ফতুয়া-পায়জামা। ভারী শরীর। লম্বা দাড়ি। ভারী গলা। ভাস্কর্যের লোক। কিন্তু এইটুকুতেই শর্বরী রায়চৌধুরীকে চেনা ফুরিয়ে যায় না। লম্বা দাড়িতে, শর্বরীকাকা প্রায়শই গুঁজে রাখত দুটো ছোট ফুল। কলাভবনের ক্লাস হোক, বাড়িতে হোক, লম্বা দাড়িতে সেই ফুল আলগোছে লেগে থাকত। প্রথম প্রথম সাইকেল চড়ে ঘুরে বেড়াত শান্তিনিকেতন। পরবর্তীকালে, বিশেষ করে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রিকশার প্রতি টান বেড়ে যায় ওর। তবে, শুধু রিকশা চড়ার প্রতি না। রিকশা চালানোর প্রতিও।
৯.
তখন শর্বরীকাকা ফোরটি ফাইভ কোয়ার্টার থেকে সরে নিজের বাড়িতে এসে পড়েছে। দুরন্ত সেই বাড়ি খাস শ্যামবাটিতে! বড় ও উঁচু একটা স্টুডিও। উচ্চতা প্রায় ২০-২৫ ফিট মতো হবে। সেখানে একফালি জায়গা দিয়ে উঠে গিয়েছে একটা সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি পৌঁছয় একটা ঘরে, যাকে বারান্দাও বলা চলে, একটা দিকই খোলা– যেখান থেকে স্টুডিও দেখা যায়। সেই একচিলতে জায়গাটায় একটা মোড়া, একটা খাট। ওখানেই আমি থেকেছি বহুদিন। সকালবেলা উঠে সেই ঘরবারান্দা দিয়ে শর্বরী রায়চৌধুরীর স্টুডিও দেখতে পেতাম।
স্টুডিওটা ভর্তি ছিল নানা রেপ্লিকাতে। কাজ কীভাবে হয়ে উঠেছে, টের পাওয়া যেত তাই দেখে। এই ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত লাগত। স্টুডিওতেই একটা জায়গার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, সেখানে রয়েছে সিদ্ধেশ্বরী দেবী, আলি আকবর খান, বড়ে গুলাম আলি খাঁ, আলাউদ্দীন খাঁ, রামকিঙ্কর বেইজ– আর সেসবের মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করছে শর্বরীদা। অনেক সময় যাঁদের ভাস্কর্য দেখছি, তাঁদেরই গান শুনছি। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন, যাঁদের নাম করলাম, অধিকাংশই গানের লোক। শর্বরীকাকার বিপুল মাপের মিউজিক কালেকশন ছিল। খুব যত্নে রাখত সেইসব। গানের লোকজন বাদ দিয়ে ওঁর একটা প্রিয় ভাস্কর্য ছিল কিঙ্করদারই। কলাভবনে ওঁদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাছাড়া দু’জনেই তো ভাস্কর্যেরই লোক।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সিনেমাটোগ্রাফার অভীক মুখোপাধ্যায়-সহ গোটা চারজন মিলে হাজির হলাম শর্বরীকাকার কাছে। শুট করলাম। এখানে যেটা বলে নেওয়া দরকার, শর্বরীকাকা ভারী গলায় খুব আস্তে কথা বলত। তা সত্ত্বেও, সেই তথ্যচিত্রে শর্বরীকাকাকে দিয়েই কথা বলিয়েছিলাম। নিজের ছোটবেলা, কাজ, শান্তিনিকেতন– নানা বিষয়ে কথা বলেছিল। কয়েক দিন পর এডিট করে তথ্যচিত্রটা পাঠিয়ে দিলাম দিল্লিতে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
প্রথম প্রথম শান্তিনিকেতন গেলে শর্বরীকাকার কাছেই থাকতাম। পরে রঞ্জাবতীদের বাড়িতে। একদিন রঞ্জাদের বাড়িতে ভরা আড্ডা। আমি, সাম্যন্তক, রঞ্জা, ঝুমা বসাক, মৈনাক বিশ্বাস। সেসময় শর্বরীকাকা আমাদের আমন্ত্রণ জানাল পরের দিন যেন অবশ্যই স্টুডিওতে যাই। কথামতো, হাজির হলাম সক্কলে। ওর ছেলে সরোদ বাজাত। শর্বরীকাকার স্টুডিওতেই বাজাল সে। চারিদিকে ভাস্কর্য, ছবি, তার মধ্যেই সরোদ– এমনটা সচরাচর ঘটে না।
বেশ কিছুকাল পর আমার কাছে দূরদর্শন থেকে একটা প্রস্তাব এল তথ্যচিত্র করার। বিষয়: বাংলার শিল্পী। এহেন প্রস্তাব পেয়ে দু’জনের কথা ভাবলাম। একজন যোগেন চৌধুরী, আরেকজন শর্বরী রায়চৌধুরী।
সিনেমাটোগ্রাফার অভীক মুখোপাধ্যায়-সহ গোটা চারজন মিলে হাজির হলাম শর্বরীকাকার কাছে। শুট করলাম। এখানে যেটা বলে নেওয়া দরকার, শর্বরীকাকা ভারী গলায় খুব আস্তে কথা বলত। তা সত্ত্বেও, সেই তথ্যচিত্রে শর্বরীকাকাকে দিয়েই কথা বলিয়েছিলাম। নিজের ছোটবেলা, কাজ, শান্তিনিকেতন– নানা বিষয়ে কথা বলেছিল। কয়েক দিন পর এডিট করে তথ্যচিত্রটা পাঠিয়ে দিলাম দিল্লিতে।
তখন দূরদর্শনে একটু রাতের দিকেই তথ্যচিত্র দেখানো হত। কয়েক দিন পর দেখানো হল শর্বরীকাকার ওপর তথ্যচিত্রটাও।
দু’চারদিন পরে বাড়ির ফোন বেজে ওঠে, ল্যান্ডলাইন।
হ্যালো– হ্যালো–
ওপাশ থেকে কোনও আওয়াজ আসে না।
তারপর জলদগম্ভীর এক চেনা গলা: তুমি, কি, জিৎ? (হে পাঠক, শর্বরীকাকা এভাবেই, এত ধীরেই কথা বলতেন যে অতিরিক্ত যতিচিহ্ন দরকার পড়ল)
–হ্যাঁ।
–তোমার, ছবিটা তো, খুব ভালো, হয়েছে।
–টেলিভিশনের পর্দায় ৩০ মিনিটের তথ্যচিত্রে নিজেকে ২০ মিনিট ধরে দেখলে, ভালো তো লাগবেই!
–না, ছবিটা, সত্যিই, খুব ভালো।
–এই যে দ্বিতীয়বার তুমি বললে, খুব ভালো, কীসের ভিত্তিতে বলছ বলো তো?
–না, আসলে, নিন্দুকেরাও, খুব প্রশংসা, করছে।
ফতুয়া-পায়জামা। ভারী শরীর। লম্বা দাড়ি। ভারী গলা। ভাস্কর্যের লোক। কিন্তু এইটুকুতেই শর্বরী রায়চৌধুরীকে চেনা ফুরিয়ে যায় না। লম্বা দাড়িতে, শর্বরীকাকা প্রায়শই গুঁজে রাখত দুটো ছোট ফুল। কলাভবনের ক্লাস হোক, বাড়িতে হোক, লম্বা দাড়িতে সেই ফুল আলগোছে লেগে থাকত। প্রথম প্রথম সাইকেল চড়ে ঘুরে বেড়াত শান্তিনিকেতন। পরবর্তীকালে, বিশেষ করে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রিকশার প্রতি টান বেড়ে যায় ওর। তবে, শুধু রিকশা চড়ার প্রতি না। রিকশা চালানোর প্রতিও।
ভাবুন একবার। শান্তিনিকেতনের রাস্তা। কলাভবনের শিক্ষক। ফতুয়া-পায়জামা, দাড়িতে দুটো ফুল। রিকশা চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। রিকশার পিছনে যাত্রীর সিটে হয়তো বসে আছে এক হতভম্ব রিকশাচালক।
…ফ্রেমকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৮। পুরনো বইয়ের খোঁজে গোয়েন্দা হয়ে উঠেছিলেন ইন্দ্রনাথ মজুমদার
পর্ব ৭। কলকাতার জন্মদিনে উত্তম-সুচিত্রার ছবি আঁকতে দেখেছি মকবুলকে
পর্ব ৬। বিয়ের দিন রঞ্জা আর স্যমন্তককে দেখে মনে হচ্ছিল উনিশ শতকের পেইন্টিং করা পোর্ট্রেট
পর্ব ৫। আলো ক্রমে আসিতেছে ও আমার ছবি তোলার শুরু
পর্ব ৪। মুম্বইয়ের অলৌকিক ভোর ও সাদাটে শার্ট পরা হুমা কুরেশির বন্ধুত্ব
পর্ব ৩। রণেন আয়ন দত্তর বাড়ি থেকে রাত দুটোয় ছবি নিয়ে বেপাত্তা হয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী
পর্ব ২। ইশকুল পার হইনি, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত একটা ছোট্ট রামের পেগ তুলে দিয়েছিল হাতে
পর্ব ১। ঋতুর ভেতর সবসময় একজন শিল্প-নির্দেশক সজাগ ছিল