ইতালির গ্রামে কফি-বিক্রি করা ছিল তাঁর নিত্যদিনের কাজ। সেখান থেকে আজ ইউরো কাপে স্লোভাকিয়ার ডাগআউটে কোচের ভূমিকায়। এখানেই শেষ নয়। শুরুতেই চমক। ইউরো অভিযানের প্রথম ম্যাচেই শক্তিশালী বেলজিয়ামকে হারিয়ে চমকে দিয়েছে তাঁর প্রশিক্ষণাধীন স্লোভাকিয়া। সেই ফ্র্যান্সিসকো ক্যালজোনার জীবনটাও কম চমকপ্রদ নয়।
ক্যালাব্রিয়া। দক্ষিণ ইতালির জন্নত-এ-ফিরদৌস বলা চলে জায়গাটাকে। পাহাড় আর সমুদ্র ছুঁয়ে আছে একে-অপরকে। রোম কিংবা মিলানের মতো প্রাসাদোপম বাড়িতে সাজানো নয়, বরং ছবির মতো জায়গা এই ক্যালাব্রিয়া।
পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট গ্রাম। আরও নয়নাভিরাম। নয়ের দশকের কথা। সেখানেই কফি বিক্রি করে ফ্র্যাঙ্কো। উদয়-অস্ত পরিশ্রম। খাটনির কাজ। আয়ও যে খুব বেশি হয়, তা নয়। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কো নিরুপায়। ওটুকু না করলে পেট চলবে কী করে! তবে কফি বেচে মন ভরে না ফ্র্যাঙ্কোর। মন ভরে ফুটবল খেলে। হ্যাঁ, ফুটবল। ইতালি আর ফুটবল তো সমার্থক। ইতালীয় ফুটবল দর্শনকে কুর্নিশ করে না ইউরোপে এমন দেশ আছে নাকি! ফ্র্যাঙ্কোর জানা নেই।
বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছিল ফ্র্যাঙ্কোর। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবে যে মস্ত ফারাক, ফ্র্যাঙ্কোর চেয়ে তা ভালো আর কে জানে! নেপলস, তুরিন, মিলান– শহর ঘুরে কত ক্লাবেই না ট্রায়াল দিল, কিন্তু ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল কই!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কীভাবে আয়ের সঙ্গে সঞ্চয়টাও বাড়ানো যায় তাই নেপলসের ব্যাঙ্কার-বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছিল ফ্র্যাঙ্কো। কিন্তু এ লোক ব্যাঙ্কার কেন হল কে জানে! সর্বক্ষণ ফুটবল আর ফুটবল করে মাথা খাচ্ছে। ব্যবসা নিয়ে কম, ফুটবল নিয়েই তাঁদের আলোচনা বেশি চলে। কোচ হলে এই লোকটার হওয়া উচিত। মনে মনে ভাবে ফ্র্যাঙ্কো।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অগত্যা কফি বেচাকেনা! তাই সই। তবে ফুটবলের পাট পুরোপুরি চুকিয়ে দেয়নি ফ্র্যাঙ্কো। কফি-ডিলার সে। ব্যবসাটা ধরে রাখতে হবে। সারাদিন ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়, ফুরসত খুব একটা মেলে না। কিন্তু সূর্যটা বিকেল ছুঁলেই মনটা আনচান করে ওঠে ফ্র্যাঙ্কোর। তখন ফুটবলে পা না ছোঁয়ালেই নয়। তাই পেশার সঙ্গে নেশাটাও আছে বহাল-তবিয়তে। ইতালিয়ান আমেচার ফুটবল। পায়াভারী নাম। আসলে ফুটবলের মাধ্যমে অপেশাদারের আনন্দ অর্জন। সেটা করেই দিলখুশ ফ্র্যাঙ্কোর।
এরই মধ্যে জুটল চাকরির প্রস্তাব। প্লেয়ার-কাম ম্যানেজার লাগবে। ক্যালাব্রিয়ার তুসকানের ক্লাব তোগেলিতো পারফরম্যান্স তথৈবচ। কোচ তাড়ানো হয়েছে একপ্রকার বাধ্য হয়ে। তাদের নতুন কোচ চাই। সঙ্গে চাই একজন অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার। দলটাকে যে পিছন থেকে নেতৃত্ব দেবে। বন্যার মতো গোল খাচ্ছে টিমটা। রোগটা তো ডিফেন্সে, বুঝছেন ঝানু ক্লাব অফিশিয়ালরা। সব ভেবেই ফ্র্যাঙ্কোকে প্রস্তাবকে দেওয়া হয়েছে। এক ঢিলে দুই পাখি মারা গেলে ভালোই হয়।
ফ্র্যাঙ্কো? সে কি রাজি? উহু, মনটা তাঁর উশখুশ করছে। কোচিংয়ে আসার ইচ্ছা তাঁর আছে। কিন্তু এখনই নয়। আরেকটু পর। তাঁর ইচ্ছা তোগেলিতোর ডিফেন্সে পাহাড় হওয়ার। সাপোর্টারদের নয়নের মণি হয়ে বেঁচে থাকবে বছরের পর বছর, কেরিয়ারের সায়াহ্নে এর চেয়ে বড় পাওনা আর কী হতে পারে।
চোখে ঘোর, মনে প্রশ্ন। এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লে ফ্র্যাঙ্কো শরণাপন্ন হয় একজনেরই। বন্ধু। নেপলসের মানুষ। পেশায় ব্যাঙ্কার। আলাপটা করিয়ে দিয়েছিল ফ্র্যাঙ্কোর আরেক বন্ধু, ওই ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে। আসলে বয়স বাড়ছে, সঞ্চয় বাড়াতে হবে। সেসব ভেবেই, কীভাবে আয়ের সঙ্গে সঞ্চয়টাও বাড়ানো যায় তাই নেপলসের ব্যাঙ্কার-বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছিল ফ্র্যাঙ্কো। কিন্তু এ লোক ব্যাঙ্কার কেন হল কে জানে! সর্বক্ষণ ফুটবল আর ফুটবল করে মাথা খাচ্ছে। ব্যবসা নিয়ে কম, ফুটবল নিয়েই তাঁদের আলোচনা বেশি চলে। কোচ হলে এই লোকটার হওয়া উচিত। মনে মনে ভাবে ফ্র্যাঙ্কো।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন রোদ্দুর মিত্র-র লেখা: ফি-বৃদ্ধি চাইছেন না এরিকসেনরা, চাইছেন মহিলা দলের ‘ইকুয়াল পে’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। কিন্তু সে কাজেও বিস্তর ঝামেলা। ফ্র্যাঙ্কোর ব্যাঙ্কার বন্ধু খ্যাপাটে টাইপের। কিন্তু এতটা, জানা ছিল না ফ্র্যাঙ্কোর। কোচ হতে না হতেই নতুন ফ্যাকরা তুলেছে। তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে হবে ফ্র্যাঙ্কোকে। তাহলেই সে কোচ থাকবে, নয়তো না। ফ্র্যাঙ্কো মহাফাঁপড়ে। কোচের সহকারী মানে, তাঁকেও কোচিং নিয়ে ভাবতে হবে, নিজের খেলার স্বপ্ন লাটে উঠবে।
তাই হল শেষমেশ। ব্যাঙ্কার-বন্ধুর সহকারী হিসেবেই ফ্র্যাঙ্কো যোগ দিল তোগেলিতোয়। সোনা ফলল সেই জুটির হাত ধরে। তোগেলিতোর পর পেরুগিয়া, আলেসান্দ্রিয়া, সোরেনতো, এম্পোলি। ছবিটা সর্বত্র কমবেশি এক। সোনালি সাফল্যের হাত ধরে এল সেই দামি মুহূর্ত। ফুটবলার জীবন যা তাঁকে দিতে পারেনি, কোচের সত্তা তাই উপহার দিল। নাপোলিতে কোচিং-এর ডাক।
মারাদোনার ক্লাব। ফুটবল বরপুত্রের ঘ্রাণ যেখানে ছড়িয়ে রয়েছে আকাশে-বাতাসে। নাপোলির কোচের পদে তাঁর ব্যাঙ্কার-বন্ধু, আর ফ্র্যাঙ্কো? সহকারী। ততদিনে ফুটবল দর্শনের আঁতুড়ঘর ইতালিতে সাড়া ফেলে দিয়েছে তাঁদের ফুটবল-ট্যাকটিক্স, বিশ্বফুটবল যাকে ‘সারি-বল’ নামে চেনে। কোচ মৌরোসিও সারি, ফ্র্যাঙ্কোর সেই ব্যাঙ্কার-বন্ধু। তাঁর নামেই তৈরি ‘সারি-বল’ ফুল ফোটাল নাপোলিতে।
ওই নাপোলিতেই ফ্র্যাঙ্কোর সঙ্গে পরিচয় এক ফুটবলারের। মারেক হামসিক। ছিপছিপে। স্টাইলিশ। মাঝমাঠের প্রাণভ্রোমরা। ইতালীয় না হয়েও ‘সারি-বল’ প্রধান শর্ত যা, অর্থাৎ ফ্লেক্সিবিলিটি, তার সঙ্গে দারুণ মানিয়ে নিয়েছে ছেলেটা। পারফেক্ট চয়েস। ক্রমেই ফ্র্যাঙ্কোর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা দাঁড়াল বাবা-ছেলের। বছর দুয়েক আগে সেই হামসিকের কাছ থেকে এল প্রস্তাবটা, জাতীয় দলের কোচ হওয়ার। হেড কোচ, হেড কোচের সহকারী নয়।
এবার আর দোনামনা নয়। এক কথায় রাজি হল ফ্র্যাঙ্কোর মন। ‘ভয় পেলে চলবে না। প্রতিপক্ষ যতই শক্তিশালী হোক, গোল খাওয়ার ভয় মনে ঢুকে গেলে কখনও জেতা যায় না। তাই মন খুলে খেল। ভয় পেও না।’ প্রথমদিন ড্রেসিংরুমে ফ্র্যাঙ্কোর কথাগুলো প্লেয়াররা শুষে নিল অন্তর থেকে। নিটফল? ইউরো কাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে সাতটা জয়, একটা ড্র, দুটো হার। সে হার দুটো একই প্রতিপক্ষর বিরুদ্ধে, পর্তুগাল। অবশেষে ইউরোর দরজা খুলল ফ্র্যাঙ্কোর ছেলেরা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়-এর লেখা: অবিনশ্বর হয়ে থেকে যাবে ফুটবলের প্রতি ‘ওল্ড ম্যান’-এর প্রেম
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
১৭ জুন, ২০২৪। ফ্র্যাঙ্কফুর্ট। ইউরো অভিযানে প্রথম ম্যাচ। প্রতিপক্ষ বিশ্বের তিন নম্বর বেলজিয়াম। কেভিন ডি’ব্রুয়েন, রোমেলু লুকাকু, লিওনার্ডো ত্রোসার্ডের বেলজিয়াম। ধারেভারে তো বটেই ফিফা ক্রমতালিকাতেও প্রতিপক্ষের সঙ্গে ফারাক আকাশজমিন। হলেই বা। তাদের ডাগআউটে যে একটা ফ্র্যাঙ্কো আছে। যার দু’চোখে শুধু জয়ের স্বপ্ন। সেটাই স্বপ্ন সত্যি হয়ে ফুটল স্টেডিয়ামে। ৯০ মিনিট শেষে গ্যালারি আবিষ্কার করল বেলজিয়াম হেরে গিয়েছে। হেরে গিয়েছে ফ্র্যাঙ্কোর ছেলেদের কাছে, ০-১ গোলে। এবার ইউরোর প্রথম অঘটন। জয়ী প্লেয়াররা ছুটে যাচ্ছেন গ্যালারির দিকে। উদ্বেলিত সমর্থকরা আনন্দে জড়িয়ে ধরছেন একে অপরকে, কাঁদছেন। সে-এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
ডাগআউটের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন ফ্র্যাঙ্কো। মুখে একচিলতে হাসি। মনে কি পড়েছিল তখন ‘ব্যাঙ্কার-বন্ধু’ মৌরোসিও সারিকে। নাকি মনে পড়ছিল কালাব্রিয়াকে? ছবির মতো যে কালাব্রিয়া বুকে করে রেখেছে তাঁর ‘না হয়ে ওঠার’ ব্যথাবেদনা। কে জানে!
ও হো! এত কথায় ফ্র্যাঙ্কোর পুরো নামটাই যে বলা হয়নি। আসুন আলাপ করিয়ে দিই–
ফ্র্যান্সিসকো ক্যালজোনা।
ইউরোয় বেলজিয়াম-ঘাতক স্লোভাকিয়ার হেড কোচ!