পুজোর ছুটির পর স্কুল খুললে টিফিন টাইমে বন্ধুদের নিজেদের প্রেমজীবন নিয়ে অল্প কমিয়ে খানিকটা বাড়িয়ে গল্পই যদি না শোনাতে পারি, তাহলে তো এ জীবন ব্যর্থ। সুতরাং পুজোতে প্রেম মাস্ট। আমার আবার সবেতেই একটু বাড়াবাড়ি। শুধু যে একটা কিশোরী প্রেম হল তা নয়, প্রথম চুমুর ছোঁয়াও পেলাম।
৩.
পুজোর সময় হাতখরচ বাবদ বরাদ্দ ছিল ২৫ টাকা। প্রতিদিন পাঁচ টাকা করে। নানারকম ফন্দিফিকির করতাম এই টাকাটা যেন কোনওভাবেই খরচা না হয়। তাও ক্যাপ বন্দুক কেনা, সপ্তমীর সন্ধেবেলায় হার্ট শেপ বেলুন, টুইনওয়ান আইসক্রিম– এসব শখ মেটাতে মেটাতে দশ টাকা খরচা হয়েই যেত। কথায় বলে, শখের দাম লাখ টাকা। আমি না হয় লাখ টাকার সমান আমার দশ টাকাই খরচা করলাম সারা পুজোতে। বন্ধুদের মুখে মুখে তখন ঘুরছে ভ্যালেন্টাইনস ডে, ফ্রেন্ডশিপ ডে-র কথা– ১৪ ফেব্রুয়ারি, এমটিভি, আর্চিজ গ্যালারি, টাইটানিকের জ্যাক-রোজের আদর– সব এসে মিশে গেছে আমাদের লাল রঙের একতলার বাড়ির সরু গলির মধ্যে। আর্চিজের কার্ডের অনেক দাম, আর আমার স্কুলব্যাগে তখন ১৫ টাকা। তার মধ্যেই কার্ড, গোলাপ ফুল, ডেয়ারি মিল্ক দিতে হবে– এত সহজ হিসেব ভালবাসায় আর কোনও দিনও করে উঠতে পারলাম না। সবকিছু গুছিয়ে স্কুলব্যাগে লুকিয়ে লাইব্রেরি যাওয়ার নাম করে, সারাদিনের অপেক্ষার পর ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোর নিচে তার হাতে দিলাম আমার কিশোরী মনের রোমাঞ্চ।
আজও ঠান্ডা ঘরে বসে নিজেকে মাঝে মাঝে ল্যাম্পপোস্টের নিচে দেখতে পাই, শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে রাস্তার সাদা ফ্যাটফেটে আলোটা ঘরে এসে ঢোকে। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো কমে আসছে আস্তে আস্তে শহরে।
পুজো পাঁচদিনের, কিন্তু ‘পুজো আসছে’-র আনন্দ দীর্ঘ। আমার পুজোতে কোনও দিনও অনেক জামাকাপড় হত না। বাবা যে দুটো জামা কিনে দিত, তাই ছিল আমার পরম যত্নের ধন। সবকিছুই কম কম ছিল বলে যত্নআত্তি ছিল বেশি। সিক্স থেকে সেভেনে উঠব সেই বছর। ক্লাসে প্রায় সবাই টুকটাক প্রেম করছে। অবশ্য ‘টুকটাক’ শব্দটা একেবারেই ঠিক নয় এক্ষেত্রে, কারণ আমার সব বন্ধুরাই প্রায় একপ্রকার স্থির করে ফেলেছে যার সঙ্গে প্রেম, তাকেই বিয়ে করতে হবে, থাকতে হবে সারাজীবন ভালবাসায়। ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’-র রাহুলের বিখ্যাত ডায়লগ তখন সবার মুখে মুখে– ‘হাম একবার জিতে হ্যায়, একবার মারতে হ্যায়, শাদি ভি একবারই হোতি হ্যায় অর পেয়ার ভি একবার হোতা হ্যায়’। শাহরুখকে অমান্য করব এমন সাধ্য আমাদের কারও ছিল না। পুজোর ছুটির পর স্কুল খুললে টিফিন টাইমে বন্ধুদের নিজেদের প্রেমজীবন নিয়ে অল্প কমিয়ে খানিকটা বাড়িয়ে গল্পই যদি না শোনাতে পারি, তাহলে তো এ জীবন ব্যর্থ। সুতরাং পুজোতে প্রেম মাস্ট। আমার আবার সবেতেই একটু বাড়াবাড়ি। শুধু যে একটা কিশোরী প্রেম হল তা নয়, প্রথম চুমুর ছোঁয়াও পেলাম। প্রথম শুনলাম এবং শিখলামও স্মুচ কাকে বলে। টিফিনের একটাকা বাঁচিয়ে রেখে স্কুল ছুটির পর ল্যান্ডলাইনে ফোন। প্রেমের কোটেশন সংগ্রহ করে নির্ভুল বানানে প্রেমপত্র লেখার যে চাপ, যে অধ্যাবসায়– মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগেও সেই চাপ টের পাইনি কখনও।
একবার দোলে আমার বাড়ির সামনে এসেছিল আবির মাখাবে বলে। দাঁড়িয়েছিল বাড়ির সামনে বন্ধুদের নিয়ে, বাবা কিছুতেই বেরতে দিল না। এখনও পাড়ায় মাঝেমধ্যে গেলে মাঠের পিছনে দোতলা বাড়িটার দিকে চোখ চলে যায় অভ্যাসবশত। এখন আর কেউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে না, এখন আর কেউ আমার সঙ্গে একবার দেখা করবে বলে পাশের গলিতে অপেক্ষা করে না। স্কুল ড্রেসটাও তো ছোট হয়ে গেছে কোনও পুরনো কাপড়ের বস্তার মধ্যে। আমায় একবার একটা গ্রিটিংস কার্ড দিয়েছিল– দুটো সাদা রাজহাঁস জলের মধ্যে আর আকাশে ঘন কালো মেঘ। লিখেছিল– ‘তোকে শুধু আমি’।
ফেসবুকে খুঁজে পেয়ে গেলাম সহজেই, প্রথম প্রেমপত্র লেখার মতো অত বেগ পেতে হল না। প্রোফাইলটা অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখলাম। অজান্তেই খানিকটা বিয়োগ করলাম, যোগ করা হয়ে উঠল না। আবির লাগানোর অপেক্ষা এখনও আছে, শুধু অন্য কারও জন্য।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডেয়ারি মিল্কের স্বাদ কি বিস্বাদ লাগে? কোন গিফট প্রেমকে চিরন্তন করতে পারে? কতগুলো এক টাকার কয়েন জমা করলে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলা যায়, লাইন কাটে না? কতটা শুধু আমি হলে আমরা হব? প্রশ্নগুলো সহজ নয় আর উত্তরগুলো…। তাই শাহরুখের ভাষায় ‘প্যায়ার দোস্তি হ্যায়’।