গত প্রায় ১৫-২০ বছর তাঁর লেখা আমাদের হাসায়, আমাদের কাঁদায়। কী-বোর্ডের কালচে আলো যে আঙুলে হয়ে ওঠে মায়াবী কবিতা, সে আঙুলেই তা হয়ে ওঠে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। গান, কবিতা, স্ট্যান্ড-আপ কমেডি-র পাশাপাশি সমান দক্ষতায় বেঁধে ফেলেন স্ক্রিপ্ট, বানান সিনেমাও। বলুন, ‘জবরা ফ্যান’ না হয়ে আমাদের আর উপায় কী? এহেন বরুণ গ্রোভার-কে আড্ডায় পেয়ে, প্রশ্নের ঝাঁপি খুললেন অম্বরীশ রায়চৌধুরী ও উদয়ন ঘোষচৌধুরি। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
‘প্যাশন ফর সিনেমা’ (passionforcinema.com, সংক্ষেপে পিএফসি) নামে যে ব্লগটা ছিল– যেখানে আপনি, বসন বালা, নীরজ ঘেওয়ান, অনুরাগ কাশ্যপ এঁরা লেখালেখি করতেন– লেখক হিসেবে আপনার কেরিয়ারের শুরুতে ওই ব্লগটার কোনও ভূমিকা ছিল বলে মনে করেন?
আমি কিন্তু লেখক হিসেবে ওখানে খুব অ্যাক্টিভ ছিলাম না, আমি মূলত পাঠক ছিলাম। হ্যাঁ, পিএফসি ব্লগটা পড়লে মনে হত, ওই বিশাল ঝাঁ-চকচকে, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে যে বলিউড, তার বাইরেও কিছু মানুষ আছেন, একটা কমিউনিটি আছে… অনুরাগ কাশ্যপ, সুধীর মিশ্রা, দিবাকর ব্যানার্জি, হনসল মেহেতা– ওখানে ওঁদের উপস্থিতি টের পেতাম। পিএফসি-র আসল আড্ডাটা, অন্তত আমার কাছে, একটু ‘ক্লোজড-গেট’ লাগত। আমি আউটসাইডার ছিলাম। অনুরাগের একটা পোস্টে একদিন দুম করে কমেন্ট করেছিলাম, আমি একটা কবিতা লিখেছি… তো, ওঁর কী মনে হল, আমাকে ফোন করলেন, দেখা করতে বললেন, ওখান থেকে ওঁর সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হল। তো, সেদিক থেকে ভাবলে ওই ব্লগের একটু ভূমিকা আছে আমার কেরিয়ারে…
আমার কথা বাদ দিয়ে বলি, পিএফসি-র অন্য অনেক কন্ট্রিবিউশন আছে ইন্ডাস্ট্রিতে। বসন বালা, নীরজ ঘেওয়ান, সোমেন মিশ্রা– এরকম যাঁরা আউটসাইডার ছিলেন, যাঁরা নিজেদের মতো করে সিনেমা বানানো বা স্টোরিটেলিংয়ের স্বপ্ন দেখছিলেন, ওই ব্লগ তাঁদের আশার আলো দেখিয়েছে, তাঁদের সেই কল্পনা এখন সত্যি হয়েছে… তো, হ্যাঁ, আধুনিক হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে পিএফসি একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক…
ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে, সেলিম-জাভেদের আগে, লেখকরা খুব একটা মর্যাদা বা সম্মান পেতেন না। ওঁরা দু’জন এই বিষয়ে অনেক কথা বলেছেন, অনেক লড়াই করেছেন। আবার, এখনকার দিনেও শোনা যায় লেখকদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয় না। আপনার কী মনে হয়, কথাটা সত্যি? সত্যি হলে, আপনার মতে কারণটা কী?
দেখুন, এরকম কোনও মাপকাঠি নেই যে, সেখান থেকে সেলিম-জাভেদের সময়কার বাকি লেখকদের কী অবস্থা ছিল সেটা জানা যাবে! ওঁরা সুপারস্টার ছিলেন, ওঁদের সেই সুনাম ছিল। আমরা ধরে নিয়েছি, ওই সময়ে লেখকদের মর্যাদা ছিল, কারণ আমরা সেলিম-জাভেদের নামটা জানি। ওঁরা লাগাতার দুর্ধর্ষ কাজ করেছেন! সাংঘাতিক ভালো ভালো কাজ! ওঁরা নিজেদের অধিকার, নিজেদের স্ট্যাটাস পাওয়ার জন্য লড়াই করেছেন, কারণ ওঁদের সাপোর্ট করেছে ওঁদের ওইসব কাজ… আমার মনে হয় না, সাতের দশকে সব লেখকের সম্মান হঠাৎ খুব বেড়ে গিয়েছিল! সেলিম-জাভেদের সম্মান বেড়েছিল, তার পিছনে যথেষ্ট যুক্তি ছিল! তো, আমি বলতে পারব না ওইসময়ের তুলনায় এখন উন্নতি হয়েছে, না অবনতি হয়েছে, না একই আছে… হ্যাঁ, মনে হয়, ব্যাপারটা হয়তো একই আছে…
এখনের সময়ে জুহি চতুর্বেদী-কে দেখুন! পরপর কী ভালো কাজ করছেন! লোকজন সেলিব্রেট করছে… ‘ভিকি ডোনার’, ‘পিকু’, ‘অক্টোবর’, ‘গুলাবো সিতাবো’… বা, লিরিক্সে দেখুন, ইরশাদ কামিল! গত কয়েক বছর ধরে দুর্দান্ত কাজ করছেন! আপনি হয়তো হঠাৎ কোনও চ্যানেলে দেখতে পাবেন, এ. আর. রহমান আর ইমতিয়াজ আলি-র সঙ্গে ইরশাদ বসে ইন্টার্ভিউ দিচ্ছেন। নইলে কোথাও কোনও সিনেমার প্রোমোশনে লিরিক্স রাইটারকে দেখতে পাবেন না। তো, পুরো ব্যাপারটা নির্ভর করছে ব্যক্তিবিশেষের ওপর, তিনি কীরকম কাজ করছেন তার ওপর। আপনার কাজ ভালো হলে নিশ্চয়ই সেলিব্রেট করবে মানুষ। তার মানে এই নয় যে, একইভাবে বাকিদের নিয়েও মাতামাতি হবে…
এবারে গান লেখার কথাতেই আসি। প্রথমেই মার্জনা চেয়ে নিই যে, আমরা মূলত হিন্দিভাষী নই, তাই বিষয়টা বুঝতে বা বোঝাতে গোলমাল করতে পারি। পাঁচের দশক থেকে নয়ের দশক পর্যন্ত হিন্দি গানের কথায় যেসব শব্দ শুনেছি, আপনি এসে অনেক শব্দ প্রথম শোনালেন। যেমন, ‘মোহ’, ‘মুরা’, ‘বোনি’… এইরকম শব্দ, আমাদের মতো বিভিন্ন ভাষা-ভাষীর দেশে, যেকোনও সাধারণ মানুষ না-ও বুঝতে পারেন– কিন্তু যদি কেউ বুঝতে পারেন, তিনি অবশ্যই রসটা নিতে পারবেন। তো, এগুলো কী ভেবে লেখেন? সচেতন চিন্তা-ভাবনা করে, খানিকটা ইচ্ছাকৃতভাবে করেন?
হ্যাঁ, খানিকটা তো ইচ্ছাকৃতই বটে। কারণ, যেকোনও আর্টই ইচ্ছাকৃত, সচেতন। তবে, আমার চেষ্টা থাকে দু’-তিনটে জিনিস করার। এক, ক্লিশে শব্দ লিখব না। অন্তত আমার কাছে যেসব শব্দ বোরিং লাগে, সেগুলো বসাব না। অডিয়েন্সের কাছে কিছু শব্দ কখনওই বোরিং হয় না। যেমন, ‘দিল’, ‘প্যার’, ‘মহব্বত’, ‘ইশক’… এগুলো প্রায় সব গানেই থাকে। এইসব গান চলেও খুব। যেমন ‘শুন রহা হ্যায় না তু, রো রহা হুঁ ম্যাঁয়…’ খুব সহজ-সরল শব্দ। বহুল ব্যবহৃত শব্দ। এই গানটা আমারও ভালো লাগে। এর কম্পোজিশন, গাওয়া, ফিল্মের কনটেক্সট– সব মিলিয়ে আর কী… তবে, আমার মতে, গানের কথায় নতুন আঙ্গিক আনতে হলে, ক্লিশে শব্দ বর্জন করতে হবে। সেটা করা সবসময় সম্ভব হয় না। কারণ সুর, ফিল্মের কনটেক্সট, পরিচালক বা সুরকার কী চাইছেন– এগুলোও ভাবতে হয়…
দুই, আমি সচেতনভাবে চেষ্টা করি এমন শব্দ বসাতে, যেগুলো খুব জটিল নয়, কিন্তু হয়তো অনেকে আনমিউজিক্যাল মনে করেন। হয়তো শব্দটা মিউজিক্যাল হতেও পারে, কিন্তু একটা প্রচলিত ধারণা থাকে যে, এই শব্দটায় কাব্যিক মাধুর্য ততটা নেই, তাই সুরে ঠিক বসবে না। যেমন, ‘মছলি’ শব্দটা। ‘আঁখোঁ দেখি’-র একটা গানে লিখেছিলাম, ‘তেরে হাথ মছলি বনকর…’ মানে, মাছের মতো বয়ে যাচ্ছে আমাদের হাত… তো, সুরকার প্রথমেই বললেন, এই শব্দটা চলবে না। ফিল্মটার থিম এত ফিলোজফিক্যাল, ‘মছলি’ কী করে রাখব? আমি বললাম, চেষ্টা করে দেখিই না! গাওয়ার পরেও যদি মনে হয় ভালো লাগছে না, তখন পালটে দেব। কোনও নির্দিষ্ট শব্দ মিউজিক্যাল বা আনমিউজিক্যাল– এরকম আমার মনে হয় না। ভাগ্যিস পরিচালক রজত কাপুর আমাকে সাপোর্ট করেছিলেন! বলেছিলেন, হ্যাঁ, দেখাই যাক! কিন্তু, আমার তখনও মনে হয়েছিল, বাকিরা ভাবছিলেন কেন ওই শব্দটা লিখেছি!
আমার কাছে ‘মছলি’ খুব সোজাসাপটা শব্দ। কোনও জটিলতা নেই। এরকম নয় যে, গুলজার সাব যেমন মাঝেমাঝে এমন শব্দ লেখেন যেগুলোর মানে হয়তো কেউ বুঝবেন না! ধরুন, ‘কজরা রে…’ ওই ফিল্মে ওটাই সবথেকে ধুমাধার গান! আইটেম সং! আইটেম সংয়ের উদ্দেশ্যই হল পাবলিককে খাওয়ানো, আর তাই সেটা খুব সহজ করতে হয়। অথচ, ওই ফিল্মের জটিলতম লিরিক্স ওটা! শব্দগুলো দেখুন… ‘কিমাম’, ‘জ্যায়সে গর্মিয়োঁ কি লু হ্যায়…’ এই ‘লু’ তো রীতিমতো কুরুচিকর! কারণ, ইংরেজিতে ‘loo’ মানে টয়লেট আর হিন্দিতেও মানেটা খুব ইয়ে… গানটা শুনে প্রথমে আমার মনে হয়েছিল ‘কিলু’ বলছে… কয়েকবার শোনার পর বুঝতে পেরেছিলাম, গরমকালের কথা বলছে মানে লু-ই হবে। এবার দেখুন, গানটা সর্বকালের অন্যতম হিট! যশ রাজের চ্যানেলে আর কোনও গানে অত ভিউ নেই।
তো, এরকম ধারণা থাকে যে, এই এই শব্দ বসাতে হবে আর এই এই শব্দ বসানো যাবে না। এইসব আইডিয়া একটা এস্ট্যাবলিশমেন্ট থেকে আসে। ওই এস্ট্যাবলিশমেন্টটা কাল্পনিক, কিন্তু আছে। আমি ওই জায়গাটা ভাঙতে চাই, বা দেখাতে চাই, প্রমাণ করতে চাই এগুলোও হতে পারে। যেমন, ‘সক’ (Shauq) শব্দটা… আমার কাছে খুব মিউজিক্যাল আর কাব্যিক। শব্দটা খুব জটিলও নয়, হয়তো অন্য গানেও ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু, মুখরাতে? পাবেন? কপাল ভালো, ওই ফিল্মের পরিচালক নিজেই একজন লিরিক্স রাইটার…
তো, আজ পর্যন্ত সবথেকে সহজে আর তাড়াতাড়ি, বোধহয় ২০ মিনিটের মধ্যে, ওই গানটা লিখেছি। কোনও কাটাকুটিও করতে হয়নি। ওটা লিখে নিজে খুব তৃপ্তি পেয়েছি। কারণ, আমি যেরকম অলংকার বা রূপক বসাতে চাই, সেটা করতে পেরেছি। অন্যান্য জায়গায় ওই কাজ করতে হলে অনেককে বুঝিয়ে রাজি করাতে হয়। এখানে পরিচালক নিজে লিরিক্সটা জানেন, বোঝেন, লেখেন… আর, অমিত ত্রিবেদী! যেকোনও জিনিস খোলা মনে নিতে পারেন। ওই একজন সুরকার, যাঁর সঙ্গে কাজ করে দেখেছি উনি কোনও শব্দকে চট করে আনমিউজিক্যাল বলেন না। ওঁর কাছে সব কিছুই মিউজিক্যাল, যদি সেটা মিটারে থাকে। ব্যস, ওটুকুই ওঁর চাহিদা।
গীতিকার সমীর এক জায়গায় বলেছেন, কবি আর লিরিসিস্ট– দু’জন আলাদা মানুষ। তো, সেখানে শেষে তিনি বলেছেন, গুলজার একজন কবি, কিন্তু লিরিসিস্ট নন। আপনি কী মনে করেন?
হ্যাঁ, আমি একমত যে, কবি আর লিরিসিস্ট আলাদা মানুষ। কবিতা লেখা আর গান লেখা– দুটো আলাদা ক্রাফট। কবিতা লেখার সময়ে কেউ কোনও নির্দেশ দেন না। গান লেখার সময়ে ৩-৪ রকমের নির্দেশ থাকে, সেগুলো মাথায় রাখতে হয়। এক, স্ক্রিপ্টের কী চাহিদা, মানে সিচুয়েশনটা কী। দুই, ফিল্মটার ল্যাঙ্গুয়েজ, কী ধরনের ফিল্ম। তিন, সুরকারের দেওয়া সুর, মিটার, আরও কিছু টেকনিক্যাল ব্যাপার থাকে। আর, চার নম্বর, মার্কেটটা ভাবতে হয়। মানে, এমন শব্দ লিখবেন যেগুলো খুব বেশি জটিল নয়, খুব অস্পষ্ট নয়, মানুষের কাছে সহজবোধ্য হবে। তো, এইসব ভেবে দেখলে লিরিক্স লেখাটা আসলে নানা সীমা-পরিসীমা মেনে, কবিতা লেখা। এই ব্যাপারটায় আমি একমত।
কিন্তু গুলজার সাব একজন কবি, লিরিসিস্ট নন– এটা মানতে পারছি না। একই মানুষ একইসঙ্গে দুর্দান্ত কবি আর দুর্দান্ত গীতিকার হতেই পারেন। গুলজার সাব অবশ্যই তাঁদের মধ্যে একজন।
আচ্ছা, আমাদের মতো বাঙালি যদি হিন্দি কবিতা পড়তে চান, তাহলে আপনার মতে কোথা থেকে শুরু করা উচিত?
জানি না, এটা সত্যিই জানি না। কবিতা পড়া সম্বন্ধে আমি কখনও কাউকে কোনও পরামর্শ দিতে পারি না। কোন কবিতাটা কার পছন্দ হবে, সেটা নির্ভর করবে সেই মানুষটা কীরকম তার ওপর… আমি যদি কাউকে না জেনে-বুঝে, তার বিয়ের সম্বন্ধ দেখে দিই… ব্যাপারটা পুরো ঘেঁটে যাবে, তাই না? তো, আমি কোনও পরামর্শ দিতে চাই না এই ব্যাপারে। হ্যাঁ, আমার পছন্দের কয়েকজন কবির নাম বলতে পারি। যেমন সর্বেশ্বর দয়াল সাক্সেনা (হিন্দি), অমৃতা প্রীতম (হিন্দি-পাঞ্জাবি), গুলজার (হিন্দি-উর্দু), জাভেদ আখতার (হিন্দি-উর্দু), শিব কুমার বাটালভি (পাঞ্জাবি)… আর, ওঃ, আমার সাংঘাতিক ভালো লাগে নরেশ সাক্সেনা আর উদয় প্রকাশ… এবার আমি কিন্তু জানি না এঁদের মধ্যে কোন কবিতা কার ভালো লাগবে বা কার লাগবে না…
বেশ। আপনি বলেছিলেন, ভারতে স্ট্যান্ড-আপ কমেডি সোজাসুজি হাস্য-কবি সম্মেলন থেকে এক লাফে আমেরিকান স্টাইল ধরে নিয়েছে। বলেছিলেন, ওই শূন্যস্থানটা আপনি ভরাট করতে চান। সেটা করতে পেরেছেন বলে মনে করেন?
মনে হয়, শুধুমাত্র আমি একা নই, অনেকেই ওই শূন্যস্থান পূরণ করতে চেষ্টা করছেন। অনেকে তো ভীষণ সফল হয়েছেন। একটা বিশাল উদাহরণ দিই, জাকির খান! ওঁকে এখন সারা পৃথিবী চেনে! ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ড-আপ কমেডির সবথেকে বড় রকস্টার, জাকির! উনি হিন্দি, হিন্দুস্তানি, উর্দুতে কথা বলেন। আমেরিকান স্টাইল নকল করেন না। হাস্য-কবি সম্মেলন টাইপও করেন না। মাঝামাঝি একটা পথ বেছে নিয়েছেন। নিজের জীবনের গল্প বলেন, নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। আজকের দিনে উনি যেকোনও হিন্দি ফিল্মস্টার বা সিঙ্গারের মতোই জনপ্রিয়… তো, অনেকেই এই কাজটা করছেন, আমিও আমার মতো করে চেষ্টা করছি…
আমাদের দেশে স্ট্যান্ড-আপ কমেডিতে জেন্ডার ডাইন্যামিকটা কীরকম? এই ফিল্ডে খুব কমসংখ্যক মেয়ে আসেন, কেন?
দুনিয়ার কোথায় এই সমস্যাটা নেই, বলুন তো! কমেডির ফিল্ডটা তো আকাশ থেকে পড়বে না! বিশাল বড় একটা ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রির ছোট্ট একটা অংশ এটা। সেই ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রি সমাজেরই ছোট্ট একটা অংশ। আর, সেই সমাজ ঘুরেফিরে রাষ্ট্রের একটা অংশ… সব জায়গায় দেখুন, মেয়েদের আন্ডার-রিপ্রেজেন্টেড করে রাখা হয়েছে…
তবে, আমি পজিটিভলি ভাবছি। দেখুন, অন্যান্য বহু জায়গায় মেয়েদের জন্য কোনও ইন-বিল্ট ইনসেন্টিভ নেই। বরং, টপ ম্যানেজমেন্ট বা ক্ষমতাসীন পদে মেয়েদের ঢুকতে বাধাই দেওয়া হয়। কিন্তু, কমেডিতে মেয়েদের জন্য একটা ইন-বিল্ট ইনসেন্টিভ আছে। কারণ, কমেডিতে সবসময় নতুন স্বর, নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন কাহিনির দরকার হয়। ওই স্বর যত নতুন হবে, যত আলাদা হবে– সাফল্যের সম্ভাবনা তত বেশি হবে। গত ৫ বছরে অনেক মেয়ে এই ফিল্ডে এসেছেন, আরও আসবেন। নেক্সট ৫ বছরে হয়তো এই সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। আমি খুব আশাবাদী এই ব্যাপারে। ছবিটা পালটাবে। নিশ্চয়ই পালটাবে।
এ দেশের কমেডির কথা ভাবলে, প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত, রাজনীতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
সবসময়েই গুরুত্বপূর্ণ। কমেডিতে আরেকটা ইন-বিল্ট ইনসেন্টিভ আছে, আপনি পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট কথাবার্তা বলতে পারেন। তাই তো মানুষ বারবার কমেডির কাছে আসেন, তা সে স্ল্যাপস্টিক কমেডি হলেও! পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট কথা থাকে বলেই তো হাসির উদ্রেক হয়! এখন, হ্যাঁ, সেই পলিটিক্সটা রিগ্রেসিভ হতে পারে, প্রোগ্রেসিভ হতে পারে। কিন্তু, ওটা ছিল, আছে, থাকবে। কমেডির একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ, রাজনীতি।
সকলেই কাউকে না কাউকে শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন। আপনি আপনার পূজনীয় কারও সম্বন্ধে কৌতুক পরিবেশন করতে পারবেন?
অবশ্যই পারব। আমার পূজনীয় মানুষদের নিয়ে আমি রসিকতা করি, জোক লিখি। আমার লেটেস্ট স্ট্যান্ড-আপ সোলো, যেটা নিয়ে এখন নানা জায়গায় শো করছি– ‘নাথিং মেকস সেন্স’– সেখানে আমার মতো তথাকথিত লিবারেল লোকজন কীভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে, ভারতের গণ্যমান্য লিবারেলরা, আমরা আমাদের কোথায় নিয়ে চলেছি… এইসব ব্যাপারেই অনেক কিছু বলছি…
ফিল্ম পরিচালনা করে কেমন লাগল?
পরিচালনার অভিজ্ঞতা বলতে, ভীষণ ভীষণ বিধ্বস্ত হয়েছি… মানে, এটাই আমার মনে প্রথমে আসে। এমন প্রচুর ছোটো-বড় অসংখ্য কাজ করতে হয়েছে, যেগুলো কিছুই জানতাম না। শুটিং, পোস্ট-প্রোডাকশন, রিলিজ, রিলিজের পর ফিডব্যাক পড়া, রিভিউ দেখা, ইন্টারভিউ দেওয়া, লোকজনের প্রশ্নের জবাব দেওয়া… বিরাট দীর্ঘ রাস্তা, ভীষণ ক্লান্তিকর… কিন্তু একইসঙ্গে ভীষণ তৃপ্তিদায়ক।
নিজের হাতে কোনও কিছু তৈরি করা, শুধু তো হাত নয়… হাত, মাথা, মন, শরীর– সবকিছু ঢেলে দিতে হয় ফিল্ম বানানোর জন্য। ওই অনুভূতিটা একেবারেই অন্যরকম। নাঃ! ‘অন্যরকম’ শব্দটা খুব বোরিং… (একটু ভেবে) আমি বলব, খুব ভারি… যেন সিসিফাসের মতো একটা বিশাল পাথরের চাঁই টেনে পাহাড়ের মাথায় তুলছেন… শেষমেশ তুলতে পেরেছেন… আর, সেই জন্যেই বোধহয় তখন মাথার মধ্যে আনন্দের নিউরনগুলো জেগে ওঠে…
আর, এই যে সিনেমার একটা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ, যেটা আমাদের দেশে শুরু হয়েছিল ১৯১৩ থেকে, সেই সুবিশাল লম্বা একটা চেইনের অংশ হওয়া… সেই চেইনে অনেক দুর্দান্ত ফিল্ম আছে, অনেক মোটামুটি ফিল্ম আছে, অনেক জঘন্য ফিল্ম আছে, অ্যাজেন্ডা, প্রোপ্যাগান্ডা, সোশ্যাল মেসেজ– সব আছে… তারপর, একদিন দেখলেন, সেই লাইনে সেই গ্রাফে কোথাও একটা ছোট্ট বিন্দু হয়ে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন! এইটাই ভীষণ তৃপ্তিদায়ক। ফিল্মটা কী হয়েছে, সেসব তখন বড় কথা নয়। কথাটা হল, ভারতীয় বা হিন্দি সিনেমার গ্রাফে ওই দাঁড়িয়ে থাকাটা। তো, ওখানেই আমার সব ক্লান্তি ধুয়ে-মুছে যায়…
ফিল্মটায় কী চাইছেন সেই সম্বন্ধে একজন পরিচালকের স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি?
হ্যাঁ, আমার মনে হয়, প্রতিটা ধাপে স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি। সেই ধারণাটা বদলাতে পারে। হতে পারে, শুরুতে যেটা ভাবছিলেন, সেটার কিছু কারণ ছিল। বানাতে আরম্ভ করে হয়তো এমন কিছু বুঝলেন, যার জন্য কিছু দৃশ্য পালটে দিলেন। তো, সেটা সেই সময়ের ধারণা। হয়তো এডিটিংয়ের সময়ে আরেকটা কিছু মাথায় আসতে পারে। তো, নানা ধাপে এগুলো হয় আর প্রতিটা ধাপেই স্পষ্ট ধারণাটা দরকার। হ্যাঁ, ধারণা বদলাতেই পারে।
আবার বানাবেন সিনেমা? বড় কোনও স্টারকে পরিচালনা করার চ্যালেঞ্জ নিতে চাইবেন, না নন-স্টারদের সঙ্গে কাজ করতে পছন্দ করবেন?
হ্যাঁ, অবশ্যই আরও ফিল্ম বানাব। তবে, তার জন্য বড় স্টার বা বড় অ্যাক্টর– কাকে পরিচালনা করব, কী হবে জানি না। জানি না, কীভাবে কবে হবে। মানে, আমি তো এখনও ভাবিইনি সেটা ভালো হবে, না মন্দ হবে, না কী হবে… জাস্ট জানি না। যখন যেমন হবে, তখন তেমন হবে।
অনেক ভালোবাসা, বরুণ। পরবর্তী কাজের জন্য আগাম শুভেচ্ছা। হাসিতে থাকুন, হাসাতে থাকুন…
হ্যাঁ, ধন্যবাদ, আপনারাও ভালো থাকুন।
[শেষ]
আজ যখন আমরা মার্কস ও এঙ্গেলসের বন্ধুত্বকে নতুন চোখে দেখে কমিউনিস্ট ইতিহাস রচনার কথা ভাবি, তখন একই সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নারীবাদী ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমাদের মেয়েদের এই বিপ্লবী কমরেডশিপের সম্ভাবনার, নারীবাদী বন্ধুত্বের রাজনীতির দিকেও নজর দিতে হবে।