প্রাতরাশ করার পর, কোনও কোনও দিন রাত ২-৩টে পর্যন্ত একটানা লিখতেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ১২৫তম জন্মবর্ষকে উপলক্ষ করে প্রকাশিত হয়েছে ৪০০ পাতার ‘হাঁসুলি’ পত্রিকা।
সাহিত্যের অন্তঃকরণে একটি সুবাতাস থাকে, যা জীবনস্রোতে খেলে যায় আপনাআপনি। পাঠকের সঙ্গে বিনিময় হয় অনেক কিছুই। কিছু চেনা, কিছু অচেনা আত্মবোধ জাগরিত হয়। আর এভাবেই ঘটে যায় দুই প্রান্তের পরিবর্তন। নিগড়ের মতো আসীন হয় অন্তঃসার। সম্প্রতি রাঢ়বঙ্গের দুর্গাপুর থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘হাঁসুলি’ পত্রিকা। হ্যাঁ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধায়ের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ থেকেই এই পত্রিকার নামকরণ। কথাসাহিত্যিকের ১২৫ তম জন্মবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘও জানানো হয়েছে এই পত্রিকার মাধমে। আর এই পত্রিকার সম্পাদক খোদ পৌত্র সৌম্যশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। একটি স্মৃতিকথাও রয়েছে তাঁর। তারাশঙ্করের জীবনচর্চার খানিকটা অবলোকন করবেন পাঠক। তিনি লিখেছেন, ‘তারাশঙ্করের দিন শুরু হত উষালগ্নে। সূর্য উদয়ের পূর্বে শয্যা তাগ করে প্রাতঃকৃত সম্পন্ন করে তিনি এসে তিনি বসতেন লেখার আসনে।… ডায়ারি লিখতেন।… ডায়ারি লেখা শেষ হলে তিনি বসতেন চা আসরে।… সাড়ে আটটা নাগাদ সামান কিছু প্রাতরাশ করে বসতেন লেখার আসনে। এখন থেকে উনি টানা লিখে চলতেন। কখনও বারোটা-সাড়ে বারোটা, এমনকী দুটো-তিনটে পর্যন্ত তাঁকে লিখতে দেখেছি।’
তারাশঙ্করের সাহিত্য নিয়েও একটি প্রবন্ধ লিখেছেন রিমি মুৎসুদ্দি। লোককথায় গাঁথা মহাকাব্য তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। রিমি লিখেছেন, ‘অনার্য সংস্কৃতির সংস্কার ও লোককথাকে তিনি কুসংস্কার বলেননি। বরং তাঁর দৃপ্ত ঘোষণা, আর্যদের আখান যেমন পুরাণ ও মহাকাব্যে স্থান পেয়েছে, অনার্যদের লোককাহিনিও তেমনই এক মহাকাব্যই।’ বিকশ এস. জয়নাবাদ লিখেছেন ধর্মমঙ্গলের কয়েকজন কবি ও সমাজ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ। ধর্মমঙ্গলকাব্য নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। যদুনাথ থেকে সীতারাম দাস, ঘনরাম চক্রবর্তী, রূপরাম চক্রবর্তী প্রমুখ কবির অজানা তথ্য উঠে এসেছে।
একাধিক প্রবন্ধ, গল্প-কবিতার সম্ভার নিয়ে সমৃদ্ধ ‘হাঁসুলি’। রাঢের ভাদু ও টুসুগান নিয়ে গবেষণাভিত্তিক প্রবন্ধ লিখেছেন নন্দদুলাল আচার্য। চারশো পাতার সুসম্পাদিত পত্রিকা। প্রতিটি পাতায় যত্নের ছাপ স্পষ্ট। গল্প লিখেছেন উল্লাস মল্লিক, বিপুল দাস, অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য, হামিরউদ্দিন মিদ্দ্যা, সুকুমার রুজ, উৎপল মান, বীরেন শাসমল, অশোক তাঁতী প্রমুখ। অনুগল্প লিখেছেন রবিন বন্দ্যোপাধ্যায়। কবিতা বিভাগও সমুজ্জ্বল। লিখেছেন দেবারতি মিত্র, মৃদুল দাশগুপ্ত, শামলকান্তি দাশ, বিশ্বদেব মুখোপাধায়, বিকাশ নায়ক, নিবেদিতা আচার্য, রুমা তপাদার-সহ আরও অনেকে। প্রায় সকলের কবিতা ছুঁয়ে যাবে পাঠককে। সংগ্রহে রাখার মতো এই ‘হাঁসুলি’ পত্রিকা।
হাঁসুলী
সম্পাদক সৌম্যশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
পরম্পরা। মূল্য ৪০০
মানুষ চিরদিন নিজের মধ্যেই দ্বিখণ্ডিত। একদিকে শেষ সমস্ত প্রকৃতিকে হারিয়ে দিয়ে যেন নিজের চিরস্থায়ী বৈভবে প্রকাশিত। অন্যদিকে, সেই মানুষই মাটির কয়েক ফুট নিচে অন্ধকারে অন্ধভাবে ফিরে যাচ্ছে তার শেষ মূক আশ্রয়ে, যেখানে সে পচতে পচতে একদিন স্রেফ উবে যাবে। তাহলে অনন্ত বলে কিছু নেই? সবাই মৃত্যু পথের যাত্রী?