জাতকের কাহিনি শাশ্বত। আবহমান আখ্যানের ভিতরই জীবনের গূঢ় অর্থের সন্ধান। আজও তা সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। লিখছেন দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত।
‘জাতক’ মানে যে জন্মেছে। কিন্তু ‘যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ’, সেই ফুটফুটে ‘নবজাতক’ ছাড়া এই শব্দটিকে আমরা বড় একটা স্পর্শ করি না। তুলে রেখেছি বুদ্ধদেবের নাম করে। তাঁর পূর্ব পূর্বজনমের কাহিনিই জাতক। ইশকুলের দ্রুতপঠন পুস্তিকা বা ‘অমর চিত্রকথা’-র কল্যাণে সেকথা আমাদের ছোটবেলা থেকেই জানা। তাহলে আর ধুলো ঘেঁটে হ্যাঁচ্চো করতে করতে খটোমটো ভাষার পুরনো মোটকা বইগুলো খুঁজে বের করার কী দরকার ছিল?
সে শুধু শুদ্ধ গল্পের টানে। যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও শতক কয়েক আগে পালি ভাষায় লেখা গল্পগুলো সময়ের পলি পড়ে মিইয়ে যায়নি মোটেও। বরং এই সোজা সরল নির্মেদ কাহিনির মাঝে চকিতে খুঁজে পাওয়া যায় সমসাময়িকতা। যেমন কাউন্সেলিং-এর এই গল্প। আনুষাঙ্গিক উপদেশ, প্রাসঙ্গিকতা, তত্ত্বকথা সব সরিয়ে ঢুকে পড়ি সেই গল্পের চাষজমিতে।
সেকালের রাজগৃহনগর। তার পুবদিকে শালিন্দিক নামে এক ব্রাহ্মণ গ্রাম। সেই গ্রামের পুব সীমানায় এক বিশাল ধানখেত। সেই ঊর্বর জমিতে শালিধানের প্রচুর ফলন। জমির মালিক বামুনটি খেত পাহারার জন্য লোক রেখেছেন।
একদিন তেমন এক কর্মচারী শুকনো মুখে মালিকের কাছে এলেন। ব্রাহ্মণ সদয় মানুষ। তিনি বললেন, কী হে, ফলন তো এ-বছর ভালই হচ্ছে শুনছি।
লোকটি ম্রিয়মাণ গলায় বলল, আজ্ঞে ফলন খুবই ভাল। কিন্তু–
–কিন্তু কী? বন্যা অতিবৃষ্টির কোনও পূর্বাভাস নেই তো?
–আজ্ঞে না। তবে জমির পুবদিকে পাহাড়ের নীচে যে শিমুল গাছের বন সেখানে অনেক শুকপাখির বাস।
ব্রাহ্মণ এবার হেসে ফেলেন। ‘পাখিতে আর কত ধান খাবে হে?’
শুধু পেট ভরে খাওয়া নয়, পাখির পালের যে সর্দার সেই বলশালী শুকরাজটি ভরপেট খেয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ঠোঁটে করে বেশ খানিক ধানের শীষ নিয়ে যায়– যা খেলো তার চেয়ে কিছু কম নয়।
ব্রাহ্মণ বিচলিত হন। ধানের ক্ষতির কথা ভেবে নয়, পাখির এমন আচরণের কারণ বুঝতে না পেরে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। কৌতুহলী ব্রাহ্মণ বাইরে কিছু প্রকাশ না করে কর্মচারীটিকে বললেন, তাই তো হে, বিরাট ক্ষতির আশঙ্কা! তুমি বরং ঘোড়ার নরম লোম দিয়ে এক ফাঁদ তৈরি কর। সেখানে সর্দার পাখি ধরা পড়লে তাকে যেন কোনও আঘাত করো না। সটান অক্ষত নিয়ে আসবে আমার কাছে।
আর ফাঁদে পড়বি তো পড়, সেই শুকসর্দারই ধরা পড়ল পরদিন সকালে! এই পাখি কিন্তু সাধারণ নয়, স্বয়ং বোধিসত্ত্ব সেবার জন্মেছেন শুকরাজ হয়ে। তাই তার গভীর বিবেচনাবোধ। সর্দার ভাবলে, খেতে এসেই যে আমি ফাঁদ বন্দি হলাম, এখনই চেঁচামেচি করলে আমার সঙ্গীদের খাওয়ায় বিঘ্ন ঘটবে। তাই সে চুপ করে ফাঁদের মধ্যে বসে রইল। তারপর খাওয়া শেষ করে পাখির দল যখন বাসার দিকে ডানা মেলল, শুকরাজ তখন আর্তনাদ করে বলল, ‘ফাঁদে আটকে পড়েছিইই–।’
কিন্তু হায়, একটি পাখিও সে চিৎকারে কর্ণপাত করল না। বরং কলরব শুনে সেই পাহারাদার কর্মচারীটি দৌড়ে এল। তার আনন্দ আর ধরে না, যার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ সেই হৃষ্টপুষ্ট সর্দারই ধরা পড়েছে। সে ফাঁদ থেকে বের করে শক্ত করে পাখির পা-দুটোকে বাঁধল। তারপর তাকে নিয়ে এল ব্রাহ্মণের কাছে।
কৌতুহলী ব্রাহ্মণ পরম স্নেহে শুকরাজকে কোলের কাছে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বুঝি খিদে মেটে না, তাই রোজ খাওয়ার শেষে ঠোঁটে করে ধানের শীষ নিয়ে যাও?
শুকরাজ শান্ত স্বরে বলল, ও ধান তো ঋণ শোধ করার।
–ঋণ? কার কাছে এত ঋণ তোমার?
–আমার বাবা-মায়ের কাছে, আমার দলের বয়স্ক, দুর্বল পাখিদের কাছে। তাদের খাওয়ার জন্য ধান নিয়ে যাই।
অভিভূত ব্রাহ্মণ পাখির বাঁধন খুলে পায়ের ক্ষতে শুশ্রূষা করলেন। তারপর তাকে ছেড়ে দিলেন।
শুকরাজ উড়ে চলল এক পুণ্য জন্ম থেকে আর এক পুণ্যের দিকে।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved