স্বৈরাচারী শাসন দমন করতে জানে, আর দমন করে সেই স্বৈরাচারী শাসন ভেক ধরবে গণতন্ত্রের দরদী শাসকের। ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’ আওড়াতে আওড়াতে তিনি নিহত হত্যাকারী প্রতিবাদী, অত্যাচারী– সকলকে মিলিয়ে দেবেন মৃত্যু নামক অন্ধকারের প্রতি বার্গম্যান সুলভ নিস্পৃহতায়, এমন অভাবনীয় বিষয় আমরা আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। বাংলায় অবশ্য আরও একটি শব্দ এ বিষয়ে প্রচলিত। তার নাম ‘কুম্ভীরাশ্রু’। যাদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন করে প্রাণ দিলেন ছাত্র আন্দোলনের শহিদ ভাইবোনেরা, তারাই এসে তাদের জন্য শোকদিবস পালন করছে, এতে সকলের সামনে প্রমাণ হল এই যে, আমরা অভিভাবক, দমন করতে জানি, শমনকেও নিয়ে আসি।
বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কে এখান থেকে তেমন কোনও মন্তব্য করা উচিত নয় যদিও, তবু, তাঁরা যে উদাহরণটি আমাদের সামনে রাখলেন, তা আমাদের মুহূর্তের মধ্যে মনে করিয়ে দেয় সুকুমার রায়ের কবিতা। এ একমাত্র সুকুমার রায়ের কবিতা পড়েই সম্ভব। আজ যদি ধরুন একজন হত্যাকারী হত্যার পরে, দস্তয়ভস্কির রাসকলনিকভের মতো অন্তর্গত কথনের মধ্যে প্রবেশ করে কিংবা সেই নিহত ব্যক্তির শরীরের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে কাঁদে, অথবা এক শোকদিবস ঘোষণা করে তাঁর আত্মার শান্তিতে প্রদীপ জ্বালে, তাতে মনে হয় হিংসা, হিংসার চেয়েও আরও তীব্র হয়ে যায়। সুকুমার রায়ের সেই চরিত্র, যে কিনা বলছে ‘ভয় পেওনা, ভয় পেও না, তোমায় আমি মারব না’, সে-ই আবার বলছে ‘ সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে’। আসলে স্বৈরাচারী শাসন দমন করতে জানে, আর দমন করে সেই স্বৈরাচারী শাসন ভেক ধরবে গণতন্ত্রের দরদী শাসকের। ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’ আওড়াতে আওড়াতে তিনি নিহত হত্যাকারী প্রতিবাদী, অত্যাচারী– সকলকে মিলিয়ে দেবেন মৃত্যু নামক অন্ধকারের প্রতি বার্গম্যান সুলভ নিস্পৃহতায়, এমন অভাবনীয় বিষয় আমরা আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। বাংলায় অবশ্য আরও একটি শব্দ এ বিষয়ে প্রচলিত। তার নাম ‘কুম্ভীরাশ্রু’। যাদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন করে প্রাণ দিলেন ছাত্র আন্দোলনের শহিদ ভাইবোনেরা, তারাই এসে তাদের জন্য শোকদিবস পালন করছে, এতে সকলের সামনে প্রমাণ হল এই যে, আমরা অভিভাবক, দমন করতে জানি, শমনকেও নিয়ে আসি। আবার তারপর তাদের প্রতি অশ্রুবিসর্জনও করতে জানি। কারণ, আমরা রাষ্ট্রের প্রধান। তাই শোকদিবসের কারণ আমরা, শোকদিবসের উদ্যোগও আমাদের। কিন্তু আমরা জবাব কোনওমতেই দেব না, শোকদিবসের কারণ সম্পর্কে।
সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ (কোটা) সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার প্রেক্ষিতে একটানা বিক্ষোভ, হাতাহাতি, মারামারি সবকিছুই চলেছিল। দুশো জনেরও বেশি মানুষের প্রাণ গিয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ করেছিল সরকার। কারফিউ জারি করেছিল। জীবনযাত্রা যে থমকে গিয়েছিল, তা এখনও স্বাভাবিক হয়নি। এখনও এই লেখার সময়ও নানা জায়গায় আবারও ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে। যদিও এসবই পর্যবেক্ষণ। কিন্তু আজকের যুগে, এ তো স্পষ্ট, যে, এখনও সে দেশে সেনাবাহিনী মার্চ করছে। ইন্টারনেট চালু হয়নি। ২১ জুলাই বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের ঘোষণা অনুযায়ী, ৯৩ শতাংশ নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে হতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিদের জন্য ৫ শতাংশ এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া নৃ-গোষ্ঠী-র জন্য (চাকমা, মারমা, ব্রু, রিয়াং ইত্যাদি) ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্যে ১ শতাংশ আসন সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই আন্দোলন দমনের জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনই যেভাবে অত্যাচার করেছে, হত্যা করেছে নির্বিবাদে, তা তো ইতিহাসই হয়ে গিয়েছে বলা যায়। এর আগে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন হয়েছে বাংলাদেশে। বাহান্ন সালে যে রক্তক্ষয়ী ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল, তা নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যাননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এখানে ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করেছেন। কিন্তু এবারের আন্দোলন যেন অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী, অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক। আওয়ামী লিগ টানা ১৬ বছর ক্ষমতাতে থাকলেও এবং ২০১২ থেকে ১৪ এখানে ছাত্র আন্দোলন হলেও, তা দমন করতে এত হিংসাত্মক হতে হয়নি রাষ্ট্রকেও। তবে কেন এই আন্দোলন এত ধ্বংসাত্মক হয়ে পড়ল, তা চিন্তার। তার কি এটাই কারণ যে, ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্যে মিশে গিয়েছিল দেশের সরকার বিরোধী দল, যারা তুলনায় অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করে? না কি এটাই কারণ, যে ছাত্রদের এই আন্দোলনকে দমন করতে শাসকদলের ছাত্র সংগঠনকে এই বিক্ষোভ দমনের কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল? কারণ আওয়ামী লিগের বিরোধী রাজনৈতিক দল তো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে বিশ্বাসই করে না। তাছাড়াও রয়েছে সেখানে মুসলিম মৌলবাদী কিছু রাজনৈতিক দল। আবার সেই সুকুমার রায়ের কথাই মনে পড়ে আমাদের। একুশে আইনের কথা। বাংলাদেশে শোকদিবস পালন করছেন তাঁরাই, যাঁরা শোকদিবসের কারণ।
কিন্তু এই একুশে আইন বাংলাদেশেই একমাত্র দেখা যাচ্ছে, তা তো নয়। আমাদের দেশের এটা চিরাচরিত সমস্যা। আমাদের দেশে ছাত্র আন্দোলনগুলি, অন্তত গত ৫০ বছরে, এত তীব্রতায় ফেটে পড়েনি। শাসক এত তীব্রতায় দমনও করেনি। এদেশে সত্তরে যখন নকশাল আন্দোলন দমন করা হয়েছে, তখন তাদের নির্বিচারে হত্যা করেছে পুলিশ, ভাসিয়ে দিয়েছে গঙ্গার জলে কিংবা তাদের আর পাওয়াই যায়নি। অকথ্য অত্যাচার করেছে। এসব ইতিহাস আমাদের জানা। স্বাধীনতার সময়ে, কিংবা ছয়ের দশক, সাতের দশকে যখন ছাত্র আন্দোলন দমন করতে গেছে শাসক, সে যে-শাসকই থাকুন না কেন, তাঁরা কোনও অন্যায় ক্ষমাপ্রদর্শনের রাস্তায় যাননি। কিন্তু ভুবনায়নের পর থেকে ছাত্র আন্দোলনগুলির দিকে এ দেশের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা পাল্টেই গিয়েছে। তা আবার আরও জটিল। এদেশে ছাত্র আন্দোলন হবে, বিক্ষোভ হবে, কিন্তু কয়েকদিন পরেই সেই বিক্ষোভের কিছুই আর দেখা যাবে না। কারণ আন্দোলন করতে এসে এক একজন নেতা হয়ে যাবেন। আর তারপর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে হারিয়ে যাবেন। অথবা এখানে দলমত নির্বিশেষে একমাত্র আন্দোলন হয়েছিল সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময়। তারপর যে যে ছাত্র আন্দোলন দেখি, সেগুলি আন্দোলন না বলে বিক্ষোভ বলাই ভালো। সেগুলি কোনও না কোনও ভাবে কোনও না কোনও দলের অ্যাজেন্ডাকে প্রতিফলিত করে। দলের অ্যাজেন্ডাই সেইসব ছাত্র রাজনীতির মূল বিষয়। দলের রাজনীতির বাইরে গিয়ে এখানকার ছাত্র আন্দোলনগুলি এখন দানা বাঁধছে কি না, তা প্রশ্নের মুখে।
কিন্তু এসব সূক্ষ্ম রাজনৈতিক প্রতর্ক নিয়ে আলোচনা রাজনীতি বিশেষজ্ঞরাই করতে পারেন। ব্যক্তিগত ভাবে আমার দেখা একজন ব্যক্তি হিসেবে। আমার কাছে রয়েছে ইতিহাসের এক সুবিশাল প্রেক্ষাপট এবং একটি চলমান ইতিহাসের প্রেক্ষাপট। অর্থাৎ ইতিহাস এবং চলমান ইতিহাসের মধ্যে এক বিন্দুর মতো প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে দেখা ছাড়া আমার আর বিশেষ করার কিছু নেই। কিন্তু ‘মানুষ মেরেছি আমি, তার রক্তে আমার হৃদয় ভরে গেছে’ একথা যদি শাসক বলেন নিহত প্রতিবাদী মানুষের মৃতদেহের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে, তাহলে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঠিক যেমন চণ্ডাশোকের ধর্মাশোক হয়ে যাওয়ার কাহিনিও বিশ্বাসযোগ্য নয়। যিনি শাসক, তিনি যদি ধর্মাশোক হন, তাহলে তিনি শাসক থাকতে পারেন না। তাই তাঁর শোক মানবিকতার অশ্রুবিসর্জন নয়, বলা যায় এক কূটনৈতিক দেখানেপনা। মৃতদেহের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে রক্তাক্ত হাতে সমাধিপ্রস্তর উন্মোচন করার মতো অশ্লীল হিংসা দেখে মনে হয় মানবিকতার নামে এ-ও এক প্রহসন।
মনে হয়, গণতন্ত্র বিষয়টিই প্রহসন। এদেশে যেমন তা সত্য, তেমনই তা সত্য ওদেশেও। বাংলাদেশে নিহতদের জন্য শোকপ্রকাশ হোক, শাস্তি পাক তাদের হত্যাকারীরা।
চিরকালের যৌবনের রহস্যময়তার প্রতীক হয়ে থাকতে চেয়ে নায়িকা যদি তাঁর রূপযৌবন সম্মান প্রতিপত্তি থাকতে থাকতেই সব মোহ ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় অসামাজিক, অন্তরালবর্তিনী হয়ে যান, সেটা তো অসামান্য সংযমের, সুবিবেচনার এবং ইচ্ছাশক্তির কাজ।
এই লাল অবশ্য, দেশে দেশে, মুক্তির রং হিসেবে, ছড়িয়ে পড়লেও, তার রং, ফ্যাকাশে হতেও সময় লাগেনি। ঘন লাল, মাঝারি লাল, হালকা লাল, গোলাপি লাল, আগ্রাসী লাল, একসময় সাম্রাজ্যবাদী লালও হয়ে ওঠে, একনায়ক লাল, ফ্যাসিস্ট লাল– এমনভাবেই লাল তার এক ধরনের রাজনৈতিক চেহারা নিল, আমরা দর্শক বনে গেলাম।
বছর খানেক আগে হাওড়ায় রাম নবমীর মিছিলে কিশোর সুমিত শা-এর ছবি ভেসে ওঠে, যে বন্দুক উঁচিয়ে হুংকার দিচ্ছিল ‘জয় শ্রী রাম’। মনে পড়ে যায় পহেলু খানকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত দুই কিশোরের কথা যারা অ্যাডোলেসেন্সের জেমির চরিত্রের মতোই সাজা কাটাচ্ছে বিশেষ সংশোধনাগারে।