নির্বাচনী ক্ষেত্রে যখন আরও স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে লড়াই চলছে, তখনই সুপ্রিম কোর্ট সম্পূর্ণ উল্টো পথে হাঁটল! একটি সাম্প্রতিক রায়ে তারা জানিয়েছে, প্রার্থীদেরও রয়েছে গোপনীয়তার অধিকার! তাদের প্রতিটি অস্থাবর সম্পত্তির হিসেব দিতে হবে, তেমনটা মোটেও নয়। কোনও ব্যক্তির সম্পত্তি সংক্রান্ত ‘সব কিছু’ জানার অধিকার নেই ভোটারদের!
অনেক কিছুই আমাদের জানতে ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে– ‘তুমি কি সেই আগের মতোই আছো নাকি অনেকখানি বদলে গেছ…’।
বিশেষ করে, এই ভোট বাজারে। যাঁকে ভোট দিয়ে জিতিয়ে বিধানসভা বা লোকসভায় জনতা পাঠিয়েছিল, পাঁচ বছর পর তাঁর হাল-হকিকত, কতটা ভোলবদল হয়েছে, সেটা জানা ভোটারদের দায়িত্ব, অধিকার। আর সে-কারণেই বিদায়ী বিধায়ক বা সাংসদের কাজের খতিয়ান নিয়ে ভোটারের দরজায় কড়া নাড়েন রাজনৈতিক দলগুলির কর্মীরা। থাকে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি-প্রতিশ্রুতির নানা বিবরণ।
ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত, পুরসভা থেকে লোকসভা পর্যন্ত সমস্ত নির্বাচনেই প্রার্থীদের সম্পত্তির বিবরণ, তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ফৌজদারি মামলার তথ্য প্রকাশ্যে আনার ব্যবস্থা রয়েছে। নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের বিবরণ প্রকাশ করে। যা থাকে পাবলিক ডোমেনে। যে কেউ ইচ্ছে করলেই সেই তথ্য দেখতে পারেন, প্রয়োজনে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। যদিও এই তথ্য নিয়ে আদৌ কতজনের মাথাব্যথা রয়েছে বা কোনও চতুর্বর্গ লাভ হয় কি না, জানা নেই। যেমন ফৌজদারি মামলার তথ্য। কমবেশি সমস্ত রাজনৈতিক দলই বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্তদের প্রার্থী করে। হতে পারে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেই মামলা হয়তো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের হয়েছে। কিন্তু তার বাইরেও খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, মহিলাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের মতো গুরুতর অভিযোগও থাকে। তারপরেও হইহই করে তাঁরা জিতে যান!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জীবনযাপন আগের চেয়ে অনেক বদলে গিয়েছে। যার ভাঙা ঘরে টালির চালের ফুটো দিয়ে জল ঢুকত, তিনি তিন মহলা অট্টালিকা হাঁকাচ্ছেন। ভাঙা সাইকেল, লড়ঝড়ে মোটরবাইকে সওয়ার থাকা কোনও নেতার গ্যারেজে ঢুকে পড়ছে দামি এসইউভি। পরিস্থিতি এমনই যে, কোনও জাদুবলে সাংসদ-বিধায়কদের সম্পদ বহু গুণ বেড়ে যায়, সেই রহস্য উন্মোচন করতে ২০১৫ সালে উদ্যোগী হয়েছিল খোদ সুপ্রিম কোর্ট।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
গত লোকসভা নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীদের হলফনামা যাচাই করে ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস’ (এডিআর) জানিয়েছে, বর্তমান সাংসদদের ৪৪ শতাংশের বিরুদ্ধে রয়েছে ফৌজদারি মামলা। তার মধ্যে ২৯ শতাংশের বিরুদ্ধে রয়েছে গুরুতর অভিযোগ। অভিযুক্ত সাংসদদের ৫০ শতাংশের বেশি আবার বিজেপির।
বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জীবনযাপন আগের চেয়ে অনেক বদলে গিয়েছে। যার ভাঙা ঘরে টালির চালের ফুটো দিয়ে জল ঢুকত, তিনি তিন মহলা অট্টালিকা হাঁকাচ্ছেন। ভাঙা সাইকেল, লড়ঝড়ে মোটরবাইকে সওয়ার থাকা কোনও নেতার গ্যারেজে ঢুকে পড়ছে দামি এসইউভি। পরিস্থিতি এমনই যে, কোনও জাদুবলে সাংসদ-বিধায়কদের সম্পদ বহু গুণ বেড়ে যায়, সেই রহস্য উন্মোচন করতে ২০১৫ সালে উদ্যোগী হয়েছিল খোদ সুপ্রিম কোর্ট। ‘লোকপ্রহরী’ নামে লখনউয়ের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আবেদনের ভিত্তিতে ‘সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস’ জানিয়েছিল, অন্তত সাতজন লোকসভার সাংসদ এবং ১১ জন রাজ্যসভার সাংসদের আয়ের সঙ্গে সম্পত্তির কোনও সঙ্গতি নেই। দেশে তেমন বিধায়কের সংখ্যা ২৫৭। ব্যস, এ পর্যন্তই। তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপের খবর নেই। শীর্ষ আদালতের আক্ষেপ, সরকারই এ-বিষয়ে তদন্তে খুব একটা ‘উৎসাহী’ নয়। লোকপ্রহরী আবেদন করেছিল, হলফনামায় প্রার্থীদের আয়ের উৎস জানানো বাধ্যতামূলক করা হোক। তার ভিত্তিতেই সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালে রায় দেয়, প্রার্থীদের স্বামী-স্ত্রী এবং নির্ভরশীলদের আয়ের উৎস প্রকাশ করতে হবে। আয়ের উৎস-সহ প্রার্থীদের সম্পর্কে সমস্ত প্রাসঙ্গিক তথ্য জানার মৌলিক অধিকার রয়েছে ভোটারদের।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ভোট থেকে পুরাণ, বিষয়বৈচিত্রে ভরপুর হলেও বোলান আজ মলিন
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কিমাশ্চর্যম! নির্বাচনী ক্ষেত্রে যখন আরও স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে লড়াই চলছে, তখনই সুপ্রিম কোর্ট সম্পূর্ণ উল্টো পথে হাঁটল! একটি সাম্প্রতিক রায়ে তারা জানিয়েছে, প্রার্থীদেরও রয়েছে গোপনীয়তার অধিকার! তাদের প্রতিটি অস্থাবর সম্পত্তির হিসেব দিতে হবে, তেমনটা মোটেও নয়। কোনও ব্যক্তির সম্পত্তি সংক্রান্ত ‘সব কিছু’ জানার অধিকার নেই ভোটারদের! দুই বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, কোনও প্রার্থীর বিলাসবহুল জীবনযাপনের লক্ষণ দেখা গেলে তবেই সমস্ত সম্পত্তির হিসেব দেওয়ার প্রশ্ন উঠতে পারে।
কী করে মানুষ বুঝবে, তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির জীবনযাত্রার ভোলপাল্টে গিয়েছে? হাতের ঘড়িটা ব্র্যান্ডেড কি না, তার দাম লাখে না কোটিতে, কীভাবে জানা যাবে? পোশাকের আড়ালে থাকা সোনার চেন কত ভরির, সেটাই বা কীভাবে বুঝবে? সাদা পথে আয় এবং বিনিয়োগ তো হলফনামায় স্পষ্ট। কিন্তু কালো টাকার সম্পদ বিদেশের কোন ব্যাঙ্কে গচ্ছিত আছে, কোন ভুয়া সংস্থায় তিনি বা তাঁর নিকটাত্মীয় বিনিয়োগ করেছেন, সে তথ্য মিলবে কীভাবে?
দুর্নীতির অভিযোগ এ দেশের রাজনীতিতে নতুন নয়। প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেনন লন্ডনে ভারতের রাষ্ট্রদূত থাকার সময় তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম জিপ কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে। সেটা ১৯৪৮ সাল। কাট টু ২০২৪। এখনও সেই ট্র্যাডিশন চলছে। ‘বিকশিত ভারত’-এ দুর্নীতির শতদল সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সহস্রদলে পরিণত হতে পারে, এমন আশঙ্কা কিন্তু অমূলক নয়।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved