ডার্বি ম্যাচের আগেরদিন সকালে টুটু বোস বরাবর একটা অদ্ভুত জিনিস করতেন। ক্লাব থেকে হয়তো বের হতে যাব, টুটু’দা ক্লাবের একদিকে আমাকে ডেকে নিয়ে যেতেন। তারপর নিজের কপালটা আমার কপালে ঘষে দিতেন। হয়তো নিজের কপালের ওপর ওঁর অগাধ আস্থা ছিল। সেই বিশ্বাস থেকেই হয়তো নিজের কপালটা আমার কপালে ঘষে দিতেন।
১১.
ডার্বি ম্যাচের দিনও সকালে নিয়ম করে বাইবেল পড়তাম। এটা আমার বরাবরের অভ্যাস।
জানি না, ডার্বি নিয়ে এখনও একইরকমভাবে সমর্থকরা উত্তেজিত হন কি না, তবে কলকাতার দুই ক্লাবে কর্পোরেট আবহ চলে আসার পর ডার্বি ঘিরে ক্লাবকর্তাদের ব্যস্ততা একটু কমেছে, তা বলাই যায়। আমাদের সময়ে ডার্বি নিয়ে সমর্থক, কর্মকর্তাদের মধ্যে কী হত, তা শুধু আমরাই জানি।
ধরুন, কাল ম্যাচ। আজকে প্র্যাকটিস করে উঠেছি। মাঠ থেকে টেন্টের ভিতরে যেতে পারতাম না। সমর্থকরা ঘিরে ধরত। ম্যাচ জেতানোর দাবিতে এমনভাবে ভালবাসার অত্যাচার করত, মনে হত দমবন্ধ হয়ে মারা যাব বোধহয়। ডার্বির আগের দিন টেন্ট থেকে বের হতে পারতাম না। গাড়ির সামনে শুয়ে পড়তেন সমর্থকরা। ডার্বি ম্যাচের ১০ দিন আগে থেকে শুধু একটাই দাবি কানে ভাসত, ‘ইস্টবেঙ্গলকে হারাতে হবে’। মাঠে, টেন্টে, শপিং-মলে যেখানে যেতাম, এই এককথাই শুনতে পেতাম।
কখনও সমর্থকদের আবদার রাখতে পেরেছি, কখনও পারিনি। কিন্তু ডার্বি ম্যাচের দিন আলাদা কিছু যেন আমাকে ভর করত। আর দেখতাম ভারতীয় ফুটবলে আমার অন্যতম প্রিয় বন্ধু বাইচুংকেও। ডার্বি ম্যাচে যেন কীরকম বদলে যেত ও। পরে বাইচুংকে নিয়ে আলাদা একদিন লিখব ঠিক করেছি। আজ ডার্বি ঘিরে অন্য একটা গল্প বলছি।
ডার্বি ম্যাচের আগেরদিন আমরা যখন প্র্যাকটিস করতাম, মাঠের পাশে মোহনবাগানের বড় বড় ছাতা লাগানো থাকত। আর তার নীচে বসে থাকতেন টুটু’দা, অঞ্জন’দা, টুম্পাই, দেবাশিসরা। মোহনবাগানে একটা জিনিস বড় ভালো ছিল। কর্তারা কখনও আমাদের ড্রেসিংরুমে ঢুকতেন না। সবাই টেন্টের ভিতর গোল টেবিলের সামনে থাকতেন। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার থাকলে কোচের সঙ্গে কথা বলে ড্রেসিংরুমে এসে তাঁদের বক্তব্য রাখতেন কর্তারা। তবে ডার্বি ম্যাচের আগেরদিন সকালে টুটু বোস বরাবর একটা অদ্ভুত জিনিস করতেন। ক্লাব থেকে হয়তো বের হতে যাব, টুটু’দা ক্লাবের একদিকে আমাকে ডেকে নিয়ে যেতেন। তারপর নিজের কপালটা আমার কপালে ঘষে দিতেন। হয়তো নিজের কপালের ওপর ওঁর অগাধ আস্থা ছিল। সেই বিশ্বাস থেকেই হয়তো নিজের কপালটা আমার কপালে ঘষে দিতেন। সেবারও সেরকমই করেছিলেন। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম, সেদিন কোনও কপালই আমাকে বাঁচাতে পারবে না!
আসলে সেবার কোনও একটা কারণে ব্রাজিল থেকে কলকাতায় আসতে ভীষণ দেরি করে ফেলেছিলাম। সম্ভবত পারিবারিক কোনও সমস্যায় ব্রাজিলে আটকে গিয়েছিলাম। এদিকে, মরশুমের শুরুতেই কলকাতার লিগের ডার্বি। আমি যেদিন কলকাতায় এলাম, তার দু’দিন পরেই কলকাতায় বড়ম্যাচ। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, ৯০ মিনিট খেলার জায়গায় আমি নেই! যে বছরের কলকাতা ডার্বির কথা বলছি, সেবার সুভাষ ভৌমিকের কোচিংয়ে বাইচুংরা হায়াত রিজেন্সি হোটেলে থেকে আশিয়ান কাপের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
ডার্বির আগের দিন প্র্যাকটিসে এলাম। তখন আর বৈশাখীতে থাকি না, সল্টলেকের একটা ফ্ল্যাটে চলে এসেছি। সেখান থেকেই ক্লাবে এলাম। তবে প্র্যাকটিসের কোনও কিট নিয়েই সেদিন ক্লাবে আসিনি। একদিন পরেই ডার্বি। অথচ দলের সঙ্গে কোনওরকম প্রি-সিজন করিনি। কোমরের ওপর সামান্য চর্বিও বেড়েছে। ঠিক করলাম, ক্লাবে গিয়ে বলব, কালকের ডার্বি আমার পক্ষে খেলা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় আমাকে না খেলিয়ে কোনও ফিট প্লেয়ারকে মাঠে নামাতে। কারণ, আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম, সামান্যতম খেলার জায়গায় নেই আমি। ডার্বি খেলব না, ঠিক করেই ফেলেছিলাম। কর্তাদের তা বলব ভেবেই ডার্বির আগের দিন ক্লাব গেলাম।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ডার্বি ম্যাচের আগেরদিন আমরা যখন প্র্যাকটিস করতাম, মাঠের পাশে মোহনবাগানের বড় বড় ছাতা লাগানো থাকত। আর তার নীচে বসে থাকতেন টুটু’দা, অঞ্জন’দা, টুম্পাই, দেবাশিসরা। মোহনবাগানে একটা জিনিস বড় ভালো ছিল। কর্তারা কখনও আমাদের ড্রেসিংরুমে ঢুকতেন না। সবাই টেন্টের ভিতর গোল টেবিলের সামনে থাকতেন। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার থাকলে কোচের সঙ্গে কথা বলে ড্রেসিংরুমে এসে তাঁদের বক্তব্য রাখতেন কর্তারা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মরশুমের প্রথম ডার্বি সেবার। স্বভাবতই সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে। ব্রাজিল থেকে আমি চলে আসায় সমর্থকরা আরও উজ্জীবিত। সকালে ক্লাবে ঢোকার মুখেই সমর্থকরা ঘিরে ধরল। ভাবল, ডার্বির আগেই যখন চলে এসেছি, তখন আর চিন্তা নেই। কিন্তু আমি তো জানি আমার কী অবস্থা। সত্যি কথা বলতে, মরশুম শেষে যখন ব্রাজিল গিয়েছিলাম, তখন খেলার বুটটা ঠিক কোথায় রেখে গিয়েছিলাম মনে নেই। কারণ, দেশে ফেরার ঠিক একদিন আগেই এই নতুন ফ্ল্যাটে উঠে এসেছিলাম। ফলে খেলার বুটটা আগের বাড়িতেই রয়েছে না নতুন ফ্ল্যাটে সেটাও ঠিক মনে নেই। যাই হোক, ক্লাব পৌঁছলে যেভাবে সমর্থকরা আমাকে ঘিরে ধরল, তাতে বুঝতেই পারলাম, ওরা ধরে নিয়েছে আমি খেলছি। আর সমর্থকদের ওরকম ভালবাসা দেখে আমারও যে খেলার ইচ্ছে হচ্ছিল না, তা নয়। তবে আমি নিজেই সবচেয়ে ভালো জানতাম, আমার নিজের কী অবস্থা!
ক্লাবের ভেতর ঢোকামাত্রই টুটু’দা স্বভাবসিদ্ধভাবে নিজের কপালটা আমার কপালে ঘষে দিয়ে বললেন, ‘ডার্বিতে গোল করে ইস্টবেঙ্গলকে হারাতেই হবে।’ আমি তখন বোঝানোর চেষ্টা করছি, খেলার মতো জায়গায় নেই আমি। কিন্তু টুটু বোসকে বোঝায় কার সাধ্যি? আমি কলকাতায় আছি। চোট নেই। কিন্তু ডার্বিতে মাঠের বাইরে বসে থাকব, কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না টুটু’দা। বোঝালাম, ম্যাচ খেলার মতো ফিট নই আমি। টুটুদা পাল্টা যুক্তি দিল, ‘আমি মাঠে থাকলেই প্রতিপক্ষ অর্থাৎ ইস্টবেঙ্গল চাপে থাকবে। বিপক্ষের ডিফেন্স নিশ্চিন্তে খেলতে পারবে না। তাই আমাকে খেলতেই হবে।’ একদিকে টুটু’দা-সহ কর্তারা, অন্যদিকে সমর্থকরা। টুটু’দার কথা শেষমেশ ফেলা গেল না। ডার্বি খেলার জন্য শেষপর্যন্ত রাজি হতেই হল।
কিন্তু খেলব কোন বুটে? আমার সঙ্গী তখন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর ক্রীড়া সাংবাদিক দুলাল দে। ওকে আমার সঙ্গে নতুন ফ্ল্যাটে নিয়ে যাব বললাম। ঠিক করলাম, সল্টলেকের ফ্ল্যাটে গিয়ে বুটজোড়া খুঁজতে হবে। আর না পেলে অ্যাডিডাসের শোরুমে গিয়ে খেলার বুট কিনব। আমার তখন কোয়ালিস গাড়ি ছিল। দুলালকে নিয়ে হায়াতের পাশ থেকে যাওয়ার সময় ওর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বলল, হায়াতেই রয়েছে বাইচুং. ডগলাসরা। ও চাইছে, ডার্বির ম্যাচের আগের দিন ব্যারেটো ইস্টবেঙ্গল শিবিরে পা রাখুক। একটা ছবি এবং খবর– ব্যস, এইটুকু ও চায়।
কী আর করা যাবে। আমিও সেভাবে খেলার মুডে ছিলাম না। তারপর দুলাল অনুরোধ করতে আর না করতে পারিনি। ওই তাড়াতাড়ি বাইচুংকে ফোনে খবরটা দিল, আমি হায়াতে ঢুকছি। তাড়াতাড়ি নিজেদের ফটোগ্রাফারকেও ডেকে আনল। আমি হায়াতে এসেছি শুনে বাইচুং, ডগলাস, মুসা, আলভিটোরা চলে এল সুইমিং পুল সাইডে। ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর ফটোগ্রাফারও এল। ছবি উঠল। সত্যিসত্যিই ডার্বির আগের দিন ইস্টবেঙ্গল শিবিরে বাইচুং, ডগলাস, আলভিটোদের সঙ্গে আড্ডায় বসে গেলাম।
এখনকার দিনে এরকম একটা ঘটনা কল্পনা করতে পারেন ? ডার্বির আগের দিন সকালে দিমিত্রি ইস্টবেঙ্গল টিম হোটেলে গিয়ে ফুটবলারদের সঙ্গে গল্প করছে? আসলে আমাদের সময়ে পরিস্থিতি, সম্পর্কগুলোই ছিল অন্যরকম।
পরের দিন বড়ম্যাচে মাঠে নামলাম। কিন্তু সেভাবে খেলতে পারলাম না। কারণ, মারাত্মক আনফিট ছিলাম। বাইচুং একাই শেষ করে দিয়েছিল ম্যাচটা।
(চলবে)
অনুলিখন: দুলাল দে
…তোতাকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১০। ইংরেজি শেখাতে বাড়িতে আসতেন এক মোহনবাগান সমর্থক
পর্ব ৯। বারপুজোয় সমর্থকদের ভালোবাসার হাত থেকে বাঁচতে দৌড় লাগিয়েছিলাম টেন্টের দিকে
পর্ব ৮। মাঠে তো বটেই, ইয়াকুবু বাথরুমে গেলেও ফলো করবে স্যালিউ
পর্ব ৭। আর একটুর জন্য হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল জাতীয় লিগ জয়
পর্ব ৬। জাতীয় লিগের প্রথম ম্যাচেই বেঞ্চে বসে রইলাম
পর্ব ৫। আশিয়ানের আগে সুভাষ ভৌমিক প্রায়ই ফোন করত আমাকে, বোঝাত ইস্টবেঙ্গলে সই করার জন্য
পর্ব ৪। আর একটু হলেই সই করে ফেলছিলাম ইস্টবেঙ্গলে!
পর্ব ৩। মোহনবাগানের ট্রায়ালে সুব্রত আমায় রাখত দ্বিতীয় দলে
পর্ব ২। কলকাতায় গিয়েই খেলব ভেবেছিলাম, মোহনবাগানে ট্রায়াল দিতে হবে ভাবিনি
পর্ব ১। ম্যাচের আগে নাইটপার্টি করায় আমাকে আর ডগলাসকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ক্লাব
জীবনের বাকি শাখা-প্রশাখা থেকে বাদুড়ের মতো ঝুলতে দেখা যায়, ‘অকৃতজ্ঞ’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘তঞ্চক’ নামের নানা কুটিল শব্দবন্ধকে। যারা উদর নয়, হৃদয়কে তাক করে। বারবার। যন্ত্রণার ক্ষেপণাস্ত্র চালিয়ে বুকের বাঁ দিকটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে থাকে সুযোগ পেলে।