মোহনবাগানে সই করার পর থেকেই দীপেন্দু, দেবজিৎ-দের মুখে বারপুজোর নানা গল্প শুনতাম। বারপোস্টকে পুজো করার চল আমাদের দেশে কোনওদিন দেখিনি। আমরা নিজের মতো করে বারপোস্টকে প্রণাম করি, প্রার্থনা করি। কিন্তু দীপেন্দুদের মুখে শুনতাম, বাংলা নববর্ষ-র দিন, ক্লাবে বারপুজোর অনুষ্ঠান হয়। ওদের মুখে শুনতাম, কিন্তু কোনওদিন উপস্থিত থাকতে পারিনি। কারণ, সেই সময় জাতীয় লিগের শেষের দিকের খেলাগুলো চলত।
৯.
দুটো জাতীয় লিগ আমার পকেটে।
কিন্তু দ্বিতীয়বারের জাতীয় লিগ জয়কে ঘিরে যে উৎসব হয়েছিল, সেটা কখনও ভুলব না। প্রথমবার জাতীয় লিগ যেহেতু চারটে ম্যাচ আগে থাকতেই জিতে গিয়েছিলাম, সেই কারণে হয়তো আনন্দ হলেও ব্যাপারটার মধ্যে সেই উন্মাদনা টের পাইনি। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম ছিল– লিগ খেতাব আমাদের পাওয়ার কথা, পেয়েছি। এর বাইরে আলাদা কোনও উত্তেজনা অনুভব করিনি। কিন্তু দ্বিতীয়বারের কথা ভাবুন। পরিস্থিতি মোটেই আমাদের অনুকূল ছিল না। চার্চিল ব্রাদার্সের ঘরের মাঠে ম্যাচ। ওরা ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন। সেই কঠিন পরিস্থিতি থেকে আমরা চার্চিলকে হারিয়ে জাতীয় লিগটা জিতে ফিরলাম। এই অপ্রত্যাশিত জয়ের জন্যই বোধহয় সেদিন মোহনবাগান সমর্থকদের মধ্যে ওমন বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস দেখতে পেয়েছিলাম।
আমি থাকতাম, কেষ্টপুর সংলগ্ন সল্টলেকের বৈশাখীতে।
কলকাতা বিমানবন্দর থেকে বৈশাখী গাড়িতে আসতে কত সময় লাগা উচিত ? খুব বেশি হলে মিনিট ২০। কিন্তু জাতীয় লিগ জিতে সেদিন বিমানবন্দর থেকে বৈশাখী আসতে আমার সময় লেগে গিয়েছিল কম করে পাঁচ ঘণ্টা। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম, মোহনবাগান সমর্থকরা আমাকে কত গভীরভাবে ভালোবাসেন।
গোয়া থেকে সকালে বিমানবন্দরে নেমে দেখি শুধুই মানুষের ঢল। সবুজ-মেরুন পতাকা নিয়ে বিমানবন্দর চত্বরে থিকথিক করছে শুধু মানুষের মাথা। ঢাক-ঢোল নিয়ে এসেছে। সঙ্গে চলছে সবুজ-মেরুন আবির নিয়ে উৎসব। কলকাতার মাটি ছোঁয়ার আগেই দেবজিৎদের মুখে শুনছিলাম, আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে না কি, বিমানবন্দরে প্রচুর মানুষ হাজির হতে পারে। কিন্তু এরকম ভাবে মানুষর ঢল নামবে সত্যিই বুঝিনি।
বিমানবন্দরের ভিতরে লাগেজ নেওয়ার জন্য যখন অপেক্ষা করছি, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, বাইরে কী অপেক্ষা করছে! লাগেজ বেল্টের সামনে তখন বিমানবন্দরের অন্য যাত্রী, স্টাফরা ছবি তোলার জন্য ভিড় করে ফেলেছে। সেই সময় এখনকার মতো সেলফি তোলার হিড়িক ছিল না, এই রক্ষে! তখন সবাই বাড়িয়ে দিত অটোগ্রাফের খাতা। কিন্তু অভিনন্দনের অত্যাচারে বিমানবন্দরের ভিতরে আমার তখন পাগল হওয়ার অবস্থা। যে পারছে, হাত দুটো ধরে আমাকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। মিষ্টিমুখ করে হাসা ছাড়া আমার অন্য কোনও উপায় ছিল না। কলকাতা বিমানবন্দরের ভিতরে তখন মনে হচ্ছিল, সবাই যেন মোহনবাগান সাপোর্টার।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সালটা ঠিক মনে নেই। তবে একবার জাতীয় লিগ চলাকালীন এই বিশেষ দিনটায় হাজির ছিলাম ক্লাবে। বারপুজো ঠিক কী, দেখার কৌতূহলও ছিল। ব্যস, দলের অন্য ফুটবলারদের মতো আমিও সকালবেলা ক্লাবে হাজির। বারপোস্টের পুজোর সামনেই দাঁড়িয়ে রইলাম। আর দেখছিলাম, মাঠের ভিতর একটু একটু করে ভিড় বাড়ছে সমর্থকদের। আর সবার লক্ষ্যবস্তু হলাম– আমি! ক্লাবে উপস্থিত কর্মকর্তারা ব্যাপার আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, তাই আমার চারপাশে হাত দিয়ে একটা কর্ডন করেছিলেন, যাতে সমর্থকদের জোয়ারে ভেসে না যাই। কিন্তু হাতের বাঁধ দিয়ে কি আর জনসমুদ্রকে আটকানো যায়!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
লাগেজ নিলাম। ধীরে ধীরে বাইরে বের হওয়ার জন্য এগজিট গেটের দিকে এগিয়ে গিয়েছি। গেটের কাছে পৌঁছে সবেমাত্র বাইরের দিকে তাকিয়েছি– কিছু সমর্থক আমার দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে ‘ব্যারেটো’ বলে চিৎকার করে উঠল, তাতে ভয়ে আবার ভিতরে ঢুকে গেলাম। এ তো মানুষের ভিড় নয়, জনসমুদ্র! এই অবস্থায় বের হব কী করে! মোহনবাগান সমর্থকদের ভালোবাসার অত্যাচারে ওখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতাম। সত্যিই ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বুঝতেই পারছিলাম না, বিমানবন্দরের বাইরে গিয়ে কীভাবে টিম বাসে উঠব। পরিস্থিতি বিচার করে ঠিক হল, টিম বাসটা অন্য গেটে সরিয়ে নিয়ে যাওযা হবে। আর পুরো ব্যাপারটা অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে করতে হবে। কারণ সমর্থকরা জেনে গেলে সেই গেটে গিয়েই একই রকম ভিড় জমাবে। তখন কলকাতা বিমানবন্দর এখনকার মতো ছিল না। মূল গেটের অনেকটা বাঁ-দিকে অন্য একটা গেটে টিম বাসটা রাখা হয়েছিল। নিরাপত্তারক্ষী দিয়ে এক এক করে আমাদের সেই বাসে তুলে দেওয়া হল। এদিকে, আমরা অনেকক্ষণ বিমান থেকে নেমে পড়েছি। তারপরেও সমর্থকরা দেখছে, আমরা বিমানবন্দর থেকে বেরোচ্ছি না। কিছু সমর্থকদের সন্দেহ হয়, তাহলে কি ভিড় এড়াতে আমাদের অন্য কোনও গেট থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে? এই সন্দেহ থেকে কিছু সমর্থক ঢাক-ঢোল নিয়ে অন্য গেটগুলির দিকে খোঁজ নিতে শুরু করে। দেখতে পায়, একটা গেটের সামনে মোহনবাগানের টিম বাস দাঁড়ানো। আর আমি তাতে ওঠার জন্য এগিয়ে চলেছি। দেখতে পেয়ে আমাকে ধরার জন্য সমর্থকরা তখন হুড়মুড় করে দৌড় শুরু করেছে। আমি কালবিলম্ব না করে একলাফে টিম বাসের ভিতরে ঢুকে পড়েছিলাম।
ছবিটা কল্পনা করতে পারেন? আমাদের টিম বাসের সামনে তখন হাজারে-হাজারে মোহনবাগান সমর্থক। তাদের সামনে আবার বিশাল বাইক বাহিনী। বাসের জানালা থেকে দেখছি, চারিদিকে সবুজ-মেরুন আবির উড়ছে। সে এক অবিশ্বাস্য, অবর্ণনীয় দৃশ্য! আমি ভালো খেলতে পারি। কিন্তু সেদিনের সেই দৃশ্যকে বর্ণনা করা আমার অসাধ্য। এটুকু বলতে পারি, আমরা ফুটবলাররা সমর্থকদের এরকম পাগলামির মধ্য দিয়ে সব সময় বাঁচতে চাই। তবে সমর্থকদের এই ভালোবাসার অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য এই প্রথম নয়। আরও একবার জীবন বাজি রেখে আমাকে দৌড়ে মোহনবাগান তাঁবুতে ঢুকতে হয়েছিল।
সেটা বারপুজোয়।
মোহনবাগানে সই করার পর থেকেই দীপেন্দু, দেবজিৎ-দের মুখে বারপুজোর নানা গল্প শুনতাম। বারপোস্টকে পুজো করার চল আমাদের দেশে কোনও দিন দেখিনি। আমরা নিজের মতো করে বারপোস্টকে প্রণাম করি, প্রার্থনা করি। কিন্তু দীপেন্দুদের মুখে শুনতাম, বাংলা নববর্ষ-র দিন, ক্লাবে বারপুজোর অনুষ্ঠান হয়। ওদের মুখে শুনতাম, কিন্তু কোনও দিন উপস্থিত থাকতে পারিনি। কারণ, সেই সময় জাতীয় লিগের শেষের দিকের খেলাগুলো চলত।
সালটা ঠিক মনে নেই। তবে একবার জাতীয় লিগ চলাকালীন এই বিশেষ দিনটায় হাজির ছিলাম ক্লাবে। বারপুজো ঠিক কী, দেখার কৌতূহলও ছিল। ব্যস, দলের অন্য ফুটবলারদের মতো আমিও সকালবেলা ক্লাবে হাজির। বারপোস্টের পুজোর সামনেই দাঁড়িয়ে রইলাম। আর দেখছিলাম, মাঠের ভিতর একটু একটু করে ভিড় বাড়ছে সমর্থকদের। আর সবার লক্ষ্যবস্তু হলাম– আমি! ক্লাবে উপস্থিত কর্মকর্তারা ব্যাপার আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, তাই আমার চারপাশে হাত দিয়ে একটা কর্ডন করেছিলেন, যাতে সমর্থকদের জোয়ারে ভেসে না যাই। কিন্তু হাতের বাঁধ দিয়ে কি আর জনসমুদ্রকে আটকানো যায়! একটা সময় সমর্থকদের চাপে সেই হাতের কর্ডন গেল খুলে। ব্যস, পড়িমড়ি করে টেন্টের দিকে দৌড়তে শুরু করলাম। সে এক অপরূপ দৃশ্য! ভালোবাসার হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি দৌড়চ্ছি। আমার পিছনে সমর্থকরা।
কলকাতা থেকে অনেক দূরে, আরব সাগর-পারে বসে এখন এইসব স্মৃতি রোমন্থন করছি। মোহনবাগান ক্লাব, সমর্থকদের সঙ্গে আমার ভালোবাসার সম্পর্কের স্মৃতিগুলি বারবার মনে পড়ে। মনে হয়, এই তো সেদিন…। সামনে আবার বারপুজোর উৎসব। সবাই ভালো থাকবেন…।
আর হ্যাঁ, আমাকে জানাবেন, কেমন লাগছে আমার গল্প শুনতে।
(চলবে)
অনুলিখন: দুলাল দে
…তোতাকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৮। মাঠে তো বটেই, ইয়াকুবু বাথরুমে গেলেও ফলো করবে স্যালিউ
পর্ব ৭। আর একটুর জন্য হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল জাতীয় লিগ জয়
পর্ব ৬। জাতীয় লিগের প্রথম ম্যাচেই বেঞ্চে বসে রইলাম
পর্ব ৫। আশিয়ানের আগে সুভাষ ভৌমিক প্রায়ই ফোন করত আমাকে, বোঝাত ইস্টবেঙ্গলে সই করার জন্য
পর্ব ৪। আর একটু হলেই সই করে ফেলছিলাম ইস্টবেঙ্গলে!
পর্ব ৩। মোহনবাগানের ট্রায়ালে সুব্রত আমায় রাখত দ্বিতীয় দলে
পর্ব ২। কলকাতায় গিয়েই খেলব ভেবেছিলাম, মোহনবাগানে ট্রায়াল দিতে হবে ভাবিনি
পর্ব ১। ম্যাচের আগে নাইটপার্টি করায় আমাকে আর ডগলাসকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ক্লাব
পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা বলতে বলতে তাঁর অশ্রুসজল চোখ দেখে শুধু সেই সময় নির্বাক হয়েছিলাম তা’ নয়, আজও তাঁর সেই চোখ দেখতে পাই, শুনতে পাই মানুষের প্রতি মানুষের বর্বরোচিত অত্যাচারের সেই গল্প বলতে বলতে তাঁর রুদ্ধ কণ্ঠস্বর।