যুদ্ধ আর দারিদ্র্যময় এক অনিকেত জীবন। সেই ভ্রান্তিময় ছিন্নমূল জীবনে মডরিচকে দু’দণ্ডের শান্তি দিয়ে ছিল ফুটবল। সেটাও জীবনের মতো অনিশ্চয়তায় মোড়া। শেষ বাঁশি বাজা না-অবধি কে হাসবে, আর কে কাঁদবে– বোঝা কঠিন। কল্পতরু হয়ে ফুটবল ক্রোয়েশিয়ানকে যেমন দু’হাত উপুড় করে দিয়েছে, তা নয়। বদলে নিয়েছেও প্রচুর। সেই ছিনিয়ে নেওয়া মুহূর্তগুলো বড় নিষ্ঠুর। বড় করুণ। ঠিক সোমবার রাতের মতো।
স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নিষ্ঠুরের সংজ্ঞা এক এক রকম। ছোটবেলায় নিষ্ঠুর বলতে যাঁর মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে এখনও, তিনি আমাদের ইশকুলের পরমপূজ্য ভূগোলের মাস্টার। ক্লাসরুম হোক কিংবা ক্লাসের বাইরে– সর্বত্র বিরাজ করত তাঁর গমগমে গলা। আর বিরাজমান ছিল তাঁর হাতের বেত! সেটাও কথা বলত, একটু অন্য উপায়ে। সেই ‘বেত্রসংহার’-এর স্বাদ ইহজন্মে যে অভাগারা লাভ করেছে, তারা জানে নিষ্ঠুর কাহাকে বলে! কে জানে, হয়তো মাস্টারমশাইয়ের বেতের নামা-ওঠা আর দুর্বিনীত এই আমাদের প্রবল আর্তনাদেই বেঁকে গিয়েছিল পৃথিবীর দ্রাঘিমারেখাগুলো। কিংবা চোখ থেকে ঝরে পড়া অভিশাপেই জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর এই আজকের ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’-এর।
শুধু মাস্টার নয়, নিষ্ঠুর মনে হত সেই বন্ধুদেরও, যারা কথা দিয়েও ভরসন্ধে ব্যাটিং বকেয়া রেখে ‘কেটে’ পড়ত অনায়াসে। সেই নিষ্ঠুর চরিত্রে আমি নিজেও অভিনয় করে দেখেছি কখনও-সখনও, মন্দ লাগত না। পরে দেখলাম, নিষ্ঠুর কেবল মাস্টার আর বন্ধু নয়। আমার ঘরের লোকও। বেছে বেছে বিকেলে খেলার মহার্ঘ সময়টাকেই তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন আমার টিউশন স্যরের আসার আদর্শ মুহূর্ত হিসেবে। নিষ্ঠুর মনে হত বাবাকেও! কোনও এক সকালে ঘুম ভেঙে যখন উঠে দেখতাম, না-বলেই ফাদার-ফিগার চলে গিয়েছে অফিসের কাজে, আমায় এক হপ্তার অপেক্ষায় বেঁধে।
আরও একটু বড়বেলায় বুঝতে শিখলাম, নিষ্ঠুর আসলে রক্তবীজের বংশধর, ইতিউতি সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কোচিং ক্লাসের একঘেয়ে নোট তখন নিষ্ঠুর, একজোড়া নরম চোখের হাজিরায়। আত্মীয়-পরিজনের রাশভারী পরামর্শ নিষ্ঠুর, আমার বেপরোয়া স্বপ্নসন্ধানী মনে। নিষ্ঠুর সেই ইউনিয়নের দাদা, যাঁর নির্দেশ মেনে থেকে যেতে হয়েছিল প্রতিবাদ সমাবেশে, মানি স্কোয়ারে ‘প্রতিক্ষারতা’-কে অপেক্ষায় রেখে। নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল মৃত্যুকে, প্রথম বিয়োগযন্ত্রণার অভিঘাতে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সোমবার রেড বুল এরিনায় ৫৪ মিনিটে, মডরিচের পেনাল্টি-কিক ইতালীয় গোলরক্ষক ডোনারুম্মার গ্লাভস ছুঁয়ে বাইরে ছিটকে যেতে মনে হয়ছিল, বরাবরের মতো মডরিচের ভাগ্য নিষ্ঠুর পরিহাস করছে তাঁর সঙ্গে। তারপর এক মিনিট! স্রেফ এক মিনিটের ব্যবধানে সেই আশঙ্কাকে মুছে ফেলেছিলেন ক্রোট-অধিনায়ক, দুরন্ত গোলে। কিন্তু কে জানত, ফুটবলবিধাতা আরও নিষ্ঠুর হবেন তাঁর ওপর।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আসলে বয়সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিষ্ঠুরের পাল্লা বাড়ে, ডেসিবেল চড়িয়ে। সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিল চাকরি জীবনের সহজপাঠ। টার্গেট মানে লক্ষ্যভেদ নয়, ‘মালিক’-এর লক্ষ্মীলাভ– বুঝেছিলাম সেই রঙ্গমঞ্চেই। আর সেটা ‘ফুলফিল’ না হলে ‘বস’ নামক প্রজাতি কতটা নিষ্ঠুর হয়, বুঝেছিল বনগাঁ লোকালে ঝুলে আসা এ-জীবন। চাকরি বদল করেও দেখেছি, সেই নিষ্ঠুরের ভূত পিছু ছাড়েনি আমার। কখনও বোনাসের অঙ্কে থাবা বসিয়েছে। কখনও নতুন বছরে মাইনে বাড়ানোর স্বপ্নে। ঠিক আমার মতো, সেই নিষ্ঠুরের প্রেত কি দেখতে পেয়েছিলেন লুকা মডরিচ, লেইপজিগের দর্শকঠাসা রেড বুল এরিনায়, সোমবার রাতে? নিষ্ঠুরের দেহধারী হয়ে কি তাঁর সামনে দেখা দিয়েছিলেন মাতিয়া জ্যাকাজিনি? ঠিক যেমন কাতার বিশ্বকাপে দেখা দিয়েছিলেন লিওনেল মেসি? কিংবা ২০১৮-র বিশ্বকাপ ফাইনালে কিলিয়ান এমবাপে? ডাগআউটের কোণায় আলো-আঁধারি মাখা মডরিচের শক্ত চোয়াল হয়তো সেই সময় পড়ে নিচ্ছিল তাঁর নিষ্ঠুর ভাগ্যকে। এই ঠিক আমাদের মতো ‘ঘরপোড়া’ জীবের মতো।
যুদ্ধ আর দারিদ্রময় এক অনিকেত জীবন। সেই ভ্রান্তিময় ছিন্নমূল জীবনে মডরিচকে দু’দণ্ডের শান্তি দিয়ে ছিল ফুটবল। সেটাও জীবনের মতো অনিশ্চয়তায় মোড়া। শেষ বাঁশি বাজা না-অবধি কে হাসবে, আর কে কাঁদবে– বোঝা কঠিন। কল্পতরু হয়ে ফুটবল ক্রোয়েশিয়ানকে যেমন দু’হাত উপুড় করে দিয়েছে, তা নয়। বদলে নিয়েছেও প্রচুর। সেই ছিনিয়ে নেওয়া মুহূর্তগুলো বড় নিষ্ঠুর। বড় করুণ। ঠিক সোমবার রাতের মতো।
বিশ্বফুটবলে মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো যুগে দাঁড়ি টেনে ব্যালন ডি’অর জয় করেছিলেন মডরিচ। দেশের জার্সিতে তাঁর নিরলস পরিশ্রম, ক্লাবফুটবলে অতিমানবীয় পারফরম্যান্স তাঁকে এনে দিয়েছিল সেই শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। কিন্তু দেশের জার্সিতে সাফল্যের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছেন আজন্ম, তা অধরাই থেকে গেল ক্রোট-যোদ্ধার। কী বলবেন একে? নিষ্ঠুর নিয়তি নয়! সোমবার রেড বুল এরিনায় ৫৪ মিনিটে, মডরিচের পেনাল্টি-কিক ইতালীয় গোলরক্ষক ডোনারুম্মার গ্লাভস ছুঁয়ে বাইরে ছিটকে যেতে মনে হয়ছিল, বরাবরের মতো মডরিচের ভাগ্য নিষ্ঠুর পরিহাস করছে তাঁর সঙ্গে। তারপর এক মিনিট! স্রেফ এক মিনিটের ব্যবধানে সেই আশঙ্কাকে মুছে ফেলেছিলেন ক্রোট-অধিনায়ক, দুরন্ত গোলে। কিন্তু কে জানত, ফুটবলবিধাতা আরও নিষ্ঠুর হবেন তাঁর ওপর। খেলার ৮০ মিনিটে যখন গর্বিত পদক্ষেপে মাঠ থেকে নিষ্ক্রমণ ঘটছে মডরিচের, তখন ক্রোট গ্যালারি জয়ের আগাম উল্লাসে ভাসতে শুরু করেছে। ক্রোয়েশিয়ান সমর্থকরা অনুমান করতে পারেননি ম্যাচের শেষ মুহূর্তে এক হৃদয়বিদারক গোলের যন্ত্রণা নিয়ে উদয় ঘটবে জ্যাকাজিনির। যাঁর গোলটা কার্যত নিষ্ক্রমণের দখিন-দুয়ার দেখিয়ে দেবে ক্রোয়েশিয়াকে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন প্রবুদ্ধ ঘোষ-এর লেখা: ক্রুজ-পেপেরা জার্সিকে ভালোবেসে কী কাণ্ডটাই না করছেন
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মার্কিন মুলুকে বিশ্বকাপ শুরু হতে এখনও বছর দুই দেরি। ততদিনে মডরিচ ছুঁয়ে ফেলবেন চল্লিশের গণ্ডি। ফলে সেই মঞ্চে কাপ-জয়ের স্বপ্নকে সম্বল করে আদৌ ফিরবেন কি না ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ড-জেনারেল, তা জানা নেই। সোমবার রাতে ম্যাচ শেষে মডরিচের শূন্যতামাখা মুখ, কান্নাভেজা চোখ সে-সব না বলা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল অবিরামভাবেই। মাঠে তখন লুটিয়ে পড়ে কেঁদে চলেছেন মডরিচের সতীর্থরা। একইসঙ্গে ইতালির ফুটবলাররাও! একটা দলের কান্না আসলে আনন্দের, স্বস্তির। অপর দলের সফলতার নিশ্চিত হাতছানি থেকে ব্যর্থতার অতলে তলিয়ে যাওয়ার। মডরিচের শরীরীভাষায় সেই গ্লানি পড়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছিল না অনুরাগীদেরও। আসলে নিষ্ঠুরকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সে আমার-আপনার মতো ছাপোষা মানুষ হোক, কিংবা মডরিচ!
………………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………………
তত্ত্ববিদ, মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার কাজ নিয়েছে মস্কো রেডিয়োতে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ‘মির’ বা ’প্রগতি’তে অনুবাদক হয়েছে, কেউ বা সাংবাদিকতায় পি.এইচ. ডি. ডিগ্রি অর্জন করে সংবাদপত্রের দফতর খুলে তার অন্তরালে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছে।