ছাদ ফাঁকা ক্যানভাসের মতো। যে আসছে, তার মনের রং ছাদের জগৎ তৈরি করে। কারও জন্য গরমের সন্ধ্যাবিলাস, বর্ষার বৃষ্টিবন, শরতে জ্যোৎস্না দেখার মানমন্দির, হেমন্তে আকাশপিদিম দেওয়ার কোণ, শীতে রোদ পোহানোর অজুহাত, বসন্তে মনকেমনের একান্তবাস। কেজো মানুষের কাছে সব ঋতুতেই দশ পাক হাঁটা, কাপড় মেলা, বড়ি দেওয়া, কুকুর হাঁটানো, পাখি খাওয়ানো, গাছে জল দেওয়া, গরমে জল ছিটিয়ে নীচের ঘর শীতল করার জায়গা। বালকের ঘুড়ি আর কিশোরের কল্পনা এখানে ডানা মেলে, তরুণের প্রেম হাওয়ায় উড়ে যায় আর এক ছাদের দিকে, যৌবনে মনের কথা ভাগ হয়, বয়সকালে শান্তির খোঁজ চলে।
ছাদ এক অমোঘ অবস্থিতি। একতলা বাড়ি হোক বা বহুতল, ছাদ থাকে পায়ের তলার জমির সমান্তরাল হয়ে। ছাদে দাঁড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে বহুদূর দেখে ফেলা যায়। ছাদের ক্ষেত্রফলের সঙ্গে সুখের বিশেষ সম্পর্ক নেই। একফালি হোক বা একপৃথিবী– ছাদ তার মালিকের আদরের। অতিথির প্রিয় হওয়ার জন্য কেউ তাকে সুদৃশ্য টালিতে মুড়ে দেয়, কেউ বাগান করে। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ডাংকি’ সিনেমায় দেখেছি ছাদে এরোপ্লেন বানানো মানে সে বাড়ির সন্তান বিদেশ গিয়েছে। তেমন অর্থবহ না হলেও ছাদে ফুটবল, মন্দির, জাহাজ প্রভৃতি বসান অনেকেই। কোথাও চিলেকোঠা থাকে, কোথাও এমনিই সিঁড়িঘরের লাগোয়া কার্নিশ লম্বায় বেড়ে ছায়ায় ঢেকে রাখে কিছুটা।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন অরুণোদয়-এর লেখা: সত্যজিৎ-ঘনিষ্ঠ প্রমাণের জন্য ঘন ঘন ‘মানিকদা’ ব্যবহার করুন
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ছাদের বন্ধুর নাম হাওয়া। ভোরবেলা যে ছাদে ব্যায়াম করতে যায়, তার সঙ্গে গল্প করে সে। দুপুরে কাপড় মেলার সময় খুনসুটি করে শাড়ি-চাদর জট পাকিয়ে দেয়। সন্ধ্যার পায়চারিতে পায়ে পায়ে জড়িয়ে যায়। মধ্যরাত্রে দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়। এই প্রবল কষ্টের গরমে যখন প্রাণ ওষ্ঠাগত, তখন সূর্য ডুবলেই ছাদ হয়ে ওঠে নিজস্ব হাওয়ামহল। গরমকালের নিজস্ব একটি অনুষ্ঠান আছে। বিকেল হলেই গা ধুয়ে, গলায়-বগলে পাউডার লাগিয়ে, ফুরফুরে জামা পরে ছাদে যাওয়া। সারাদিনের মালিন্য সরিয়ে যেন নতুন মানুষ হয়ে ওঠা। ছাদের হাওয়া তখন আর তপ্ত শ্বাস ফেলে না। চারদিকের গাছপালা, ফুলের রেণু, শুকোতে দেওয়া আচার, গন্ধতেল, ধুনোর ধোঁয়া, আমপোড়ার, লিরিল সাবানের ঘ্রাণ মেখে ভারী হয়ে ওঠে। হাত বুলিয়ে যায় সদ্যস্নাত-র গ্রীবায়, কাঁধে, চুলে– যেখানে এখনও জল লেগে আছে। মাটি থেকে পোড়া গন্ধ সরে গিয়ে নতুন হাওয়া দৌড়তে থাকে ছাদ থেকে ছাদে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………….
লোডশেডিং হলে পলকের জন্য আকাশে ভেসে ওঠে আলোতে ঢেকে থাকা অগুনতি তারা। বড়রা চিৎ হয়ে শুয়ে আঙুল দিয়ে দিয়ে চিনিয়ে দেন কালপুরুষ, ক্যাসিওপিয়া কিংবা লুব্ধক। টিমটিমে নক্ষত্র আর স্থির আলোর গ্রহ দেখতে দেখতে হঠাৎ কেমন যেন ভয় করে। নিজেদের বড় একলা মনে হয় এ ব্রহ্মাণ্ডে। চলে যাওয়া কাছের মানুষদেরকে একেকটা তারায় দেখতে দেখতেই হয়তো অন্ধকার চিরে চলে যায় উল্কা। উত্তেজনায় উঠে বসার মুহূর্তে এলাকায় কারেন্ট ফিরে আসে, মহাজাগতিক আলো চাপা পড়ে যায় ত্রিফলায়, হ্যালোজেনে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………….
সন্ধ্যায় সেখানে মাদুর পেতে বসা চলে। চটি খুলে রেখে, বাটিতে মুড়ি-শসা নিয়ে গল্প করা যায় যতক্ষণ না কাজের হাঁক আসে। এ ছাদ-ও ছাদ হাসি চালাচালি করা যায়। ছাদে ঘুমনো যায় ঘরে শান্তি না পেলে। কেউ কেউ অপেক্ষায় থাকে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার। একসঙ্গে অনেকটা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার তো দেখা যায় না আজকাল। লোডশেডিং হলে পলকের জন্য আকাশে ভেসে ওঠে আলোতে ঢেকে থাকা অগুনতি তারা। বড়রা চিৎ হয়ে শুয়ে আঙুল দিয়ে দিয়ে চিনিয়ে দেন কালপুরুষ, ক্যাসিওপিয়া কিংবা লুব্ধক। টিমটিমে নক্ষত্র আর স্থির আলোর গ্রহ দেখতে দেখতে হঠাৎ কেমন যেন ভয় করে। নিজেদের বড় একলা মনে হয় এ ব্রহ্মাণ্ডে। চলে যাওয়া কাছের মানুষদেরকে একেকটা তারায় দেখতে দেখতেই হয়তো অন্ধকার চিরে চলে যায় উল্কা। উত্তেজনায় উঠে বসার মুহূর্তে এলাকায় কারেন্ট ফিরে আসে, মহাজাগতিক আলো চাপা পড়ে যায় ত্রিফলায়, হ্যালোজেনে।
গরমকালে কালবৈশাখী আসে। জানলা দিয়ে আকাশে মেঘ জমতে দেখলেই ছাদে চলে যেতে হয় জামাকাপড় তুলতে, বয়ামপাতি-ঝাঁটা-গামলা বালতি ঢুকিয়ে রাখতে। উদ্বিগ্ন মা-বাবা চটপট নেমে আসতে বলেন বজ্রপাতের ভয়ে। সবাই বাধ্য সন্তান হয় না। জিনিসপত্র সিঁড়িঘরে রেখে তারা রেলিংয়ে ভর দিয়ে দেখে ঝড় আসা। বহুদূর থেকে গাছপালা তোলপাড় করতে করতে তার এগোতে থাকা। ছাদের বন্ধু হাওয়া তখন ভয়ংকর রেগে যায় সূর্যের ওপর। ধুলো ছুড়ে দেয় আকাশে, যা পায় সব ভাঙতে থাকে, গর্জন করে। মা বা দিদি এসে কান ধরে নিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত কোনও এক দশবছুরে মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকে সেই তাণ্ডব। খানিক পর যখন বৃষ্টি নামে, তখন সেই মা-দিদিদেরই কেউ কেউ আবার গায়ে গামছা জড়িয়ে ছাদে চলে যায়। উঁকি মেরে দেখে নেয়, অন্য উঁচু ছাদে বা পড়শি জানলায় কেউ নেই তো? তারপর এক পা-দু’পা করে এসে দাঁড়ায় ধারাবর্ষণের ঠিক মাঝামাঝি, দেহে-আত্মায় জল মেখে নেয়। সে যেন এক একান্ত গোপন নৃত্য। চরাচরে তার দর্শক হওয়ার যোগ্য কেউ নেই। গায়ের গামছা হয়ে ওঠে বহুমূল্য আভরণ। ছাদের মাঝখানে শুয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে এই বর্ষণসিক্তা বসুন্ধরার সম্রাজ্ঞী মনে হয়। জল থইথই ছাদ নিজের সীমানা ভেঙে আরও আরও ছাদে মিশে যেতে থাকে। তারপর পথ, তারপর মাঠ, তারপর আরও যা কিছু। সমস্ত পৃথিবী তখন একটাই ছাদ হয়ে ওঠে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন দেবজ্যোতি মিশ্রর লেখা: সারি সারি কবরের পাশে ব্যাঞ্জো হাতে পিট সিগার
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ছাদ ফাঁকা ক্যানভাসের মতো। যে আসছে, তার মনের রং ছাদের জগৎ তৈরি করে। কারও জন্য গরমের সন্ধ্যাবিলাস, বর্ষার বৃষ্টিবন, শরতে জ্যোৎস্না দেখার মানমন্দির, হেমন্তে আকাশপিদিম দেওয়ার কোণ, শীতে রোদ পোহানোর অজুহাত, বসন্তে মনকেমনের একান্তবাস। কেজো মানুষের কাছে সব ঋতুতেই দশ পাক হাঁটা, কাপড় মেলা, বড়ি দেওয়া, কুকুর হাঁটানো, পাখি খাওয়ানো, গাছে জল দেওয়া, গরমে জল ছিটিয়ে নীচের ঘর শীতল করার জায়গা। বালকের ঘুড়ি আর কিশোরের কল্পনা এখানে ডানা মেলে, তরুণের প্রেম হাওয়ায় উড়ে যায় আর এক ছাদের দিকে, যৌবনে মনের কথা ভাগ হয়, বয়সকালে শান্তির খোঁজ চলে। কারও কাছে ছাদ একার, কারও কাছে দলবদ্ধ হইহই। বন্ধুরা এলে ছাদ দেখাতে হয়, কাছের মানুষ এলেও। কেউ লুকিয়ে সিগারেট খায়, হাতচিঠি খুলে দেখে, চুমু খায়, সকলের ওপর অভিমানে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আবার এই ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলোর সাক্ষীও থেকে যায় কেউ, সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে। ছাদের সীমা থেকেও নেই। নিখিল ব্রহ্মাণ্ড ঝুঁকে পড়ে আছে ওই পাঁচিলঘেরা ক্ষেত্রটুকুতে। দেখতে পারলে বিশ্বদর্শন, না পারলেও ক্ষতি নেই। খোলা আকাশের নীচে একটুখানি নিজের জায়গা– সেই বা কম কী?
সময় বদলেছে। ছাদের বিলাসিতাও সর্বজনীন নেই। উত্তরাধিকারসূত্রেই যা পাওয়া। জমি কিনে বাড়ি বানানোর বিত্ত অনেকেরই থাকে না। তাদের ভাগে যে বহুতল, তাকে ‘আমার’ বলার অধিকার নেই– নানা মানুষের আনাগোনা। ছাদের ওপর একাধিক জলের ট্যাংক, লিফটের ঘর, ডিশ অ্যান্টেনা, তারের জঙ্গল। এর গোলাপ আর ওর ক্যাকটাসের টবে জলচল নেই। এর তারে ওর জামা মেলা যায় না। একটু অন্যমনস্ক হলেই হোঁচট লাগবে কোনও না কোনও বিম-এ। যেটুকু জায়গা হেঁটে বেড়ানোর মতো মেলে, তাতে আজও হাওয়া দেয়। কিন্তু আমরা এখন ঘরেই নিভৃতি খুঁজে নিই। বৃষ্টি, জ্যোৎস্না, কুয়াশা দেখি ব্যালকনিতে। পা মেলে গল্প করা, বিয়ারে চুমুক, ঠান্ডা হাওয়া, লুকিয়ে চুম্বন, মনখারাপ করা, ব্যায়াম– সবের জন্যই আলাদা আলাদা ঘর থাকে। ছাদের নীচেই আমাদের সমস্ত পৃথিবী সেঁধিয়ে গিয়েছে।
ছাদেরও এখন তাই হাওয়া ছাড়া কোনও বন্ধু নেই।