আড্ডা ছিল বাঙালির ‘চলমান সংস্কৃতি’। এবং এতটাই ছিল তার সর্বজনগ্রাহ্যতা যে, অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির একাদশ সংস্করণে শব্দটি জায়গা করে নেয় ২০০৪ সালে। শঙ্কা জাগে, হয়তো একসময় শুধু অভিধানেই এর উল্লেখ থাকবে। নতুন প্রজন্ম ‘মিট’ করবে, আর ‘আড্ডা’ মারবে না।
কফি হাউসের সেই আড্ডাটা যে আজ আর নেই, ক’বেই কথায়-সুরে বলে গিয়েছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার-মান্না দে। কিন্তু বাঙালির নির্ভেজাল আড্ডাও কী আর আগের মতো আছে? গ্রামবাংলার চণ্ডীমণ্ডপ, রাস্তার ধারের মাচা এখন ইতিহাসের পাতায়। শহর-শহরতলির রকও উঠে গিয়ে মাথা তুলেছে বহুতল। রকবাজ বাঙালির ‘ঠেক’ ভেঙে গিয়েছে। পুজোমণ্ডপেও চট করে কেউ আড্ডা মারতে বসে না। পটলডাঙার টেনিদা, হাবুল, ক্যাবলা, প্যালাদের মতো রকে বসে আড্ডা মারার প্রজন্ম দ্রুত অপসৃয়মাণ। শুধু কি তাই? মেস বাড়িতে ঘনাদার আড্ডা, ক্লাবে বসে তাস-ক্যারম খেলার ফাঁকে আড্ডা, দোকানে চায়ের কাপে তুফান তোলা আড্ডাও যেন ক্রমশ স্মৃতির পাতায় ঢুকে পড়ছে।
হঠাৎ আড্ডা নিয়ে এত হা-হুতাশ কেন?
কারণ, ভারতীয় দলের তরুণ লেগ স্পিনার রবি বিষ্ণোইয়ের একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্ট। ধামাকাদার আইপিএল মরশুম শেষে রবি গ্রামের বাড়িতে বিশ্রাম নিতে গিয়েছেন। রাজস্থানের যোধপুরের অখ্যাত সেই গ্রাম বিরামি। সার্থকনামা। দৈনন্দিন ব্যস্ততার ‘বিরাম’। কয়েকটি ছবি পোস্ট করে রবি তার ক্যাপশন দিয়েছেন, ‘গ্রামীণ জীবন: যেখানে চা হচ্ছে জ্বালানি এবং গসিপ হল বেঁচে থাকার রসদ’।
বস্তুত, এটাই কিন্তু ছিল গোটা দেশ তথা বাংলারও এক সময়ের চেনা ছবি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তা অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে। ঠিক যেন যাযাবরের কথায়, ‘আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ। তাতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আয়েস’। মানুষ ক্রমাগত ছুটছে, পড়ে যাচ্ছে। উঠে আবার ছুটছে। এখনকার মানুষ থামতে জানে না। এটাও ঠিক যে, ‘অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন’। কিন্তু কীভাবে চলব, সেটাও তো ভাবতে হবে।
কেউ কেউ বলবেন, আবেগ দিয়ে জীবন চলে না, বাস্তব দিয়ে চলে। বাস্তবের মাটিতে পা রেখেই সবকিছু ভাবতে হয়। তাহলে তো মানুষ আর যন্ত্রমানবের মধ্যে কোনও তফাত থাকে না। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হল, মন আর মস্তিষ্কের মধ্যে নিরন্তর লড়াই। আর এটাও সত্যি যে, প্রতিটি মানুষের আলাদা আলাদা বৃত্ত থাকে। কেউ সেই বৃত্তের বাইরে যেতে পারে না। কিন্তু সেই বৃত্ত কতটা বড় হবে, তাতে ক’জনের ঠাঁই হবে, কত বিন্দু জুড়ে সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে, তা নিজেদেরই ঠিক করে নিতে হয়। কেউ হয়তো চোখের আড়াল হলে মনের আড়ালে চলে যায়। আবার কেউ ‘নয়ন সমুখে না থাকলেও নয়নের মাঝখানে ঠাঁই নেয়’। সেই সম্পর্কের বন্ধন তৈরি হয় নানা কারণে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
দক্ষিণ কলকাতার প্যারাডাইস ক্যাফের আড্ডা ছিল সোনার খনি। মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, তাপস সেন, বিজন ভট্টাচার্য, বংশী চন্দ্রগুপ্তের মতো যশস্বী যে আড্ডায় বসবেন, সেখানে যে পরচর্চা-পরনিন্দা হবে না, বলাই বাহুল্য। আড্ডা বসত সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে বসত বঙ্গীয় কলা সংসদের আড্ডা। হেমেন্দ্রকুমার মজুমদারের বিডন স্ট্রিটের বাড়ির আড্ডায় ভিড় জমাতেন বহু চিত্রশিল্পী।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আর কোনও স্বার্থের সম্পর্করহিত যে নিখাদ ভালো লাগার তৃপ্তি, সেটাই তৈরি হত বন্ধুত্বের মাধ্যমে। আড্ডায় বসে। তার নানা ধরন-প্রকরণ।
দক্ষিণ কলকাতার প্যারাডাইস ক্যাফের আড্ডা ছিল সোনার খনি। মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, তাপস সেন, বিজন ভট্টাচার্য, বংশী চন্দ্রগুপ্তের মতো যশস্বী যে আড্ডায় বসবেন, সেখানে যে পরচর্চা-পরনিন্দা হবে না, বলাই বাহুল্য। আড্ডা বসত সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে বসত বঙ্গীয় কলা সংসদের আড্ডা। হেমেন্দ্রকুমার মজুমদারের বিডন স্ট্রিটের বাড়ির আড্ডায় ভিড় জমাতেন বহু চিত্রশিল্পী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে প্রবীণ-নবীন সাহিত্যিকদের আড্ডা জমত। এ রকম সাহিত্য-চলচ্চিত্র-শিল্পভিত্তিক আড্ডা এক সময় কলকাতার আনাচ-কানাচে তৈরি হয়েছিল। কালীঘাট ট্রাম ডিপোর উল্টোদিকে চায়ের দোকানে আড্ডা দিতেন সাগরময় ঘোষ। ধর্মতলায় কার্জন পার্কের সবুজ ঘাসও অনেক আড্ডার সাক্ষী।
কিন্তু তার বাইরেও ছিল শুধু নিখাদ আড্ডা, টাইম পাস। যার ছিল না কোনও নির্দিষ্ট আঙ্গিক। সিনেমা-খেলা থেকে শুরু করে চিত্রতারকাদের অন্দরমহল, ব্যক্তিগত জীবনযাপন নিয়ে কেচ্ছা, সিপিএম-কংগ্রেস, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল থেকে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান, উত্তম-সৌমিত্র থেকে পাড়ার উঠতি সুন্দরী, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন থেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী, আদি রসাত্মক গল্প– বিশেষজ্ঞের কোনও অভাব ছিল না। তার সঙ্গে বাড়তি পাওনা– পরস্পরের সঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকা। এখনকার মতো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো নয়। যৌথ পরিবারের যে রূপ ছিল স্বাভাবিক, তারই ছোট সংস্করণ তৈরি হত এই সমস্ত আড্ডায়। পরস্পরের বিপদে-আপদে খবর পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিকতা ছিল। ছিল স্বস্তির আশ্বাস। বন্ধুর বাড়ির অনুষ্ঠানে কোমরে গামছা বেঁধে পরিবেশন, অসুস্থ আত্মীয়ের জন্য হাসপাতালে রাত জাগা, মৃত প্রতিবেশীর দেহ নিয়ে শ্মশানযাত্রা ছিল অবশ্য কর্তব্য। তাতে দেহের ক্লান্তি ছিল, মনের শ্রান্তি ছিল না।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন সুতীর্থ চক্রবর্তীর লেখা: ভারতীয় রাজনীতিতে ‘রাহুল-যুগ’ কি আর শুধুই অলীক কল্পনা?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এই সমস্ত আড্ডা, গল্প নিজেদের আরও জীবনের সঙ্গে জুড়ে দেয়, তা আমরা হারিয়েছি। অর্থ উপার্জনের প্রয়োজনীয়তা আগেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু তার বাইরে ‘জীবন’ বলেও একটা ব্যাপার ছিল। তা তৈরি হত এই ধরনের আড্ডার আসরে, গল্প-গুজবের ফাঁকে, সম্পর্কের নানা পরতে। তার মূল্য অনেক। আর এখন! দু’-চারজন একসঙ্গে হলেও মনোযোগ পড়ে থাকে হাতের স্মার্টফোনে। এখন আড্ডা হয় ‘গুগল মিট’-এ! আড্ডা জমাতে মাঝেমধ্যে এলাহি আয়োজন করে বিভিন্ন মাল্টিপ্লেক্স, কফি শপ। যেখানে হাতি-ঘোড়া-রাজা-উজির মেরে সময় কাটানোর চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায় পে-প্যাকেজ, ফরেন ট্রিপ, শেয়ার-মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নির হিসেবনিকেশ। একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তির খোঁজে আড্ডা সত্যিই আর হয় না। কর্মব্যস্ত জীবন, ফেসবুক, সোশাল সাইটের চক্করে আড্ডা তার গুরুত্ব, চরিত্র– দুটোই হারিয়েছে।
আড্ডা ছিল বাঙালির ‘চলমান সংস্কৃতি’। এবং এতটাই ছিল তার সর্বজনগ্রাহ্যতা যে, অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির একাদশ সংস্করণে শব্দটি জায়গা করে নেয় ২০০৪ সালে। শঙ্কা জাগে, হয়তো একসময় শুধু অভিধানেই এর উল্লেখ থাকবে। নতুন প্রজন্ম ‘মিট’ করবে, আর ‘আড্ডা’ মারবে না।
……………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………….