Robbar

মানুষ যখন শিশুদের চিনি-রং-ফ্লেভারে ভবিষ্যৎ খোঁজে, তখন জনস্বাস্থ্য আর নীতির নয়, লাভের প্রশ্ন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 29, 2025 4:58 pm
  • Updated:October 29, 2025 4:58 pm  

জনস্বাস্থ্য ও বাণিজ্যের টানাপোড়েন নতুন কিছু নয়। কিন্তু এখানে লড়াইটা হল ‘ORS (ওআরএস)’ শব্দের ব্যবহার নিয়েই। লক্ষ করার মতো বিষয় হল– ২০২২-এ FSSAI (এফএসএসএআই) যে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তারপর ট্রেডমার্ক আইনের অজুহাতে নিজেই আবার সেই অনুমতি ফিরিয়ে দেয়। ফলে এক অর্থে এখানে রাষ্ট্র স্বীকার করে নিল যে, এখন মানুষের জীবনের চেয়ে বড় হল কর্পোরেট স্বার্থ। আর তারাই এখন জনস্বাস্থ্যের নিয়ম নির্ধারণের কাণ্ডারি।

অভিজিৎ রায়

এক গ্লাস চিনি-জলে ঢাকা পড়েছে ভারতের জনস্বাস্থ্যের ইতিহাস!

ওষুধের দোকানের আলোর নিচে ঝকঝকে বোতল। নীল, কমলা, সবুজ রঙের লিকুইড, আর তার ওপরে বড় হরফে লেখা– ‘ওআরএস’। যে নাম একসময় হাজারও প্রাণ বাঁচিয়েছিল, আজ তা বিকোচ্ছে ‘refreshing drink’ হিসেবে। ফ্লেভার ও চিনির মোড়কে।

বাজারে সেই বোতলগুলোর চকচকে শরীরের ভেতর লুকিয়ে আছে এক ধূসর নৈতিকতার কাহিনি। জনস্বাস্থ্যের ইতিহাসে এ এক অদ্ভুত পরিহাস। যেখানে ‘জীবনরক্ষক দ্রবণ’ এখন পরিণত হয়েছে ‘কর্পোরেট শর্করা’-র প্রতীকে।

যে পানীয় ঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে

এই গল্প শুরু হয়েছিল এক বাঙালির হাত ধরে, আর তা এখন আর এক ভারতীয় শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের হাত ধরে অগ্নিপথের স্বাক্ষী হয়ে থাকছে।

এক বাঙালির হাতে বিশ্বের এক অলৌকিক আবিষ্কার। তখন ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যখন শরণার্থী শিবিরে কলেরা, ডায়রিয়া, পানীয় জলের অভাব, আর মৃত্যুর মিছিল চলছে। ওষুধ নেই, স্যালাইন নেই, হাসপাতাল নেই। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় জল। সেই জলও তখন বিষাক্ত। সেই সময়েই এক তরুণ বাঙালি বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক, ডা. দিলীপ মহলানবীশ, খুঁজে পেলেন এক মানবিক সমীকরণ– এক লিটার জলে এক চামচ লবণ, আট চামচ চিনি।

ডা. দিলীপ মহলানবীশ

এই সাধারণ দ্রবণেই লুকিয়ে ছিল জীবনের সমাধান। ডায়রিয়ায় হারানো ইলেকট্রোলাইট ও তরল পুনরুদ্ধারে এই পানীয় কাজ করল আশ্চর্যভাবে। মৃত্যু কমল, শিশুদের মুখে ফের ফুটল হাসি। এভাবেই এক সাধারণ মিশ্রণ– চিনি, লবণ আর জল; পরিণত হয়েছিল জনস্বাস্থ্যের বিপ্লবে। তাঁরই হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল ‘পিপলস মেডিসিন’-এর ধারণা। যেখানে ওষুধ নয়, সাধারণ মানুষই হয়ে ওঠে আরোগ্যের বাহক।

পরে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা একে স্বীকৃতি দিয়ে বলল– ‘The most important medical discovery of the 20th century.’ অর্থাৎ, ‘বিশ শতকের চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।’

এক বাঙালির গৃহস্থালির পরিমাপেই বিশ্ব খুঁজে পেল তার জনস্বাস্থ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাঠ: low-cost, high-impact human science (স্বল্প ব্যয়ে, উচ্চ প্রভাবের মানববিজ্ঞান)।

এর ঠিক অর্ধশতক পর, এখন শহরের দোকানগুলোতে বিকোচ্ছে ওআরএসএল, ইলেকট্রোলাইট ড্রিঙ্ক, আর ‘ইনস্ট্যান্ট এনার্জি সলিউশন’। লেবেলে লেখা– ‘‘ORS (ওআরএস), ‘For instant rehydration, Doctor recommended’ (চিকিৎসক স্বীকৃত)”। কিন্তু বোতলের ভিতরে যে দ্রবণ, তা আর মহলানবীশের মানবিক সমীকরণ নয়। WHO (বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা) অনুমোদিত ওআরএসে যেখানে প্রতি লিটারে ১৩.৫ গ্রাম চিনি, সেখানে এসব পণ্যে সেই মাত্রা প্রায় ১০ গুণ বেশি। অর্থাৎ, ডায়রিয়ায় জীবন বাঁচানোর পরিবর্তে এই পানীয় বাড়িয়ে দিচ্ছে বিপদ। চিনি জলকে টেনে নিচ্ছে অন্ত্রের ভেতর থেকে, শরীর আরও জলশূন্য হচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই বিকৃতি– বাজারের কাছে আত্মসমর্পণ। ‘ওআরএস’– যে নামটি একসময় ছিল মানবতার প্রতীক, আজ তা ব্যবসার ব্র্যান্ড।

হাসপাতালের বাইরে, শহরের ওষুধের দোকানে, এমনকী, মলের কোল্ড ড্রিংকস সেকশনে পর্যন্ত এখন দেখা যায় বোতলভর্তি ‘ORSL (ওআরএসএল)’। চিনির জলে ঢাকা পড়ে গিয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের আসল পাঠ। এখানে বাজারি ব্যবস্থাই বিজ্ঞানের শিক্ষক। তাই ভারতের মতো দেশে আজ স্বাস্থ্য একটি ব্র্যান্ড, আর জীবন কেবল এক লেবেল।

এই প্রতারণার বিরুদ্ধে একরোখা লড়ছেন হায়দরাবাদের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শিবরঞ্জনী সন্তোষ। ২০১৭ সালে প্রথম তিনি লক্ষ করেন– বাজারে ‘ORS (ওআরএস)’ নামের আড়ালে বিকোচ্ছে WHO (বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা)-এর অনুমোদনহীন মিশ্রণ। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিঠি লিখেছিলেন FSSAI (এফএসএসএআই), CDSCO (সিডিএসসিও), ও স্বাস্থ্যমন্ত্রকে। কোনও উত্তর মেলেনি।

ডা. শিবরঞ্জনী সন্তোষ

তবু থামেননি তিনি। ২০২২ সালে তিনি দায়ের করেন পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন (PIL)। বলেন, ‘ORS (ওআরএস) শব্দ ব্যবহারের অধিকার কেবল WHO (বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা) ফরমুলার।’

সেই থেকে শুরু এক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের আট বছরের একাকী লড়াই– কোর্টের নোটিশ, শুনানি, প্রশাসনের নীরবতা, কর্পোরেট লবির চাপ। তাঁর ভাষায়,

“People think they’re giving something healthy to rehydrate their child, but high sugar worsens diarrhoea. It’s a national shame that FSSAI has consented to the disposal of high-sugar ORSL stock.”

যার বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়–

‘মানুষ ভাবে তারা তাদের শিশুকে জলশূন্যতা থেকে বাঁচাতে স্বাস্থ্যকর কিছু দিচ্ছে, কিন্তু অতিরিক্ত শর্করা আসলে ডায়রিয়া আরও বাড়িয়ে দেয়। এ এক জাতীয় লজ্জা যে, এফএসএসএআই উচ্চ-শর্করা যুক্ত ওআরএসএল মজুত ও বিক্রির অনুমতি দিয়েছে।’

ডা. শিবরঞ্জনি সন্তোষের লড়াইয়ের টাইমলাইন রইল এখানে:

 

বছরঘটনা
২০১৭বাজারে WHO (বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা)-অনুমোদনহীন ORS (ওআরএস) বিক্রি লক্ষ করেন ডা. সান্তোষ।
২০১৮–২০২১FSSAI (এফএসএসএআই) ও স্বাস্থ্যমন্ত্রকে চিঠি পাঠান, কোনও সাড়া পাওয়া যায় না।
২০২২ (এপ্রিল)FSSAI (এফএসএসএআই) ‘ORS (ওআরএস)’ শব্দ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
২০২২ (জুলাই)ট্রেডমার্ক আইনের ছুতোয় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার।
২০২২ (সেপ্টেম্বর)তেলেঙ্গানা হাইকোর্টে PIL দায়ের।
২০২৩–২০২৪নাগরিক সমাজে আলোড়ন, সংবাদমাধ্যমে প্রচার।
১৪ অক্টোবর ২০২৫FSSAI (এফএসএসএআই) ঘোষণা করে: WHO (বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা)-র ফর্মুলা ছাড়া ORS (ওআরএস) লেখা যাবে না।
২৪ অক্টোবর ২০২৫দিল্লি হাই কোর্ট ইন্টারিম স্টে দেয়; শুনানির নির্দেশ। কারণ একটি কোম্পানির ১৮০ কোটি টাকার সামগ্রীর নাহলে ক্ষতি হয়ে যাবে। 
বর্তমানলড়াই অব্যাহত– This fight is not over yet.

 

তবে জনস্বাস্থ্য ও বাণিজ্যের টানাপোড়েন নতুন কিছু নয়। কিন্তু এখানে লড়াইটা হল ‘ORS (ওআরএস)’ শব্দের ব্যবহার নিয়েই। লক্ষ করার মতো বিষয় হল– ২০২২-এ FSSAI (এফএসএসএআই) যে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তারপর ট্রেডমার্ক আইনের অজুহাতে নিজেই আবার সেই অনুমতি ফিরিয়ে দেয়। ফলে এক অর্থে এখানে রাষ্ট্র স্বীকার করে নিল যে, এখন মানুষের জীবনের চেয়ে বড় হল কর্পোরেট স্বার্থ। আর তারাই এখন জনস্বাস্থ্যের নিয়ম নির্ধারণের কান্ডারি। তবু হার না মানা লড়াই মনে সাহস জাগায়। তবে তারপরও এক অদৃশ্য আইন বনাম নৈতিকতার লড়াইয়ে যুঝতে থাকি আমরা। তাই তো ২০২৫ সালের অক্টোবরে আবারও যখন নিষেধাজ্ঞা আসে, তখন দিল্লি হাই কোর্ট সেই নির্দেশের ওপর স্টে অর্ডার জারি করে– ১৮০ কোটি টাকার স্টক বাঁচাতে কোম্পানিগুলিকে ‘ন্যায্য সুযোগ’ দেওয়া দরকার বলে! আর এই ঘটনাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা রোগীর নয়, পণ্যের প্রতি অনুগত। রাষ্ট্র যেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের নয়, ব্যবসার যুক্তি মেনে চলে। কর্পোরেট পুঁজির কাছে মাথা নত থাকে দেশের।

তবে শুধু ওআরএসএল নয়। এই একই মিথ্যার জাল ছড়িয়ে পড়েছে শিশুদের প্রতিদিনের খাবার ও পানীয়তেও। আসলে নামের জাদু যত বড়, বিভ্রান্তিও তত গভীর। উদাহরণ নিম্নরূপ–

  • কিন্ডার জয়– উচ্চ শর্করা ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট, শিশুদের স্থূলতা ও দাঁতের ক্ষয়ের কারণ।
  • হরলিক্স, বুস্ট, বর্নভিটা– বিজ্ঞাপনে ‘বুদ্ধি বাড়ায়’, বাস্তবে প্রতি ১০০ গ্রামে ৩০-৪০ গ্রাম চিনি।
  • কমপ্ল্যান ও মিল্কশেক– মালটোডেক্সট্রিন ও কৃত্রিম ফ্লেভারে ভরা, যা শিশুদের মিষ্টিজাত দ্রব্যে আসক্ত করে।
  • ইলেকট্রোলাইট সোডা ও স্পোর্টস ড্রিঙ্ক– লবণ-চিনির ভারসাম্য নষ্ট করে, হাইপারগ্লাইসেমিয়া বাড়ায়।

এইসব পণ্যের আসল শক্তি বিজ্ঞাপনে, বিজ্ঞানে নয়। শিশুর হাসি, মায়ের হাত, স্কুলের প্রতিযোগিতা– সব কিছুকে বাজার ব্যবহার করে health aspiration (সুস্বাস্থ্যের গঠন)-এর প্রতীকে।

এইসব পণ্যের আসল শক্তি বিজ্ঞাপনে, বিজ্ঞানে নয়

ফলে, যখন কোনও মা ওষুধের দোকানে ORSL (ওআরএসএল) কিনে সন্তানের হাতে তুলে দেন, তখন তিনি বুঝতেই পারেন না এই উচ্চ শর্করাযুক্ত দ্রবণ হয়তো তাকে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে, বাঁচানোর নয়। আসলে একটি জাতি যখন তার শিশুদের চিনি-রং-ফ্লেভারে ভবিষ্যৎ খোঁজে, তখন জনস্বাস্থ্য আর নীতির নয়, লাভের প্রশ্নে মাপা হয়।

আর এই পুরো ব্যবস্থাটাই দাঁড়িয়ে আছে রাষ্ট্রের ব্লাইন্ড স্পটের ওপর। ভারতের খাদ্যনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এক পরস্পরবিরোধী গোলকধাঁধা। FSSAI (এফএসএসআই) খাদ্যের মান দেখে, CDSCO (সিডিএসসিও) ওষুধের অনুমোদন দেয়, আর স্বাস্থ্যমন্ত্রক নীতির তত্ত্বাবধান করে।

কিন্তু এই তিনের মাঝের অস্পষ্ট সীমারেখায় হারিয়ে যায় দায়িত্ব। আর পুঁজিপতিরা জানে, রাষ্ট্রের এই ব্লাইন্ড স্পটই তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র। একদিকে বিজ্ঞাপনের গতি আর অন্যদিকে মানুষের বিশ্বাসের অস্ত্রে ভর দিয়ে রমরমিয়ে চলবে কারবার। আদালতে মামলা চলতে থাকে, ঠিক তখনই সুপারমার্কেটের তাক ভরে যাবে নতুন বোতলে। আর অন্যদিকে হয়তো পুঁজিপতিদের সুবিধা করে দিতেই রাষ্ট্রের ‘আঠারো মাসে বছর’ মনোভাবের সুবিধা তুলছে বাজার অর্থনীতি। এই কাহিনি কেবল এক পণ্য বা এক কোম্পানির নয়; এটি রাষ্ট্রের নৈতিক কাঠামোর ভাঙনেরও গল্প বটে।

এক সময় জনস্বাস্থ্য ছিল এক সমষ্টিগত দায়। সরকার, চিকিৎসক, নাগরিক– প্রত্যেকে মিলে তৈরি করত প্রতিরোধের বলয়। এখন সেই দায়িত্ব বিক্রি হয়েছে marketing consultant (বাজার অভিজ্ঞ)-এর কাছে।

বিজ্ঞাপনে দেখা যায়– এক শিশু মাঠে খেলছে, ঘামে ভিজে বাড়ি ফিরে মিষ্টি ফ্লেভারের ‘ওআরএস ড্রিঙ্ক’ খাচ্ছে, আর মা হাসছেন। ক্যামেরা থেমে যায় সেই হাসিতে, কিন্তু পর্দার বাইরে এক চিকিৎসক লড়ছেন– এই মিথ্যার বিরুদ্ধে।

এই দ্বন্দ্বটাই আমাদের সময়ের প্রতীক। যেখানে বাস্তবের চিকিৎসক বাজারের গল্পে হারিয়ে যায়, আর রাষ্ট্রের কণ্ঠে শোনা যায় কর্পোরেটের প্রতিধ্বনি।

ডা. শিবরঞ্জনী সন্তোষ শুধু এক মামলা লড়ছেন না; তিনি আসলে ফিরিয়ে আনছেন এক বাঙালি চিকিৎসকের উত্তরাধিকার। তিনি কেবল একজন চিকিৎসক নন; তিনি প্রতিরোধের প্রতীক।

এক নারী চিকিৎসক, যিনি জানেন প্রশাসনকে প্রশ্ন করা মানে নিজের ভবিষ্যৎকে ঝুঁকিতে ফেলা। তবুও তিনি থামেননি। তাঁর ই-মেল উপেক্ষিত হয়েছে, মেমো ফেরত এসেছে, সংবাদমাধ্যমও প্রথমে নীরব ছিল– কিন্তু তিনি একাই আদালতের দরজায় দাঁড়িয়ে গেছেন।

এই সাহস যেন ডা. মহলানবীশের সেই বিশ্বাসেরই প্রতিধ্বনি, যে বিজ্ঞান মানুষের, বাজারের নয়। এক কাপ লবণ-চিনি-জল, যা একদিন মৃত্যুর মুখে জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিল।

দুঃখের বিষয়, আজ সেই প্রতীকেরই পাশে লেখা আছে– refreshing orange flavour. এই পরিহাসটাই আমাদের সভ্যতার সারাংশ। যেখানে জল বিক্রি হয় বোতলে, বায়ু বিক্রি হয় ক্যানে, আর বিজ্ঞান বিক্রি হয় বিজ্ঞাপনে।

এই ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা একটাই। জনস্বাস্থ্য আর বিজ্ঞানের পক্ষে নয়, বাজারের কেন্দ্রে। যেখানে লবণ-চিনির অনুপাত নির্ধারণ করে বিজ্ঞাপন সংস্থা, আর চিকিৎসকের সতর্কতা ডুবে যায় ট্রেডমার্কের কাগজে।

এ যেন আধুনিক ভারতের প্রতিচ্ছবি, যেখানে ‘consumer protection’ (ক্রেতা সুরক্ষা) শব্দটি শিশুর সুরক্ষার বদলে কোম্পানির সুরক্ষার প্রতীক।

তবু ডা. সন্তোষ আজও লড়ছেন। প্রতিটি আদালতের শুনানির পর তিনি জানান–

‘This fight is not over yet. (লড়াই এখনো শেষ হয়নি)।’ তাঁর সেই এক বাক্যই এখন জনস্বাস্থ্যের বিবেক। যখন রাষ্ট্র নতজানু, যখন বিজ্ঞান বিক্রিত, তখন একজন চিকিৎসকের নীরব প্রতিরোধই সবচেয়ে বড় আশা। একদিন ডা. মহলানবীশ বলেছিলেন, ‘The simplest solutions can save the most lives. (খুব সাধারণ সমাধান আমাদের জীবন বাঁচাতে পারে)’।

ওআরএসের যে গল্প শুরু হয়েছিল এক কাপ লবণ-চিনি-জলের মানবিক আবিষ্কার দিয়ে। আজ তা শেষ হচ্ছে এক বোতল রঙিন চিনি-জলের বাজারযুদ্ধে। ডা. মহলানবীশের সেই সরল-সাদামাটা সমাধানই সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে– কারণ তার চারপাশে গড়ে উঠেছে জটিল মুনাফার রাজনীতি। ওআরএসের গল্প তাই শুধু চিকিৎসা বা আইন নয়– এ এক আয়না, যেখানে দেখা যায় আমাদের দেশ, বাজার, আর বিবেকের মুখ। এক কাপ জল– যার মূল্য একসময় ছিল জীবন, আজ তা পরিণত হয়েছে পণ্যে, যার দাম লেখা লেবেলে। আর লবণ-চিনির সেই মানবিক সমীকরণ আজ দাঁড়িয়ে আছে প্রশ্নচিহ্ন হয়ে। 

তাই ডা. শিবরঞ্জনি সান্তোষের লড়াই কেবল এক ব্র্যান্ডের বিরুদ্ধে নয়– এ রাষ্ট্রের নৈতিকতার পুনরুদ্ধারের আহ্বান। যখন একজন ডাক্তারকে আট বছর ধরে একা আদালতে দাঁড়াতে হয়, তখন বোঝা যায়– এই দেশের জনস্বাস্থ্যের শিরায় জলের বদলে সত্যিই বয়ে চলেছে কর্পোরেট শর্করা।