যখন লোকমুখে শুনি, এটা ‘শিবপ্রসাদের ছবি’, নন্দিতাদির নামটা উহ্য থেকে যায়, তখন খারাপ লাগে। আসলে আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সিনেমা-জগতে কোথাও একটা মেনেই নেওয়া হয় যে, পুরুষরা বোধহয় মেয়েদের চেয়ে সিনেমা পরিচালনা বেশি ভালো করে। এসব নিয়ে আপত্তি জানিয়েও কিছু হয়নি। আমি আমার তরফে আগেও চেষ্টা করেছি। ‘উইন্ডোজ’ থেকে যখনই কোনও পোস্টার রিলিজ করে, দেখবেন সেখানে নন্দিতাদির নাম প্রথমে থাকে, সিনেমাতেও তাই। তার কারণ, নন্দিতাদি আমার চেয়ে বয়সে বড়। দ্বিতীয়ত, উনি আমার চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। সর্বপরি, মহিলা পরিচালক হিসেবে বাংলা ফিল্ম-ইন্ডাস্ট্রিতে নন্দিতাদির যা অবদান, তা ভোলার নয়।
একে চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ। মত আর পথের মিল হলে পক্ষ কখনও বিপক্ষ হয় না। তখন দুয়ে মিলে এক সত্তা। আমার আর নন্দিতাদির মধ্যে বোঝাপড়া বা তালমিল, যাই বলুন– ঠিক তেমনই। আলাদা দু’জন মানুষ। তবু আমাদের সত্তাটা এক। সেটাই আমাদের যৌথ পরিচালনার মূল চাবিকাঠি।
নন্দিতাদি আমার চেয়ে বয়সে বড়। শ্রদ্ধা সে কারণেই শুধু নয়। তিনি আমার শিক্ষক, আমার গুরু। ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা। সিনেমা চর্চা থেকে সিনেমা তৈরি– কত ভাবে যে নন্দিতাদি শিখিয়েছেন।
যে কোনও সম্পর্কে, বিশেষত জুটিতে বন্ধুত্ব যেমন থাকা দরকার, তেমনই দরকার পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাসও। যৌথ পরিচালনার শুরুর দিন থেকে আমার আর নন্দিতাদির মধ্যে তা ছিল। আজও আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। আসলে যাঁর সঙ্গে আপনার ‘জুটি’, তাঁর প্রতি যদি আপনার শ্রদ্ধা না থাকে, ভরসা না থাকে, তাহলে কেমেস্ট্রি তৈরি হবে কী করে! আমাদের ভাবনাচিন্তা কিংবা পরিকল্পনায় ফারাক খুব কম। মিলটাই বেশি।
নন্দিতাদির সঙ্গে ‘বন্ডিং’ আচমকা তৈরি হয়নি। প্রথম আলাপ হয়েছিল নয়ের দশকের শেষে, ১৯৯৮ সালে। নীতীশ রায়, নন্দিতাদির স্বামী, একটা সিনেমা পরিচালনা করছিলেন– ‘জামাই নম্বর ওয়ান’। সেই ছবিতে আমি নায়ক! সেই সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে নীতীশদা-নন্দিতাদির পরিবারের সঙ্গেও সখ্য। সত্যি বলতে, সেই সময় অভিনেতা হিসেবে বেশি-কিছু বলা, বাড়তি একটু ইচ্ছাপ্রকাশ করা, সেই অধিকার অভিনেতাদের সচরাচর থাকত না। থাকলে তাঁরা অবধারিতভাবে সিনেমা থেকে ঘ্যাচাং ফু! তার উল্টোপথে হেঁটে সেই অনধিকার চর্চা বা অধিকারের স্বাধীনতা– যাই বলুন না কেন, তা নীতীশদা-নন্দিতাদি– দু’জনেই আমাকে দিয়েছিলেন।
ইন্ডাস্ট্রিতে এসে, শুরুর দিকে, ছিলাম লেখালেখি নিয়েই। পরিচালনা করব, একথা ভাবিনি। পরিচালনার কথা মাথায় আসে টেলিভিশনে কাজ করতে শুরু করার পর। ২০০১ সালের আশপাশ থেকেই ব্যাপারটা গজিয়ে ওঠে মাথায়। নানা ভাবনা, লেখালেখি– এসব তো চলছিলই, চলছিল স্ক্রিপ্ট লেখাও। তখন ধীরে ধীরে পরিচালনা করার ইচ্ছেটাও তৈরি হতে থাকে। যখন দেখলাম, লেখার ভাবনায় মিল হচ্ছে, মনে হল পরিচালনার সময়ও এমনটাই হবে। ভাবনার এই আদানপ্রদানের জায়গা থেকে কোথাও একটা টিম তৈরি হয়, গড়ে ওঠে যৌথতার বোধ। নন্দিতাদির সঙ্গে আমার সেটাই হয়েছে। যৌথ পরিচালনায় এই জুটি তৈরি হওয়া নেপথ্যে আমাদের কোনও হাত নেই, ছিলও না। পুরোটাই নিয়তি-নির্ধারিত। ভাগ্যে লেখা ছিল। যেমনটা একজন নায়কের সঙ্গে একজন নায়িকার হয়, যেমনটা একজন সংগীত পরিচালকের সঙ্গে সুরকারের, তেমনই একজন পরিচালকের সঙ্গে আরেক পরিচালকের মেলবন্ধন তৈরি হয়ে যায়। সেই তালমিল থেকেই নন্দিতাদির সঙ্গে ‘টিম’ হিসেবে কাজ করা শুরু করি।
প্রথমে আমি একটা প্রস্তাব করেছিলাম যে, জুভেনাইল ক্রাইম– তার ওপরে যদি একটা কাজ করা যায়। আসলে অনেক অল্পবয়সের ছেলেমেয়ে কেন, ঠিক কোন কারণে ক্রিমিনাল হয়ে যায়, সেটার ওপর সিনেমা করতে চেয়েছিলাম। আমাদের গল্পের নায়ক ছিল ১৫ বছরের একটি ছেলে। যে ১৫ বছর বয়সে নায়ক হয়ে ওঠে, এলাকার ত্রাস হয়, তারপর মাত্র ১৯ বছর বয়সে তার জীবন কীভাবে শেষ হয়ে যায়– এটাই ছিল গল্পের মূল জায়গা। তারপর ‘ইচ্ছে’, ‘অলীক সুখ’-এর স্ক্রিপ্ট লিখি। এভাবেই যৌথ পরিচালনার কাজ শুরু আমাদের। এই যৌথ প্রয়াসে বন্ধুত্বের পাশাপাশি কাজের পরিসরে পেশাদারিত্ব কখনও বাধা হয়নি। বরং তাকে কীভাবে গুরুত্ব দিতে হয়, সেটা নন্দিতাদির কাছেই শিখেছি। শিখেছি কীভাবে মিলেমিশে কাজ করতে হয়। কোনও কাজের দায়িত্ব হয়তো আমি সামলাই, কোনওটা নন্দিতাদি। এই দায়িত্বভাগটা তৈরি হয়ে গিয়েছে অলিখিতভাবেই। আলাদা করে বলতে হয়নি।
যেমন ধরুন, যে-গল্প নিয়ে সিনেমা হচ্ছে, সেই গল্পের ভাবনা বা প্লট, যদি সেটা বাইরের কারও লেখা হয় তো আলাদা কথা, নয়তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে গল্পের বীজ, সেটা হয়তো আমি বলেছি, নন্দিতাদি সেটা শুনেছেন। কিন্তু নন্দিতাদিকে চট করে রাজি করানো মুশকিল। হয়তো নন্দিতাদি রাজি হলেন। কিন্তু সেই গল্পের নেপথ্যে যে তথ্য, তা সংগ্রহ করে দিতে হয় আমায়। ‘হামি’র কথাই ধরুন। ‘হামি’ ছবিতে কী দেখতে পাই আমরা? একটা বাচ্চা আরেকটি বাচ্চাকে হামি খেয়েছে। সেটা দিয়ে আপনি ১২০ মিনিটের বা ১৪০ মিনিটের সিনেমা কীভাবে ভাববেন? আপনাকে তো ১০০টা দৃশ্য ভাবতে হবে। আমি গল্পটা বলার পরে নন্দিতাদি বললেন, ‘এটা দিয়ে সিনেমা কী করে হবে! তাছাড়া এর আগে-পরে কী আছে?’ আমাকে তখন সেই গল্পটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য যুক্তি সাজাতে হয়, সেই যুক্তিকে জোরালো করে তুলতে দশটা লোকের সঙ্গে কথা বলতে, অজস্র ভাবনা, রিসার্চ চলতেই থাকে। সেই গবেষণাটা আমি করি এবং করার পর আমার ভাবনাগুলো আমি নন্দিতাদির সঙ্গে শেয়ার করি। ওই সবকিছু শুনে তারপর নন্দিতাদি চরিত্রায়ন করেন, সিনেমার প্লটের প্রয়োজনে চরিত্র গড়েন, সিনেমার আদলে একটা চিত্রনাট্য তৈরি করেন। যাকে আমরা বলি ‘স্ক্রিন-প্লে’। সেই স্ক্রিন-প্লে আসার পরে, বা চিত্রনাট্য তৈরি হওয়ার পর সংলাপ বসানোর কাজ চলে। সেই দায়িত্বটা থাকে আমার কাঁধে।
যেহেতু থিয়েটারের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আমার উঠে আসা, তাই নন্দিতাদির কোথাও মনে হত যে, সংলাপটা আমি হয়তো ভালো করতে পারব। ফলে সেই দায়িত্ব বরাবর আমি সামলাই। এছাড়া থাকে প্রোডাকশন প্ল্যানিং, অভিনেতা ও টেকনিশিয়ান নির্বাচন– সেই সব ব্যাপার। এগুলো যৌথভাবেই আলোচনা করে ঠিক করা হয়। কিন্তু সবকিছুর শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমি নন্দিতাদিকেই নিতে বলি। তার কারণ, আমি নন্দিতাদিকে সত্যি আমার ‘বস’ মনে করি।
এরপরেও বহুকিছু আছে। যেমন সিডিউলিং করা। অর্থাৎ, কবে শুটিং হবে, সেই সব ব্যাপার। এটা নন্দিতাদি খুব সুন্দরভাবে করেন। তারপর অভিনেতাদের সঙ্গে কথা বলা, তাদের চিত্রনাট্য অনুযায়ী বোঝানো, এই দায়িত্বটা আমি সামলাই। এসবের পরে শুটিং-এর সময় ফ্লোর-ডিরেকশনের কাজটা আমার ওপর বর্তায়। তবে ফাইনাল কল, অর্থাৎ কোনও দৃশ্যে সংলাপটা ঠিকঠাক কিংবা মানানসই হচ্ছে কি না, সেই সিদ্ধান্তটা আমি নন্দিতাদির ওপরেই ছেড়ে দিই। দিদি মনিটরে থাকেন, হয়তো বললেন, ‘তুমি এই সিনটা আরও একবার শুট করো।’ আমি সেইমতো করার চেষ্টা করি।
এরপর যা থাকে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল এডিটিং। এটা পুরোপুরিই নন্দিতাদি সামলান। আবার ডাবিং-এর পুরো দায়িত্বটা আমার। পাশাপাশি মিউজিক এবং সাউন্ড ডিজাইনের দায়িত্বটাও আমি সামলাই। তবে সাউন্ড ডিজাইনারের সঙ্গে কথা বললেও সঙ্গে নন্দিতাদি থাকেন। আমরা যৌথভাবে বসেই খুঁটিনাঁটি বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলি। ফাইনাল সিদ্ধান্ত, সেটাও যৌথভাবেই নেওয়া হয়। এরপর সিনেমা রিলিজের সময় পিআর, পাবলিসিটি– সেসব সমস্ত কিছু আমার দায়িত্ব। এটাই হল পুরো প্রসেস। মোটামুটি এই প্রক্রিয়ায় আমরা সিনেমা করে আসছি এতদিন ধরে। শুরুটা যৌথভাবে নন্দিতাদি আর আমি মিলে করলেও এখন আমাদের একটা বড় টিম তৈরি হয়ে গিয়েছে। ফলে এখন কাজ এবং দায়িত্ব অনেকে মিলেই সামলে নেয়।
এত কিছুর পরেও যখন লোকমুখে শুনি, এটা ‘শিবপ্রসাদের ছবি’, নন্দিতাদির নামটা উহ্য থেকে যায়, তখন খারাপ লাগে। আসলে আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সিনেমা-জগতে কোথাও একটা মেনেই নেওয়া হয় যে, পুরুষরা বোধহয় মেয়েদের চেয়ে সিনেমা পরিচালনা বেশি ভালো করে। এসব নিয়ে আপত্তি জানিয়েও কিছু হয়নি। আমি আমার তরফে আগেও চেষ্টা করেছি। ‘উইন্ডোজ’ থেকে যখনই কোনও পোস্টার রিলিজ করে, দেখবেন সেখানে নন্দিতাদির নাম প্রথমে থাকে, সিনেমাতেও তাই। তার কারণ, নন্দিতাদি আমার চেয়ে বয়সে বড়। দ্বিতীয়ত, উনি আমার চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। সর্বপরি, মহিলা পরিচালক হিসেবে বাংলা ফিল্ম-ইন্ডাস্ট্রিতে নন্দিতাদির যা অবদান, তা ভোলার নয়। নন্দিতাদির মতো বর্ষীয়ান পরিচালক, যিনি জেলের সংশোধনাগার ও তার আবাসিকদের জীবন নিয়ে ‘মুক্তধারা’র মতো ছবির গল্প লিখেছেন, ওই রকম কাজ অতীতে বা পরবর্তী কালে হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। পাশাপাশি রোড অ্যাক্সিডেন্টের ওপর সিনেমা করেছেন। বাস দুর্ঘটনা, ১৫ বছরের বেশি পুরনো বাস কেন রাস্তায় চলছে, এমন একটা সিরিয়াস ইস্যু নিয়ে সিনেমা করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন নন্দিতাদি। একইসঙ্গে ‘হামি’র মতো সিনেমা করেছেন। সেটা এমন একটা কঠিন সময়ে, যখন স্কুল এবং তার পরিবেশ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল।
‘কণ্ঠ’র মতো সিনেমা, যেখানে ল্যারিংজিয়াস ক্যানসার মূল বিষয়, তাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, সারা বিশ্বের কাছে ‘কণ্ঠ’ এক্ষেত্রে অনন্য দলিল বলা চলে। তার পরবর্তী কালে ‘বেলাশুরু’র মতো সিনেমা করেছেন, যা অ্যালঝাইমারের ওপর নির্মিত। যখন গতানুগতিক সোশ্যাল ড্রামা বেশি হচ্ছে, তখন আমূল বদল এনে দর্শকদের উপহার দিয়েছেন ‘বহুরূপী’র মতো সিনেমা, যা কি না ব্যাঙ্ক ডাকাতির ওপর গল্প।
এই যে ব্যাপ্তি, রেঞ্জ অফ ডিরেকশন– আমি জানি না, মহিলা পরিচালক হিসেবে সমসাময়িক বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে আর কারও আছে কি না। এত ব্যাপ্ত পরিসরে কাজ করা, সিনেমার মতো শিল্পমাধ্যমে খুব কঠিন ব্যাপার– নন্দিতাদি তা করে দেখিয়েছেন। আমার সৌভাগ্য সেই জার্নিটার সঙ্গে নিজেকে জুড়ে নিতে পেরেছি। তাই কে কী বলল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশ্বাস করি, নিষ্কাম কর্মই পারে মোক্ষলাভের পথটাকে প্রশস্ত করতে। কাজেই সৃষ্টির আনন্দ অন্তরে অনুভব করতে পারছি কি না, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যৌথ পরিচালনার ক্ষেত্রে, আমাদের কাছে ‘বহুরূপী’, ‘রক্তবীজ’কিংবা ‘রক্তবীজ-২’ করাটাই আসল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ ছিল ‘হামি’ করার ক্ষেত্রেও।
আমরা যখন ‘বেলাশেষে’ করলাম, সেই সিনেমায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত-সহ ১৬ জন গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন। আমরা যখন ‘প্রাক্তন’ করলাম তখন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়-ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অভিনয় করেছিলেন, যখন ‘পোস্ত’ করেছি, তখন সেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যিশু সেনগুপ্ত, মিমি চক্রবর্তীর মতো অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন। এরপর যখন ‘হামি’ করতে যাচ্ছি, তখন সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে– ‘এ কী! স্টারেদের নিয়ে ছবি করে তোমরা বাচ্চাদের নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছ? দুটো বাচ্চা, তাদের পোস্টারে রাখছ!’ এটাই আসলে আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল, আমরা দু’জনেই বরাবর বিশ্বাস করেছি, বিষয়বস্তুই হিরো হবে। আমরা চাই, নন্দিতা-শিবপ্রসাদকে যেন কখনও শুনতে না হয়, ‘তোমাদের সিনেমায় কে আছে?’ যেন প্রশ্ন করা হয়, ‘এবার তোমাদের সিনেমা কী নিয়ে?’ যেদিন এই প্রশ্ন থেমে যাবে, জানবেন, পরিচালক হিসেবে সে মৃত! যৌথ পরিচালনায় এই চ্যালেঞ্জটাই আমাদের কাছে উপভোগ্য। বাড়তি কোনও পাওয়ার বাসনা নয়, বরং নিজের কাজটুকু করে যাওয়াটাই আমাদের পাথেয়।
‘দুই’ দিয়ে কথা শুরু করেছিলাম। দুই দিয়েই যবনিকা টানি। দুই-এর কথাপ্রসঙ্গে মা-র কথা মনে পড়ল। আমি মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। আমার মা আমার কাছেই থাকেন। মা-র বয়স এখন ৯০। মা আমায় এখন ‘বাবা’ বলে ডাকেন। দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে এ আমার কাছে অদ্বিতীয় প্রাপ্তি। একই রকম অনুভূতি কাজ করে আমাদের দ্বিতীয় সিনেমা ‘মুক্তধারা’কে কেন্দ্র করেও। ‘মুক্তধারা’ যখন করছি, তার আগে আমাদের তিন-তিনটে সিনেমা– ‘ইচ্ছে’, ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ ও ‘হ্যালো মেমসাহেব’ মুক্তি পায়নি, আইনি জটে আটকে গিয়েছিল। ইন্ডাস্ট্রিতে আমাদের নামই হয়ে গিয়েছিল ‘অপয়া’! সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে যখন ‘মুক্তধারা’ করতে যাচ্ছি তখন সেই ছবির হিরো কে? নাইজেল আকারা! যে কি না সংশোধনাগার থেকে মুক্তি পাওয়া সাজাপ্রাপ্ত এক আবাসিক। ভাবুন, এমন পরিচালক জুটি, যাদের কি না তিন-তিনটে সিনেমা আটকে গিয়েছে, তাদের পরের সিনেমার নায়ক একজন সাজাপ্রাপ্ত সংশোধনাগারের প্রাক্তন আবাসিক। কে টাকা ঢালবে, এমন সিনেমায়! আমরা কিন্তু হাল ছাড়িনি।
কঠিন কাজ, তবু ‘মুক্তধারা’ এক অনন্য অভিজ্ঞতা যা করতে গিয়ে খুব মজা পেয়েছিলাম। বিচিত্র সব মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, আর সেই আলাপের সূত্রে জানতে পেরেছিলাম, সংশোধনাগারে থাকা আবাসিক মাত্রেই সবাই ‘অপরাধী’ নয়। নাইজেল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ‘মুক্তধারা’য় এবং পরবর্তী সময়ে ও যে যে কাজ করেছে, তা অসাধারণ। সেটাই ‘মুক্তধারা’র সার্থকতা। যৌথ পরিচালনায় সেটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি। তাই যাই ঘটুক, নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জুটি চিরকাল অটুট থাকবে, ‘গুপি-বাঘা’র মতো। ভাঙন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। কখনও না।
………………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
………………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved