মনে রাখা দরকার, অধিকাংশ হিন্দুই যেমন হিন্দুত্ববাদী নন, অধিকাংশ মুসলিম নন মৌলবাদের পক্ষে, তেমনই ইহুদিদের বিরাট অংশ জায়নবাদী নন৷ গোটা বিশ্বজুড়ে ইজরায়েলের গণহ্যার বিরুদ্ধে পথে নামছেন জায়নবাদ বিরোধী ইহুদিরা৷ ‘জিউস ভয়েস ফর পিস’-এর কর্মকর্তা জেথরো আইজেস্টাইন বলছিলেন, ‘‘আমরা হলোকাস্টের কথা জানি৷ আমাদের অনেকের পরিবার কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে প্রাণ হারিয়েছেন। আমরা তাই সর্বশক্তি দিয়ে বলার চেষ্টা করছি, ‘নট ইন আওয়ার নেম।’ বন্ধ হোক এথনিক ক্লিনজিং।’’ ‘যুদ্ধপরিস্থিতি’-র দ্বিতীয় পর্ব।
পর্ব ২
এক
যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র কয়েকদিন পরেই ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর স্ত্রী সারার ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা এবং অফিস ম্যানেজার জিপি নাভোন ইজরায়েলের সেনাবাহিনীর কাছে একটি আর্জি জানিয়েছিলেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল, অবরুদ্ধ গাজার বাসিন্দাদের হত্যা না করে বাঁচিয়ে রেখে বাড়ি বাড়ি ঢুকে নির্মম অত্যাচার করা হোক। কিন্তু আটক ফিলিস্তিনিদের জিভ যেন অক্ষত রাখা হয়। কারণ ইজরায়েলিরা তাদের আর্তনাদ উপভোগ করতে চায়। আটক আরবদের কান এবং চোখ যেন আস্ত রাখা হয়, যাতে তারা দেখতে এবং শুনতে পারে ইজরায়েলিদের উল্লাস।
ভদ্রমহিলার এমন অদ্ভুত চাহিদাকে আপাতদৃষ্টিতে ‘বিকৃতি’ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, প্যালেস্তাইনের বাসিন্দা আরবদের প্রতি ইজরায়েলের এই নৃশংসতা তাদের রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অংশ৷ কিছুদিন আগে নেতানিয়াহু মন্ত্রীসভার এক সদস্য ফিলিস্তিনিদের ওপর পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের প্রস্তাব দিয়েছেন। এগুলি মোটেই কোনও ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ নয়। গত সাড়ে সাত দশকে ধীরে ধীরে ইজরায়েলের অতিদক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজের দেশের অধিকাংশ জনগণের কাছে ফিলিস্তিনি জনগণের অবমানবীকরণ (Dehumanisation) ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। খুব সহজেই তারা বলে দিতে পারে, ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের কোনও প্রশ্ন নেই, কারণ তারা ‘মানুষ’ নয়, জানোয়ার। বছরের পর বছর, দশকের পর দশক এই নৃশংস নির্যাতন চলছে। কেন ইজরায়েল যে কোনও সংঘর্ষেই এত বেশি সংখ্যক ফিলিস্তিনি সিভিলিয়ানকে হত্যা করে? কারণ এটাই ইজরায়েলের রণকৌশল। এমনকী, যখন যুদ্ধ চলছে না, তখনও ঝাঁকে ঝাঁকে ফিলিস্তিনিকে বাছবিচারহীনভাবে হত্যা করা হয় গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে। এগুলি কোনও আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়। এসবের নেপথ্যে রয়েছে ইজরায়েলের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের পরিকল্পিত অঙ্ক।
পড়ুন প্রথম পর্ব: মৃত শিশুদের মিছিলের মুখে অসহায় বেঁচে থাকা
১৯৯৬ সালে বিপুল ফিলিস্তিনি গণবিক্ষোভের পর ইজরায়েলের মেজর জেনারেল গাবি ওফির বলেছিলেন, ‘প্যালেস্তিনীয়রা তাদের সংগ্রাম বন্ধ না করলে আমাদের আরও ভয়াবহ এবং যন্ত্রণাদায়ক প্রতিক্রিয়া দেখানো প্রয়োজন৷ তাতে ওরা ভাবতে বাধ্য হবে, আদৌ কি প্রতিরোধ সংগ্রাম করে কোনও লাভ আছে, না কি আমাদের আধিপত্য মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণ করাটাই মঙ্গল?’ ইজরায়েলের ডিফেন্স ফোর্সের নীতিনির্ধারকরা প্রথম থেকেই ফিলিস্তিনিদের ওপর একটানা হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন, একমাত্র নির্যাতনের পথেই তাদের বোঝানো সম্ভব যে, ইজরায়েলের পায়ের তলায় থাকা ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই।
দুই
ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ‘সন্ত্রাস’, তথাকথিত ইসলামি মৌলবাদ বা অধুনা হামাসের আক্রমণ ইজরায়েলের কাছে গণহত্যা চালানোর ছুতো ছাড়া আর কিছু নয়৷ প্রথম এবং দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামের নেতৃত্বে হামাস ছিল না। দু’টি ইন্তিফাদাতেই নেতৃত্বকারী ভূমিকায় ছিল ‘পিএলও’। যার কেন্দ্রীয় অবস্থানে ছিল (এখনও আছে) প্রয়াত ইয়াসের আরাফতের সংগঠন, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তি ‘ফাতাহ্’। সহযোগী শক্তি হিসাবে ছিল একাধিক বামপন্থী দল ও গোষ্ঠী। সেই দু’টি ইন্তিফাদার সময়ও ফিলিস্তিনিদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছিল ইজরায়েল। এখন যেমন তারা দায়ী করছে হামাসকে, প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময়ে তারা দায়ী করেছিল আরাফত, ‘ফাতাহ্’ এবং ‘পিএলও’-কে৷ ‘হামাস’ বা ‘পিএলও’ বা কমিউনিস্ট গেরিলা ‘পিএফএলপি’– যে শক্তিই ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব দিক, গোটা প্যালেস্তাইনের আবালবৃদ্ধবনিতাকে ‘কালেক্টিভ পানিশমেন্ট’-এর মুখে ফেলা ইজরায়েলের সমরনীতির অংশ।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ‘পিএলও’-র নিরাপত্তা কর্মকর্তা মোহাম্মদ দাহলান ইজরায়েলের তৎকালীন চিফ অফ স্টাফ শাউল মোফাজকে ফোন করে বলেছিলেন, এ কেমন যুদ্ধ, যেখানে শতাধিক ফিলিস্তিনি মারা গেল, অথচ একজন ইজরায়েলিও মরল না! মোফাজ কোনও জবাব দেননি। তিনি এই পরিসংখ্যানকে কমপ্লিমেন্ট হিসাবে নিয়েছিলেন। আগেকার দিনে শিকারিরা যেমন বন্য পশুপাখি শিকার করে তাদের চামড়া ঝুলিয়ে রাখতেন ড্রইং রুমে, ঠিক তেমনই ফিলিস্তিনের খুন করে ইজরায়েল। শিকারের সঙ্গে এর কোনও পার্থক্যই নেই। নয়তো ২০১৪ সালে ইজরায়েল যখন গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, অসংখ্য শিশু ঝলসে যাচ্ছে, সেই অনুপম দৃশ্য দেখার জন্য পাহাড়ের উপর খাদ্য এবং পানীয় নিয়ে জায়নবাদীরা ভিড় জমাত না৷ চলমান যুদ্ধে হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু তাই নিছক কোনও দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত গণহত্যা।
তিন
লন্ডন-সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধবিরোধী মিছিলে অংশ নিচ্ছেন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি৷ তাদের হাতে ব্যানার, ‘এই যুদ্ধ ৭ নভেম্বর শুরু হয়নি।’ সত্যিই তাই৷ গত ৭৫ বছর ধরে প্যালেস্তাইনের সাধারণ মানুষ বসবাস করে একটি স্থায়ী ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ বা ‘দীর্ঘস্থায়ী গণহত্যা’র মধ্যেই৷ হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়া হিসাবে এই চলমান গণহত্যায় মৃত্যুর সংখ্যা অনেকখানি বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবতার কোনও মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। ঝাঁকে ঝাঁকে ফিলিস্তিনিকে খুন করার জন্য ইজরায়েলের কোনও হামাস-অজুহাতের প্রয়োজন নেই। ফিলিস্তিনিদের খুন করা জায়েজ, কারণ তারা ফিলিস্তিনি। গাজায় যখন নির্বিচারে গণহত্যা চলছে, তখন ঠিক কী পরিস্থিতি ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে? সেখানে তো হামাসের অস্তিত্ব নেই। খাতায়-কলমে শাসনভার ‘পিএলও’ পরিচালিত প্যালেস্তাইন অথরিটির (পিএ) হাতে। তারা ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি৷ ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকে একটি রকেটও উড়ে যায়নি ইজরায়েলের দিকে। অথচ গত একমাসে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ৪৪ জন শিশু-সহ ১৬৪ জন ফিলিস্তিনিকে খুন করেছে ইজরায়েল। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের বাসিন্দা অসংখ্য ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করে চূড়ান্ত নির্যাতন চলছে। জেলের ভিতরে বন্দিদের গায়ে কুকুর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। একাধিক বন্দি জেলের ভিতরে প্রাণ হারিয়েছে।
কথা হচ্ছিল ‘পিএলও’-র অন্যতম শরিক ফিলিস্তিনের কমিউনিস্ট শক্তি ‘প্যালেস্তাইন পিপলস পার্টি’র নেত্রী নওল মুসার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের পরিস্থিতি যে কোনও পরাধীন দেশের চেয়েও ভয়াবহ। পিএলও শাসনক্ষমতায় আছে ঠিকই, কিন্তু কার্যত তার কোনও ক্ষমতাই নেই৷ গোটা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের মাত্র ১৮ শতাংশ এলাকা এখন পুরোপুরি ‘পিএলও’-র নিয়ন্ত্রণে। ২২ শতাংশ এলাকার আংশিক নিয়ন্ত্রণ ‘পিএলও’-র, আংশিক ইজরায়েলের সশস্ত্র বাহিনীর। বাকি ৬০ শতাংশ এলাকা অবৈধ এবং সশস্ত্র ইজরায়েলি দখলদার এবং সেনাবাহিনীর দখলে। গোটা ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক জুড়ে প্রতিদিন নির্যাতন চালায় ইজরায়েলের সশস্ত্র বাহিনী। খুন, বাড়িঘর ভাঙচুর, ধর্ষণ, নির্বিচারে গুলিবর্ষণ নিত্যদিনের ঘটনা। কেবলমাত্র ২০২২ সালেই ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে খুন হয়েছে দুই শতাধিক ফিলিস্তিনি। মনে রাখতে হবে, গত বছর কিন্তু কোনও যুদ্ধ চলছিল না, ইজরায়েলের উপর কোনও আক্রমণ হয়নি। তা সত্ত্বেও দুশোর ওপর ফিলিস্তিনি খুন হয়ে গেল৷ ২০২২ সালকে বলা হচ্ছে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ‘ডেডলিয়েস্ট ইয়ার’। যারা ৭ নভেম্বরের আগের ইতিহাস থেকে চলমান যুদ্ধকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে, তারা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সুবিচার করছে না। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডকে বাদ দিয়ে চট্টগ্রামে সূর্য সেনের নেতৃত্বে সংগঠিত যুব বিদ্রোহকে বিচার করা যায় না। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গকে বাদ দিয়ে ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকির বোমাবর্ষণকে বিচার করা যায় না।
কেবল ২০২২ নয়, প্রতি বছর ঝাঁকে ঝাঁকে শিশু-সহ ফিলিস্তিনিরা খুন হয়েছে গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে। ২০১৮ সালে ২৯৯ জন ফিলিস্তিনিকে খুন করে ইজরায়েল। গুরুতর আহত হন ৩১,৭২৩ জন ফিলিস্তিনি। ২০১৯ সালে খুন হন ১৩৩ জন ফিলিস্তিনি। তার মধ্যে ২৫ জন নাবালক-নাবালিকা। গাজায় খুন হন ১০৪ জন, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ২৬ জন। ২০২১ সালে খুন হন ৩১৩ জন ফিলিস্তিনি৷ তার মধ্যে নাবালক-নাবালিকা ৭১ জন। ২০২২ সালে খুন হন ২০৪ জন ফিলিস্তিনি। ১৪২ জন গাজায়, ৩৭ জন ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে। একের পর এক বছর ধরে ধরে এইরকম হিসাব দেওয়া যায়। এই নৃশংস গণহত্যার সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের প্রথম নকবার সময় থেকেই। ক্রমে তার তীব্রতা বেড়েছে।
চার
মনে রাখা দরকার, অধিকাংশ হিন্দুই যেমন হিন্দুত্ববাদী নন, অধিকাংশ মুসলিম নন মৌলবাদের পক্ষে, তেমনই ইহুদিদের বিরাট অংশ জায়নবাদী নন। গোটা বিশ্বজুড়ে ইজরায়েলের গণহ্যার বিরুদ্ধে পথে নামছেন জায়নবাদ বিরোধী ইহুদিরা। ‘জিউস ভয়েস ফর পিস’-এর কর্মকর্তা জেথরো আইজেস্টাইন বলছিলেন, ‘‘আমরা হলোকাস্টের কথা জানি৷ আমাদের অনেকের পরিবার কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে প্রাণ হারিয়েছেন। আমরা তাই সর্বশক্তি দিয়ে বলার চেষ্টা করছেন, ‘নট ইন আওয়ার নেম।’ বন্ধ হোক এথনিক ক্লিনজিং।’’ প্রতিটি যুদ্ধবিরোধী মিছিলেই হাজারে হাজারে অংশ নিচ্ছেন ইজরায়েলের বামপন্থী দল ‘মাকি’র সদস্যরা। তাদের অন্যতম আমোস এবং আখিবা– দুই ভাই। তাঁদের কাছ থেকে শুনছিলাম, প্রবল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখেও যুদ্ধের নামে গণহত্যা বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ হচ্ছে ইজরায়েলে। আমোস বলছিলেন, ‘আমাদের সোশাল মিডিয়ার রিচ কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আমরা বিকল্প পদ্ধতিতে প্রচার করছি। টেলিগ্রাম, টিকটক ব্যবহার করছি।’
মিছিলে বিরাট সংখ্যায় আসছেন ‘জিউস ভয়েস ফর লেবার’-এর সদস্যরা। লেবার পার্টির প্রাক্তন নেতা জেরেমি করবিনের অনুগামী তাঁরা। আসছেন ‘জিউস নেটওয়ার্ক ফর প্যালেস্তাইন’-এর সদস্যরা। এমন আরও অনেক সংগঠন। করবিন বলছিলেন, ‘লড়াইটা খুব শক্ত। কিন্তু এই লড়াইটা না লড়ে আমাদের উপায় নেই৷ আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, ইজরায়েলের নৃশংস দখলদারির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানে ইহুদিবিদ্বেষ নয়। বরং মানবতার পক্ষে থাকা ইহুদিরা ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন। সোচ্চারে বলছেন, এই গণহত্যার রক্ত কেবল জায়নবাদীদের হাতেই লেগে রয়েছে। সব ইহুদির হাতে নয়।
পাঁচ
ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ হিব্রু বাইবেল বা ‘তানাখ’ অনুসারে, নবী আব্রাহামকে ঈশ্বর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁর বংশধরদের জন্য একটি ভূখণ্ড নির্দিষ্ট করা রয়েছে। এই মাটি তাঁদের পূণ্যভূমি। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বর্তমানের প্যালেস্তাইন এবং ইজরায়েলই সেই তথাকথিত পূণ্যভূমি। যদিও বাইবেলের আরেকটি বিবরণ অনুসারে এই পূণ্যভূমি মিশর থেকে ইউফ্রেটিস নদীর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত।
এ-কথা অস্বীকার করার কোনও প্রশ্নই নেই যে, সুপ্রাচীন কাল থেকেই এই অঞ্চলে ইহুদিরা বসবাস করে আসছিলেন। আনুমানিক ৭০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রোমানরা জেরুজালেমে ইহুদিদের মন্দির ধ্বংস করে তাদের তাড়িয়ে দেয়। এরপর ইহুদিদের এক বিরাট অংশ মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ইহুদি জাতির চেতনায় রয়ে যায় পুণ্যভূমিতে ফিরে আসার স্বপ্ন। তবে একইসঙ্গে বলা দরকার, ইহুদিদের একটি বড় অংশ বিতাড়িত হলেও বাকিরা রয়ে গিয়েছিল ওই এলাকাতেই। তাদের একাংশ পরবর্তীকালে ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে। বাকিরা ইহুদিই থেকে যায়।
জায়নবাদের রমরমা শুরু হয় বিশ শতকের শুরুতে। ১৮৯৫ সালে অস্ট্রিয়ার লেখক নাথাম বারমবুম প্রথম ‘জায়নিজম’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তার দু’বছর পর ১৮৯৭ সালে আরেক অস্ট্রিয়ান ইহুদি থিওডর হারজেলের উদ্যোগে সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরে প্রথম বিশ্ব জায়নবাদী কংগ্রেস হয়। এর ২০ বছর বাদে ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার ব্যালফোর জায়নবাদী নেতা ব্যারন রথসচাইল্ডকে চিঠি লিখে জানান, প্যালেস্তাইনে ইহুদি আবাসভূমি গড়ে তুলতে যা প্রয়োজন, তাই করবে ব্রিটিশ সরকার।
ব্যালফোর ঘোষণা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে থাকা প্যালেস্তাইন ভূখণ্ড প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ইংরেজদের হাতে চলে যায়। এই ভূখণ্ডে আগে থেকেই আরব মুসলমানদের পাশাপাশি সংখ্যায় কম হলেও খ্রিস্টান এবং ইহুদিরা বসবাস করতেন। এই ইহুদিরা ছিলেন অধিকাংশই প্রাচ্যের ইহুদি, যারা ‘মিজরাহি’ নামে পরিচিত ছিলেন। উনবিংশ শতকের শেষদিক থেকে এই ভূখণ্ডে ইউরোপ থেকে ইহুদিরা আসতে থাকে, যারা ‘আশকেনাজি’ নামে পরিচিত। ব্যালফো-র ঘোষণাপত্রের পরে বহিরাগত ইহুদিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তারা স্থানীয় আরবদের থেকে জমিজমা কিনে বসবাস করতে শুরু করে। ইজরায়েল রাষ্ট্র বনাম প্যালেস্তাইনের জনতার সংগ্রামকে তাই কোনওভাবেই মুসলিম বনাম ইহুদি বিরোধ হিসাবে দেখানো যায় না। কারণ ফিলিস্তিনের অধিবাসীদের মধ্যে কেবল মুসলিম নেই। আছেন আরব খ্রিস্টানরাও। প্যালেস্তাইনের মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বামপন্থী চরিত্র জর্জ হাবাস ছিলেন খ্রিস্টান।
ছয়
একদম প্রথম থেকেই এই সংকটের জন্য অনেকখানি দায়ী ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকার। ১৯২১ সালেই ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ মদতে হাগনাহ নামে আধাসামরিক বাহিনী তৈরি হয়। পরে আরও দু’টি জায়নবাদী সশস্ত্র সংগঠন– ‘ইরগুন’ এবং ‘স্টার্ন গ্যাং’ গড়ে ওঠে। এই সংগঠনগুলোর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে ভারতের রণবীর সেনা বা সানলাইট সেনার সঙ্গে। কার্যকলাপও একই রকম– আরবদের উপর সন্ত্রাস চালানো, খুন, লুটপাট, ধর্ষণ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। মজার বিষয় হল, ১৯৪৮ সালে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর এই সংগঠনগুলি ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে মিশে যায়।
নাৎসি আমলে বীভৎস অত্যাচার এবং গণহত্যার শিকার হন ইহুদিরা। এই ভয়াবহ অত্যাচার ইহুদিদের নিজস্ব রাষ্ট্র তৈরির জায়নবাদী দাবিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ সালে জায়নবাদীদের বাল্টিমোর সম্মেলনে প্যালেস্তাইনের একাংশে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব পাশ হয়। যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৪৫ সালে। তার আড়াই বছরের মধ্যেই ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর সদ্যগঠিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডকে ইহুদি এবং আরবদের মধ্যে দুই ভাগ করার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। আরব লিগ এতে আপত্তি তোলে। তাদের বক্তব্য ছিল, ইহুদিদের ওপর নির্যাতন করেছে নাৎসিরা। তাদের পাপের ফল কেন মধ্যপ্রাচ্য বহন করবে?
গাজায় ইজরায়েলের এমন নৃশংস কার্যকলাপ শিকড় লুকিয়ে আছে ইজরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ানেট-এর ‘প্ল্যান দালেত’ বা ‘প্ল্যান ডি’ পরিকল্পনায়। এর মাধ্যমে আরবদের নিশ্চিহ্ন করার ছক কষেছিলেন তিনি। ১৯৪৮ সালের ১০ মার্চ প্ল্যান ডি চূড়ান্ত হলে হাগনাহ, স্টার্ন গ্যাং সমেত জায়নবাদী সংগঠনগুলি হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজের মাধ্যমে গোটা অঞ্চলে বিপুল সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাড়ে সাত লক্ষ ফিলিস্তিনি আশপাশের আরব দেশগুলিতে উদ্বাস্তু হিসাবে আশ্রয় নেয়। বেশ কিছু জায়গায় দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে কিছু ইহুদিও মারা যায়। এর মধ্যেই মে মাসে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে গুরিয়ান স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। ১৯৯৮ সালে জায়নবাদীরা যখন ইজরায়েলের জন্মের ৫০ বছর পালন করছেন, তখন থেকেই আরবরা ১৫ মে তারিখটিকে ‘আল নকবা’ বা ‘বিপর্যয়’ হিসাবে পালন করেন।
সাত
প্রথম নকবার ঘরছাড়া হয়েছিলেন মহম্মদ সালেহ্। তখন তাঁর বয়স ৬ বছর, অশীতিপর সালেহ্-র সঙ্গে কথা বলছিলাম লন্ডনের ক্রয়ডনের রাস্কিন হাউজে। সালেহ্ বলছিলেন, ‘তাড়া খেয়ে আমরা প্রথমে যাই লেবাননে। তারপর মিশরে। একটু বড় হওয়ার পর বুঝতে পারি, আমাদের পক্ষে আর ফেরা সম্ভব নয়। গোটা জীবনটাই কাটাতে হবে উদ্বাস্তু শিবিরে। তাই আপ্রাণ চেষ্টা করে পড়াশোনা শিখি। প্রথমে বৃত্তি নিয়ে নিজে চলে আসি ইংল্যান্ডে। তারপর পরিবারকে নিয়ে আসি।’
কট্টর বামপন্থী সালেহ্ নিজে বামপন্থী গেরিলা সংগঠন পিএফএলপি-র প্রবাসী সংগঠনের হয়ে কাজ করেছেন। গত ৬০ বছর ধরে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন প্রবাসী ফিলিস্তিনিদের আন্দোলনে। তিনি বলছিলেন, ‘গত ৭৫ বছরে চারটি বড় আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের প্রতিটিতে আমরা পরাজিত হয়েছি। ১৯৬৭ সালে গোলান উপত্যকা, পূর্ব জেরুজালেম এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইজরায়েল তার কর্তৃত্ব স্থাপন করে। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি আমাদের অনেককে আশাবাদী করে তুলেছিল। কিন্তু চুক্তির কোনও শর্তই ইজরায়েল মানেনি৷ দখলদারি এবং নির্যাতন আরও বেড়েছে। প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে অবৈধভাবে জমি দখল, বসতি নির্মাণ, ফিলিস্তিনিদের সব রকমের নাগরিক অধিকার হরণ, পানীয় জলের সরবরাহ বন্ধ করা– সবকিছুই করে চলেছে ইজরায়েল। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আমাদের পবিত্র কর্তব্য।’
২৮ বছর বয়সি ফিলিস্তিনি তরুণী আইনাজ বক্তৃতা করছিলেন ইসলিংটনের ভিড়ে ঠাসা সভাঘরে। প্যালেস্তাইন ইয়ুথ মুভমেন্টের গ্রেট ব্রিটেনের সংগঠক তিনি। মঞ্চের ঠিক সামনেই হুইল চেয়ারে বসে ছিলেন তাঁর মা– ফতিমা। ইজরায়েলের হামলায় দুটো পাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে বছর পঞ্চাশের মহিলার। আইনাজ বলছিলেন, ‘ওরা যদি গোটা গাজা ধ্বংস করে দেয়, যদি সব শিশুকে খুন করে, তাহলেও প্যালেস্তাইনের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে খতম করতে পারবে না। আমার দিদা শহিদ হন প্রথম ইন্তিফাদায়৷ তাঁর কাছ থেকে আমার মা পেয়েছে স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন। দ্বিতীয় ইন্তিফাদায় আমার মায়ের দুটো পা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তার কাছ থেকে ইন্তিফাদার চেতনা পেয়েছি আমি৷ আমার কাছ থেকে পাবে আমার সন্তান। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমরা লড়ব। একদিন প্যালেস্তাইন মুক্ত হবেই।’
ছবিঋণ: লেখক