সাধারণ অসুখ-বিসুখের জন্য ডাক্তারের চেম্বারে লাইন দেওয়া বা পাড়ার ওষুধের দোকানে ছোটার দরকারই হত না সে-সময়ে। শুধু আমাদের পরিবার নয়, সে সময়ে কলকাতার সমস্ত অঞ্চলে ’৭০-এর হোমিওপ্যাথির পুনর্জাগরণের পর জন্ম নিয়েছিল একাধিক হোমিও-প্রতিষ্ঠান। সেই কাঠের কাউন্টারের ওপারে সার সার আলমারিতে ঠাসা কাচের বিভিন্ন রকমের শিশি আর বোতল থেকে বড়ি বার করে পর্দার আড়ালে মাদার মিশিয়ে ওষুধ তৈরি করতেন রহস্যময় কম্পাউন্ডার-রা। যেন একটা সিনেমার সেট।
‘যা, যা, যা… দৌড়ে গিয়ে আমার বাক্স থেকে সাইলেসিয়ার শিশিটা নিয়ে আয়। ভাল্কুর আবার কাঁটা ফুটেছে’– বড় জেঠুর গলা বেসে আসছে।
একটা ধুলো-পড়া কাঠের বাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি– পুপ্লু সিঁড়ি বেয়ে ছুটে নেমে আসছে, হাতে সাইলেসিয়ার শিশি। বড়জেঠু শান্ত মুখে শিশি থেকে পাঁচটা দানা সেজজেঠুর জিভে গড়িয়ে দিয়ে একটা হালকা যুদ্ধ-জয়ের হাসি হেসে– ‘উটেরাও কাঁটা বেছে খায়’, বলে শিশি হাতে ওপরে চলে গেল।
বাড়িতে নামকরা অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার তিনজন। কিন্তু চরম বাড়াবাড়ি না হলে তাঁদের ত্রিসীমানায় ঘেঁষা যেত না যাঁদের জন্য, তাঁরা হলেন– আমার বড় জেঠু (পি. ব্যানার্জী– মিহিজাম ঘরানা), আমার ছোটকাকা (মহেন্দ্রলাল সরকার ঘরানা) এবং আমার বাবা (কালী ডাক্তার ঘরানা)। তাছাড়াও ছিলেন ফুলদাদু, হাইড্রোথেরাপি এবং ম্যাগনোটো-থেরাপিতে সিদ্ধহস্ত।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: সিংহের গর্জন থেকে বাঁশির সুর: নাক ডাকার বিচিত্র রেওয়াজ
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সেবার গরমের ছুটিতে বোধি এল, সপ্তাহখানেক থাকবে– এই পরিকল্পনা নিয়ে, আর এসেই বাধিয়ে ফেলল ধুম জ্বর! এ বাড়ির পালস্ যারা বোঝে, তারা জ্বর হলে গোপনে চাদর মুড়ি দিয়ে, সন্ধে নামলে পিছনের দরজা দিয়ে, সন্তর্পণে বার হয়ে বাগান পার করে ও বাড়ির ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় ধুঁকতে ধুঁকতে উঠে, আবার পাকা সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নেমে মেজদাদু-র (ডাক্তার পি.কে রায়চৌধুরী, অ্যালোপ্যাথ, বিধান রায় ঘরানা) চেম্বারে ঢুকে সারেন্ডার করত। একবার ঢুকে পড়তে পারলে আর চিন্তা নেই। নাড়ি টিপে, পেট টিপে, জিভ দেখে, দাগ-কাটা কাগজ সাঁটা সিরাপ মিশ্রিত মিক্সচার হাতে ধরিয়ে, পথ্য বুঝিয়ে, নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকার প্রেসক্রিপশন লিখে দিতেন মেজদাদু।
বিপদ ছিল অন্যত্র। খবর যেত রান্নাঘর থেকে। যেই শোনা গেল কারও জন্য অল্প খিচুড়ি করতে বলা হয়েছে অমনি শুরু হল খোঁজ। রোগী ধরা পড়তে না পড়তেই বড়জেঠু কলেজে বেরনোর আগে, বোধিকে ব্রায়োনিয়ার একটা ডোজ্ দিয়ে কঠোরভাবে বলে গেলেন– এখনই অ্যালোপ্যাথি শুরু না করতে। বিকেলে আরেক ডোজ্ পড়লেই জ্বর ছেড়ে যাবে। বড়জেঠুর প্রস্থানের সামান্য পরেই ছোটকাকার প্রবেশ। ‘দাদা আজকাল ভাল করে কিছু না দেখেই দুমদাম ওষুধ দিয়ে দেয়, শোন এটা ব্রায়োনিয়ার কেস নয়, এই নে, এই চারটে গ্লোবিউল বেলেডোনা মুখে রাখ, সন্ধেবেলা এসে আর একবার খাইয়ে যাব, দাদার ওষুধগুলো ফেলে দে। জিজ্ঞেস করলে বলে দিবি– খেয়েছিস।’ পেশেন্ট– বোধিসত্ত্ব, গালের একপাশে চারটে লুকনো ব্রায়োনিয়া আর আরেক পাশে চারটে সদ্য গোঁজা বেলেডোনা চিবিয়ে সবেমাত্র শেষ করেছে কি করেনি, সিঁড়িতে বাবার পায়ের শব্দ!
বোধি আমার হাতে-পায়ে ধরে বলছে– ‘খবরদার বলবি না জ্বর, খবরদার…’ বলতে বলতে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমের দিকে এগোতেই পর্দার ওপাশ থেকে বাবার গলা ভেসে এল– ‘কী রে, জ্বর বাধিয়েছিস?’ বোধি– ‘না, না, কোথায়? এই তো চানে…’ কথা শেষ হয় না; বাবা জুতো খুলতে খুলতে আমার উদ্দেশে বলে যায়– ‘ওপরের তাক থেকে রাসট্যাক্স থার্টিটা নিয়ে আমার হাতে দে’। বোধি বাথরুমে চৌবাচ্চা থেকে জল ঢালতে ঢালতে কেন জানি না– ‘খর বায়ু বয় বেগে, চারিদিক ছায় মেঘে,’ গাইতে শুরু করেছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
খেলতে গিয়ে, পড়ে গিয়ে আঘাত পেলে জাদুকরের মতো জেগে উঠত আর্নিকা। আঞ্জনি বা চোখ উঠলে–পালসেটিলা। একমাত্র ডেরিটল পারত প্রেশার ফল করলে তাকে বাড়িয়ে তুলতে। একমাত্র পেট্রোলিয়াম পারত শীতে হাতে-পায়ে চামড়া উঠে ভয়াবহ হয়ে উঠলে তাকে মসৃণ করে তুলতে। মাথাব্যথা, পেটখারাপ, গলায় ব্যথা, সর্দি-কাশি, জ্বর, গ্যাস বা অম্বলের কত নিত্যনৈমিত্তিক বিকারের বিরুদ্ধে এক সলজ্জ সুলভ ও বিনীত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারত ওই পরপর কর্কের ছিপি আঁটা মায়াগন্ধময় সাদা গোল বড়ি ভর্তি শিশিগুলি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
‘কার্বোভেজ ৩০’, ‘নাক্সভমিকা ৩০’, ‘কোলোসিন্থ ৩০’, ‘ম্যাক্সল ৩০’, ‘পোডোফাইলাম ৩০’ ১০ গ্রাম, গ্লোবিউল ৪০– একটা কাগজে লেখা। কাগজটা বুক পকেটে নিয়ে সাইকেল চালাচ্ছি। ‘কিং কোম্পানি’-র বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে এল। এর মধ্যে দুটো ওষুধ বাবাকে পৌঁছে দিয়ে বাকি বড়জেঠুর বাক্সে ভরে রাখতে হবে। ‘জানিস ইউরোপে এখন যে কোনও ডাক্তারের কাছে গেলে জিজ্ঞেস করে– কী চিকিৎসা করাবেন? হোমিওপ্যাথি না অ্যালোপ্যাথি? আর আমাদের এখানে আয়ুর্বেদ, ইউনানি, চাঁদসি তো ছেড়েই দে, অ্যালোপ্যাথির চাপে হোমিওপ্যাথিটাও হারাতে চলেছে…’। এঁদের কেউ অধ্যাপনা করতেন, কেউ প্রকাশনা, কেউ নাট্যকার। না, হোমিওপ্যাথির কোনও কলেজে পড়ে আসেননি। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তারা হ্যানিম্যান, মেন্ট-এর মেটেরিয়া মেডিকা, রিচার্ড হিউজের বই পড়ে হোমিওপ্যাথি শিখেছিলেন, যাতে বাড়ির মানুষেরা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব বিনা পয়সায় সহজ নিরাময়ের সন্ধান পান।
খেলতে গিয়ে, পড়ে গিয়ে আঘাত পেলে জাদুকরের মতো জেগে উঠত আর্নিকা। আঞ্জনি বা চোখ উঠলে–পালসেটিলা। একমাত্র ডেরিটল পারত প্রেশার ফল করলে তাকে বাড়িয়ে তুলতে। পেট্রোলিয়াম পারত শীতে হাতে-পায়ে চামড়া উঠে ভয়াবহ হয়ে উঠলে তাকে মসৃণ করে তুলতে। মাথাব্যথা, পেটখারাপ, গলায় ব্যথা, সর্দি-কাশি, জ্বর, গ্যাস বা অম্বলের কত নিত্যনৈমিত্তিক বিকারের বিরুদ্ধে এক সলজ্জ সুলভ ও বিনীত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারত ওই পরপর কর্কের ছিপি আঁটা মায়াগন্ধময় সাদা গোল বড়ি ভর্তি শিশিগুলি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: গঙ্গাজল নয়, মুখে দিও হুইস্কি
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সাধারণ অসুখ-বিসুখের জন্য ডাক্তারের চেম্বারে লাইন দেওয়া বা পাড়ার ওষুধের দোকানে ছোটার দরকারই হত না সে-সময়ে। শুধু আমাদের পরিবার নয়, সে সময়ে কলকাতার সমস্ত অঞ্চলে ’৭০-এর হোমিওপ্যাথির পুনর্জাগরণের পর জন্ম নিয়েছিল একাধিক হোমিও-প্রতিষ্ঠান। সেই কাঠের কাউন্টারের ওপারে সার সার আলমারিতে ঠাসা কাচের বিভিন্ন রকমের শিশি আর বোতল থেকে বড়ি বার করে পর্দার আড়ালে মাদার মিশিয়ে ওষুধ তৈরি করতেন রহস্যময় কম্পাউন্ডার-রা। যেন একটা সিনেমার সেট। সিলিং ফ্যানের ঘড়ঘড় শব্দ ছাড়া অধিকাংশ নৈঃশব্দ্যের ভেতর হালকা হলুদ আলোয় দেওয়ালে মৃদু দুলতে থাকত সাহেব-সুবো ডাক্তার, পথিকৃৎদের ছবি। হোমিওপ্যাথি হয়ে উঠেছিল ঘরোয়া। হয়ে উঠেছিল অস্বচ্ছল মানুষের নির্ভরযোগ্য পরম উপশম। মাঝেমধ্যেই এ শিশি, ও শিশি খুলে দু’-একটা বড়ি মুখে দিয়ে মুখশুদ্ধিও করে নিত বাচ্চা থেকে বুড়োবুড়ির দল। ফাঁকা শিশি ঠোঁটের নিচে চেপে বাঁশির মতো বাজিয়ে রেফারি সাজত সেজদা। নকুলদানা ফুরিয়ে গেলে মাঝেমধ্যে ঠাকুরের তাকেও তাকে বিরাজ করতে দেখেছি, আর আমাদের সরযূকাকা তো হোমিওপ্যাথির মাদার খেয়েই নেশা করত ভরপুর।
হোমিওপ্যাথির জনপ্রিয়তা হয়তো কমেনি কিন্তু বাড়িতে বাড়িতে তার প্র্যাকটিস অপস্রিয়মাণ। পাড়ার চেম্বারে একলা বসে থাকা ডাক্তারের মতো দাঁড়িয়ে আছি সেই কাঠের বাক্সটার সামনে। ধুলোয় ঢেকে গেছে সব।
টেবিলে উপনিষদ… হ্যানিম্যান… চশমা ওল্টানো…
অডিটোরিয়াম থেকে ব্যাক স্টেজে আসার যে দরজা সেটা দিয়ে উঠে আসছিল খুব রোগা মতো একটি ছেলে, গায়ের রংটা শ্যামলা, তাকে দেখে বলি, ‘একটু দেখবেন ভাই, অডিটোরিয়াম এ সামনের রো-তে রশিদ খান বলে কেউ আছেন কিনা’, সে শুধু বলল, ‘জি’, আবারও বলি, ‘প্লিজ একটু দেখবেন’, আমি তখনও তাঁকে ভাবছি ‘usher’ জাতীয় কেউ। এবার সে একটু ইতস্তত করে নম্রভঙ্গীতে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘জি, ম্যায় হুঁ’।