ক্যালাইডোস্কোপের আনমনা ব্যবহারে ফুটে ওঠা নকশাগুলি জন্মই নিচ্ছে মিলিয়ে যাবে বলে। জীবনের নানা ওঠাপড়া সহজে গায়ে না লাগার বিজ্ঞাপনী পরামর্শ মনে করিয়ে দেয়। কোনও লেখাই দীর্ঘ নয়। সামান্য অবসর পেলেই দু’-চারটি লেখায় মন ভরিয়ে তোলা যায়। লেখকের ভাষা সুন্দর। তবে কোথাও কোথাও ‘কলোকিয়াল’ টোন একটু কমানোও যেত হয়তো। সেটুকু বাদ দিলে প্রতিটি লেখাই উপভোগ্য। ‘ঘটনার ঘনঘটা’ সবখানে নেই, যা আছে তা হৃদয়ে আঁচড় ফেলা মুহূর্তের জলছাপ।
জীবন বয়ে যায়। যেন নদী। আর পলির মতো জমে থাকে মুহূর্ত। থাকে মানুষ। তারা কেউ আজ মৃত। কেউ বা জীবিত হলেও বহু দূরে। স্মৃতির আয়নায় কত মন ছায়া ফেলে যায়! যিনি লেখেন, তিনি সেই মন লিখে রাখেন খাতায়। সাদা পাতায় তা ফুটে থাকে আঁচড়ের মতো। গল্প নিটোল হলে প্লটের জোর লাগে। কিন্তু প্লট নয়, যখন গল্পের উড়ানটুকুই কেবল উদ্দেশ্য, তখন লিখনের চরিত্র আলাদা হতে বাধ্য। রাজেশ কুমারের ‘জলের খোঁজে ভেসে’ তেমনই কিছু রচনার সংকলন।
কাহিনি এই বইয়ের কোথাও নেই। আবার আছেও, তার নিজস্ব শর্তে।
মনে পড়ে গুলজারকে। ‘দেখো আহিস্তা চলো অউর ভি আহিস্তা জারা/ দেখ না সোচ সামহাল কর জারা পাঁও রাখ না।’ কেননা ‘কাচ কে খাব হ্যায় বিখড়ে হুয়ে তনহাই মে’… রাজেশের লেখা যেন তেমনই এক ধীর চলনের কথা বলে। যদিও গুলজারের লেখাটি যেদিকে যায়, এই লেখাগুলোর গন্তব্য সেদিকে নয়। এ এমন সব স্বপ্ন যা ভেঙেই আছে। কাচের মতো ছড়িয়ে থাকা স্বপ্নের মতো সব ঘটনা ও চরিত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে লেখকের– ‘তনহাই মে’… একাকিত্বে। একলা মানুষের স্মৃতির পর্দায় ভেসে ওঠা এইসব উপাখ্যান পর পর ছড়িয়ে রয়েছে কাচের মতো। কিংবা ভাঙা স্বপ্নের মতো। সব বেদনার যেমন নিজস্ব স্মৃতি থাকে, সব স্মৃতিরই থাকে নিজস্ব বেদনাভার।
রাজেশ যে সব মানুষের কথা লিখেছেন তাঁদের অনেককেই কি আমরা দেখিনি? যেমন ‘এভারেস্ট ও হিন্দি সিনেমা’। বইয়ের একেবারে শেষ লেখা। সেখানে দেখা মেলে মনোজের। গোন্দলপাড়ার এক ক্লাবে জিম চালাত সে। কিন্তু শেষপর্যন্ত রাস্তা দিয়ে তার হ্যান্ডকাফ পরে হেঁটে যাওয়া আবার স্বমহিমায় ফিরে আসা, এই গল্প বড় চেনা মনে হয়। এমন চরিত্র আমাদের স্মৃতিতে, কেবল স্মৃতিতে কেন এই সময়ে দাঁড়িয়েও হেঁটে চলে বেড়ায়। রাজেশ তাকে ধরে রাখলেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এই বইয়ের অন্যতম সেরা লেখা ‘লাঞ্ছিত বিকেল’। পিতৃত্বের এক আশ্চর্য যন্ত্রণাকাতর আর্তিমাখা এই রচনা মাত্র পাতা চারেকের মধ্যেই লিখে রাখে এক বিষণ্ণ গাথা। লেখাশেষে থেকে যায় ছোট্ট একটি হাতের স্পর্শ। পিতার হাতের আঙুল ধরে রাখা সেই মুঠোর ভিতরে বুঝি জেগে থাকে আস্ত এক ব্রহ্মাণ্ড! আবার ‘স্পর্শ’ এক ভিন্নমাত্রার লেখা। মফস্সলের এক চাকরিপ্রত্যাশী যুবক। কলকাতা তার কাছে সুদূরের ভুবন। চাকরির পরীক্ষার ফর্ম জমা দিতে বা পরীক্ষা দিতে আসাটুকুই সংযোগ।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আবার ‘নেকড়ের প্রহর’। ‘সূর্য নিভে গেলে শুধু পৃথিবীটাই নয়, অন্ধকার নামে মানুষের মনের মধ্যেও। রাত গভীর হলে আসে নেকড়ের প্রহর।’ বার্গম্যানের ‘আওয়ার অফ দ্য উলফ’ এমন এক ছবি যা একবার দেখলে সারা জীবনের অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। রাজেশেরও তাই হয়েছে। তিনি এর সঙ্গে মিশিয়েছেন নিজের কৈশোরের ফেলে আসা কালখণ্ড। ‘কীসের যেন তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে আসে। কখনও শিসের মতো ধারাল, কখনও অলৌকিক পাখির ডাকের মতো অশনি ছড়ানো।’ কৈশোর যে কোনও মানুষের এক ফেলে আসা দ্বীপ। যে নির্জন দ্বীপের মধ্যে রয়ে গিয়েছে ‘কতগুলো জীবিত কিংবা মৃত চরিত্র।’ এই লেখায় যেন নিষিদ্ধ এক অন্ধকার। একদিকে প্রথম সিগারেটে টান, অন্যদিকে প্রথম নারীসংসর্গ। অথচ দু’ক্ষেত্রেই কেমন এক জড়োসড়ো ব্যর্থ প্রয়াসের কুয়াশা। প্রতিটি পিউবার্টিই কি নিজস্ব এক ‘নেকড়ের প্রহর’ রচনা করে না?
এই বইয়ের অন্যতম সেরা লেখা ‘লাঞ্ছিত বিকেল’। পিতৃত্বের এক আশ্চর্য যন্ত্রণাকাতর আর্তিমাখা এই রচনা মাত্র পাতা চারেকের মধ্যেই লিখে রাখে এক বিষণ্ণ গাথা। লেখাশেষে থেকে যায় ছোট্ট একটি হাতের স্পর্শ। পিতার হাতের আঙুল ধরে রাখা সেই মুঠোর ভিতরে বুঝি জেগে থাকে আস্ত এক ব্রহ্মাণ্ড! আবার ‘স্পর্শ’ এক ভিন্নমাত্রার লেখা। মফস্সলের এক চাকরিপ্রত্যাশী যুবক। কলকাতা তার কাছে সুদূরের ভুবন। চাকরির পরীক্ষার ফর্ম জমা দিতে বা পরীক্ষা দিতে আসাটুকুই সংযোগ। এমন ‘বিদেশে’ একদিন পরীক্ষা দিতে এসে তার সাক্ষাৎ হয় এক দৃষ্টিহীন মহিলার সঙ্গে। মনমরা যুবকের উদ্দেশে তাঁর আশীর্বাণী যেন গমগম করে বেজে ওঠে পাঠকের হৃদয়ে। সম্পূর্ণ অনাত্মীয়া এক মাতৃসমার এমন স্নেহস্পর্শ বুঝিয়ে দেয়, গনগনে আঁচে পুড়তে থাকা জীবনে আকস্মিক ছায়া পড়ে বলেই জীবন এত সুন্দর।
এমনই নানা রচনা। ক্যালাইডোস্কোপের আনমনা ব্যবহারে ফুটে ওঠা নকশাগুলি জন্মই নিচ্ছে মিলিয়ে যাবে বলে। জীবনের নানা ওঠাপড়া সহজে গায়ে না লাগার বিজ্ঞাপনী পরামর্শ মনে করিয়ে দেয়। কোনও লেখাই দীর্ঘ নয়। সামান্য অবসর পেলেই দু’-চারটি লেখায় মন ভরিয়ে তোলা যায়। লেখকের ভাষা সুন্দর। তবে কোথাও কোথাও ‘কলোকিয়াল’ টোন একটু কমানোও যেত হয়তো। সেটুকু বাদ দিলে প্রতিটি লেখাই উপভোগ্য। ‘ঘটনার ঘনঘটা’ সবখানে নেই, যা আছে তা হৃদয়ে আঁচড় ফেলা মুহূর্তের জলছাপ।
শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা প্রচ্ছদ বড় মনোরম। ঢাউস রেডিও, পিছনে প্লাস্টারখসা দেওয়ালের চালচিত্র স্মৃতির সরণিকে জাগিয়ে তোলে। কিন্তু নামাঙ্কনে ক্যালিগ্রাফি ব্যবহার করার সময় আরও একটু অন্যভাবেও ভাবা যেতে পারত। কেননা নামটি একধাক্কায় পড়তে একটু বাধে। ছাপা চমৎকার, বানান ভুলও তেমন চোখে পড়ে না। তবু কোথাও কোথাও রাসবিহারী হয়েছে রাজবিহারী, দামোদর হয়েছে দামদর। আশা করা যায়, পরের সংস্করণ বা মুদ্রণে নিশ্চয়ই তা থাকবে না।
জলের খোঁজে ভেসে
রাজেশ কুমার
২০০
মণিকর্ণিকা প্রকাশন