বহু আবাসন কমিটির কাজের ধরন অনেকটা স্বৈরাচারী। যেখানে নিয়ন্ত্রণ থাকে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে। তারা ব্যক্তিগত সাম্রাজ্যের মতো কাজকর্ম চালায়। আর যারা এই ‘কোর’ গ্রুপের মধ্যে নেই, তাদের সমস্ত নির্দেশিকা মুখ বুজে মেনে চলতে হয়। অমান্য বা প্রতিবাদ করলেই শুরু হয় পদে পদে অসম্মান, হেনস্তা।
সে এক সময় ছিল বটে। কথায় কথায় ধোপা-নাপিত বন্ধ করে দেওয়া, জরিমানা, একঘরে করে দেওয়া, সমাজচ্যুত করার নিদান। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে সমসাময়িক নানা গল্প-উপন্যাসে সে-যুগের সামাজিক অত্যাচারের বর্ণনা রয়েছে। যা এখনও ভারতের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে খাপ পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বলবৎ। স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গদেশের পাড়ায় পাড়ায় এরপর শুরু হল দাদাদের মাস্তানি। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় অনুষ্ঠান করার অনেক আগেই যার ফলে ‘দাদাগিরি’ শব্দটা ঢুকে পড়েছিল আমাদের অভিধানে। কিন্তু তা বলে গগনচুম্বী হাল ফ্যাশনের অত্যাধুনিক আবাসনেও!
রামমন্দির উদ্বোধন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা মণিশঙ্কর আইয়ারের মেয়ে সুরণ্যা। তাঁকে দিল্লির জাঙ্গপুরার একটি আবাসন কমিটির তরফে অন্যত্র চলে যেতে নোটিস দেওয়া হয়েছে। পোস্টটি বিতর্কিত কি না, তা ‘ঘৃণাভাষণ’ কি না, তা দেখার জন্য পুলিশ রয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি দেওয়ার জন্য রয়েছে আদালত। তাহলে সংশ্লিষ্ট আবাসন কমিটি কেন পুলিশ ও আদালতের বিকল্প হয়ে উঠতে চাইছে?
বস্তুত, এই শহরেই হোক বা অন্যত্র, আবাসন কমিটির ‘মাতব্বরি’ নিয়ে অভিযোগ নতুন নয়। এমনকী, তা নিয়ে বিস্তর থানা-পুলিশ, মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত হয়েছে।
বাগুইআটির একটি আবাসনে ফ্ল্যাটের সামনে অস্থায়ী অফিস ঘর নির্মাণের চেষ্টা করে ম্যানেজিং কমিটি। ফ্ল্যাটের বাসিন্দার আপত্তিতে তা ভেস্তে যায়। অভিযোগ, তার পরই ক্যানসার আক্রান্ত ওই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকার উপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন শুরু হয়। গুরগাঁও, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, মুম্বইয়ের বহু আবাসনে গৃহ-সহায়িকাদের লিফ্ট ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অর্থাৎ, ১০-১৫ কিংবা ২০ তলা হলেও তাদের সিঁড়ি বেয়েই ওঠা-নামা করতে হবে! কোনও আবাসনে কুকুর বা অন্য পোষ্য নিয়েও ছুঁৎমার্গ। বেঙ্গালুরুর একটি আবাসনে ব্যাচেলরদের থাকা নিয়ে সমস্যা। বেশি রাতে তাদের ঢোকা-বের হওয়ায় নজরদারি, নৈশ পার্টি নিয়েও আপত্তি। কোথাও আবার বাসিন্দাদের কাছে আসা অতিথিদের সম্পর্কেও অনাবশ্যক কৌতূহল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রামমন্দির উদ্বোধন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা মণিশঙ্কর আইয়ারের মেয়ে সুরণ্যা। তাঁকে দিল্লির জাঙ্গপুরার একটি আবাসন কমিটির তরফে অন্যত্র চলে যেতে নোটিস দেওয়া হয়েছে। পোস্টটি বিতর্কিত কি না, তা ‘ঘৃণাভাষণ’ কি না, তা দেখার জন্য পুলিশ রয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি দেওয়ার জন্য রয়েছে আদালত। তাহলে সংশ্লিষ্ট আবাসন কমিটি কেন পুলিশ ও আদালতের বিকল্প হয়ে উঠতে চাইছে?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বিভিন্ন শহরে দ্রুত গজিয়ে উঠছে বহু সোসাইটি, ‘রুদ্ধদ্বার’ কলোনি বা আবাসন। বাড়ি ছেড়ে তাতে ঢুকে পড়ছে মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষ। কিন্তু পাড়ায় মাতব্বরির অভ্যাস যাবে কোথায়! পাশাপাশি, বহিরাগতদের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব বাড়ছে। ঘেরা এলাকার মধ্যে নিজেদের ‘সুরক্ষিত’ বলে মনে করে এই ছোট ছোট ‘সম্প্রদায়’। তাই গুরুত্ব বাড়ছে সংশ্লিষ্ট আবাসন ওয়েলফেয়ার কমিটির, যারা এই ‘সুরক্ষা’ নিশ্চিত করবে, বাসিন্দাদের নানা সুবিধা-অসুবিধার দেখভাল করবে। প্রয়োজনে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা মেটাবে। কিন্তু ওই সমস্ত কমিটি মাঝেমধ্যেই এমন সমস্ত ‘ফতোয়া’ দেয়, যার সঙ্গে আইনের কোনও সম্পর্কই নেই। সেগুলো মূলত ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, পক্ষপাতিত্ব, এমনকী ‘বাতিক’ বললেও অত্যুক্তি হয় না। বাসিন্দারা রোজ কী করছেন, কী খাচ্ছেন, কী পরছেন, সেদিকেও তাদের সদা উৎসাহী নজর! ঘরে কীসের মাংস ঢুকছে? ঘুরতে বেরনো কিশোরীর হট প্যান্ট কতটা ছোট? ব্যাচেলর ছেলের ঘরে কোনও মেয়ে এসেছে কি না? বাসিন্দাদের জীবন কীভাবে চলবে, সেটাও কি আবাসন কমিটি নিয়ন্ত্রণ করবে?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: লিভ-ইন সম্পর্কেরও সরকারি নথিভুক্তিকরণ হলে, বিয়ের সঙ্গে তফাত রইল কী!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আবাসিকদের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে তৈরি হওয়া কমিটির শেষপর্যন্ত ‘গুরুত্বপূর্ণ ও একমাত্র’ কাজ হয়ে দাঁড়ায় তাদের স্বার্থের পরিপন্থী, নিজেদের মর্জিমাফিক কিছু নিয়ম চাপিয়ে দেওয়া। এই ধরনের অসংখ্য ঘটনার নির্যাস– বহু আবাসন কমিটির কাজের ধরন অনেকটা স্বৈরাচারী। যেখানে নিয়ন্ত্রণ থাকে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে। তারা ব্যক্তিগত সাম্রাজ্যের মতো কাজকর্ম চালায়। আর যারা এই ‘কোর’ গ্রুপের মধ্যে নেই, তাদের সমস্ত নির্দেশিকা মুখ বুজে মেনে চলতে হয়। অমান্য বা প্রতিবাদ করলেই শুরু হয় পদে পদে অসম্মান, হেনস্তা। আবাসন কমিটি সাধারণত সোসাইটিস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ১৮৬০-এর অধীনে একটি স্বেচ্ছাসেবী সমিতি হিসেবে নথিভুক্ত হয়। এটা বুঝে নেওয়া দরকার, কোনও আবাসন কমিটিই তাদের সদস্য হোক বা না হোক, বাসিন্দাদের স্বাধীনতার অধিকার বা গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করতে পারে না। অর্থাৎ, কে ফ্ল্যাটে আসছেন, বা তাদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ, অবাঞ্ছিত ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বিব্রত করতে পারে না। দিতে পারে না কোনও আবাসিককে হুমকি। আইন তো তাই বলছে। কিন্তু প্রায়শই আবাসন কমিটির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচার, দমনমূলক আচরণ এবং কাজকর্মে গোপনীয়তা বজায় রাখার অভিযোগ ওঠে।
মানুষ সততই গোষ্ঠীবদ্ধ জীব। পাড়ায় হোক বা আবাসনে ‘মিলে-মিশে’ থাকা বাঞ্ছনীয়। এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কিছু আবাসিক ঝামেলা তৈরি করেন, পরিবেশ দূষিত করেন। যে কোনও সামাজিক পরিসরেই তারা ‘অবাঞ্ছিত’। আর সব আবাসন কমিটিকেই এককথায় ‘খলনায়ক’ আখ্যা দেওয়া ঠিক নয়। আবাসিকদের যেমন ‘কমিউনিটি লিভিং’-এর অভ্যাস তৈরি করতে হবে, তেমনই দায়িত্বপূর্ণ ও গণতান্ত্রিকভাবে চলতে হবে আবাসন কমিটিকেও। না হলে আবাসনগুলো হয়তো আধুনিক ‘ঘেটো’তে পরিণত হবে।