Robbar

প্রাথমিক স্কুলগণ্ডি থেকেই সহিষ্ণুতা আর কল্পনাশক্তি মেরে ফেলার নয়া ‘সিলেবাস’

Published by: Robbar Digital
  • Posted:July 20, 2025 3:49 pm
  • Updated:July 20, 2025 8:04 pm  

একেবারে হালে দিল্লি ও উত্তরাখণ্ডে শিক্ষাদপ্তর অষ্টম শ্রেণিতে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ্যে যে ইতিহাস পড়ানোর নির্দেশিকা জারি করেছে তাতে মুঘল আমলকে দেখানো হয়েছে অসহিষ্ণু ও নিপীড়নমূলক শাসনকাল হিসেবে। সেখানে বাবর এক নিষ্ঠুর, নির্মম সম্রাট, আকবর সহিষ্ণুতা ও নৃশংসতার মিশ্রণ আর ঔরঙ্গজেব মন্দির ও গুরুদ্বার ধ্বংসের নায়ক। অর্থাৎ, উদ্দেশ্য আগেই প্রস্তুত; মুসলমানকে শত্রু হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া। এদের লক্ষ্য: এদেশের ইতিহাস থেকে মুসলমান ধর্মাবলম্বীর অনুষঙ্গকে বাদ দেওয়া। ভারত মানে হিন্দু ভারত; ভারতের যা কিছু গৌরবজনক ইতিহাস তা সবই হিন্দুদের সৃষ্টি! শাসকের তাই লক্ষ্য, ভারতের ইতিহাসের মধ্যযুগের গৌরবকে অগ্রাহ্য করা, বিকৃত করা আর সবের ওপর হিন্দু আধিপত্য স্থাপন করা। অথচ পুরো ব্যাপারটাই দাঁড়িয়ে আছে মিথ্যের ওপর।

সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়

ঠিক কবে যে গানটা প্রথম শুনেছিলাম, তা আজ আর মনে পড়ে না। সিনেমাটা যে সময় তৈরি হয়েছিল, তখন আমি জন্মাইনি। প্রথম দেখেছিলাম আটের দশকে, কলকাতা দূরদর্শনে। সিনেমার নাম ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’। আর গান: ‘ওরে হাল্লা রাজার সেনা, তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল…’।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর আখ্যান থেকে সত্যজিৎ রায় বানিয়েছিলেন সেই সিনেমা; গানটিও ওঁরই লেখা। সেই ছেলে-বয়সে এ সমস্ত যে জানা ছিল, তা নয়, কিন্তু মাথায় গানটা ঢুকে গিয়েছিল। ‘যুদ্ধ’ যে বিশেষ ভালো জিনিস নয়, বুঝেছিলাম তখনই। অত তত্ত্ব কথা তো জানতাম না, কিন্তু ছবি দেখে এটা বেশ বুঝে গিয়েছিলাম, যারা রাজার হয়ে যুদ্ধ করে তাদের যদি মণ্ডা-মিঠাই খাওয়ানো যায়, তবে তারা আর যুদ্ধ করে না। পরে বুঝেছিলাম মণ্ডা-মিঠাই প্রতীক মাত্র। পেট ভরে খেতে পেলে মানুষ নিজেদের মধ্যে হানাহানি-কাটাকাটি করে না।

Tallenge - Goopy Gayen Bagha Bayen - Large Poster Paper (18 x 24 inches) : Amazon.in: Home & Kitchen

 

আর একটু পরে শুনেছিলাম, ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।’ মানে এই যে নানা শাসক যুদ্ধ করে তাতে তো প্রাণ যায় আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরই। আর একটু উঁচু ক্লাসে গিয়ে পড়েছিলাম উইলফ্রেড ওয়েনের কবিতা ‘সেন্ড অফ’ আর জন আরভিনের ‘প্রগ্রেস’ নাটক। যুদ্ধবিরোধী এই কবিতা আর নাটক মন ছুঁয়ে গিয়েছিল।

ভাবছেন, নিজের স্কুলে পড়ার এত সাতকাহন লিখছি কেন? লিখছি সাম্প্রতিক একটা খবর পড়ে। খবরটা চিন্তার, খবরটা মনখারাপ করে দেওয়ার। তা হল– মহারাষ্ট্র সরকার সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে– তারা স্কুলের প্রাথমিক শ্রেণিতে যুদ্ধ শেখাবে। জুন মাসের এক আদেশনামায় জানানো হয়েছে, স্কুলের নিচের ক্লাসে যুদ্ধবিদ্যা শেখানোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেম, শৃঙ্খলা এবং সামরিকবিদ্যার পাঠ দেওয়া হবে। এই পাঠ দেবেন কারা? খবরে প্রকাশ, রাজ্যজুড়ে পাঠ দেওয়ার জন্য নিয়োজিত হবেন আড়াই লক্ষ লোক, থাকবেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা। আর শেখাবেন কাদের? শেখাবেন কোমলমতি বালক-বালিকাদের; প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মানে তাদের বয়স ৫-৬ বছর থেকে ৯-১০ বছর। এই কি তাদের সামরিকবিদ্যা শেখার সময়! ছেলেবেলাটা তো কল্পনাশক্তি বিকাশের সময়। সেই কবে ১২৯৯ বঙ্গাব্দে, (১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে), রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন–

Rabindranath Tagore's Norm-Defying Novel, "Chokher Bali" - Owlcation

‘ছেলে যদি মানুষ করিতে চাই, তবে ছেলেবেলা হইতেই তাহাকে মানুষ করিতে আরম্ভ করিতে হইবে, নতুবা সে ছেলেই থাকিবে, মানুষ হইবে না। শিশুকাল হইতেই কেবল স্মরণশক্তির উপর সমস্ত ভর না দিয়া সঙ্গে সঙ্গে যথাপরিমাণে চিন্তাশক্তি ও কল্পনাশক্তির স্বাধীন পরিচালনার অবসর দিতে হইবে। সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেবলই লাঙল দিয়া চাষ এবং মই দিয়া ঢেলাভাঙা, কেবলই ঠেঙা লাঠি, মুখস্থ এবং একজামিন– আমাদের এই ‘মানব-জনম’ আবাদের পক্ষে আমাদের এই দুর্লভ ক্ষেত্রে সোনা ফলাইবার পক্ষে, যথেষ্ট নহে। এই শুষ্ক ধূলির সঙ্গে এই অবিশ্রাম কর্ষণ-পীড়নের সঙ্গে রস থাকা চাই।  কারণ মাটি যত সরস থাকে ধান তত ভালো হয়। তাহার উপর আবার এক-একটা বিশেষ সময় আসে যখন ধান্যক্ষেত্রের পক্ষে বৃষ্টি বিশেষরূপে আবশ্যক। সে-সময়টি অতিক্রম হইয়া গেলে হাজার বৃষ্টি হইলেও আর যেমন সুফল ফলে না, বয়োবিকাশেরও তেমনই একটা বিশেষ সময় আছে যখন জীবন্ত ভাব এবং নবীন কল্পনাসকল জীবনের পরিণতি এবং সরসতা সাধনের পক্ষে অত্যাবশ্যক।’

শিক্ষার হেরফের। রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনে পঠিত

সমস্যা হল, আমরা তো রবীন্দ্রনাথকে মূর্তি গড়ে রেখে দিয়েছি! তাঁর ভাবনা তো আর আমরা মনে রাখি না। তাই তা কাজে লাগানোর প্রশ্নই নেই। বাচ্চাদের যুদ্ধ শেখানোর খবরে রবীন্দ্রনাথের আর একটা লেখার কথা মনে পড়ল। ছেলেরা কী আর অত জানে! যুদ্ধ তাদের কাছে একটা খেলা বই আর তো কিছু নয়! ছেলেরা দুই সারি পুতুল সাজিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলছে।
‘‘রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কার সঙ্গে কার যুদ্ধ?’
তারা বললে, ‘কর্ণাটের সঙ্গে কাঞ্চীর।’
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কার জিত, কার হার?’
ছেলেরা বুক ফুলিয়ে বললে, ‘কর্ণাটের জিত, কাঞ্চীর হার।’
মন্ত্রীর মুখ গম্ভীর হল, রাজার চক্ষু রক্তবর্ণ, বিদূষক হা হা ক’রে হেসে উঠল।’’

সদ্য কর্ণাট জয় করা কাঞ্চীর রাজা অবোধ শিশুদের খেলা মানবেন কেন? তাই আদেশ হল, ‘এই গ্রামকে শিক্ষা দেবে, কাঞ্চীর রাজাকে কোনোদিন যেন ভুলতে না পারে।’ ছেলেদের বেদম বেত মেরে মহারাজার মান রক্ষা হল। কেবল বিদূষক বললে, ‘আমি মারতেও পারিনে, কাটতেও পারিনে, বিধাতার প্রসাদে আমি কেবল হাসতে পারি। মহারাজের সভায় থাকলে আমি হাসতে ভুলে যাব।’

বিদূষক। লিপিকা। রচনাকাল: বৈশাখ ১৩২৯

যুদ্ধ করতে হলে তো কাউকে শত্রু খাড়া করতে হবে। সেই শত্রু খাড়া করার কাজও সমানে চলছে। একেবারে হালে দিল্লি ও উত্তরাখণ্ডে শিক্ষাদপ্তর অষ্টম শ্রেণিতে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ্যে যে ইতিহাস পড়ানোর নির্দেশিকা জারি করেছে তাতে মুঘল আমলকে দেখানো হয়েছে অসহিষ্ণু ও নিপীড়নমূলক শাসনকাল হিসেবে। সেখানে বাবর এক নিষ্ঠুর, নির্মম সম্রাট, আকবর সহিষ্ণুতা ও নৃশংসতার মিশ্রণ আর ঔরঙ্গজেব মন্দির ও গুরুদ্বার ধ্বংসের নায়ক। অর্থাৎ, উদ্দেশ্য আগেই প্রস্তুত; মুসলমানকে শত্রু হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া। এদের লক্ষ্য: এদেশের ইতিহাস থেকে মুসলমান ধর্মাবলম্বীর অনুষঙ্গকে বাদ দেওয়া। ভারত মানে হিন্দু ভারত; ভারতের যা কিছু গৌরবজনক ইতিহাস তা সবই হিন্দুদের সৃষ্টি! শাসকের তাই লক্ষ্য, ভারতের ইতিহাসের মধ্যযুগের গৌরবকে অগ্রাহ্য করা, বিকৃত করা আর সবের ওপর হিন্দু আধিপত্য স্থাপন করা। অথচ পুরো ব্যাপারটাই দাঁড়িয়ে আছে মিথ্যের ওপর। ভারত এমন একটা দেশ যেখানে কখনওই শাসকের ধর্ম, সারা দেশের ধর্ম হয়ে ওঠেনি। শাসক ভিন্নধর্মে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও রাজকাজে অন্য ধর্মাবলম্বীকে তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এমন ঘটনা ভারত-ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। আকবরের আমলে রাজস্ব ব্যবস্থা তথা অর্থনীতির ভারপ্রাপ্ত টোডরমল ছিলেন হিন্দু। আর তাঁকেই আকবর করেছিলেন মুন্সিফ-ই-দেওয়ান বা সাম্রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। একইসঙ্গে তিনি ছিলেন ভকিল-আস-সুলতানাত বা সম্রাটের মন্ত্রণাদাতা। কতটা বিশ্বাসযোগ্যতা থাকলে কাউকে প্রশাসনে এতটা গুরুত্ব দেওয়া যায়, তা একবার ভেবে দেখুন। এই ইতিহাস ছাত্রেরা শিখলে তো তাদের একথা ‘বোঝানো’ যাবে না যে, মুসলমান মুঘল শাসকেরা হিন্দুদের প্রতি কতটা বিদ্বিষ্ট ছিলেন! ভেবে দেখুন যে-হলদিঘাটের যুদ্ধে আকবর রাণা প্রতাপকে পরাজিত করেছিলেন সেই যুদ্ধে আকবরের প্রধান সেনাপতি ছিলেন অম্বরের রাজা মানসিংহ। একথা ছাত্ররা জানলে তো আর আজকের শাসক একথা বলতে পারবে না যে, মুঘল যুগ মানেই হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের ইতিহাস!

Aurangzeb Holding Darbār
ঔরঙ্গজেবের দরবারে। সূত্র: ইন্টারনেট

……………………………

ভারত এমন একটা দেশ যেখানে কখনওই শাসকের ধর্ম, সারা দেশের ধর্ম হয়ে ওঠেনি। শাসক ভিন্নধর্মে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও রাজকাজে অন্য ধর্মাবলম্বীকে তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এমন ঘটনা ভারত-ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। আকবরের আমলে রাজস্ব ব্যবস্থা তথা অর্থনীতির ভারপ্রাপ্ত টোডরমল ছিলেন হিন্দু। আর তাঁকেই আকবর করেছিলেন মুন্সিফ-ই-দেওয়ান বা সাম্রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। একইসঙ্গে তিনি ছিলেন ভকিল-আস-সুলতানাত বা সম্রাটের মন্ত্রণাদাতা। কতটা বিশ্বাসযোগ্যতা থাকলে কাউকে প্রশাসনে এতটা গুরুত্ব দেওয়া যায়, তা একবার ভেবে দেখুন। এই ইতিহাস ছাত্রেরা শিখলে তো তাদের একথা ‘বোঝানো’ যাবে না যে, মুসলমান মুঘল শাসকেরা হিন্দুদের প্রতি কতটা বিদ্বিষ্ট ছিলেন! ভেবে দেখুন যে-হলদিঘাটের যুদ্ধে আকবর রাণা প্রতাপকে পরাজিত করেছিলেন সেই যুদ্ধে আকবরের প্রধান সেনাপতি ছিলেন অম্বরের রাজা মানসিংহ। একথা ছাত্ররা জানলে তো আর আজকের শাসক একথা বলতে পারবে না যে, মুঘল যুগ মানেই হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের ইতিহাস!

……………………………

আকবর থেকে ঔরঙ্গজেব, কোনও মুঘল শাসকের কাছেই তাদের ব্যক্তিগত ধর্মীয় পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ‘মুসলমান’ আকবর ধর্মীয় বিষয়ে উলেমাদের ব্যাখ্যাকে চূড়ান্ত হিসেবে মানেননি। বরং ১৫৭৯ সালে ‘মাজহার’ বা ‘অভ্রান্ততার নির্দেশনামা’ জারি করে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে কোনও ধর্মীয় বিষয়ে উলেমারা যদি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হন তবে সম্রাটই তার চূড়ান্ত ব্যাখ্যা প্রদান করবেন, আর তা হবে অভ্রান্ত। ফলে সহজেই বোঝা যায়, শাসকের কাছে ধর্ম বিচার্য ছিল না, বিচার্য ছিল শাসকের সার্বভৌমিকতা। আবার যে ঔরঙ্গজেবকে হিন্দুবিদ্বেষের জন্য অভিযুক্ত করা হয় তিনি সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক প্রয়োজনে হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানদের ওপরও নতুন কর বসিয়েছিলেন। ঔরঙ্গজেব ধর্মস্থান ধ্বংসের দায়ে অভিযুক্ত। তাৎপর্যপূর্ণ হল তার মধ্যে মসজিদও ছিল। তিনি এই অভিযান করেছিলেন রাষ্ট্রের শাসকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আখড়া ভাঙতে। কোনও মুঘল শাসকই ধর্মীয় আদর্শকে দেশের শাসনভার দেননি; প্রধান গুরুত্ব দিয়েছিলেন শাসকের সার্বভৌমিকতা রক্ষার বিষয়টিকে। ঔরঙ্গজেবই এক সুন্নি ওমরাহকে লিখেছিলেন, ‘জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে ধর্মের কী সম্পর্ক? প্রশাসনের কাজকর্মে ধর্মের নাক গলানোর কী অধিকার আছে! ধর্ম যার যার।’

Israeli strike kills dozens sheltering in Gaza school, officials say - BBC News
ভাঙাচোরা ইশকুল। গাজা। সূত্র: ইন্টারনেট

যুদ্ধে মরে মানুষ আর সাম্প্রদায়িকতায় মরে মনুষ্যত্ব। ভিন রাজ্যে যুদ্ধবিদ্যা আর রামায়ণ ও গীতা পাঠ্য ক’রে ধর্মশিক্ষার নামে শৈশবেই শুরু হল স্বাধীন চিন্তাশক্তি আর সহিষ্ণুতার আদর্শকে মেরে ফেলে শত্রু খাড়া করার শিক্ষা দেওয়া।