বিতর্কের সূত্রপাত ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি নির্দেশিকা ঘিরে। যেখানে বলা হয়েছিল, রূপান্তরকামী, সমকামী পুরুষ ও মহিলা যৌনকর্মীরা রক্তদান করতে পারবেন না। কারণ হিসেবে বলা হয়, এঁদের রক্ত থেকে যৌনরোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা থেকে যায়। সমকামী পুরুষ অর্থে পুরুষের সঙ্গে পুরুষের যৌন সম্পর্ক স্থাপনের (এমএসএম) উল্লেখ করা হয়েছিল ওই নির্দেশিকায়। যা চ্যালেঞ্জ করে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন সমাজকর্মী তথা সাংবাদিক শরিফ ডি রঙ্গনেকার। তিনি দাবি করেন, সমকামী পুরুষ এবং রূপান্তরকামীদের নিয়ে প্রাচীন এবং অবাস্তব ধারণা থেকে এই নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে।
রক্তদান মানে জীবনদান। বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেলেও এর বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। পাশাপাশি, রক্তদান মানবিক ও সামাজিক কর্তব্যও বটে। এটা এমন একটা বিষয়, যার মাধ্যমে নানা ধরনের ভেদাভেদও মুছে ফেলা সম্ভব। মানুষে মানুষে বিভেদ ঘুচলে তৈরি হতে পারে উন্নত সমাজ।
শুধু ভারতেই প্রতি বছর রক্তের অভাবে প্রায় ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া বিভিন্ন অসুস্থতায়, অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জরুরি অবস্থায় রক্তের প্রয়োজন পড়ে। প্রতিটি সুস্থ ব্যক্তিই রক্ত দিতে পারেন। তবে যাঁদের রক্তের ক্যানসার, ডায়াবেটিস, করোনারি আর্টারি ডিজিজ, এইডস, হেপাটাইটিস-বি কিংবা সি রয়েছে, তাঁরা রক্ত দিতে পারেন না। রক্ত দিলে শরীরের অতিরিক্ত আয়রন দূর হয়, কমে হৃদরোগের মতো কার্ডিওভাস্কুলার রোগের ঝুঁকি। হেমাক্রোমাটোসিসের মতো বংশগত জিনগত রোগে আক্রান্ত হলে রক্তদানে উপকৃত হন। দেহে সুস্থ রক্তকণিকা তৈরি হয়। দাতাদের রক্তচাপ, হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ও কোলেস্টেরল স্ক্রিনিং হয়। ফলে কেউ অসুস্থ কি না, তার ছোটখাটো পরীক্ষাও হয়ে যায়।
কিন্তু বাস্তব তথ্য বলছে, স্বেচ্ছায় রক্তদানে পিছিয়ে রয়েছে বিশ্বের অর্ধেকের উপর দেশ। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১২ কোটি ব্যাগ রক্ত স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। তার অর্ধেকেরও বেশি আসে উচ্চ আয়ের দেশগুলো থেকে। অনুন্নত দেশ থেকে উন্নত দেশে স্বেচ্ছা রক্তদাতার সংখ্যা প্রায় ন’গুণ বেশি। মোটের ওপর ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। এই যখন অবস্থা, তখন সরকারি নির্দেশিকাতেই রক্তদানে শর্ত চাপিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরির যৌক্তিকতা কোথায়? এমন প্রশ্ন উঠছে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্নে, পদক্ষেপে।
বিতর্কের সূত্রপাত ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি নির্দেশিকা ঘিরে। যেখানে বলা হয়েছিল, রূপান্তরকামী, সমকামী পুরুষ ও মহিলা যৌনকর্মীরা রক্তদান করতে পারবেন না। কারণ হিসেবে বলা হয়, এঁদের রক্ত থেকে যৌনরোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা থেকে যায়। সমকামী পুরুষ অর্থে পুরুষের সঙ্গে পুরুষের যৌন সম্পর্ক স্থাপনের (এমএসএম) উল্লেখ করা হয়েছিল ওই নির্দেশিকায়। যা চ্যালেঞ্জ করে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন সমাজকর্মী তথা সাংবাদিক শরিফ ডি রঙ্গনেকার। তিনি দাবি করেন, সমকামী পুরুষ এবং রূপান্তরকামীদের নিয়ে প্রাচীন এবং অবাস্তব ধারণা থেকে এই নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। যার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তার প্রেক্ষিতে কেন্দ্রের জবাব চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। নোটিস দেওয়া হয়েছে ন্যাশনাল এইডস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন এবং ন্যাশনাল ব্লাড ট্রান্সফিউশন কাউন্সিলকেও।
প্রশ্ন হল, রূপান্তরকামী, সমকামী পুরুষ ও যৌনকর্মী হলেই তাঁদের রক্ত নিরাপদ নয়– এমন স্থিরসিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার কোনও বৈজ্ঞানিক কারণ আছে কি? এঁদের বাইরে প্রতি বছর যে লক্ষ লক্ষ দাতা রক্ত দিচ্ছেন, তাঁদের রক্ত নিরাপদ? তাঁদের কেউ অসুরক্ষিত যৌন সংসর্গ করেন না? কোনও সংক্রামক রোগে তাঁরা আক্রান্ত হতে পারেন না? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দিষ্ট সুপারিশ রয়েছে, দান করা রক্ত ব্যবহারের আগে সংক্রমণমুক্ত ও নিরাপদ কি না, স্ক্রিনিং করতে হবে। বিশেষ করে এইচআইভি, সিফিলিস, হেপাটাইটিস-বি এবং সি রয়েছে কি না, পরীক্ষা করতেই হবে। পাশাপাশি, ব্লাড ব্যাগও পরীক্ষা করা হয়। কাউকে রক্ত দেওয়ার আগে পরীক্ষা হয় ভেনেরিয়াল ডিজিজ (এসটিডি), রক্তের গ্রুপ। করা হয় ক্রস ম্যাচিংও। তাই যিনিই রক্তদান করুন না কেন, কাউকে তা দেওয়ার আগে সেটা নিরাপদ কি না, যাচাই করা অবশ্য কর্তব্য।
যদি তা না করা হয়, সেটা অমার্জনীয় অপরাধ। মানুষের জীবন নিয়ে খেলার শামিল। ওই নির্দেশিকা দিয়ে কেন্দ্র কি প্রকারান্তরে এটাই মেনে নিয়েছিল যে, সংগৃহীত রক্ত ট্রান্সফিউশন করার আগে যথাযথ পরীক্ষা করা হয় না? যদি তা-ই হয়, তাহলে তো দেশে রক্তদান কর্মসূচিই বড়সড় প্রশ্নের মুখে পড়ে যেতে বাধ্য।
…………………………………………………………….
রূপান্তরকামী, সমকামী পুরুষ ও যৌনকর্মী হলেই তাঁদের রক্ত নিরাপদ নয়– এমন স্থিরসিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার কোনও বৈজ্ঞানিক কারণ আছে কি? এঁদের বাইরে প্রতি বছর যে লক্ষ লক্ষ দাতা রক্ত দিচ্ছেন, তাঁদের রক্ত নিরাপদ? তাঁদের কেউ অসুরক্ষিত যৌন সংসর্গ করেন না? কোনও সংক্রামক রোগে তাঁরা আক্রান্ত হতে পারেন না? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দিষ্ট সুপারিশ রয়েছে, দান করা রক্ত ব্যবহারের আগে সংক্রমণমুক্ত ও নিরাপদ কি না, স্ক্রিনিং করতে হবে। বিশেষ করে এইচআইভি, সিফিলিস, হেপাটাইটিস-বি এবং সি রয়েছে কি না, পরীক্ষা করতেই হবে। পাশাপাশি, ব্লাড ব্যাগও পরীক্ষা করা হয়।
…………………………………………………………….
আর যদি সমস্ত নিয়ম মেনেই রক্ত সংবহন হয়, তাহলে ওই নির্দেশিকার কারণ কী? সেক্ষেত্রে কেন্দ্রের এই অবস্থানের কোনও যৌক্তিকতাই থাকতে পারে না। তাহলে বুঝতে হবে, প্রান্তিক যৌনতার জনগোষ্ঠী ও যৌনকর্মীদের প্রতি অসূয়া থেকেই এই নির্দেশিকার উৎপত্তি। যৌনতা ব্যক্তিনির্ভর এবং কখনও একরৈখিক হতে পারে না। সেটা যেমন সমাজের অন্যদের বুঝতে হবে, তেমনই বোঝা উচিত রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতায় থাকা কর্তাদেরও। এটা শুধু এ দেশে নয়, গোটা বিশ্বেই সত্য। আজও বহু দেশে সমকামিতা-রূপান্তরকামিতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু ভারতের মতো কল্যাণকামী রাষ্ট্রেও যৌন সংখ্যালঘুদের সঙ্গে বিমাতৃসুলভ আচরণ চলতে থাকবে! ২০১৮ সালেই ৩৭৭ ধারা বিলোপ করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। অর্থাৎ, সমকামী-উভকামী বা রূপান্তরকামীরা আইনের চোখে আর অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন না। কিন্তু সরকার তারপরেও তাঁদের অপাংক্তেয় করে রেখে দেয়। কোনও সদর্থক পদক্ষেপ করেনি। বরং সমলিঙ্গ বিয়ে, লিভ ইন এবং সন্তানপালনের অধিকার নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হলে প্রবল বিরোধিতা করে কেন্দ্র।
একইভাবে অবহেলিত যৌনকর্মীরাও। মৌলিক নানা সুবিধা-পরিষেবা থেকে তাঁরা বঞ্চিত। সামাজিকভাবেও কার্যত একঘরে। অথচ দুর্গাপুজোয় পতিতাপল্লি থেকে মাটি আনতে, ভোটের সময় তাঁদের সামনে করজোড়ে দাঁড়াতে অসুবিধা হয় না। তাঁরাও যে মানুষ, কাজ ফুরোলে সেটা ভুলে যাওয়াই দস্তুর। অক্লেশে তাঁদেরও সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার বার্তা কোনও সরকার যে দিতে পারে, ওই নির্দেশিকায় তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
………………………………………………………….
আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: মৃত ‘অপরাধ’ করিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই
………………………………………………………….
যে দলই সরকার গড়ুক না কেন, মনে রাখা উচিত যে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের কোণঠাসা করে রেখে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। ভারতে বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ বাস করেন। তাহলে কেন শুধু ভিন্ন যৌনতার জন্য মানুষকে ব্রাত্য করে রাখা হবে? একঘরে করে দেওয়া হবে একটা নির্দিষ্ট পেশার মানুষকে? রক্তদাতা বা দাত্রী সুস্থ কি না, তাঁর কোনও সংক্রমণ রয়েছে কি না, সেটাই বিবেচ্য হোক। তাঁর যৌন পরিচয় বা পেশা নয়।
কে জানে, একবিংশ শতকের উন্নয়নশীল দেশের সরকারের কাছে সেটুকু চাওয়াও হয়তো অলীক প্রত্যাশা।
………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………..
যথাসম্ভব নো মেকআপ লুক নিয়ে ফ্লোরে গিয়ে বসলাম আমার নির্দিষ্ট জায়গায়। তরুণ চক্রবর্তী ঢুকল। অন্যান্য দিন কুশল বিনিময় হয়, আজ কেবল স্তব্ধতা। শুরু করলাম অধিবেশন, চিরাচরিত হাসিটি আজ মুখে নেই। তারপরেই তরুণের মুখে উচ্চারিত হল প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নিহত হওয়ার সংবাদ। ঘোষিত হল রাষ্ট্রীয় শোক।
পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণির মানুষ বলতেন, ওঁরা তো ভোটে না জিতে নেতা হয়েছেন। হ্যাঁ, সীতারাম ইয়েচুরি কখনও ভোটে জিতে মন্ত্রী বিধায়ক হননি। তারপরও দলমত নির্বিশেষে যে গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা তিনি দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্জন করেছিলেন, সেটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।