গণপিটুনির পিছনে যে জনগণ থাকে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আমরা তেমন খোঁজখবর করি না। আর করবই বা কীভাবে, বিপুল জনসংখ্যার যে দেশে দু’বেলা খেয়ে পরে থাকাটাই সমস্যার, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবাটা সেখানে বিলাস মাত্র। কিন্তু বারবার আমরা দেখেছি খুনি ও ধর্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা আছে। তার সঙ্গে সমাজের অতিরিক্ত অস্থিরতা, বৈষম্য, বেকারত্ব, এক নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে। এই সব কিছুর ফলাফলে একটা প্রতিহিংসার আক্রোশের বোধ তৈরি হচ্ছে। যে নীতিনৈতিকতা দিয়ে মানুষ তাকে প্রশমিত করে রাখত সেটিও ভোগবাদের দুনিয়ায় নড়বড়ে। প্রকৃত অর্থেই জনগণ দিশাহারা।
প্রচ্ছদ: দীপঙ্কর ভৌমিক
যে কোনও শুরুর শুরু থাকে। মার দিয়ে যে জীবনের শিক্ষা শুরু হয়, সেই হিংসা প্রবাহিত হতে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। কেউ কেউ বলেন আগেকার দিনের কড়া শিক্ষকরা ছিলেন প্রকৃত সংশোধনকারী। তাঁদের বেতের ভয়ে ত্যাঁদোড় বাঁশ নুয়ে যেত। এমন শিক্ষকদের অভাবেই নাকি অধুনা সমাজে নির্ভীক ছাত্রদের দাপাদাপি। কিন্তু এই যুক্তিতে পৃথিবীর সব কারাগারের কয়েদিদের সাধু হয়ে ফিরে আসার কথা। থার্ড ডিগ্রির পরে তো তাদের হিমালয়ের উদাসীবাবা হয়ে যাওয়া উচিত! আমাদের চিরকালীন রবীন্দ্রনাথ এই বিষয়ে আমার চিরপ্রণম্য। তাঁর ‘ছাত্রের পরীক্ষা’-য় কথোপকথনে দেখি–
‘মধুসূদন। আজ্ঞে, মারের চোটে খুব সিধে জিনিসও বেঁকে যায়।
অভিভাবক। কালাচাঁদবাবু, ওটা আপনার ভ্রম। মারপিট করে খুব অল্প কাজই হয়। কথা আছে গাধাকে পিটোলে ঘোড়া হয় না, কিন্তু অনেক সময়ে ঘোড়াকে পিটোলে গাধা হয়ে যায়। অধিকাংশ ছেলে শিখতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ মাস্টার শেখাতে পারে না। কিন্তু মার খেয়ে মরে ছেলেটাই।’
কোনও কিছু অন্যায়ের জন্য শারীরিক প্রহারই যে একমাত্র শাস্তি, এটি একবার মনে গেঁথে বসলে শান্ত মানুষটিও একেই একমাত্র অস্ত্র মনে করে। আপাত অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও কথাগুলি এল এই প্রসঙ্গে যে, ক্রমবর্ধমান হিংসা প্রতিদিন আমাদের বিস্মিত ও স্তম্ভিত করে দিচ্ছে। ক’দিন আগে বাংলাদেশে এক ভবঘুরেকে পেট ভরে ভাত খাইয়ে পিটিয়ে মারার ঘটনায় মানবতার মৃত্যু ঘটে গিয়েছে মনে হচ্ছে। ঘটনাটি ঘটিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। আর ক’দিন আগে যে দেশের ছাত্রদের নিয়ে আমরা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলাম! যা আমরা আফগানিস্তানে তালিবান শাসনে বা কিছু পরিমাণে পাকিস্তানেও দেখেছি, তারই যেন অনুকরণের একটা অন্ধ প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে সে দেশে।
মানুষ অন্যান্য প্রাণীর মতোই নিজের উদর পূরণের, আত্মরক্ষার বা পরিবার রক্ষার জন্য ঘাতক হয়ে উঠতে পারে। তখন তার সঙ্গে তুলনীয় জীবজগৎ। খাদ্যের জন্য একটি চিতাবাঘকে হরিণ শিকার করতে হয়। হস্তীযূথ তার নিরাপত্তার বিষয়ে সজাগ থাকে, প্রয়োজনে ভয়ানক আক্রমণ করে। এই অবধি সহনীয়। কিন্তু সম্পূর্ণ অকারণে হত্যা হিংসার আনন্দ পাওয়া মানে মনের বিনাশকাল উপস্থিত। আমাদের মনের ভিতর থাকা ঈর্ষা-হিংসা-দ্বেষ আমরা কিয়ৎ পরিমাণে শৃঙ্খলিত করে রাখি শিক্ষা ও যুক্তির শৃঙ্খলে। একেবারে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় গলদ থাকলে সমস্যা শুরু হয়। আমাদের বিপুল বিত্তহীন, পরিষেবাহীন মানুষের দল শৈশব থেকে মানুষের মতো বেঁচে ওঠার কোনও পরিবেশ পায় না। ধনী-দরিদ্রের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য দেখে তাদের আক্রোশ বাড়ে। এমনিতেই বসের অপমান বাড়ি এসে বউকে ফিরিয়ে দেয় স্বামী, বউ সেটি ফিরিয়ে দেয় বাড়ির কাজের মেয়েটিকে। অত্যাচারিত শ্রমিকের হাতে অত্যাচারিত হয় তার ওপর নির্ভরশীল পরিবার।
ক্রোধ-হিংসার এই প্রবহমান ধারা স্তিমিত হতে পারে সমাজে স্থিতাবস্থা থাকলে, দুর্নীতি কম থাকলে। সর্বোপরি রাষ্ট্রের তরফে কৌশলে ধর্মের নামে হানাহানিতে ইন্ধন না জোগালে। বাংলাদেশের ঘটনার পাশে আমাদের কোরপান শায়ের কথা ভুলে গেলে চলবে না। ভুললে চলবে না গর্ভিনী হস্তীকে সর্বসমক্ষে বর্ষা মশালে গেঁথে মেরে ফেলার ঘটনা। আর মারল কে? বনদপ্তরের অস্থায়ী কর্মীদের হুলা পার্টি। নিন্দুকে বলল, এই যথাযথ প্রশিক্ষণহীন হুলা পার্টি, মানে যাদের হাতি তাড়ানোর কথা– তারা ওই সিভিক ভলেন্টিয়ারের মতো স্থানীয় নেতাদের স্নেহধন্য। এটাই তাদের কাজ পাওয়ার যোগ্যতা। ফল যা হওয়ার তা হল।
মব লিঞ্চিং-এ প্রতিবেশী দেশকে সমালোচনা করার আগে নিজেদের দিকেও তাকানো দরকার। অপহরণকারী বা চোর সন্দেহে মারার সঙ্গে সঙ্গে গোরক্ষকদের হাতে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। আকছার শোনা যাচ্ছে, কোনও একটি গ্রামের বাসিন্দারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং সামাজিকভাবে নিম্নবর্ণ হিসেবে বিবেচিত গোষ্ঠীর সদস্যদের আটক করছে, দলবদ্ধভাবে পিটিয়ে মারছে। তাঁদের গোমাংস ভোজন করতে দেখছে এমনটাও নয়, স্রেফ হয়তো তখন তাঁরা লরিতে মহিষ বা বাছুর তোলার চেষ্টা করছিলেন মাত্র! যদিও ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় গণপিটুনিতে খুনের সাজা হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড তো বটেই, মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। প্রথমবারের মতো গণপিটুনি এবং বিদ্বেষপূর্ণ অপরাধে হত্যার ঘটনাকে একটি পৃথক বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জাতি, বর্ণ, সম্প্রদায় বা ব্যক্তিগত বিশ্বাসের মতো কারণের ওপর ভিত্তি করে পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির একটি হত্যার ঘটনা প্রমাণিত হলে চরম শাস্তি ঘোষিত হবে। কিন্তু আইনের নানা ফাঁকফোঁকরে আমরা জানি, অভিযুক্ত হওয়া আর প্রমাণাভাবে খালাস হয়ে যাওয়া– এই দু’টি এত বেশি দৃশ্যমান যে, শাস্তির ভরসা তেমন হয় না। চারদিন জেলের ভাত খেয়ে তার দু’দিন পর অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে জেলের বাইরে ফুলের মালার সংবর্ধনা পায়। অভিযোগকারী গ্রামছাড়া হয়, বলতে গেলে অপরাধীর আস্ফালনে জীবন ধ্বংস হয় তার।
……………………………………………………
প্রাণীজগতের শীর্ষস্থানে আমরা পৌঁছেছিলাম করুণা সহানুভূতি মানবতার কারণে। চর্চা করেই এই করুণা সহানুভূতির বোধ অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষ অনেকটা দূর অবধি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। জিম করবেট পশু হত্যাকারী থেকে পশু সংরক্ষণকারী হয়ে ওঠেন। বহু একদা শিকারি পরবর্তীকালে নিখাদ পশুপ্রেমী হয়েছেন। হাতের রক্ত তাদের উল্লাসিত না করে বিষণ্ণ করেছে। নিখুঁত লক্ষ্যভেদের বুলেট থমকে গিয়েছে হরিণীর মায়াবী চোখে।
……………………………………………………
গণপিটুনির পিছনে যে জনগণ থাকে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আমরা তেমন খোঁজখবর করি না। আর করবই বা কীভাবে, বিপুল জনসংখ্যার যে দেশে দু’বেলা খেয়ে পরে থাকাটাই সমস্যার, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবাটা সেখানে বিলাস মাত্র। কিন্তু বারবার আমরা দেখেছি খুনি ও ধর্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা আছে। তার সঙ্গে সমাজের অতিরিক্ত অস্থিরতা, বৈষম্য, বেকারত্ব, এক নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে। এই সব কিছুর ফলাফলে একটা প্রতিহিংসার আক্রোশের বোধ তৈরি হচ্ছে। যে নীতিনৈতিকতা দিয়ে মানুষ তাকে প্রশমিত করে রাখত সেটিও ভোগবাদের দুনিয়ায় নড়বড়ে। প্রকৃত অর্থেই জনগণ দিশাহারা। তার মধ্যে বিচারব্যবস্থার জটিলতা ঢিলেমি কখনও কখনও সেখানেও ন্যায় বিচার না পাওয়া জনগণকে হতাশ করছে। দীর্ঘদিন অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় পেতে দেখে সে সুযোগ পেলে আইন হাতে তুলে নিচ্ছে।
আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতাটি একটি রাষ্ট্রে নিরাপত্তার জন্য অতি বিপদজনক। আমাদের দ্বিচারিতা কখনও কখনও এগুলিকে সমর্থন করে। আমরা মনে মনে এনকাউন্টার বিশেষজ্ঞদের আদর্শের মর্যাদায় বসাই। হাতে গরম বিচার ও শাস্তি চাই। অথচ ভুলে যাই পদ্ধতি যদি এটাই হয়, তাহলে যেকোনও দিন কোনও কারণে রাষ্ট্রের আমাকে অপছন্দ হলে, আমার স্বাধীন মতো প্রকাশকে থ্রেট মনে করলে আমার দিকেও বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে।
প্রাণীজগতের শীর্ষস্থানে আমরা পৌঁছেছিলাম করুণা সহানুভূতি মানবতার কারণে। চর্চা করেই এই করুণা সহানুভূতির বোধ অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষ অনেকটা দূর অবধি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। জিম করবেট পশু হত্যাকারী থেকে পশু সংরক্ষণকারী হয়ে ওঠেন। বহু একদা শিকারি পরবর্তীকালে নিখাদ পশুপ্রেমী হয়েছেন। হাতের রক্ত তাদের উল্লাসিত না করে বিষণ্ণ করেছে। নিখুঁত লক্ষ্যভেদের বুলেট থমকে গিয়েছে হরিণীর মায়াবী চোখে।
……………………………………………
আরও পড়ুন শতাব্দী দাশ-এর লেখা: অন্ধ যে গণ মারে আর শুধু মরে
…………………………………………….
চোর সন্দেহে লাইট পোস্টে বেঁধে মারা এ আমার শৈশবেও ছিল। ধরা পড়া ছিঁচকে চোরের ওপর হাতের সুখ করে নিত এ-পাড়া ও-পাড়ার পুরুষেরা। বাড়ি ফিরে দ্বিপ্রাহরিক মাংসের ঝোল ভাতে মাখতে মাখতে বেশ হৃষ্ট মনেই গিন্নি ও পরিবারকে তারা এই গল্প করত। কিন্তু এখানে একটা সান্ত্বনা ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হত্যার দিকে এগোনোর আগে পুলিশের হস্তক্ষেপ ঘটত। তবে সময় যেমন ইতর হয়, মানুষের মনও নিম্নগামী হল। কিন্তু কেন আমরা এত হিংস্র হয়ে উঠলাম? কেন তাকে পিটিয়ে মারার আগে খেতে দিলাম? কী জানি, একেক সময় মনে হয়, পথের ধারে যে মাংসর দোকানের সামনে দিয়ে আমরা যাতায়াত করি আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি, সেখানেও কাটার আগে পাঁঠাকে কাঁঠাল পাতা খেতে দেওয়া হয়।
খরা, বন্যা, ধস, উষ্ণায়ন– আমাদের পাপেই প্রকৃতিও আজ সদা প্রতিকূল। পৃথিবী যেন ক্রমশঃ তার হৃদয়হীন শলাকা বিছিয়ে দিচ্ছে। তার ওপর শরশয্যায়, পিতামহ ভীষ্মের মতো আমরা অন্তিম প্রার্থনার জন্য অপেক্ষা করছি।
..……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………….
পারথে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম হার। প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৫০ রান করেও, ২৯৫ রানে জয় ভারতের। সেই জয়ের নেপথ্যে বুমরার অসামান্য বোলিং, বিরাটের ত্রিশতম টেস্ট সেঞ্চুরি ছাপিয়ে আলোচনায় বছর বাইশের যশস্বীর দুরন্ত পারফরম্যান্স। ক্রিকেট ও ক্রিকেটের বাইরে তাঁর অনমনীয় লড়াই নিয়ে দু’-চার কথা।
আজ যখন আমরা মার্কস ও এঙ্গেলসের বন্ধুত্বকে নতুন চোখে দেখে কমিউনিস্ট ইতিহাস রচনার কথা ভাবি, তখন একই সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নারীবাদী ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমাদের মেয়েদের এই বিপ্লবী কমরেডশিপের সম্ভাবনার, নারীবাদী বন্ধুত্বের রাজনীতির দিকেও নজর দিতে হবে।