Robbar

ব্যক্তিগত ও সামাজিক সত্তার সীমান্ত মুছে যাচ্ছে এখন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:August 19, 2025 8:44 pm
  • Updated:August 19, 2025 8:44 pm  

দুটো সত্তা যখন একে-অপরের ওপর চেপে বসে, তখন কখনও কখনও সেটা ক্লিনিকাল অসুখে পরিণত হয়। যাঁর দুটো সত্তার মাঝের সুস্পষ্ট ভেদটা মুছে যায়, তখন অসুখের সূত্রপাত হয়। আর এটা কিন্তু ব্যক্তি নিজে বুঝতে পারেন না। পারেন তাঁর আশপাশের মানুষ। পাশের মানুষ বুঝতে পারবে যে এই মানুষটার দুটি সত্তা জুড়ে যাচ্ছে, আলাদা করা যাচ্ছে না। ব্যবধান বাড়তে থাকছে, যে হিসেব-নিকেশ করার কথা ছিল, সেটা হচ্ছে না। আমি যে ভাবনার ইশকুল থেকে আসছি– সাইকো অ্যানালিসিস, সেখানে আমরা দেখতে পারছি এই উৎস ছোটবেলায়। ছোটবেলা থেকেই তাঁদের এই বাহ্যিক জগতের সঙ্গে এমন এক বোঝাপড়া তৈরি হচ্ছে, সেটা সমস্যাজনক। কারণ এই সামাজিক বাইরের পৃথিবীটা তাঁদের আঘাত করেছে। গুলিয়ে যাচ্ছে কোনও সামাজিক আর কোনটা ব্যক্তিগত। ফলে তাকে নানা ধরনের ডিফেন্স তৈরি করতে হচ্ছে। সামাজিকতা এত প্রবল রূপ ধারণ করছে যে তাঁর আর ব্যক্তিগতের আড়ালটুকুও থাকছে না।

ঝুমা বসাক

প্রতিটি মানুষই দুটো জীবনের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। প্রতিটি মানুষ নিজেকে ভাগ করে দু’ভাগে– একটি ব্যক্তিগত, আর-একটি সামাজিক। আমরা এ ব্যাপারে সচেতন। এভাবেই গুছিয়ে নিই নিজেদের। অন্তত সেটাই চাই। এই দু’টি সত্তা একে-অপরের থেকে আলাদা। আবার এই দুটো মিলিয়েই আমরা হয়ে উঠি ‘আমি’। দুটোরই প্রয়োজন আমাদের জীবনে বেঁচে থাকার জন্য। এই সীমানাটাই কখনও-সখনও ঝাপসা হয়ে যায়। সমস্যাটা এখানেই। উত্তর-আধুনিক যুগে আমরা গুলিয়ে ফেলেছি সামাজিক ও ব্যক্তিগতের সীমান্তটা। সামাজিক সত্তার পরিসর যেহেতু অনেকটা বড় ব্যক্তিগত সত্তার থেকে, তাই সামাজিক সত্তার প্রতি একটা লোভ রয়েছে মানুষের। সমাজ মাধ্যমের যুগে যে সমাজের হাতছানি দেখতে পাই আমরা, সেটা এড়ানো মুশকিল হয়ে যায়। বিশ্বজোড়া পুঁজিবাদী অবস্থাই এই আকর্ষণের মূল কারণ। সামাজিক সত্তার জন্য ওই চাহিদা তৈরি হয়, যা কিন্তু আমার ব্যক্তিগত স্তরে কোনও কাজেই লাগে না। এই বৃহত্তর চাওয়া-পাওয়ার জায়গায় নিজেদের হারিয়ে ফেলি।

This may contain: a poster with an image of a person upside down on their head and the caption says, what do you think?

ভালোবাসার ক্ষেত্রেও একই জিনিস হয়। আমাদের বড় হয়ে ওঠার সময় এরকম বহু সম্পর্কের হাতছানি আসে, কোনও সম্পর্ককে টিকিয়ে নিয়ে যাওয়া যেন তখন অসম্ভব একটা কাজ! ছোটবেলা থেকে এমন একটা সামাজিক ও আর্থিক অবস্থানে জন্মাচ্ছি, যেখানে আমার ঈপ্সাকে চেপেচুপে রাখতে হচ্ছে। সেটা নানা স্তরে হচ্ছে, এমনকী, মানসিক স্তরেও। আমরা অনেক সময় বুঝলেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না। সেই জন্যই ব্যক্তিগত একেবারে ধসে পড়ছে। ফলে আমার একান্ত যন্ত্রণা থেকে বুঝতে পারি, আমরা নিজেদের কখন হারিয়ে ফেলেছি। পথ খুঁজে পাচ্ছি না। কিন্তু কথা তো ছিল দুটো সত্তার মধ্যে আনাগোনা। দুটোর মধ্যে ব্যবধান এত বেড়ে গিয়েছে যে এই আনাগোনাটা আর সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের গুলিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক জায়গায় সামাজিক সম্পর্কই প্রস্ফুটিত হবে, আর ব্যক্তিগতে সেই লুকনো আমিটা থাকবে। সামাজিক জায়গায় যে অসম্মান বা দুঃখ পাই, তার যন্ত্রণা এসে পড়ে ব্যক্তিগতে। আবার উল্টোটাও। তার ফলে আমাদের অনেক বেশি প্রোজেক্ট করতে হয়, আমরা যেটা নই, সেটাই প্রকাশ করতে হয়– এ বড় যন্ত্রণার।

This may contain: an image of a man with a baby elephant in his lap on a red and blue background

এই দুটো সত্তা যখন একে-অপরের ওপর চেপে বসে, তখন কখনও কখনও সেটা ক্লিনিকাল অসুখে পরিণত হয়। যখন দুটো সত্তার মাঝের সুস্পষ্ট ভেদটা মুছে যায়, তখন অসুখের সূত্রপাত হয়। আর এটা কিন্তু ব্যক্তি নিজে বুঝতে পারেন না। পারেন তাঁর আশপাশের মানুষ। পাশের মানুষ বুঝতে পারবে যে এই মানুষটার দু’টি সত্তা জুড়ে যাচ্ছে, আলাদা করা যাচ্ছে না। ব্যবধান বাড়তে থাকছে, যে হিসেব-নিকেশ করার কথা ছিল, সেটা হচ্ছে না। আমি যে ভাবনার ইশকুল থেকে আসছি– সাইকো-অ্যানালিসিস, সেখানে আমরা দেখতে পারছি এই উৎস ছোটবেলায়। ছোটবেলা থেকেই তাঁদের এই বাহ্যিক জগতের সঙ্গে এমন এক বোঝাপড়া তৈরি হচ্ছে, সেটা সমস্যাজনক। কারণ এই সামাজিক বাইরের পৃথিবীটা তাঁদের আঘাত করেছে। গুলিয়ে যাচ্ছে কোনটা সামাজিক আর কোনটা ব্যক্তিগত। ফলে তাকে নানা ধরনের ডিফেন্স তৈরি করতে হচ্ছে। সামাজিকতা এত প্রবল রূপ ধারণ করছে যে তার আর ব্যক্তিগতের আড়ালটুকুও থাকছে না। এ এক বড় লড়াই ছোটবেলার। তাঁকে ক্রমাগত নানা ধরনের পারফরম্যান্সের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। পড়াশোনায় পারফরম্যান্স, খেলাধুলোয় পারফরম্যান্স– প্রতিটি বিষয়ে। সবকিছু তাকে বাহ্যিকভাবে দেখাতে হচ্ছে। এমনকী, বাবা-মাকে দেখাতে হচ্ছে। তা না হলে বাবা-মা সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে দেখাবে কী করে? যে কারণে অনেক আগে থেকে ছোটরা হারিয়ে ফেলছে নিজেদের। তৈরি করে ফেলছে ডিফেন্স মেকানিজম। নিজেকে বাঁচানোর জন্য। এদিকে এই ডিফেন্সেই নিজেকে হারিয়ে ফেলছি। খুব গভীরে এটা প্রভাব ফেলে যে অনেক দিন ধরে থেরাপি ও ওষুধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

This may contain: a drawing of a person's head with many faces in the shape of a brain

এই যে দুটো সত্তা, একটাকে সহাবস্থানে আনাটাই আমার কাজ। যেখানে এই আনাগোনা নেই– সেখানে সত্তা ভেঙে যাচ্ছে, স্প্লিট পারসোনালিটি তৈরি হচ্ছে, ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার (ডিআইডি)। পারসোনালিটি কিন্তু বহু ভাগে ভাগ হতে পারে। কমপক্ষে দুটো। এছাড়াও আছে বাইপোলার ডিসঅর্ডার। ডিআইডি-র ক্ষেত্রে একটা কোর সেলফ থাকে। অন্য সেলফগুলো ছোটবেলার নানা ট্রমা থেকে তৈরি হয়। সে ট্রমা এতই প্রকট যে তাকে আমরা আলাদা একটা সত্তা দিয়ে দিই। নিজের সঙ্গে যুক্ত রাখতে পারি না। সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ তৈরি করতে হয়। মুশকিল হচ্ছে এতগুলো সত্তা যার আছে, সে কিন্তু অবগত নয় যে, তার অন্য সত্তাও আছে। বাইপোলারে কিন্তু সেটা নয়। বাইপোলার অবগত তাদের দুটো সত্তা নিয়ে। বাইপোলার মানুষদের দুটোই মাত্র সত্তা– একটা ডিপ্রেশন, আরেকটা ম্যানিক। ম্যানিকে কিন্তু মানুষ পজিটিভ কাজও করে, আবার ভায়োলেন্টও হয়ে যেতে পারে।

এভাবেই আমরা দুটো সত্তার মধ্যে চলাফেরা করি, কখনও সেটা অনায়াস, কখনও সেটা বিস্মৃতির অতলে, কখনও তার মধ্যে এতই ব্যবধান যে আমরা আর সহাবস্থানে থাকতে পারি না। মানুষের মনও বিভক্ত, দু’ ভাগে, বহুভাগে।