গৃহকর্তার ভূমিকা টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে পরিবারের কোনও সদস্য যদি নিজেকে একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে, তা নিজের কন্যা হলেও, পুরুষের মাথার ঠিক থাকে না। এবার কি অন্তত ‘মাসকিউলিনিটি’ নিয়ে কথা বলার সময় হয়েছে? ঠিক যেমন ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে মেয়েদের জেন্ডার রোল নিয়ে কথা বলার থেকেও বেশি প্রয়োজন আদর্শ পুরুষত্বের অবয়ব নিয়ে গভীর আলোচনার। আজকের ভারতে সেই আলোচনার পরিসর কোথায়?
সোশ্যাল মিডিয়াতে ঘোরাফেরা করা রিল, মিম বা ছোট ভিডিও আজকের সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে একটা আর্কাইভের খনির মতো। যেমন ধরুন, কিছুদিন আগেই ফাদার্স ডে উপলক্ষে দেখলাম কলকাতার একটা জবরদস্ত রিল ঘোরাফেরা করছে। এক-দু’লাখ মানুষের কাছে সেটি ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছে। কমেন্টে সকলে অভিনন্দন জানিয়ে বলছে, একেবারে ঠিক ধরেছেন মশাই! এ যে আমার নিজের বাবার প্রতিচ্ছবিই দেখতে পাচ্ছি ভিডিওতে। কী সেই অবয়ব? রিলে দেখাচ্ছে যে, একজন আদর্শ পিতা মুখে কিছু বলে না, কিন্তু দরকারের সময় পাশে এসে দাঁড়ায়; পরীক্ষায় ভালো ফল করলে মুখ ফুটে বলে না: ‘I am proud of you son.’– কিন্তু কাজকর্মে বুঝিয়ে দেয় যে, সে খুশি হয়েছে। সকালে খবরের কাগজ, অফিসের স্যুটকেস, এক কাপ চা– এই সবেই সে মশগুল মনে হলেও আসলে ছেলেমেয়ের খেয়াল রাখে নিঃশব্দে, তাদের পার্থিব জিনিসের জোগান দিয়ে চলেছে বাবা। এই ভিডিওটি দেখতে দেখতে ভাবছিলাম যে, আজকের দিনেও একটি ভারতীয় যৌথ পরিবারে বাবার ভূমিকাটা ঠিক কী? এই যে ছত্রে ছত্রে আবেগের অবদমনের জয়গান; পিতা সহ্য করে, কম কথা বলে, তার মুখের অভিব্যক্তি দেখলে বোঝা যায় না মনের ভিতর কী চলছে; আবার সেই বাবাই রেগে গেলে ছারখার করে দেয় সবকিছু, তার আপত্তিতে কিছু করা যায় না বাড়িতে, এই ‘ইমোশনাল রিপ্রেসন’ আর ‘অ্যাগেশন’-এর মধ্যে কোনও সমানুপাতিক সম্পর্ক আছে কি?
১০ জুলাই, গুরুগ্রামে একটি ২৫ বছরের মেয়ে, রাধিকা যাদব, পেশায় টেনিস প্লেয়ার, ১৮টি স্বর্ণপদক জয়ী, তাকে তার বাড়ির রান্নাঘরে তার নিজের বাবা ৫ বার গুলি চালিয়ে খুন করেছে। তিনটি গুলি লেগে মেয়েটি মারা যায় তৎক্ষণাৎ। পুলিশি তদন্তে এখনও যা জানা গিয়েছে যে ইদানীং মেয়েটি নিজের টেনিস প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছিল পাড়ায়, ছোট ছেলেমেয়েরা সেখানে এসে খেলা শিখত– এই সিদ্ধান্তে প্রথম থেকেই আপত্তি করেছিল তার বাবা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, তার বাবাই কিন্তু টেনিস জগতে পদার্পণ করতে সাহায্য করে ছোট রাধিকাকে। এত কম বয়সে দক্ষ খেলোয়াড় হওয়ার নেপথ্যে তার বাবার পরিশ্রম কিছু কম না, তাহলে সেই ব্যক্তি কী করে নিজের আত্মজাকে নির্মমভাবে হত্যা করতে পারল? পিতা পুত্রের নিধন করছে, মা তার নিজের সদ্যোজাত শিশুকে ত্যাগ করছে এমনকী, হত্যাও করছে, এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে মেলে। কিন্তু রাধিকা যাদবের ঘটনাটিতে বারে বারে উঠে আসছে যে ঠিক কোন অসম্মানের জায়গা বা অতৃপ্তি থেকে এমন চরম সিদ্ধান্ত নিলেন হরিয়ানার মধ্যবিত্ত পরিবারের এই ব্যক্তি?
দীপক যাদব পুলিশের কাছে বয়ান দিয়েছেন যে, তাঁর মেয়ের টেনিস প্রশিক্ষণের জন্য যাবতীয় যা আয়, তাই বসে বসে নাকি আত্মসাৎ করছেন মেয়ের বাবা। নিজের রুজি-রোজগার কম– এই কটাক্ষ তাঁকে বারবার শুনতে হত পাড়া-প্রতিবেশী এবং আত্মীয়দের কাছ থেকে। ওয়াজিয়াবাদের গ্রাম, নিজের জন্মভিটায় গেলেও মেয়েকে নিয়ে নানা অশালীন কথাবার্তা শোনা যেত। কী করে এত আয়? স্বয়ংসম্পূর্ণা রাধিকার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মফসসলী শহরে ছিল এক চর্চার বিষয়। নিজের যদিও একটি দোকান ছিল দীপকের, কিন্তু অচিরেই তা কোনও কারণে বন্ধ হয়ে যায়। কিছু টাকা আসত বাড়িভাড়া দিয়ে, কিন্তু মূলত সে নাকি তার মেয়ের রোজগারে দিন কাটাচ্ছে, এমনই অপবাদ আরোপ করা হয়েছিল বলে জানান ৪৯ বছর বয়সি পুরুষ।
তার সঙ্গে ছিল রাধিকার ইন্সটাগ্রামে রিল বানানোর অভ্যাস, খুব সম্প্রতি একটি মিউজিক ভিডিওতে অংশ নেয় সে, এবং সব কিছুই হয় বাবার আপত্তিতে। তাই সকালবেলা জলখাবার বানানোর মুহূর্তে রাধিকাকে পিছন থেকে গুলি করে তার বাবা, সে হয়তো জানতেও পারেনি তার সঙ্গে ঠিক কী ঘটে গেল এবং আততায়ীর অভিসন্ধি বা পরিচয়– সবটাই এক্ষেত্রে সাংঘাতিক!
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টি দিয়ে দেখলে বোঝা যায়, যে কোনও এক চরম মুহূর্তে, নিজের আগ্রাসনকে চেপে রাখতে না পেরে গুলি চালিয়েছেন দীপক। এই রাগ বা আগ্রাসন আসলে একটি আবেগের বহিঃপ্রকাশ। বলা হয় যে, ‘অ্যাগ্রেশন’ বা তীব্র ক্রোধের নেপথ্যে আসলে কাজ করে নিরাপত্তাহীনতা। ভয় থেকেই জন্ম রাগের, ভয় পেলে পশুপাখিও আক্রমণ করে। ছোটবেলায় পাড়ার কুকুর-সাপ-ব্যাঙ বা কীটপতঙ্গের কাছে গেলে বড়রা সাবধান করতেন এই বলে যে, কোনও প্রাণী যদি নিজে ভীত হয় তাহলেই আক্রমণ করে, যদি তোমায় ‘থ্রেট’ ভাবে সে, তাহলে কামড়াতে আসবে। মানুষ তো কামড়ায় না, কিন্তু ভয়াবহ মানসিক বা শারীরিক আঘাত দিতে সেও সক্ষম, ঠিক যেমন এক্ষেত্রে ২৫ বছরের একটি মেয়ের জীবন অকালে শেষ হয়ে গেল। এই মৃত্যুতে যদিও ক্রোধের নেপথ্যে নিরাপত্তাহীনতার কথা খুবই স্পষ্ট। আততায়ী নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তাকে দিনের পর দিন গঞ্জনা সহ্য করতে হত, তাই তিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি।
এখানে পুরুষের এই নিরাপত্তা প্রদানকারী জেন্ডার রোল নিয়ে কথা বলা আবশ্যক। একটি কাল্পনিক চরিত্রের উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। ১৯৭১ সালে মাধবী মুখোপাধ্যায় আর অনিল চ্যাটার্জি অভিনীত ‘মহানগর’ সিনেমা, এটি অনেকাংশেই একটি মহিলাকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র; যেভাবে আরতির কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ, প্রথম মহিলা সেলসগার্লদের একসঙ্গে বসে অফিসে আলোচনা, কাজ করা, মেলামেশা দেখানো হয়েছে– তা সেই সময়কার বাংলা সিনেমায় বিরল। আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে জেন্ডার স্টাডিজ পড়াই, এই সিনেমাটা দেখিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, কোন চরিত্রটি তোমাদের সব থেকে ভালো লাগল। অনেক ছাত্রই দেখলাম অনিল চ্যাটার্জী এবং বিশেষ করে তার বাবার চরিত্রটির কথা বলল। তাদের সঙ্গে আলোচনায় উঠে এল অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা। বাড়ির শ্বশুরমশাই, যার চশমা ভেঙে গিয়েছে, দেখতে পাচ্ছেন না কিছুই, স্কুলমাস্টারি করেছেন সারাজীবন, বই ছাড়া থাকতে পারেন না তবুও তিনি চশমা কিনবেন না। অর্থের জোর নেই তার, কিন্তু পুরুষের অহংবোধ তো আছে। তাই নিজের পুত্রবধূর অর্থে চশমা, খাবার, বাড়ির দৈনন্দিন সাজ-সরঞ্জাম কিনতে তিনি প্রবল বিরোধী। ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছেন তার পুরনো স্টুডেন্টদের কাছে; চোখে জল, অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে কিছু টাকা ধার চাইছেন। তাতে তার অহমিকা আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে না। কিন্তু নিজের হাঁটুর বয়সি মেয়ের থেকে সামান্য চশমার টাকাটা নিতেও তিনি অসম্মত হন। ঠিক এই এক অহমিকাবোধ আমরা গুরুগ্রামের মেয়েটির মৃত্যুতেও টের পাই কি? পেরিয়ে গিয়েছে ৫৫ বছর। একটি কাল্পনিক, রুপোলি পর্দার বাংলা সিনেমার চরিত্র, আরেকটি ভারতেরই এক রাজ্যে হয়ে যাওয়া অতি সাম্প্রতিক ঘটনা– কী অদ্ভুতভাবে মিলে যাচ্ছে দু’টি চরিত্রের আদল।
পুরুষের অ্যাগ্রেশন নিয়ে কিছুদিন আগেই একটি সিরিজ রিলিজ করে– ‘অ্যাডোলেসেন্স’। একটি ১২-১৩ বছরের ছেলে খুন করে তার থেকে এক-দু’বছরের বড় একটি স্কুলের সিনিয়র দিদির। এখানেও কাজ করছে সেই একই নিরাপত্তাহীনতা, অ্যাংজাইটি এবং ‘পুরুষ হিসেবে আমি কতটা কম’– এমন স্বীকারোক্তি। ঠিক কী কী করলে আমি ‘আদর্শ পুরুষ মানুষ’ হতে পারব? আমার প্রত্যেকটি আবেগ, উৎকণ্ঠা, ভয় যদি চেপে রাখি, যদি ভীতিসঞ্চার বা রাগের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া অন্য সব আবেগকে মিউট করে দিতে পারি। একটু বয়স বাড়লে যদি উপার্জনটা ভালো হয়, কারণ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদান করা আমার গুরুদায়িত্ব এবং তা করতে গিয়ে আমি মানসিক দূরত্বের শিকার হলেও ক্ষতি নেই। পুরুষ হিসেবে আমার থেকে কাঙ্ক্ষিত আচরণ ‘মেটিরিয়াল নিড’– বাড়ির আনাজপতি, ছেলের বই, মেয়ের বিয়ের খরচ নিয়ে ভাবা; মানসিক সংবেদনশীলতা না হলেও চলবে, কারণ সেই দায়িত্ব তো ভারতীয় যৌথ পরিবার মায়ের উপর আরোপ করেছে। এমতাবস্থায় কোনও বাবা যদি তার মেয়ের ক্যারিয়ারের হাল না ধরতে পারে, উপরন্তু তাকে বিদ্রুপ শুনতে হয় যে, সে নিজে সর্বগ্রাসী, কন্যার টাকায় আয়েশে আছেন, তাহলে গ্লানিবোধ স্বাভাবিক। কিন্তু সেই অবসাদ একটা চূড়ান্ত রূপ নিল দীপকের ক্ষেত্রে, যখন ঘটে গেল বীভৎস, কল্পনাতীত খুন। যেমন কেউ প্রেমে প্রত্যাখ্যান পাওয়ার পরে অ্যাসিড ছুড়ে মারে, কিংবা সম্প্রতি ল-কলেজে ধর্ষণ। এইসব জেন্ডার ভায়োলেন্স আসলে এক সূত্রে বাঁধা। পুরুষের নিরাপত্তাহীনতা থেকে চরমতম রাগে রূপান্তর। এর সঙ্গে অবশ্যই আছে মেয়েটির চারিত্রিক নিধন। সে কাজ করছে, উপার্জন করে শান্তি পাচ্ছে, কোনও পুরুষ অভিভাবক বা স্বামীর ওপর তাকে নির্ভর করতে হচ্ছে না– এই স্বাধীনতা আজকের দিনেও সমাজ মেনে নেয় না। খাপ বসিয়ে সতীদাহ বা ডাইনি হত্যা হয়তো কমেছে, কিন্তু মানসিকতা যে একেবারে বদলায়নি, তার প্রমাণ রাধিকা যাদব। এখানে মনে পড়ে যায় মৃণাল সেনের ‘একদিন প্রতিদিন’ সিনেমার মমতা শংকরের কথা, কাজে আটকে গিয়ে এক রাত ফিরতে পারেনি বলে তার পরিবারকে কুকথা শুনতে হয়।
দীপক হয়তো গত শতাব্দী থেকে কিছুটা এগিয়েছে, ‘দঙ্গল’ সিনেমার মতো নিজের মেয়ের স্পোর্টস ক্যারিয়ারে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। কিন্তু বাধ সাধল তার পরের ঘটনাগুলি। গৃহকর্তার ভূমিকা থেকে তাকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে, পরিবারের কোনও সদস্য যদি নিজেকে একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে, সেটা তার নিজের কন্যা হলেও, মাথার ঠিক থাকে না। আসলে এমন বীভৎস ঘটনা চারপাশে অহরহ ঘটতে দেখলে মনে হয়, এবার কি অন্তত ‘মাসকিউলিনিটি’ নিয়ে কথা বলার সময় হয়েছে! ঠিক যেমন ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে মেয়েদের জেন্ডার রোল নিয়ে কথা বলার থেকেও বেশি প্রয়োজন আদর্শ পুরুষত্বের অবয়ব নিয়ে গভীর আলোচনার। আজকের ভারতে সেই আলোচনার পরিসর কোথায়? এখানে ‘অ্যাডোলেসেন্স’-এর মতো সিরিজ হয় না, ‘মহানগর’-এর অনিল চ্যাটার্জির স্ত্রীয়ের ব্যাগ থেকে লিপস্টিক খুঁজে পাওয়ার পর ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স– এমন চারিত্রিক বিশ্লেষণ আর খুঁজে পাই না। পপুলার কালচারে ‘অ্যানিমল’ চলে, এখনও ‘দিলওয়ালে’-র অমরেশ পুরী আমাদের কাছে নস্টালজিয়া গ্লোরি। তাই আমরা পুরুষের রাগ, ক্রোধ, অবদমন নিয়ে এখনও কথা বলতে রাজি নই। আর সেজন্যই রাধিকার মতো ঘটনা আমাদের তাৎক্ষণিক আঘাত করলেও এর কোনও সুদূরপ্রসারী সমাধান হয় না।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved