Robbar

অনিরুদ্ধ লাহিড়ীর কাছ থেকে ঘুরে এলে একরকম সমুদ্রবোধ নিয়ে কলকাতার রাস্তায় হাঁটা যেত

Published by: Robbar Digital
  • Posted:February 1, 2025 4:30 pm
  • Updated:February 1, 2025 4:30 pm  

অনিরুদ্ধ লাহিড়ী এই শহরের অনেক বড় বড় মাস্টারমশাইদের মাস্টারমশাই ছিলেন। সাউথ পয়েন্ট স্কুলের জন্মলগ্ন থেকেই বারকয়েক ইস্তফা এবং পুনর্যোগদানে ওঁর কর্মজীবন ছিল বিচিত্র। আশি বছর বয়সেও আত্মরক্ষার্থে তাঁকে টিউশন করতে হত এই হতভাগ্য দেশে। তাঁর শিক্ষকতার শুরু হতে পারত ক্লাস ফাইভ কিংবা আরও তলা থেকে, শেষ হত পিএইচডি কিংবা কলেজ শিক্ষক পর্যন্ত। সেই ছাত্রদের কারেকশন করা খাতা যদি আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষকমশাইরা দেখেন, বেশিরভাগই বৃত্তিবদল করবেন। প্রতিটি লাইনে এক লাইন করে ছাড় দিয়ে লেখা খাতায় যার যেমন নিজস্বতা, সেই মতো বাক্যনির্মাণ শেখাতেন মাস্টারমশাই।

সুমন্ত মুখোপাধ্যায়

চারপাশে বেশ একটা মাতুনি সবসময়ই টের পাওয়া যায় আজকাল। এই শীতকালটা, পাতা ঝরার সময় শুধু নয়, আমাদের বাংলা সংস্কৃতিরও সময়। টুনিলাইটের সংস্কৃতি। এদিকে একটা লংমার্চ চলছে, লোভী আর  মঞ্চপাগলের মিছিল। অনেক দিন ধরেই বাংলার ‘মহাসংস্কৃতি’ বলতে এইটেকেই বোঝায়। এসবের বাইরে, নিজেদের চৈতন্যের দর্পণ ক্রমাগত মাজা-ঘষা করে হাতেগোনা নিমগ্ন যে ক’জন রয়ে গিয়েছিলেন, যাঁদের কাছ থেকে ঘুরে এলে, একরকম সমুদ্রবোধ নিয়ে কলকাতার রাস্তায় হাঁটা যেত, একা একা– সেইরকম অনুভূতি থেকে হঠাৎ এক ধাক্কায় যেন অনেকটা দূরে চলে গেলাম। 

স্বগৃহে অনিরুদ্ধ লাহিড়ী

প্রায় ৮৪ বছর বয়সে পড়ার ঘরের আলো জ্বালিয়ে রেখেই অনিরুদ্ধ লাহিড়ী চলে গেলেন (২৯.১.২০২৫)। এই শহরে দরজা-জানলা খোলা খুব বেশি বাড়ি আর রইল না। যেখানে নানা দিক থেকে হাওয়া বাতাস খেলে। ৮৪ বছর যথেষ্টই বয়স। কেউ চলে গেলেই, আমাদের স্বাভাবিক এই এক জিজ্ঞাসা আসে– কত বয়স হয়েছিল ওঁর? যেন মৃত্যুর অমোঘতাকে সময় দিয়ে সইয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু কিছু ক্ষতির সহ্যযুক্তি জীবনে বয়স জুড়ে হয় না। অনিরুদ্ধ লাহিড়ী সেই বিরল মানুষ, যাঁরা প্রতিদিনই পড়াশোনার মধ্য দিয়ে বয়সে জীবন জুড়ে নিতে জানতেন। তাঁর ডাকনাম ছিল– চাঁদ। বহু বিখ্যাত লেখক এবং শিল্পীর হাজিরা ছিল চাঁদের হাটে– অর্থাৎ, আড্ডায়। আর ছিল তাঁর নানা বয়সের ছাত্রছাত্রীদের অবাধ যাতায়াত। দেশে-বিদেশে তাঁরা ছড়িয়ে রয়েছেন কত অসংখ্য শেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে। সেইসব হয়তো একদিন শহর-পুরাণ হয়ে মুখে মুখে ঘুরবে। কিন্তু পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইদানীং লেখা প্রকাশের কথাও যে ভাবছিলেন তিনি আর এই দু’বছরেই বেরিয়েছিল তাঁর তিনটি নতুন বই, সে কথাটা ভাবলে মন বিকল হয়ে যায়। 

জানা অনেক সময় ভারাক্রান্ত করে। জানানোও তাই। অনিরুদ্ধ লাহিড়ীর লেখা ও ক্রমাগত মার্জনা-উত্তর প্রকাশের সেই রেওয়াজ আমরা অবাক হয়ে দেখেছিলাম। সেরকম উদাহরণ সমকালে খুব একটা খুঁজে পাওয়া  দুষ্কর। লেখা থেকে নিজের ‘আমি’টিকে যথাসম্ভব নির্ভার করে ধীর লয়ে সরিয়ে নেওয়ার এই ক্রিয়া, বেবল্গা আত্মপ্রচারের দিনে আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে চায়। কথাটা একটু খুলে বলা যাক। আজ থেকে ২০ বছর আগের এক বইমেলায় প্রকাশ পায় অনিরুদ্ধ লাহিড়ীর প্রথম বই– তত্ত্বতালাশ: কয়েকটি পঠন।  ওঁর তখন ৬৪ বছর বয়স। লেখাগুলি প্রায় বছর ৩০ সময় নিয়ে তৈরি হয়ে উঠেছিল নানা পত্রপত্রিকায়। সদ্য আত্মহননের দুর্ঘটনায় মৃতা পরমাত্মীয়াকে লেখক উৎসর্গ করেছিলেন গ্রন্থটি। উৎসর্গ পাতায় ছিল একটি গদ্যকবিতা, ওঁর ভাষায় ‘মত প্রণীত ঋ’। বইয়ের প্রবন্ধগুলির কোথাও কোথাও এইরকম আরও কিছু কবিতা যোজনায় সেই নির্মম মৃত্যশোকের প্রকাশ ছিল অবিরত। আর ছিল মস্ত একটি সাক্ষাৎকার।

Prothoma - তত্ত্বতালাশ কয়েকটি পঠনগত দু’বছর আগে (২০২৩) একই প্রকাশন সংস্থা সেই বইয়ের অধিকাংশ প্রবন্ধ এবং দু’-একটি সংযোজন  বিয়োজন নিয়ে প্রকাশ করেছেন পাঠ্যের অভিমুখে: কয়েকটি পঠনতত্ত্বতালাশ থেকে টেক্সট বা পাঠ্যর সন্ধানেই নয়, এক্ষেত্রে বই দু’টির ভেতর থেকেও খুব আলগোছে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ব্যক্তি ‘আমি’টিকে। উৎসর্গপত্র থেকে সরে গেছে ঋক। সরে গেছে ব্যক্তিনাম। বইয়ের প্রবন্ধে ঘটেছে রদবদল। মতপ্রণীত কবিতাটুকরোগুলো গায়েব, আর নেই সাক্ষাৎকারটি– যেখানে ব্যক্তি ‘আমি’র প্রকাশ ছিল যুক্তিসঙ্গত ভাবেই স্পষ্ট। খোঁজ বা তালাশ নয়, অনেকখানি বিনীত শব্দ এই অভিমুখে পাঠ প্রচেষ্টা। একটি বইয়ের নির্মাণ থেকেই আন্দাজ পাওয়া যায় মানুষটির স্বোপার্জিত আত্মবোধ।  

PATHYER ABHIMUKHE : KAYEKTI PATHAN

অনিরুদ্ধ লাহিড়ীর কাছে গিয়ে যাঁরা বসার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরণের সাবলীলতা কীভাবে জানাকে নির্ভার করে দিতে পারে। একটা কোনও সামান্য প্রশ্নকে সামনে রেখে সেই প্রশ্নের দিগন্ত যতটা পারা যায় বাড়িয়ে নিয়ে যদি নিজেরই সঙ্গে কথা বলা যায়, তাহলে সেই উত্তর সন্ধানে জানার ভারহীন পথচলতি মুখটা দেখা দেয়। তাতে জলের মতো নিরবয়ব ঢেউ থাকে শুধু। জানানোর গাম্ভীর্যে নির্বোধের আদলই ফুটে ওঠে। সেটা জেনেও নির্বোধেরই দীপ্তি চারদিকে দেখতে পাই আমরা। এই ক্রমাগত আত্মতার ভার লাঘব করার পথে নিজের চিরজাগরূক জিজ্ঞাসা অনিরুদ্ধ তাঁর চেয়ারের পাশেই রাখা স্নেহের টেবিলল্যাম্পের মতো জ্বালিয়ে রেখে দিতেন। আর অপূর্ব রসিকতার হাওয়া খেলে যেত তাঁর জীবনদৃষ্টিতে। আড্ডায়। রসিকতাও ভারকে হালকা করে, গ্লানিকে ধুয়ে দিতে পারে। একটা প্রশ্ন অনেক সময় করতেন, বিশেষত কমলকুমার  ও কলকাতার কিসসা  নামের বিখ্যাত বইটিকে ঘিরে– ‘ম্যালিস এসে যায় নি তো?’ এসে যায় যদি তার নির্মলতার কৈফিয়তও লিখে দেবেন তিনি। যে নিন্দনীয় তাকে নিন্দা করা ন্যায় না অনীতি তা বাঙালি বিচার করুক। আমরা একটি নির্ভার জিজ্ঞাসার কথা মনে করে রাখি। 

Buy Kamalkumar O Kolkatar Kissa Book Online at Low Prices in India | Kamalkumar O Kolkatar Kissa Reviews & Ratings - Amazon.in

অনিরুদ্ধ লাহিড়ী এই শহরের অনেক বড় বড় মাস্টারমশাইদের মাস্টারমশাই ছিলেন। সাউথ পয়েন্ট স্কুলের জন্মলগ্ন থেকেই বারকয়েক ইস্তফা এবং পুনর্যোগদানে ওঁর কর্মজীবন ছিল বিচিত্র। আশি বছর বয়সেও আত্মরক্ষার্থে তাঁকে টিউশন করতে হত এই হতভাগ্য দেশে। তাঁর শিক্ষকতার শুরু হতে পারত ক্লাস ফাইভ কিংবা আরও তলা থেকে, শেষ হত পিএইচডি কিংবা কলেজ শিক্ষক পর্যন্ত। সেই ছাত্রদের কারেকশন করা খাতা যদি আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষকমশাইরা দেখেন, বেশিরভাগই বৃত্তিবদল করবেন। প্রতিটি লাইনে এক লাইন করে ছাড় দিয়ে লেখা খাতায় যার যেমন নিজস্বতা, সেই মতো বাক্যনির্মাণ শেখাতেন মাস্টারমশাই। আর নিজের জীবনকে কীভাবে প্রতিদিনের পড়ানোয় জুড়ে হালকা করে নিতেন নিজেকে, তারও একটা গল্প এখানে বলে রাখি।

ক্লাস থ্রি-র এক ছাত্র প্রথমদিন স্যরের বাড়ি ঘুরে এসে বেজায় খুশি। 

–কী শিখলে? গেরামভারী বাপ-মার প্রশ্ন উড়িয়ে দিয়ে শিশুটি জানাল– স্যরই জানতে চাইলেন আমার কাছে। 

–সে কী! কী জানতে চাইলেন?

–চোর আর জোচ্চোরের মধ্যে ভালো কে? আমি বললাম চোর ভালো। চুরি তো চোরের প্রফেশন। আর জোচ্চোর কে আমি জানি না। স্যর তখন বললেন জোচ্চোর হল যে তোমার সামনে বসে তোমারই বাড়ি খেয়ে তোমারই প্রশংসা করে যাওয়ার সময় সর্বনাশটি করে চলে যায়। হাঁ-করা বাপ-মাকে গর্বিত ছেলে জানায়– আমি ঠিকই বলেছিলাম। চোর ভালো। স্যর বললেন চোর কত পরিশরম করে। তেল মাখে। জিমন্যাস্টিক্স শেখে। সিঁদকাঠি বানায়… 

অভিভাবকদের হতচকিত করে এইরকম কত শিশু নিজের মতো বড় হয়ে উঠেছেন অনিরুদ্ধ লাহিড়ীর হাতে  আর উনি ওঁর প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা অথবা জীবনপ্রশ্নে ছেলেমেয়েদের জড়িয়ে নিয়ে এই শহরের বুকেই সামান্য ক’টা দিন কাটিয়ে গেলেন। যে ঋক উনি সরিয়ে নিয়েছিলেন ওঁর বই থেকে, সেই অপূর্ব কয়েক লাইন কবিতা আজ সবার জন্য রাখা থাক: 

নিরবয়ব যা তাকে তো শুনতে হয়। শুনি যে না– অদীক্ষিত, তাই? ভাষা-প্রসবের আগে অচিন কোটায় কথাবীজগুলি পা সবে রেখেছে কি রাখেনি টের পায় ও। নিশিযাপনের গহনে আপন আড়াল তাহলে রইল না আর। প্রচ্ছন্নে যে অপর, আমার অস্ফুটে সে কি ও তবে?  

ভাষাপ্রেমিকের কাছে বসে একটা গোটা জীবনকে আস্তে চলে যেতে দেখা এই মানুষটির কথা আমাদের এই বাংলার সত্যিকারের শিক্ষা-সংস্কৃতির ইতিহাসে মিশে থাকবে যতদিন নিরবয়বকে শুনতে শিখব আমরা।

………………………………………

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

………………………………………