একটা সময় ছিল যখন শিল্পীদেরকে মনে করা হত ‘বুদ্ধিজীবী’দের অংশ। এখনও তো ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটাকে ঠিক সেই উচ্চতায় সাধারণ মানুষ দেখেন না। তা সত্ত্বেও এই প্রত্যাশা সাধারণের রয়েছে যে, প্রতিবাদ করলে বুদ্ধিজীবীরাই করবেন, তাঁরা নন। আবার ঠিক কী কী বিষয়ে প্রতিবাদ, সেটাও তাঁরা ঠিক করে দিতে চান। স্বেচ্ছায় প্রতিবাদ করার যে প্রথা, তা বোধহয় লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। নানা বিষয়েই তো রাগ হয়, ঘেন্না হয়, বিরক্ত হই। প্রত্যেকটা জিনিস নিয়ে যদি কথা বলতেই থাকি নিরন্তর, তাহলে আমার শিল্পের কী হবে?
৮.
আমি ইদানিং দেখছি, কথা না বলতে বলতে কথা না-বলারই অভ্যেস হয়ে উঠছে। প্রতিবাদ করা আমার কাজ নয়। কিন্তু কথা না বলতে বলতে একজনের স্বভাব মিনমিনে, মুখবোজা হয়ে যেতে পারে। আমি সেই স্বভাবের নই। ফলে কথা আমি বলবই। সহজ করে কথা বলার অভ্যেস আমাদের নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমাদের মুখ ভোঁতা হয়ে গিয়েছে কবেই। সত্যিই কি তাই? সকলের? নিশ্চয়ই নয়।
শিল্পীরা প্রতিবাদ করবে, এটা সাধারণত মানুষ ভেবেই নেন। কেন ভাবেন? একটা সময় ছিল যখন শিল্পীদের মনে করা হত ‘বুদ্ধিজীবী’দের অংশ। এখনও তো ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটাকে ঠিক সেই উচ্চতায় সাধারণ মানুষ দেখেন না। তা সত্ত্বেও এই প্রত্যাশা সাধারণের রয়েছে যে, প্রতিবাদ করলে বুদ্ধিজীবীরাই করবেন, তাঁরা নন। আবার ঠিক কী কী বিষয়ে প্রতিবাদ, সেটাও তাঁরা ঠিক করে দিতে চান। স্বেচ্ছায় প্রতিবাদ করার যে প্রথা, তা বোধহয় লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। নানা বিষয়েই তো রাগ হয়, ঘেন্না হয়, বিরক্ত হই। প্রত্যেকটা জিনিস নিয়ে যদি কথা বলতেই থাকি নিরন্তর, তাহলে আমার শিল্পের কী হবে? প্রতিবাদ করেছি কি করিনি, সে তো আমার শিল্প জানে। সাধারণকে আসতে হবে আমার শিল্পের কাছে। একজন শিল্পী সবসময় লিখিতভাবে, মুখের অনর্গলতায়, টিভি ক্যামেরায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ করবেন, এমনটা ধরে নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া এসে যাওয়ার পর এই স্রোতে গা ভাসিয়েছেন অনেকেই। শিল্পীরা নাকি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করবে, কেন করবে? কবি, শিল্পী, গদ্যলিখিয়ে, বুদ্ধিজীবীদের কাজ সমাজ পরিবর্তন করা নয়, সে কাজ রাজনীতিবিদদের, রাষ্ট্রনেতাদের। আর রাষ্ট্রনেতাদের চিন্তাচেতনায় আঘাত হানবে এই কবি, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা। ঋত্বিক ঘটক তাঁর ‘কালচারাল ফ্রন্ট’-এ বারবার করে শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের কী কী করণীয়, তা পরীক্ষামূলকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে বলেছিলেন।
কিন্তু, শিল্পীদের থেকে কোনও সামাজিক সমস্যার সমাধান কি চেয়েছে কেউ? খবরের কাগজে যাঁরা এতকাল ধরে ‘কোট’ হয়ে এসেছেন, বক্তব্য রেখেছেন, তাঁরা কবি, প্রাবন্ধিক, রাজনীতিবিদ, নাট্যকার– এই সমস্ত মানুষ। শিল্পীদের কাছে বক্তব্য কি তাই বলে একেবারেই চাওয়া হয়নি? হয়েছে। কিন্তু তা অতি নগণ্য। অশোক মিত্রর কথা মনে করুন। যিনি আমাদের ভারতীয় কিংবা পাশ্চাত্য চিত্রকলার সঙ্গে আলাপ করে দিয়েছিলেন। আমাদের তৈরি করেছে তাঁর বই। ছেলেবেলায় সেইসব বই পড়েই তো ছবির ইতিহাস জানতে পেরেছি। চিনতে পেরেছি ইতিহাসের পথগুলো, বাঁকগুলো। আজকে কি আমরা এভাবে তৈরি হতে চাই? সেই পথ যা তৈরি করে দিয়েছিলেন অশোক মিত্র, সেই পথ অতি সন্তর্পণে নীরবে মুছে দিল কে? আমাদের আজ শিল্প চিনিয়ে দেবেন সাধারণের মতো করে, এরকম মানুষের সংখ্যা ক’জন?
শিল্প-সাহিত্য চিরকালই আনঅরগানাইজ সেক্টর। তাই বলে, যে শুধু কবিতা লিখে, প্রবন্ধ লিখে, গল্প-উপন্যাস লিখে, ছবি এঁকে জীবন কাটাতে চায়– সে পারবে না কেন? এটা তার বেঁচে থাকার অধিকারের মধ্যে পড়ে না? দুর্গাপুজো শিল্প নিয়ে দুটো পর্বে বিস্তারিত লিখেছি। কেউ কেউ হয়তো আপত্তি তুলবেন সেইসব লেখা পড়ে যে, এগুলো কীরকম শিল্প? খুব উচ্চমানের শিল্প কি? আমি এর উত্তর দেব না। আমি থিওরিস্ট নই। আমি গবেষকও নই। আমি শুধু জানি, শিল্পের জন্য বেঁচে থাকতে গেলে এই প্ল্যাটফর্মটা রয়েছে। যেখানে টাকা আছে, যেখানে আরও অনেক মানুষকে সঙ্গে পাব। এরপর কেমন হল, ১০-এ ২ দেওয়া হল না ১০-এ ১১– তাতে আমার কোনও হাত নেই। যাঁরা নিজের মতো করে শিল্পকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছে, আমি তাদের জন্য একটা পথ দেখাতে পেরেছি। এবার সেই পথে নানা শিল্পী হেঁটে যেতে পারেন। তৈরি করতে পারেন তাঁদের ঘরানা, নিজস্ব পথ। নানারকম পথ হলেই ভালো। তবে সব পথই সেই শিল্পের দরজা অবধি যেন যায়, এইটুকুই আমার চাওয়া।
খোলা আকাশের নীচে মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আমরা ক’জন তো গড়ে তুলতে পারলাম। যেখানে তথাকথিত শিক্ষিত-অশিক্ষিত সমস্ত মানুষ কাজ পায়, পয়সা পায়। যে শিল্প মাধ্যম মানুষের অন্নসংস্থান গড়ে দেয়, তাকেই আমি বলব শিল্প। যে শিল্প সসম্মানে বেঁচেবর্তে থাকার সন্ধান জোগায়, তাকেই আমি দুর্গাপুজো শিল্প বা ‘অন্নপূর্ণা শিল্প’ নামে উদযাপন করব।
(চলবে)
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ৭: ক্যালেন্ডারের দেবদেবীর হুবহু নকল আমি করতে চাইনি কখনও
পর্ব ৬: সাধারণ মানুষকে অগ্রাহ্য করে শিল্প হয় না
পর্ব ৫: দেওয়ালে যামিনী রায়ের ছবি টাঙালে শিল্পের উন্নতি হয় না
পর্ব ৪: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না
পর্ব ৩: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
পর্ব ২: আমার শরীরে যেদিন নক্ষত্র এসে পড়েছিল
পর্ব ১: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত
অডিটোরিয়াম থেকে ব্যাক স্টেজে আসার যে দরজা সেটা দিয়ে উঠে আসছিল খুব রোগা মতো একটি ছেলে, গায়ের রংটা শ্যামলা, তাকে দেখে বলি, ‘একটু দেখবেন ভাই, অডিটোরিয়াম এ সামনের রো-তে রশিদ খান বলে কেউ আছেন কিনা’, সে শুধু বলল, ‘জি’, আবারও বলি, ‘প্লিজ একটু দেখবেন’, আমি তখনও তাঁকে ভাবছি ‘usher’ জাতীয় কেউ। এবার সে একটু ইতস্তত করে নম্রভঙ্গীতে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘জি, ম্যায় হুঁ’।