আজকে বিহারে বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর নামে যে তথ্য চাওয়া হয়েছে, তা যদি দেশের আদালত শেষ অবধি মেনে নেয়, তাহলে বহু মহিলার নাম বাদ পড়বে বিহারের ভোটার তালিকা থেকে। নির্বাচন কমিশনের এই তুঘলকি ফরমানে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মহিলারা। সমস্ত নথি থাকা সত্ত্বেও যদি নির্বাচন কমিশন মনে করে, কাউকে তালিকার বাইরে রাখবে, তা নিয়ে মামলা করেও লাভ হবে না। তাছাড়া কত গরিব মানুষ মামলা করবেন? কত টাকা তাঁরা খরচ করতে পারবেন এই মামলার পিছনে, নিজেদের ভোটাধিকার নাগরিকত্বের অধিকার ফিরে পেতে?
বহুদিন ধরে প্রচার করা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে দলে দলে মানুষ ভারতে ঢুকে, এখানে আধার কার্ড বানিয়ে, তারপর ভোটার তালিকায় নাম তুলে ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়ে গেছে। কেন্দ্রে শাসক দলের নতুন সভাপতি বলেছেন, ভারত তো কোনও ধর্মশালা নয়, যে কেউ এসে ঢুকে পড়বে। এই প্রচারে অনেকেই প্রভাবিত হচ্ছেন এবং বিহারে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনীকে সমর্থন করছেন আর মনে মনে ভাবছেনও– এরপর বাংলায় এই একই প্রক্রিয়া নেওয়া হলে ভালোই হবে, যত ‘উইপোকা’দের এবার বাংলাদেশে পাঠানো হবে।
নির্বাচন কমিশন এই প্রক্রিয়া চলাকালীন জানিয়েছে, আপাতত কোনও প্রামাণ্য নথি না দিলেও চলবে, শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ফর্ম ভর্তি করে জমা দিলেই হবে। পাশাপাশি অবশ্য তারা এটাও জানিয়েছে, ওই ফর্ম জমা দেওয়ার এক মাসের মধ্যে নির্দিষ্ট নথি জমা করতে হবে, সেগুলি দেখেই তবে নির্বাচন কমিশন একজন ব্যক্তির ভোটাধিকার নিশ্চিত করবে।
এই ধরনের একটি প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কারা হতে পারে, এই বিষয়ে একটু তথ্যতালাশ করলে অনেকেই হয়তো অবাক হবেন। অনেকে ভাবছেন, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বেশিরভাগ মুসলিম তথা সংখ্যালঘু বাদ পড়বেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার বকলমে যা প্রচার করেছে, সেটাই সত্যি বলে প্রমাণিত হবে। কিন্তু সত্যিই কি তাই হবে? ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা কত? ২০১১ সালের জনগণনার তথ্য বলছে মোটামুটি ১৭.২২ কোটি অর্থাৎ, মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ মানুষ মুসলমান। অসমে যখন নাগরিকপঞ্জির কাজ হয় তখন দেখা গিয়েছিল শেষপর্যন্ত মোট ১৯ লক্ষ মানুষ বাদ পড়েছেন ওই তালিকা থেকে। যার মধ্যে ৭ লক্ষ মানুষ মুসলিম ধর্মাবলম্বী, অর্থাৎ প্রায় ৩৪ শতাংশ। ঘটনাচক্রে অসমের মুসলিম জনসংখ্যাও প্রায় ৩৪-৩৫ শতাংশ। যেহেতু জনগণনার হিসেব সারা দেশ ধরে করা হয় এবং বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যার হার বিভিন্ন রকম, বিহারের ক্ষেত্রেও এই বাদ পড়ার অনুপাতটাও সেই রাজ্যের জনসংখ্যার অনুপাতেই হয়তো হবে।
২০১১ সালের জনগণনার তথ্য বলছে, বিহারের মুসলিম জনসংখ্যা ১.৭৫ কোটি আর ২০২২ সালে বিহারে যে জাতি জনগণনা হয়েছিল তাতে দেখা গিয়েছিল ১৭.৭ শতাংশ মুসলমান বিহারে বসবাস করেন। তাহলে কি এই এত সংখ্যক মানুষকে বাদ দিয়ে নতুন ভোটার তালিকা তৈরি হবে? সেটা কি আদৌ সম্ভব? সেইরকম কিছু ঘটলে সারা বিশ্বে ভারতের নির্বাচন কমিশনের যে দুর্নাম হবে, তা কি নরেন্দ্র মোদি সরকারের জন্য ভালো বিজ্ঞাপন হবে?
অসমে যখন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে নাগরিক পঞ্জিকরণ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল, তখন দেখা গিয়েছিল সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন মহিলারা। বিয়ের আগের পদবির সঙ্গে বিয়ের পরের পদবির অমিল পাশাপাশি বয়স সংক্রান্ত তথ্যের অসঙ্গতির কারণে মহিলাদের সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হয়েছিল। বাংলাভাষী মানুষদের একধরনের অসুবিধা হয়েছিল, আর মহিলা ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের আর এক ধরনের অসুবিধায় পড়তে দেখেছি আমরা। দিনের পর দিন, দূরদূরান্ত থেকে মহিলারা টাকা খরচ করে, বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি যানবাহনে চেপে সরকারি দপ্তরের দরজায় দরজায় হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছেন, নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে।
নূরজাহান বেগম, অসমের বনগাইগাঁও জেলার কাছারিপেট্টি গ্রামের এক ৪৩ বছর বয়সি মহিলা, তার কথাই ধরা যাক। ২১ এপ্রিল, ২০১৬ সালে তাঁকে একটি বিদেশি ট্রাইবুনাল জানায়, তিনি ভারতে একজন অনুপ্রবেশকারী, কারণ তিনি ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালের পরে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছেন। নূরজাহানের বাবা-মা কিংবা তাঁর পাঁচ বোন এবং সন্তানের নাম কিন্তু অসমের নাগরিকপঞ্জির তালিকায় ছিল। ১৭ বছর বয়সে বিয়ের পরে নূরজাহান কাহাবাড়ি গ্রাম থেকে কাছারিপেট্টি গ্রামে চলে আসেন। বেশ কিছু প্রামাণ্য নথি তিনি দেওয়ার চেষ্টা করেন, যাতে তাঁর সঙ্গে তাঁর বাবা-মায়ের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়, এমনকী বহু টাকা খরচ করে তিনি তাঁর বিয়ের শংসাপত্রও সংগ্রহ করে জমা দেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও অসম হাইকোর্টের বিদেশি চিহ্নিতকরণের যে ট্রাইবুনাল, তার বিচারকেরা তাতে সন্তুষ্ট না হওয়ায় তাঁকে ‘বিদেশি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। কোনও দোষ না করে, শুধু নথিপত্র বিচারকদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি বলে তাঁকে দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয়। তারপরে ২১ এপ্রিল ২০২০ সালে তাঁকে একটি বিশেষ আদালত জেল থেকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেয়। নূরজাহানের উদাহরণ দেখলেই বোঝা যায়, শুধু নথি দেখাতে না পারার কারণে একজন সংখ্যালঘু মহিলাকে কী অসম্ভব অসুবিধার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। রাষ্ট্রের যখন দায়িত্ব একজন নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়ার, যখন বোঝানোর কথা যে, তাদের ভুলে নূরজাহানের এই পরিণতি হয়েছে, তখন রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
শুধু নূরজাহান বেগম নয়, বক্সা জেলার তমুলপুরের বাসিন্দা ৫০ বছরের জাবেদা বেগম, বিয়ের আগে যাঁর নাম ছিল জাবেদা খাতুন, নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করতে তাঁর পরিবারের সকলের নাগরিকপঞ্জির ১৫টি নথি জমা দেন। জমির কাগজপত্র, ভোটার তালিকায় তাঁর নাম থাকার কাগজ, প্যান কার্ড, জমির খাজনার কাগজ সব জমা করেন। গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান নিজে লিখে দেন জাবেদা বেগম বা জাবেদা খাতুন, স্বর্গীয় মহম্মদ জাবেদ আলির সন্তান এবং ভারতীয়, তা সত্ত্বেও আদালত বলে প্যান কার্ড কিংবা ব্যাঙ্কের পাসবুকে দু’রকমের পদবি থাকাটা কিছুতেই একজন মানুষের ভারতীয় হওয়ার মাপকাঠি হতে পারে না। অতঃপর দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আগের একটি রায় থাকা সত্ত্বেও জাবেদা বেগমকে বিদেশি নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
আজকে বিহারে বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর নামে যে তথ্য চাওয়া হয়েছে, তা যদি দেশের আদালত শেষ অবধি মেনে নেয়, তাহলে বহু মহিলার নাম বাদ পড়বে বিহারের ভোটার তালিকা থেকে। নির্বাচন কমিশনের এই তুঘলকি ফরমানে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মহিলারা। সমস্ত নথি থাকা সত্ত্বেও যদি নির্বাচন কমিশন মনে করে, কাউকে তালিকার বাইরে রাখবে, তা নিয়ে মামলা করেও লাভ হবে না। তাছাড়া কত গরিব মানুষ মামলা করবেন? কত টাকা তাঁরা খরচ করতে পারবেন এই মামলার পিছনে, নিজেদের ভোটাধিকার নাগরিকত্বের অধিকার ফিরে পেতে?
পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। তার সঙ্গে যুক্ত হয় সামাজিক অসাম্য। মহিলাদের অভিজ্ঞতা পাশের যে কোনও পুরুষের থেকে অনেক বেশি, যার ফলে তাঁরা নানা সময়ে বেশি বিপদ এবং অসুবিধার সম্মুখীন হবেন সেটাই স্বাভাবিক। অসমের নাগরিকপঞ্জিতে যেভাবে লক্ষ লক্ষ মহিলাদের অসুবিধায় পড়তে হয়েছে, নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে তাতে সেটা কাফকার উপন্যাসের ভয়ের কথাগুলোই মনে করিয়ে দেয়। একজন মহিলাকে যদি তাঁর নাগরিকত্ব এবং জাতীয়তাবাদের প্রমাণ করতে হয়, তাহলে সেটা যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা কিছুদিন আগে অসম বুঝেছে, এরপর বিহারের মহিলারা হয়তো বুঝবেন। তারপরে বাংলার গ্রামগঞ্জের মহিলাদের পালা। অসমে বিশেষ করে সংখ্যালঘু (শুধু মুসলমান নয়) মহিলারা যেভাবে কঠোর নিয়মাবলি এবং নথি দেওয়ার জাঁতাকলে পড়ে নাজেহাল হয়েছেন সেটা যে আবার বিহারে হতে চলেছে, তা বোঝাই যাচ্ছে। একজন মহিলা যদি ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হন, তাহলে তাঁর যে কী কী সমস্যা হতে পারে, কী কী অধিকার থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়, সেটা কোনও পুরুষ কোনওদিনই অনুধাবন করতে পারে কি?
বিবাহিত মহিলাদের সমস্যা আরও বেশি। তাঁদের পারিবারিক যোগসূত্র প্রমাণ করতে গিয়ে নিজের এবং সন্তানদের বাঁচাবেন কী করে? রাষ্ট্রপুঞ্জের আইন বলে শিশু ও নারীদের এইভাবে তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না, কিন্তু আমাদের সরকার কি সেই সব আইনের তোয়াক্কা করে? রাষ্ট্রের ঠিক করা কাগজ না থাকলে একজন মহিলা বে-নাগরিক হয়ে যাবেন? তাহলে কীসের জন্য মহিলা সংরক্ষণ বিল আর কী জন্যই বা ‘বেটি পড়াও বেটি বাঁচাও’ স্লোগান দেওয়া?
……………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
……………………………..