শুরুটা হয়েছিল গত লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে। ঘটনাচক্রে ২০১৯-এর সেই সময়টা বিদ্যাসাগরের জন্মের দুশো বছর উদ্যাপনের ঠিক আগে। অমিত শাহের রোড-শোয়ের সময়ে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলে ফেলেন, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিখ্যাত কীর্তি সহজ পাঠ’-এর কথা। তার জেরে বিজেপিকে ‘বর্ণপরিচয়’ ও ‘সহজ পাঠ’ দুয়ের পাঠ দিতেই উঠেপড়ে লাগেন বঙ্গনেতারা। বছর দুই পরে, বিধানসভা ভোটের মরশুমেও বাংলার রাজনৈতিক পরিসরে ঢুকে পড়ে দু’টি বই-ই। অথচ তাদের রাজনৈতিক বই কোনও মতেই বলা চলে না।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী
বাঙালির কোনও ইতিহাস নেই, বলেছিলেন বঙ্কিম। স্বাধীন দেশে কিছুদিন থাকলে হয়তো বলতেন, বাঙালির কোনও রাজনীতির বইও নেই। চে গেভারা থেকে কার্ল মার্কস, সকলকেই বাঙালি আপন করে নিয়েছে বটে, ইদানীং কালে সাভারকর-ভাগবতরাও রাজ্যে জাঁকিয়ে বসছেন, তবে রাজনীতিচর্চার জন্যেও সে নিজের ভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। যদিও একুশে ফেব্রুয়ারি এলে ভাষার রাজনীতি নিয়ে তাকে কথা বলতেই হয়। কীভাবে খাস বঙ্গভূমেই ইংরেজির দাপটে বাংলা ভাষা কোণঠাসা, উপরন্তু হিন্দির প্রবল আগ্রাসনও কীভাবে বাংলাকে আরও দিশেহারা করে দিচ্ছে, এবং সে ঘটমান বাস্তবের সঙ্গে রাজনীতির ক্ষমতা বিস্তারের যোগাযোগ কতখানি– সেসব নিয়ে সে কথার পিঠে কথা চাপায়। আত্মকরুণা ও আত্মসমালোচনার মিশ্র এই অনুভূতিকে সাময়িক সঙ্গী করলেও এই ভাষা-রাজনীতির রাজনৈতিক বিরোধিতা করার পরিশ্রম সে করে উঠতে পারে না। কিন্তু আকস্মিকভাবেই দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার পরাভবের একটা পালটা বয়ান উঠে আসছে। আর সে বয়ানের বাহন হয়ে উঠছে দু’টি বাংলা বই-ই। অথচ রাজনৈতিক বই তো তাদের কোনও মতেই বলা চলে না। কিন্তু ‘বর্ণপরিচয়’ ও ‘সহজ পাঠ’– এই দুই বাংলা প্রাইমারকে যেভাবে রাজনৈতিক বিরোধিতারই শরিক করে তোলা হচ্ছে, তাতে বাঙালির রাজনৈতিক বই না থাকার বিস্তৃত শূন্যতা খানিক পূরণ হয়েছে বলেও ভাবা যায় হয়তো।
শুরুটা হয়েছিল গত লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে। ঘটনাচক্রে ২০১৯-এর সেই সময়টা বিদ্যাসাগরের জন্মের দুশো বছর উদ্যাপনের ঠিক আগে। অমিত শাহের রোড-শোয়ের সময়ে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলে ফেলেন, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিখ্যাত কীর্তি সহজ পাঠ’-এর কথা। তার জেরে বিজেপিকে ‘বর্ণপরিচয়’ ও ‘সহজ পাঠ’ দুয়ের পাঠ দিতেই উঠেপড়ে লাগেন বঙ্গনেতারা। বছর দুই পরে, বিধানসভা ভোটের মরশুমেও বাংলার রাজনৈতিক পরিসরে ঢুকে পড়ে দু’টি বই-ই। সংসদের বাইরে প্রতিবাদমত্ত বঙ্গবিজেপির নেতাদের হাতে যে প্ল্যাকার্ডগুলি ছিল, তাতে লেখা বাংলা বানান বাঙালির লজ্জা বাড়াতে যথেষ্ট। দিল্লির বুকে ওইরকম বানান দেখে মানুষ কী ভাববে, এই যুক্তিতে দিলীপ ঘোষকে বাংলা ভাষা শেখার বুনিয়াদি বই ‘বর্ণপরিচয়’ পাঠিয়ে দেন তৎকালীন কংগ্রেস নেতা কৌস্তুভ বাগচী। সেই ২০২১ সালেই, সরস্বতী পুজোর আগে আগে বিজেপি-কে ‘বর্ণপরিচয়’, ‘সহজ পাঠ’ শেখাতে ট্যাবলো নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘোরে তৃণমূল। উদ্যোগ ছিল চুঁচুড়ার তৃণমূল বিধায়কের। তিনি সাফাই দিয়েছিলেন, বিজেপি-র নেতারা বাইরে থেকে এ রাজ্যে আসছেন। যাঁরা এই রাজ্যের, তাঁরাও ‘সহজ পাঠ’ বা ‘বর্ণপরিচয়’ জানেন না। সুতরাং বাঙালির হয়ে তাঁদের বাংলা প্রাইমারের পাঠ দেওয়া জরুরি বলেই যুক্তি সাজিয়েছিলেন তিনি। আবার সেই একই সময়ে সহজ পাঠের আঙ্গিক ব্যবহার করে, নন্দলাল বসুর আঁকা ছবির সঙ্গে ভোট-ছড়া লিখে প্রচারে নেমেছিল এসএফআই।
সত্যি বলতে, ভোটের প্রচারেই হোক কি রাজনৈতিক বক্তৃতায়, বাংলা ভাষা এখন সবেতেই ‘পিছড়ে বর্গ’। দেওয়াল লিখন, হোর্ডিং ব্যানার, মিছিলের প্ল্যাকার্ডে বাংলা বানানের গঙ্গাযাত্রা ঘটে গিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টের কথা তো না বলাই ভালো। নেতানেত্রীদের ভাষণেও হিন্দি শব্দের যথেচ্ছ হুংকার। আসলে রাজনীতি তো কোনও বিচ্ছিন্ন পরিসর নয়, গোটা জনমানসের প্রবণতাও হাঁটছে একই পথে। কেন্দ্রে শাসককুলের হিন্দি প্রেম, সাংবিধানিক বহুভাষিকতার তোয়াক্কা না করে হিন্দিকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে প্রচার, ছল, বল ও কৌশলে জনসংস্কৃতিতেও তা চারিয়ে দেওয়ার সমগ্র পর্বটি বাঙালির চোখের সামনেই অভিনীত হয়ে চলেছে। দক্ষিণের মতো ভাষা-অস্মিতা তার নেই, সুতরাং ক্ষমতার গা-ঘেঁষা সমৃদ্ধির মায়াহরিণের ডাকে এ আত্মঘাত নিয়ে আম-বাঙালির বিশেষ মাথাব্যথাও নেই। তাহলে তার ভাষাগত পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বহির্বঙ্গের রাজনৈতিক দলই বা মাথা ঘামাবে কেন! তাই বাংলায় এসেও বিজেপির অ-বাঙালি নেতারা, এবং তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণে বাঙালি নেতারাও ‘কার্যকর্তা’, ‘মণ্ডল’, ‘সূচনা’-র মতো শব্দ ব্যবহারে পিছপা হচ্ছেন না। বাংলা জুড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ হিন্দিতে লেখা ব্যানার ঝুলিয়েও যে প্রচার সারা যায়, এ কথা তাঁরা বুঝেই গিয়েছেন। তবে সেই নিশ্চিন্ত অনুমানকে প্রশ্ন করতেই সম্প্রতি রাজ্য বিজেপির সদর দপ্তরে কড়া নেড়েছেন একদল বাঙালি।
‘সরস্বতী ভাণ্ডার’ নামে একটি সংগঠনের শরিক তাঁরা। বাংলায় এসেও রাজনৈতিক কার্যক্রমে ভূরি ভূরি হিন্দি শব্দের মিশেলে বকচ্ছপ বাংলা বলা, যেমনতেমন বাংলা বানান লেখা, বিজেপির এইসব কাণ্ডকারখানা নিয়ে আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ই-মেল করেছেন তাঁরা। এবার কেউ হাতে বর্ণপরিচয় নিয়ে, কেউ সহজ পাঠ নিয়েই সশরীরে হানা দিয়েছেন মুরলীধর সেন লেনে। সে চত্বরে ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো সাধারণ কর্মীদের মধ্যেই বিলি করেছেন বইদু’টি। তবে শুধু বিজেপিকেই নয়, তৃণমূলকে নির্ভুল বাংলা বানান শেখাতেও কোমর বেঁধেছেন তাঁরা। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দেওয়া হোক, তবে সেখানে লক্ষ্মী বানানটিও ঠিক লেখা হোক— এইটুকুই দাবি তাঁদের। তাই এর মধ্যেই তৃণমূল ভবনেও বর্ণপরিচয় ও সহজ পাঠ নিয়ে হাজির হওয়ার পরিকল্পনা তাঁরা ছকেই ফেলেছেন।
এই পুরো ঘটনাক্রমেই, বাংলার পাঠ দেওয়ার লক্ষ্যেই ব্যবহার করা হচ্ছে বর্ণপরিচয় ও সহজ পাঠ। বই দু’টির যা কাজ, যে কারণে এ বইগুলির নির্মাণ, সে উদ্দেশ্য আদৌ ব্যহত হচ্ছে না। কিন্তু এখানে এ বই ব্যবহারের উদ্দেশ্য যে বৃহত্তর এক মাত্রা পেয়ে যাচ্ছে, সে কথা অস্বীকারেরও তো জো নেই। সে উদ্দেশ্য আপাদমস্তক রাজনৈতিক। তবে দলীয় রাজনীতি নয়, কোনও না কোনও ভাবে বাঙালি অস্মিতার আত্মরক্ষার রাজনৈতিক বয়ান হয়ে উঠছে এই ব্যবহার। বস্তুত, বাঙালির আত্মপরিচয়ের নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠার মশাল যাঁরা জ্বালিয়ে রেখেছেন নিরন্তর, সেই মনীষাদের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে আছেন বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথ। শিশুশিক্ষার প্রয়োজনে তাঁরা যে বই লিখেছিলেন, তার মধ্যেও সেই বাঙালি অস্মিতার নির্মাণ জারি ছিল। বিশেষ করে, যে সময়ে এ বইগুলি লেখা হচ্ছে, সেই সময়ে এই রচনার মধ্যেই একরকম দ্রোহের বীজ রয়ে যাচ্ছিল। ঔপনিবেশিক শাসনে, ঔপনিবেশিক শিক্ষার প্রেক্ষাপটে যে বিদ্যাসাগর গোপাল-রাখালের আখ্যান লিখছেন— বাঙালির কেমন হওয়া উচিত, তিনি বাঙালির সামনে সেই মডেলই খাড়া করতেই চাইছেন। আগেকার সামান্য দু’-তিনটি বাংলা প্রাইমারের আবেগনির্ভর কাব্যময় ভাষা ছেড়ে তাই অবলম্বন করছেন যুক্তিনিষ্ঠ, নির্মেদ গদ্যকে। ‘দীর্ঘ ঋ’, ‘দীর্ঘ ৯’-র মতো অপ্রয়োজনীয় স্বরবর্ণ বাদ দিচ্ছেন, বাদ দিচ্ছেন ধর্মের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপস্থিতিকে। ইংরেজি প্রাইমারের ভিড়ে তিনি এমন এক বাংলা প্রাইমারের আমদানি ঘটাচ্ছেন, যা তাঁর জীবদ্দশাতেই জনপ্রিয়তার চাপে নকলের পর নকল হয়ে চলবে। ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ভাষার আগ্রাসনের মুখে যে বাঙালি ঋজু স্বাতন্ত্র্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, বিদ্যাসাগরের সেই কাঙ্ক্ষিত প্রজন্মের ধারণাকেই ধরে রেখেছে বর্ণপরিচয়ের সামগ্রিক এ ইতিহাস।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন সরোজ দরবার-এর লেখা: ইতিহাসের বিপর্যয়কে এড়িয়ে গেলেই কি ইতিহাস থেকে মুক্তি মেলে?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আবার, ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ যে ‘সহজ পাঠ’ গড়ছেন, সমস্ত সহজতার আড়ালে তা আদ্যন্ত এক বৈপ্লবিক প্রয়াস। এই প্রাইমারে কোনও গুরুজন কোনও শিশুকে কিংকর্তব্য নির্ধারণ করে দেন না, শাস্তির ভয়ও দেখান না। আসলে যে শিক্ষাব্যবস্থা তোতাটির শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে চায়, যে প্রথাগত যান্ত্রিকতাকে ব্যক্তিজীবনে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ; সেখান থেকে বেরিয়ে শিশুর জগতের কৌতূহল, ঔৎসুক্য আর নতুন দেখার চোখ দিয়েই পৃথিবীকে দেখায় সহজ পাঠ। আসলে যে কোনও সিস্টেম-ই সব মানুষকে এক ঢেঁকিতে কুটে একটা পিণ্ড পাকিয়ে তুলতে চায়, যেখানে তার প্রতিস্পর্ধী কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে না। সেই ভেদজ্ঞানবিলুপ্ত একাকারতার জগৎ থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার দ্রোহ চিনিয়েছিল সহজ পাঠ। সেদিক দিয়ে বর্ণপরিচয় আর সহজ পাঠ, দুই-ই এক-একরকম করে বাঙালিকে নিজস্ব অস্মিতা সন্ধান ও তা জারি রাখার পাঠ দিয়েছিল। আজকের এই রাজনৈতিক বয়ানে যে ইতিহাসকে জুড়ে পড়া যায় অনায়াসেই। আর সেইখান থেকেই, ভাষাগত-সংস্কৃতিগত-পরিচয়গত যাবতীয় আগ্রাসনের মুখোমুখি হতে বাঙালির বর্ম হয়ে উঠতে পারে এই দু’টি বই।