অতীতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যখন ভারতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন তখন বাংলাদেশের ক্রিকেটকুলের তরফে আন্তরিকতার যে বারিবর্ষণ হত, তা আজ অস্তরাগে। এশিয়া কাপের মঞ্চে তাসকিন আহমেদের হাতে ধোনির কাটা মুণ্ডুর কাটআউট কিংবা রুবেলের হাতে কোহলির কাটা মুণ্ডুর কাটআউট নিয়ে মীরপুরের গ্যালারিতে দর্শক উল্লাস সেই বেআব্রু বৈরিতাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশি ক্রিকেট-অনুরাগীদের আত্মবিস্মৃত একাংশ ভুলে গিয়েছেন জগমোহন ডালমিয়ার মতো দক্ষ ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসকের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া তাঁদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মঞ্চে উত্তরণ সম্ভব হত না।
সময়ের ঘষা লেগে শিলালিপি ক্ষয়িষ্ণু হয়ে ওঠে। স্মৃতি তো সেই অর্থে তুচ্ছ ব্যাপার। বিশ্বকাপ ফাইনালের কথাই ধরা যাক না। অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারের পর রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিদের ওই মলিন, রিক্ত মুখগুলো অবলোকন করলে মনের গভীরে সহমর্মিতা সঞ্জাত হবে আপনা হতেই। তাঁদের রক্তাভ সাশ্রুনেত্র দেখে যন্ত্রণাদগ্ধ হবেন যে কোনও ক্রিকেট অনুরাগী। ঘুমহীন নিশিরাতে আফসোসের পাহাড় জমবে। সেই জমাট উপলখণ্ডে আছড়ে পড়বে সময়ের স্রোত। ক্ষত ধীরে ধীরে প্রশমিত হবে। জীবনযুদ্ধে নতুন প্রত্যয়ের জন্ম হবে আবার নতুন করে।
কিন্তু, বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতের হার নিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশের যে ‘বন্য উল্লাস’ বাধাবন্ধহীন হয়ে সর্বব্যাপী হয়ে উঠেছে, সেই গভীর ক্ষত কি কখনও মুছে ফেলা যাবে! বোধহয় না।
আরও পড়ুন: কবিতা পাঠ করে জুটেছিল ‘টেররিস্ট’ বিশেষণ, কমেডির জন্য জুটল এমি পুরস্কার
এ এক আশ্চর্য সময়! অদ্ভুত সময়! সেখানে সহমর্মিতাকে হারিয়ে বিদ্বেষ জিতে যেতে যায়। মানবিকতাকে যেন নতমুখ হতে হয় ঈর্ষাপরায়ণতার কাছে। বাংলাদেশের একদল উগ্র ক্রিকেট অনুরাগী আমাদের যেন সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিয়েছেন গত কয়েক দিনে। রোহিত, বিরাটদের ভেঙে-পড়া অভিব্যক্তির বিপ্রতীপে আমরা দেখেছি, অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বজয়ে বাংলাদেশিদের বিজয়-উল্লাস। যেন প্যাট কামিন্সরা নন, ভারতকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন তাঁরাই, তাঁদের দেশ। অথচ ধারেভারে শক্তিতে তাঁরা কোনও দিক থেকেই ভারতের সমগোত্রীয় নন। বিশ্বকাপ মঞ্চে ভরাডুবি আর বিতর্ক ছাড়া তাদের প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তা সত্ত্বেও পররাষ্ট্রের প্রতি এমন পরশ্রীকাতরতা কেন? কেনই বা হৃদয়ে এমন হিংসার খাণ্ডবদহন! অতীতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যখন ভারতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন তখন বাংলাদেশের ক্রিকেটকুলের তরফে আন্তরিকতার যে বারিবর্ষণ হত, তা আজ অস্তরাগে। এশিয়া কাপের মঞ্চে তাসকিন আহমেদের হাতে ধোনির কাটা মুণ্ডুর কাটআউট কিংবা রুবেলের হাতে কোহলির কাটা মুণ্ডুর কাটআউট নিয়ে মীরপুরের গ্যালারিতে দর্শক উল্লাস সেই বেআব্রু বৈরিতাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশি ক্রিকেট-অনুরাগীদের আত্মবিস্মৃত একাংশ ভুলে গিয়েছেন জগমোহন ডালমিয়ার মতো দক্ষ ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসকের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া তাঁদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মঞ্চে উত্তরণ সম্ভব হত না। আইসিসির স্টেটাস লাভে তাদের সর্বাত্মকরণে সাহায্য করেছিল ভারত, ভারতীয় ক্রিকেট। অথচ ইতিহাসের এমনই নিয়তি যে, আজ সেসবেরই প্রতিদান যেন তাঁরা দিচ্ছেন রোহিতদের বিশ্বকাপ হারে ‘বন্য সেলিব্রেশনে’! তীব্র কটাক্ষ, শ্লেষ আর প্রতিহিংসায়! বাংলাদেশের কাছ থেকে এটাই কি প্রাপ্য ছিল ভারতের! আগামীর ইতিহাসই নিশ্চিতই তার সবিশেষ মূল্যায়ন করবে। একদা ঐতিহাসিক বিচ্ছেদের নিয়তি মাথায় নিয়েই দুই ভূখণ্ডকে কাঁটাতারের যন্ত্রণা মেনে নিতে হয়েছিল। বিধির বিধান মানতেই হয়, তবু, সেই ভাঙনকালে র্যাডক্লিফ লাইন যা পারেনি, তা হল আত্মীয়তায় সুতো ছিন্ন করতে। ভাগের হিসাব মুলতবি করেই দুই দেশ, একই ভাষাভাষী বহু মানুষ বহু বছর জড়িয়ে ছিলেন অলৌকিক এক আত্মিক সম্পর্কে। এ-পার ও-পার হাতে হাত রেখে জুড়ে জুড়েই ছিল, আর মাথার ওপরে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সন্দেহ নেই, সম্পর্কের সেই খতিয়ান এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। আজ ক্রিকেটের সূত্রে যা চোখে পড়ছে, তা কাকতালীয় নয়; বরং শিকড় আরও গভীরেই প্রোথিত।
আরও পড়ুন: কাশ্মীর ওয়াল্লাদের বাকস্বাধীনতা মানেই গরাদের ওপার
খেয়াল করলে দেখা যাবে, বন্ধুরাষ্ট্র থেকে হঠাৎ-ই শত্রুরাষ্ট্র হিসাবে ভারতকে দেখতে শুরু করা বাংলাদেশের এই বিদ্বেষমূলক দৃষ্টিকোণ অরাজনৈতিক নয়। সেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে অনেক কূটনৈতিক অভিসংঘাত। দু’দেশের রাষ্ট্রনায়করা তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন, সেটাই কাম্য; তা আলাদা প্রসঙ্গও। সে নিয়ে আলোচনা, সমালোচনাও চলতে পারে। তবে কোথাকার তরবারি কোথায় রাখা হল! দেশের ফেরে যত দ্বেষ গিয়ে পড়ল ক্রিকেটের ওপরে। বাইশ গজের যুদ্ধ নিয়ে ভারত-বিপক্ষে বাংলাদেশি ক্রিকেট অনুরাগীদের যে অভিযোগ, তার সিংহভাগ যুক্তিহীন, মানসকল্পনা মাত্র। ডিআরএস কারচুপি থেকে পিচ-বিতর্ক, একটার পর একটা ইস্যুতে বাংলাদেশের একদল উগ্র সমর্থক যে অবোধ অভিযোগ হেনেছেন, তা বরাবরের মতো ফাঁপা, যুক্তিতর্কহীন। সেসবের অন্তর্নিহিত একটাই কারণ বাস্তবসম্মত হতে পারে– প্রবল ভারত-বিদ্বেষ। অথচ ঐতিহাসিক সত্য এই যে, ভারত পাশে না থাকলে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের হাত ধরে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মই হত না। স্তব্ধ হয়ে যেত স্বাধীন দেশের স্বপ্ন, সঙ্গে ভাষা হিসাবে উর্দুর বদলে বাংলাকে স্বীকৃতি দানের লড়াই। তা হয়নি। হয়নি দুর্দিনে ভারতকে পাশে পাওয়ায়। ইতিহাস সেদিন যে রাখিবন্ধন করেছিল, সেসব বেমালুম ভুলে সে-দেশের ‘ধৃতরাষ্ট্র’ ক্রিকেট-সমর্থকরা শুধু ফিরিয়ে দিলেন বিদ্বেষের ডালি। তাঁদের স্পর্ধিত স্বর কোথাও গিয়ে যেন ভারত-বিরোধী পাকিস্তানের সঙ্গে সমার্থক হয়ে যায়। এই তো সাম্প্রতিককালেই প্রাক্তন পাক অলরাউন্ডার আব্দুল রাজ্জাক বলেছেন, ‘বিশ্বকাপ ফাইনালে ক্রিকেট জিতেছে। ভারত হেরেছে।’ এর পাশে বাংলাদেশি ক্রিকেট অনুরাগীদের লাগামছাড়া উচ্ছ্বাসকে কল্পনা করুন, মিল খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না। বিহ্বলচিত্তে মনে হবে, ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশের জাতীয় সংগীতের রূপকার তো একজনই, বিশ্বকবি। তাহলে এমন অহিনকুল সম্পর্ক তৈরি হয় কী করে! আসলে সময় সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। হয়তো কৃতজ্ঞতাবোধটুকুও। তবু ইতিহাস ভুলে যাওয়া কি আদৌ কাম্য, সে প্রশ্নও একই সঙ্গে অহরহ অন্তরকে বিঁধতে থাকে।
আরও পড়ুন: এই গণহত্যার রক্ত কেবল জায়নবাদীদের হাতেই লেগে রয়েছে, সব ইহুদির হাতে নয়
এ-কথা সত্যি যে, দুই পৃথক রাষ্ট্র যখন নিজেদের মতো করে এগোয়, তখন সময়ের স্রোতে নানারকম পলি জমতে থাকে। তাতে কেবলই অমৃতকুম্ভের সন্ধান বোধহয় বাঞ্ছনীয় নয়। বরং সম্পর্কে রশি ধরে সম্প্রীতির মন্থনে খানিক অমৃত যেমন ওঠে, তেমন এই উঠে-আসা হলাহলও সত্যি। ঘোর বাস্তব। ভারত-বাংলাদেশে আত্মীয়তা যেমন নির্ভেজাল, তেমন বর্তমানের এই বিদ্বেষও সত্যি। অস্বীকার করার উপায় নেই। তবু, দুই দেশের নাড়ির সম্পর্কের কারণেই এই কালকূটকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। এমন নয় যে, বিদ্বেষই একমাত্র সত্যি। এমন নয় যে, আত্মীয়তা আর বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। তবু ইতিহাস দুই দেশের মানুষকে যে বাঁকের মুখে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তা ট্র্যাজেডিই বটে। রাজনীতি, কাঁটাতার অতিক্রম করেও জেগে থাকে মানুষ, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। সেখানে টানাটানি পড়লে মানবিকতার আকাশটাই মেঘলা হয়ে ওঠে। ক্রিকেট টুর্নামেন্ট যাবে আসবে, রাজনৈতিক চুক্তিও কালের নিয়মে অসার হবে, তবু যা চিরকাল জেগে থাকবে তা ওই পড়শির সঙ্গে পড়শির সুসম্পর্কই। তাই-ই যদি কালিমালিপ্ত হয়, তবে, যে পরাজয় গাঢ় হয়ে ওঠে, তা সামগ্রিক মানবেরই। ক্রিকেটের জয়-পরাজয় সেখানে কিছুই নয়, নেহাত উপলক্ষ মাত্র।
আমরা জানি, ইতিহাসের নানাবিধ মার তুচ্ছ করেই যা ধ্রুবতারা হয়ে থাকে, তা মানুষের ইতিহাস। কাঁটাতার, মানচিত্র কিংবা পাসপোর্ট তো দেশ নয়। বুকের গভীরে যা জেগে থাকে, তাই-ই দেশ। সেখানে দ্বেষের জায়গা থাকে না। এই সারসত্যই তো আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দুই দেশের মানুষই যাঁকে স্মরণ করে দেশের সূত্রে।
আজ এতদিন পরে, রবীন্দ্রনাথকে কি আমরা তবে হেরে যেত দেব, বাংলাদেশ?