
যে সমকামী দাম্পত্যের সম্ভব-অসম্ভব, আইন-বেআইন, যুক্তি-অপযুক্তি, উচিত-অনুচিত নিয়ে তাবড় সমস্ত তথাকথিত শিক্ষিত পরিমণ্ডলেও তরজার শেষ নেই, সেখানে এমন একটা যুগান্তকারী ঘটনা তারা ঘটিয়ে ফেলছে স্রেফ আর পাঁচটা নিত্যনৈমিত্তিক কাজ করার মতো করে, যেন এমন কিছুই হয়নি! এই আশ্চর্য স্বাভাবিকতা, এই ঈর্ষণীয় উত্তাপহীনতা, এই অভূতপূর্ব অবিস্ময় তাঁরা কীভাবে রপ্ত করলেন? আসলে রপ্ত করতে হয়নি তাঁদের। এই অভিঘাতগুলোর সঙ্গেই হয়তো সাধারণ জীবনের নিত্য ওঠাবসা, যাকে আমরা ছুঁয়ে দেখতে ভুলেই গিয়েছি প্রতিনিয়ত আদবকায়দা বেচে খাওয়ার বাজারে।
হঠাৎ একটা খবর ভেসে উঠল আপাতত নিস্তরঙ্গ সোশাল মিডিয়ার জলহাওয়ায়। ঘূর্ণি তুলে দেওয়ার সব উপাদান ছিল তাতে, ছিল ভেতো দুপুরে পাতের পাশে আঁশটে গন্ধ জোগান দিয়ে স্বঘোষিত লালচোখো বিচারসভা বসিয়ে দেওয়ার যাবতীয় উপকরণ। তবু সবার হাঁ-মুখ খোলাই রয়ে গেল, চিৎকার বের হওয়ার আগেই তাতে এসে জড়ো হল এমন বিস্ময়, যা হজম করা কঠিন!
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ঘটনা। দুই তরুণী সামাজিক বিয়েতে আবদ্ধ হলেন। এই অবধি শুনে বা পড়েই একটা টালমাটাল শোরগোলময় টানাপোড়েনের ছবি হয়তো ভেসে উঠছিল সবার মনেই। নিশ্চয়ই বাড়িতে কেউ মেনে নিচ্ছে না, পাড়ায় ঢি-ঢি পড়ে যাচ্ছে, গ্রামময় ছিছিক্কারের ধুলো উড়ে এসে পাক খাচ্ছে চায়ের ঠেক থেকে শুরু করে মুদি দোকানের নড়বড়ে বেঞ্চ পর্যন্ত! নিশ্চয়ই বহুদিন ধরে লুকিয়ে দেখাসাক্ষাৎ করত, ধরা পড়েছে, নিশ্চয়ই সালিশি সভা বসেছে, পালানোর মতলব করেছে হয়তো অনেকবার, একসঙ্গে আত্মহত্যার চেষ্টাও হয়তো আর বাকি নেই, শেষে নিশ্চয়ই জোর করেই বিয়ে করতে বসেছে ওরা! সবাই নিশ্চয়ই যা-তা বলছে ওদের! অশ্লীল বিশেষণ আর চোরাগোপ্তা আক্রমণের ধারালো কোপ থেকে একটা রক্তপাতও নিশ্চয়ই বাদ যাচ্ছে না! আবারও সেই এক সমকামী যুগলের সামাজিক যুদ্ধের হারজিতের মার্কশিট খোলা হচ্ছে গণমাধ্যমের পাতায়, একথা বোধহয় অজান্তেই ধরে নিয়েছিল সবাই। অমীমাংসিত আইনের কাঁটাতারের দু’-পাশে অস্বচ্ছ কুয়াশা তৈরি করে রাখা দড়ির দু’-প্রান্ত ধরে অচিরেই তরজায় মেতে ওঠার যাবতীয় সম্ভাবনা ভেবে চোখ চকচক জিভ লকলক করে উঠেছিল সামাজিক জেঠুদের।

কিন্তু সমস্ত প্রস্তুতিতে জল ঢেলে দিলেন ওঁরা। ওঁরা মানে শুধু মন্দিরবাজারের রিয়া সর্দার কিংবা বকুলতলার রাখী নস্কর নন, তাঁদের ঘিরে দাঁড়িয়ে-পড়া সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের সেই বাসিন্দারাও, যাঁরা একটুও পা ফেললেন না হিসেব মিলিয়ে। সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় ধরা পড়া বিয়ের ভিডিওগুলো দেখছিলাম খুঁজে খুঁজে। নিভু-নিভু, তেলতেলে মুখচোখে অভিনব একটা কিছুর সাক্ষী থাকার বিস্ময় এড়ানোর কোনও মেকি প্রচেষ্টা একটুও নেই। আমার খুঁতখুঁতে, ছিদ্রান্বেষী মন। ভাবছিলাম, ওরা সবাই কি সত্যি এতটাই প্রগতিশীল? সত্যিই নিজেদের উদ্যোগে ওরা এই মেয়েদু’টির বিয়ের আয়োজন করেছে? তাও একবার কোন একটা শান্তি সঙ্ঘ ক্লাব থেকে? কৌতূহল জাগছিল ভীষণ। ক্যামেরার পিছনে থাকা সাংবাদিকের প্রশ্ন শুনে নিশ্চিন্ত হলাম। খানিকটা খুশিও। তিনি প্রশ্ন করছেন, ‘এইরকম আগে কখনও দেখেছেন?’ নড়েচড়ে বসলাম। প্রশ্ন আসছে পরপর, ‘মেয়েতে মেয়েতে এরকম বিয়ে হয়?’ এই তো, ঠিক দিকেই এগোচ্ছে ব্যাপারটা। আর একটু নাড়া পড়লেই বেরিয়ে আসবে আসল গল্প। আমি আগ্রহী আরও। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার। এক বৃদ্ধা, নাম বললেন লক্ষ্মী মিস্ত্রি। খুব সাধারণ গ্রাম্য চালে উত্তর দিচ্ছেন, ‘ওরা বলল, বিয়ে করবে। আমরা শান্তি সঙ্ঘ মন্দিরে বিয়ে দিয়েছি।’ এবার ক্যামেরা ঘুরছে ক্লাব সদস্যের দিকে, নাম তাঁর জলধর মণ্ডল। তিনি বলছেন, ‘এমন বিয়ে মোবাইলে দেখেছি। বাস্তবে এই প্রথম দেখলাম।’ আমি অপেক্ষা করছি, এই এবার নিশ্চয়ই উঠে আসবে সেইসব অমোঘ বাক্যবাণ– ‘জীবনে কখনও যা দেখিনি…’ ‘এমন কত কিছুই যে আরও দেখতে হবে…’ ‘এসবের দরকারটা কী বুঝি না…’ ‘এমন তো আগে কখনও হয়নি, তাহলে এখন কীসের দরকারটা পড়ছে বুঝি না…’ ইত্যাদি। ভদ্রলোক আরও একবার কেটে কেটে বললেন, ‘এর আগে এমন বিয়ে হয়নি।’ কিন্তু তার পরেই তাঁর চোখ যেন জ্বলজ্বল করে উঠল, বললেন, ‘আমরা ক্লাবের ছেলেরাই সহায়তা করে বিয়েটা দিচ্ছি। এমন আগে কোনও দিন হয়নি।’ আমি তো অবাক! এটা তো চিরাচরিত স্ক্রিপ্টে কোথাও ছিল না! যা কোনও দিন হয়নি, তা হইয়ে দিতে পারার চকচকে গর্বে তো ভরে উঠছে জলধর মণ্ডলের মুখ!
এখানেই কষিয়ে সপাট একটা থাপ্পড় এসে পড়ল এই এলিট, তত্ত্বপ্রিয়, অ্যাকটিভিজমকেন্দ্রিক, কাগুজে সচেতনতার মুখে। আমরা আদতে যাদের ‘শিক্ষিত’ করার, ‘সচেতন’ করার, ‘সংবেদনশীল’ করার, ‘লিবারাল’ করার স্বঘোষিত দায়িত্ব পেয়ে জীবন বর্তে দিয়েছি, তারাই যখন আমাদের বিচারপ্রবণ মনের সামনে দিয়ে তুড়ি মেরে একটা সহজ সমাধান নিয়ে বেরিয়ে যায়, আমরা কি আদৌ হজম করতে পারি? আজ যদি এই গ্রামের মেয়ে দুটো পাড়াপড়শির থেকে নিয়মিত কটূক্তি, নিন্দেমন্দ সহ্য করত, উঠতে বসতে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে যেত কেচ্ছাগল্পের ঠেলায়, সোশাল বয়কটের মুখোমুখি হয়ে তাদের যদি আর পালানোর পথ না থাকত, তখন হয়তো শহুরে বুদ্ধিজীবীরা মসিহার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। তাতে কাজের কাজ কতদূর হত জানি না, কিন্তু সমাজমাধ্যমে প্রচুর সহানুভূতির আহা-উহু আর জ্ঞানগর্ভ সমাজ-মানসিকতা বদলানোর বাণী প্রচার করে ‘আমরা’ যে ‘ওদের’ চেয়ে আলাদা, এইটুকু অন্তত নিশ্চিত করা যেত মন দিয়ে। কোথায় কোন সুন্দরবনের কাছে নোনামাটির গ্রাম, পালিশ-করা আলোর ছোপ যেখানে দূরের দিল্লি, গ্রামকে গ্রাম যেখানে এখনও শহুরে প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্পোরেট সোশাল রেসপনসিবিলিটির আওতায় আসার জন্য মাথা কুটে মরে, তারা কীভাবে এত স্বাভাবিক কায়দায় এত বড় একটা ঘটনা নিয়ে কথা বলছে, যেন কিছুই হয়নি?

গোটা খবরটার মধ্যে সবচেয়ে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে ঠিক এই জায়গাটাই। যে সমকামী দাম্পত্যের সম্ভব-অসম্ভব, আইন-বেআইন, যুক্তি-অপযুক্তি, উচিত-অনুচিত নিয়ে তাবড় সমস্ত তথাকথিত শিক্ষিত পরিমণ্ডলেও তরজার শেষ নেই, সেখানে এমন একটা যুগান্তকারী ঘটনা তারা ঘটিয়ে ফেলছে স্রেফ আর পাঁচটা নিত্যনৈমিত্তিক কাজ করার মতো করে, যেন এমন কিছুই হয়নি! এই আশ্চর্য স্বাভাবিকতা, এই ঈর্ষণীয় উত্তাপহীনতা, এই অভূতপূর্ব অবিস্ময় তাঁরা কীভাবে রপ্ত করলেন? আসলে রপ্ত করতে হয়নি তাঁদের। এই অভিঘাতগুলোর সঙ্গেই হয়তো সাধারণ জীবনের নিত্য ওঠাবসা, যাকে আমরা ছুঁয়ে দেখতে ভুলেই গিয়েছি প্রতিনিয়ত আদবকায়দা বেচে খাওয়ার বাজারে।
গোলমালটা রয়ে গিয়েছে আমাদেরই সামাজিক শিক্ষাপদ্ধতির মধ্যে। মানুষ গড়তে গিয়ে আমরা প্রথমেই তাকে বেঁধে ফেলতে থাকি অনেকগুলো না-এর মধ্যে। শিক্ষিত উচ্চমন্য পরিবেশের উপযোগী করে গড়ে তুলতে গিয়ে এক-একটা কাদার তালকে আমরা বারবার ভাঙতে থাকি, পছন্দসই আকৃতির খোপে পুরতে চেয়ে। হাঁটা-চলা-বসা-দাঁড়ানো-কথা বলা-প্রশ্ন করা-আপত্তি জানানোর নিক্তিমাপ শেখাতে থাকি প্রতিনিয়ত। একটা সময় পর্যন্ত চলতে থাকে এই শাসনের বেড়ি পরিয়ে তোতাপাখি শিক্ষিত করার ‘টাস্ক’। অধিকাংশের মগজ তাতেই ধোলাই হয়ে ছাঁচে-ঢালা পছন্দসই অবয়ব বেরিয়ে আসে। আর এরপরেও যাদের একটু নিজস্ব বোধবুদ্ধি বা মৌলিক বাঁচার ইচ্ছে তলানি হয়ে পড়ে থাকে, তাদের আমরা একেবারে চিহ্নিত করে দিই ‘প্রতিবাদী’ নামে, তারা সব বিপজ্জনক, প্রশ্ন করার দলে। আমাদের সমাজে পরিষ্কার দুটো ভাগ রয়ে যায়– একদল নিরীহ, নির্বিবাদী, গতানুগতিক চর্বিতচর্বণের বাইরে পা রেখে কখনও সমাজকে বিপদে ফেলে না। আর অন্য দলটা ছোট, তাদের বেগড়বাঁই করাই স্বভাব, তাদের কখনও ভয় দেখিয়ে, কখনও একটু ল্যাবেঞ্চুষ দিয়ে, কিংবা বেশিরভাগ সময় তাদের নাকের ডগায় খুড়োর কল ঝুলিয়ে দিয়ে শান্ত রাখা হয়।

কিন্তু মানুষ তো দিনের শেষে সামাজিক জীব! অন্তত যাবতীয় সমাজবিদ্যার বই একেবারে গোড়ায় দাঁড়িয়ে এই কথাটাই বলে! এই সহজ স্বাভাবিক ছন্দোবদ্ধতাকে যেখানে জোর করে ক্ষুণ্ণ করার প্রচেষ্টা যত কম, সেখানেই মানুষের প্রতিটি চাওয়া-পাওয়ার আসল দাম মেলে। শহরের বুকে যদি এই দু’টি মেয়ে পরস্পরকে বিয়ে করতে চেয়ে নিজেদের পরিবার থেকে বিতাড়িত হত, সত্যি করে বলুন তো, পাশের বাড়ির অসুখের খোঁজ পর্যন্ত না-রাখা এই ঘোর বৈষয়িক শহরের বুকে তাতে কার কী আসত যেত? মন্দিরবাজারের এই গ্রামের মানুষগুলোর জীবনের কী মোক্ষলাভ হবে এই বিয়েটা দিতে পেরে? কিন্তু এদের ভাবনার গতি অদ্ভুত সহজ। গ্রামেরই দু’টি মেয়ে সমস্যার মুখোমুখি, তারা যা চাইছে, তা দিতে পারার মধ্যে কোথাও কারওর একতিল ক্ষতি নেই। সুতরাং বিষয়টা দায়িত্ব নিয়ে মিটিয়ে ফেলা যাক। শুধু এবং শুধুমাত্র এই ভাবনাটুকু থেকেই এগিয়ে এসেছেন তাঁরা। কারওর কোনও নেতা হওয়ার বাসনা নেই, জনশিক্ষা প্রচার করে খ্যাতি পাওয়ার মোহ নেই। এর জন্য তাঁদের সভা, সমিতি, আন্দোলন, মিছিল, জনসভা, পথসভা, প্রতিবাদী মঞ্চ, সচেতনতা শিবির– কিছুই করতে হয়নি। এতটাই সোজা এবং সরল হিসেবে মিলে গিয়েছে এখানে।

বিয়ের ছবিগুলোতে তাঁরা ভরে আছেন সর্বত্র। হাতে-হাতে মালা এগিয়ে দিচ্ছেন কেউ, টি-শার্টের ওপরে শাড়ি জড়িয়ে বিয়েতে বসে-পড়া কনের গলার মালা ঠিক করে দিচ্ছেন হাত বাড়িয়ে, কেউ বা বরবেশী মেয়েটির মাথায় বসিয়ে দিচ্ছেন টোপর, অত্যুৎসাহী কেউ কেউ আবার মোবাইলের ক্যামেরা চালিয়ে ছবি তুলে রাখছেন মহানন্দে। ফুলে, মালায়, আলোয়, ভিড়ে, হাসিমুখে কোথাও এতটুকু বেসুর বাজছে না তো! সবই যেন কী স্বাভাবিক, কী সচরাচর, কী অভ্যস্ত, কী সাধারণ! এই আশ্চর্য স্বাভাবিকতা আমাদের কাছে অস্বস্তিকর হয়ে উঠতেই পারে, কিন্তু এই স্বাভাবিকতা তাঁদের অর্জন। অভ্যাস কিংবা অনুশীলন দিয়ে একে রপ্ত করা যায় না। আর এই অস্বস্তির যে কাঁটাটুকু বাকিদের মনে খচখচ করছে, সেটাই এবার ফিরতি প্রশ্নের আকারে নিজেদের দিকে ঘুরে আসার পালা। এই স্বাভাবিকতা যদি অস্বাভাবিক ঠেকে, তাহলে কার শিক্ষার মধ্যে খামতি রয়ে গেল? যা ওরা পারল এত সহজেই, তা আমরা কেন পারলাম না? সিঁড়ি ভাঙাটা কঠিন, নাকি সমস্যাটা আমাদের চলার পদ্ধতিতেই?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved