স্বাধীনতার পর লেখক-কার্টুনিস্ট আর. কে. লক্ষ্মণ যখন খবরের কাগজে ‘কমন ম্যান’-কে হাজির করলেন, তখন সেই কান-খাড়া করা, ধুতি পরা, চেককাটা কোট পরিহিত প্রৌঢ়ত্বের সীমায় উপনীত মানুষটিকে দেখে পদদলিত শ্রমজীবী বলে মনে হয়নি, মনে হওয়ার কারণ নেই। দেখে মনে হয়েছিল সদ্য-স্বাধীন দেশের চাকরি করা আপাত বেচারি একজন পুরুষ, যিনি স্বাধীন দেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতির খবরাখবর রাখেন। সেই বিচিত্র সার্কাসের অলিন্দে অলিন্দে ঘোরেন, দেখেন, হাসেন, বিস্মিত হন কিন্তু রাগে ফেটে পড়েন না।
‘সাধারণ’ চার অক্ষরের শব্দ। এমনিতে আপাত নিরামিষ শান্ত একটা শব্দ, তবে জেগে উঠলে অন্যরকম। সাধারণ মানুষ আর পদদলিত মানুষ কি সমার্থক শব্দ? পদদলিতদের বোধহয় বলা যায় সাধারণের চেয়েও সাধারণ। অন্তত স্বাধীনতার পর লেখক-কার্টুনিস্ট আর. কে. লক্ষ্মণ যখন খবরের কাগজে ‘কমন ম্যান’-কে হাজির করলেন, তখন সেই কান-খাড়া করা, ধুতি পরা, চেককাটা কোট পরিহিত প্রৌঢ়ত্বের সীমায় উপনীত মানুষটিকে দেখে পদদলিত শ্রমজীবী বলে মনে হয়নি, মনে হওয়ার কারণ নেই। দেখে মনে হয়েছিল সদ্য-স্বাধীন দেশের চাকরি করা আপাত বেচারি একজন পুরুষ, যিনি স্বাধীন দেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতির খবরাখবর রাখেন। সেই বিচিত্র সার্কাসের অলিন্দে অলিন্দে ঘোরেন, দেখেন, হাসেন, বিস্মিত হন কিন্তু রাগে ফেটে পড়েন না। তিনি তো একা, সাধারণ– সব কিছুই দেখছেন, কিন্তু সহ-সাধারণদের সঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদে বিপ্লবে গলা ফাটাচ্ছেন না। কেউ তাঁকে ডেকে বলছেন না ‘শ্রমিক ঐক্য জিন্দাবাদ’, বলছেন না ‘জয় কিষান’, বলছেন না ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। তবু তিনি আছেন– রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন। শিকার যে হচ্ছেন তা বুঝতে পারছেন। যে বিষয়গুলি প্রত্যক্ষত শ্রেণিগতভাবে কিষান-মজদুরদের স্পর্শ করে না, এমন অনেক বিষয় যা এই চাকরি করা ভদ্র সাধারণকে প্রত্যক্ষত স্পর্শ করে, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকছেন লক্ষ্মণের সাধারণ মানুষ– একা, নিরুপায় কিন্তু সচেতন। খবরের কাগজের পাতায় সহ-সাধারণদের সচেতন করে দেওয়াই তাঁর কাজ। ইংরেজি ভাষা শিক্ষিত ভারতের সহ-সাধারণ ভদ্রলোকদের জন্যই তৈরি হয়েছিল এই কার্টুন।
সাধারণ ভদ্রলোক মানুষটি অবশ্য জানতেন তাঁর থেকেও বেচারা মর্মান্তিক দশায় বসবাস করা মানুষদের কথা। হাস্যমুখ নতুন মন্ত্রী হাতে নোটখাতা নিয়ে লিখছেন দারিদ্র, রোগ, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, খরা এই শব্দগুলি। তাঁর সামনে হতদরিদ্র দু’জন। পিছনে একপাশে ফাইল-বগলে আমলা, অন্য পাশে লক্ষ্মণের ‘কমন ম্যান’। রাজনৈতিক প্রহসনে এই হতদরিদ্র মানুষ আর চাকরি করা সাধারণ মানুষ যদি নানা না-পাওয়ার ঐক্যে এক হয়ে যেত! হাস্যমুখ রাজনৈতিক নেতাটি জানেন এক হতে দেওয়া যাবে না, এই অনৈক্যের ওপরেই তাঁর রাজনীতির কারবার দাঁড়িয়ে আছে। মন্ত্রীমশাই নাকি নতুন মন্ত্রী হয়েছেন। তিনি দেশ চেনেন না। তাই দেশের সমস্যাগুলি নোট করে নিচ্ছেন। দেশ আর কে চেনে! ফরাসি বিপ্লবের আগে রানি বলেছিলেন ‘লেট দেম ইট কেক’।
একটি অফিসি-চিত্র। টেবলে মাথা দিয়ে অফিসের কর্তা ঘুমোচ্ছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশনামা পড়ে শোনানো হচ্ছে। অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদির জন্য বরখাস্ত করা হল। ‘না আপনাকে নয়।’ বড়কর্তার আর্দালিকে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে– তারই চাকরি যাবে। একজন লোক লাগে, দোষ চাপানোর। তাকে দোষ দিয়ে বিদ্ধ করলে আপাতত জনরোষ প্রশমিত হয়। যিনি আসলে এ সমস্ত অপকীর্তির জনক, তিনি যেমনটি ছিলেন তেমনটি থাকেন। কী চেনা চেনা লাগছে? আসলে এভাবেই তো কৌশলী ক্ষমতা চাঁদমারি ঠিক করে নিয়ে জনরোষকে প্রশমিত করে ক্ষমতা বজায় রাখে– চিরকাল। সরকারি অফিসের দেওয়ালে নোটিস লটকানো আছে। এখানে রাজনৈতিক আলোচনা নিষিদ্ধ। সামনে হাতাহাতির চিহ্ন। এক সহকর্মীর হাতে মার খেয়ে অন্য সহকর্মী মাটিতে। কর্তা এসেছেন অবস্থা সামাল দিতে। তখন দু’-পক্ষের জবাব ‘আমরা আবহাওয়া নিয়ে আলোচনা করছিলাম’।
রাজনৈতিক দলাদলির ঊর্ধ্বে উঠে একত্রিত হয়ে মানুষের জন্য মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সামর্থ আমাদের আর কবে ছিল! লক্ষ্ণণ বামপন্থীদের নিয়ে কৌতুক করতেন, যেমন করতেন দক্ষিণপন্থীদের নিয়ে। বামপন্থীরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন আমরা রাশিয়ার প্রতি অনুগত, চিনের প্রতিও, কিন্তু আমরা কবে ভারতের প্রতি অনুগত ছিলাম! বুঝতে অসুবিধে হয় না বাতাসে ভেসে যাওয়া শিক্ষিত সাধারণের প্রশ্নবাণ শিক্ষিত সাধারণের প্রতি ধাবমান। লক্ষ্মণের কাগুজে ছবি দূরদর্শনের পর্দায় ‘ওয়াগলে কে দুনিয়া’ হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছিল। শ্রীনিবাস ওয়াগলে আর রাধিকা ওয়াগলে-র জীবনকথা টিভির পর্দায় দেখতে দেখতে ভারতের সাধারণ ভদ্রলোকেরা নিজেদের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করতেন। সে আটের দশক, শেষদিক। ভুবনায়নের চাকা তখনও ঘুরতে শুরু করেনি।
এই যে সাধারণ ভদ্রলোক, তাঁরা কি কেবল এই সচেতন নিরুপায় হয়েই কাটিয়ে দেবেন? কোনও দিন রাগে ফেটে পড়বেন না! অন্য কোনও উপায়ে ঘটাবেন না অন্তর্ঘাত! নীরজ পান্ডের ছবি ‘A Wednesday’– ২০০৮ সালের। সময় বদলে গেছে। স্বাধীনতার পরের দশকে বা আটের দশকে যে চেহারায় ভদ্র সাধারণকে দেখা যাচ্ছিল, তার থেকে অন্য চেহারা। অন্তর্ঘাত ঘটানোর উপায় বাধ্য হয়ে বেছে নিচ্ছেন একজন ‘কমন ম্যান’– নাসিরুদ্দিন শাহ তাঁর শান্ত অথচ ক্রুদ্ধ দৃঢ় কৌশলে পুলিশ কমিশনারকে নাজেহাল করছেন। কমনম্যানের গলা এবার উঠেছে। নীরজ পান্ডের ছবিতে নাসিরুদ্দিন যা করেছিলেন সেরকম কাণ্ড অমিতাভ বচ্চনকে দিয়ে একাধিক ছবিতে করানো হচ্ছে। নিকটজন মারা গেছেন, সেই অপমৃত্যুর, হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ পিতা, আত্মজন অমিতাভ কোনও একটা কৌশলী উপায় বেছে নিচ্ছেন। এক সময়ের অ্যাংরি ইয়াং ম্যান অন্য সময়ে একক কমন ম্যান। লড়ছেন।
তবু চিন্তাটা পাক খায়। একা সাধারণ মানুষ নন, দলবদ্ধ সাধারণ মানুষ। ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানো সাধারণ মানুষের দল। ফরাসি বিপ্লবে থার্ড এস্টেটের আয়তন ছিল বিপুল। নানা মানুষের সমাহার। সেখানে শিক্ষিত মানুষজন, যাঁরা থার্ড এস্টেটের বাসিন্দা, তাঁরা সকলের সঙ্গে মিলেমিশে ওপরের দুই এস্টেটের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন তৈরি করেছিলেন। মারকাটের প্রতিহিংসার সেই রক্তক্ষয়ী ভয়ংকর রূপ অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। উদ্দেশ্য আর উপায় দুয়ের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ফরাসি বিপ্লবের নির্বিচার রক্তক্ষয়কে সমর্থন করতেন না। তবে ইতিহাস নির্মম, ইতিহাস শিক্ষাদায়িনী– তাই হয়তো লক্ষ্মণের সাধারণ মানুষের চরিত্র বদলে বদলে যায়। রাজনৈতিক সার্কাসের কর্মীবৃন্দ সবসময় বুঝতে পারেন না সাধারণ জেগে উঠলে অসাধারণ, জোটবদ্ধ অসাধারণ।
.……………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
………………………………………………………