকে বিশ্বাস নিয়ে একটাই বিষয়কে ধ্যান-সাধনা করা খারাপ কেন হতে যাবে? কিন্তু মৌলবাদীরা এর অর্থাবনমন ঘটিয়ে ফেলেছেন প্রথম লগ্ন থেকেই। বীজ অবশ্য মতের মধ্যেই ছিল। শুধু একের চর্চা নয়, অন্য সবকিছুকে ভ্রান্ত জেনে অস্বীকার করে ওয়াননেস-এর চর্চা হয়ে দাঁড়াল মৌলবাদী চর্চা। আর তাতেই ঘনিয়ে এল সভ্যতার সংকট। এই যে এক দেশ, এক ভাষা, এক ভোট, এক সরকার ইত্যদি বিষয়গুলো ভালো ভালো বলে মাথার মধ্যে চিবিয়ে সরু করে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, সেখানেও সুতো ধরে ধরে এগিয়ে গেলে একটা মৌলবাদের চেহারাই খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে শব্দ বা তত্ত্ব হিসেবে ‘মৌলবাদ’ পাশ্চাত্যের বিষয়, বিশেষ করে বললে খ্রিস্টধর্মের বিষয়। ভাবতেই অবাক লাগে, দুনিয়া জুড়ে লিবারাল ঢাক পেটানো এর-ওর গায়ে মৌলবাদী তকমা সাঁটা সাহেবরাই তাত্ত্বিক মৌলবাদের বাপ-কাকা। ‘তাত্ত্বিক’ বললাম, এই কারণে যে চর্চার জায়গায় মৌলবাদের অবস্থান হাজার বছর পেরলেও তাত্ত্বিক শব্দবন্ধ হিসেবে মৌলবাদের জার্নি শুরু হয়েছে মোটে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে।
‘ফান্ডামেন্টালিস্ট’ শব্দটা সম্ভবত প্রথম ব্যবহৃত হয় ব্যাপটিস্ট ওয়াচম্যান এগজামিনার কাগজে। ১৯২০ সালে। সব ধর্মেই বেশ একটা গল্প চলছিল, তখন পরমেশ্বর তাঁর ইচ্ছের মাটি দিয়ে খেয়ালের হাওয়া দিয়ে উৎকৃষ্ট মানব সৃজন করলেন ইত্যাদি। কোথা থেকে এক দাড়িঅলা বুড়ো ডারউইন বলে বসলেন, প্রমাণও দিলেন ওসব ডিভাইন ইন্সপিরেশন থেকে নয়, বরং বিবর্তনের পথ ধরে অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট প্রাণী থেকেই তৈরি হয়েছে মানুষ। বাদবাকি জন্তু-জানোয়ারও ওই নিয়মেরই ফলশ্রুতি। ওদিকে আমেরিকার ‘স্কোপস মাংকি ট্রায়াল’ চার্চকে রাতে ঘুমোতে দিচ্ছে না। বিজ্ঞান নম্রভাবে ক্রাইস্টের ভার্জিন বার্থ নিয়ে প্রশ্নপত্র তৈরি করে দাঁড়িয়েছে হোলি স্ট্যাডেলে। প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা! অতঃকিম! প্রশ্নের মুখগুলোই দাও সেলাই করে। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। তাই নো তক্কাতক্কি! তিনি মহান, তিনি অবিকল্প, তিনি প্রশ্নাতীত। প্রশ্ন ক’রো না, বিশ্বাস করো, তিনি করুণা করবেন। আর প্রশ্ন করলে তাঁর অভিপ্রায়েই তাঁর সেবকরা তোমাকে ওদিকের টিকিট ধরাবেন। তৈরি হল ছোট ছোট মিলিট্যান্ট গ্রুপ। বিবর্তন-বিরোধী বিল পড়তে লাগল একটার পর একটা। ১৯২১ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে ৩৭টা বিবর্তন-বিরোধী বিল উত্থাপিত হল ২০টার বেশি স্টেটে। ১৯২৫-এ জন স্কোপস মামলার পরে সেগুলো আইনেও পরিণত হতে লাগল। চলতে থাকল বাইবেলের মতামত নিয়ে প্রশ্ন তোলার স্বরতন্ত্রগুলোকে অ্যামপুট করার মিশন। ‘সেক্রেড সার্ভিস’ হয়ে গেল ‘সিক্রেট সার্ভিস’। চার্চের সেই পথ মেধাবী ছাত্রের মতো বেশি বেশি শিখেছে অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদীরা এই বিশ শতকেই। ১৯৫০-এর দিকে অক্সফোর্ড ডিকশনারি-ও ‘ফান্ডামেনটালিস্ট’, ‘ফান্ডামেনটালিজম্’ শব্দগুলোকে জায়গা দিয়েছে। তবে মৌলবাদের জার্নি ওই ফান্ডামেনটালিস্ট শব্দটার প্রচলিত হওয়ার সময়ের থেকেও প্রাকপুরাণিক।
…………………………………….
সব ধর্মেই বেশ একটা গল্প চলছিল, তখন পরমেশ্বর তাঁর ইচ্ছের মাটি দিয়ে খেয়ালের হাওয়া দিয়ে উৎকৃষ্ট মানব সৃজন করলেন ইত্যাদি। কোথা থেকে এক দাড়িঅলা বুড়ো ডারউইন বলে বসলেন, প্রমাণও দিলেন ওসব ডিভাইন ইন্সপিরেশন থেকে নয়, বরং বিবর্তনের পথ ধরে অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট প্রাণী থেকেই তৈরি হয়েছে মানুষ। বাদবাকি জন্তু-জানোয়ারও ওই নিয়মেরই ফলশ্রুতি। ওদিকে আমেরিকার ‘স্কোপস মাংকি ট্রায়াল’ চার্চকে রাতে ঘুমোতে দিচ্ছে না। বিজ্ঞান নম্রভাবে ক্রাইস্টের ভার্জিন বার্থ নিয়ে প্রশ্নপত্র তৈরি করে দাঁড়িয়েছে হোলি স্ট্যাডেলে।
……………………………………..
ইহুদিদের মধ্যে ধর্মীয় ও জাতগত মৌলবাদ প্রথম শরীর নিয়েছে। ইহুদিদের আদিগুরু মুসা ছিলেন একেশ্বরবাদী। তিনি তাঁর যাযাবর অনুগামীদের মিশরের ফ্যারাওয়ের অধীনতা থেকে মুক্ত করে প্যালেস্তাইনে নিয়ে আসেন নয়া বসতের খোঁজে আনুমানিক ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্য যশুয়া প্যালেস্তাইনে একাধিপত্য স্থাপনের জন্যে শুরু করেন তুলনামূলক উন্নত সংস্কৃতির ক্যানানাইটদের নির্মূল অভিযান। সমস্ত ক্যানানাইট-সহ ওই এলাকার ২৪ জন রাজাকেও তিনি মেরে ফেলেন। ওল্ড টেস্টামেনের অরুণ সৌরি কৃত অনুবাদে ‘হার্ভেস্টিং আওয়ার সোল’ অংশটা থেকে জানতে পারছি ইহুদিদের এমন রক্তপিপাসু তিনি করতে পেরেছিলেন এটা বিশ্বাস করিয়ে যে, ঈশ্বরের অভিপ্রায়ে তাঁরাই বিশুদ্ধতম জাতি এবং সেই ঈশ্বরই তাঁকে বিধর্মীদের কোতল করার নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব প্রশ্ন, ভাবাভাবির কোনও অবকাশ সেখানে একেবারেই নেই। ঈশ্বরের নামে প্রশ্নহীন আনুগত্যের এই উসকানিই মগজ ধোয়ার কার্যকর ওয়াশিং পাউডার। যশুয়ার পথেই সউল, দাউদের মতো ধর্মধ্বজী নেতারা ইহুদিদের মৌলবাদী হতে শিখিয়েছেন। খ্রিস্টানরা ইহুদিদের সেই স্কুলেরই প্রতিশ্রুতিমান উত্তরপুরুষ। ফলে চামড়া নিয়ে, ধর্ম নিয়ে মৌলবাদী চর্চায় ইহুদিদেরও দশগোল দিলেন তাঁরা। ওদিকে হিন্দু মৌলবাদের নাটের গুরু অবশ্যই মনু। সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মনুসংহিতার সরল অনুবাদ করেছেন। সেখানে প্রথম অধ্যায়ের ৯৩ সংখ্যক শ্লোক বলছে ব্রহ্মার উত্তমাঙ্গ বা মুখ থেকে যেহেতু ব্রাহ্মণের সৃষ্টি, তাই তিনি শ্রেষ্ঠ এবং বেদ ধারণের অধিকারহেতু তিনি সমগ্র সৃষ্টিরও প্রভু। প্রয়োজন রক্তের শুদ্ধতা বজায় রাখা। এবং অব্রাহ্মণদের কাজ বর্গশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের সেবা করা। যেমনটা ইহুদি গুরু ইষ্রা বলেছিলেন, ইহুদিরা পৃথিবীর বিশুদ্ধতম সৃজন, মনু ব্রাহ্মণ্যবাদে সেটাই বললেন, কিন্তু আরও পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ ভাবে। সেখানে জাতি নয়, আরও ছোট, বর্গই বিশুদ্ধতম। পরাশরের সময় এই ব্রাহ্মণ্যবাদ কিছুটা ঢিলেঢালা। শঙ্করাচার্য সেই ক্ষত মেরামত করলেন। পরে মহাভারতের কালে এসে বিচিত্রবীর্যবিহনে সত্যবতীর নেওয়া পদক্ষেপের পাল্লায় পড়ে ব্রাহ্মণ্য রক্তশুদ্ধতার বিষয়টা গোল্লায় গেল। তবে সে ইতিহাস পড়ার ধৈর্য অধুনা নাগপুরমুখী কমলা হিন্দুদের নেই, তাঁরা মনু আঁকড়েই মৌলবাদী লম্ফঝম্প করছেন।
ইসলামি মৌলবাদের প্রেরণা হিসেবে আমরা দুটো বিষয়কে দায়ী করতে পারি। প্রথমত, ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপনের আহ্বান। দ্বিতীয়ত, সেটা বাস্তবায়িত করে তোলার কাজে জেহাদকে ব্যবহার করা। হাসান-অল-বান্না ১৯২৮ সালে মিশরে অল-ইখওয়ান অল-মুসলিমিন তথা মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেন। বান্না নিহত হলে ব্রাদারহুডের নেতা হন সৈয়দ কুতুব। অন্যদিকে মৌলানা আবুল-আলা-মওদুদি লাহোরে ১৯৪১ সালে স্থাপন করলেন জামায়েত-ই-ইসলামি। উদ্দেশ্য ইসলামের মর্যাদা রক্ষা। কিন্তু কালক্রমে এইসব প্রতিষ্ঠানের শাখাগুলিই কুরান, হাদিস ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা নিয়ে তর্যা করে জন্ম দিল কিছু স্বেচ্ছাকল্পিত উগ্র ইসলাম-সৈনিক সংগঠনের। সংবাদমাধ্যমের দৌলতে আমরা এই আউটফিটগুলোর নাম জানছি অহরহ, জানছি তাঁদের উৎকট রক্ততৃষ্ণার ফলাফল। আল্লার নামে আল্লার সৃষ্টি এফোঁড়-ওফোঁড় করে চলেছেন তাঁরা। একই কাজ নাম পাল্টে চলছে গাজা থেকে গুজরাতে। অলমাইটি-জেসাস-ভগবান-আল্লার বাণী লেখা এক একটা বই ঝোলায় পুরে মৌলবাদী চাগাড় দিয়ে রাষ্ট্র-জাতির সংগঠনগুলো সাম্য-বিজ্ঞান-যুক্তি-সহিষ্ণুতার র্যাশনাল অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে ক্রমাগত দেওয়াল ধরিয়ে দিচ্ছেন। বহুত্বকে অস্বীকার করে কেবল নিজের বিশ্বাসের একমাত্রিক সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সামাজিক প্রতিমার ওপরের নান্দনিক ছাল ছাড়িয়ে ভিতরের বিশ্রী বাঁশ-খড় বের করছেন। সংসারে সহিষ্ণুতার মৃত্যু ঘটছে। দরিদ্রের পেটে ভাত নেই, চাল ফুটো প্রকৃতি। কিন্তু মৌলবাদের নেশা লেগে যাওয়া জাতি-রাষ্ট্রের হুঁশ ফিরছে না। বাজেট রণসম্ভার কেনায় উৎসর্গীকৃত। মৌলবাদের বিপদ অনুধাবন না করে জাতিবাদকে তোল্লাই দিচ্ছেন। বুঝতে পারছেন না জাতিবাদী মানুষগুলোকে তোল্লাই দেওয়া সব সময়েই বিপদজনক, কারণ ওঁদের সংগ্রহে একটাই বই থাকে এবং যেটা ওঁরা পড়েন না। কিন্তু আমাদের মধ্যে তো এমন মানুষও আছেন, যাঁরা ওঁদের চিনতে পারছি। বুঝতে পারছি মৌলবাদ আসলেই একটা খাদ, এখানে পড়লে উদ্ধার পাওয়া মুশকিল। রাষ্ট্র পরিচালনায় মৌলবাদী অভিপ্রায়গুলোও বুঝতে পারছি। কিছু মানুষ অবশ্যই আছি যাঁরা জানি সেকুলার মানে শুধু ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ নয়। সেকুলার মানে ধর্মদ্বেষী নয়, ঈশ্বর বা ধর্মে অবিশ্বাসী নয়। সেকুলার মানে তাঁরা, যাঁরা ধর্মে বিশ্বাস রাখতেও পারেন, না-ও পারেন, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় ও যাপনে ধর্মটা কোনও আবশ্যিক ব্যাপার নয়– সেইটা বিশ্বাস করেন। সেটাই তো হওয়া উচিত! বলুক ওরা সেকু, বলুক দেশদ্রোহী, বলুক গান্ডে-পিন্ডে দেশের খাচ্ছি, বলুক নজরুল ভুল, বলুক কীসের কুসুম, তবু আমরা ওদের থামাব। থামাতেই হবে ওদের রক্তপিপাসা আর যুদ্ধজিগিরের মৌলবাদী উসকানি। না হলে ইতিহাসের আয়নায় মুখ দেখাতে পারব না যে!
খেলিফের প্রতি নেটিজেনের বিরুদ্ধতার কারণ তাই, আর যাই হোক, তা ‘মেয়েদের সমানাধিকারের’ দাবিতে নয়। সমস্যা অবশ্যই খেলিফের লম্বা, পেটানো পেশিবহুল চেহারা– যা বহু মানুষের মতে ‘নারীসুলভ’ নয়। অর্থাৎ, অলিম্পিক খেলার যোগ্যতা অর্জন করা ক্রীড়াবিদ পাশ করতে পারেননি আমাদের বিউটি প্যাজেন্টে। দুইক্ষেত্রেই লজ্জা আমাদের। তবুও খেলিফ জিতলেন, সোনা ছাড়া আর কীই বা পেতে পারতেন তিনি?