এখন যে দেশভর লিকি সিচুয়েশন চলছে, তা দেখে বিস্ময় বাঁধ মানছে না। দনাদ্দন প্রশ্নপত্র লিক। নেট লিক, নিট লিক। পরীক্ষার্থী দেখছে, পাশের কম্পিউটারে অটোমেটিক ঠিক উত্তরগুলো টিক পড়ে যাছে। ভুতুড়ে কাণ্ড! লাখ লাখ টাকা গার্জিয়ানরা অসৎ কাজের জন্য দিচ্ছে, যাতে ছেলেমেয়েরা মানুষের মতো মানুষ হতে পারে! মেধাবী ক্লাস আর গাধা বি-ক্লাস এক দর হয়ে যাচ্ছে! আর নগরে আগুন লাগলে দেবালয় কি রক্ষা পায়? ঘটা করে কয়েক মাস আগে উদ্বোধন হল রামমন্দির, মনসুন শুরু হতে না হতেই ছাদ লিক করে জল পড়ছে।
দেব রায়
‘কিন্তু বাঁধ ভাঙি যায় বেগ ভরে।
আপনি শুইলো শিষ্য বাঁধের উপরে।।’
পুরাকালে গুরু তাঁর শিষ্য আরুণিকে আদেশ করেছিলেন, ধানখেতের বাঁধ লিক করে জল বেরিয়ে যাচ্ছে, গিয়ে আটকানোর বন্দোবস্ত করো। শিষ্য গুরু আজ্ঞা পালনে বডি ফেলে দিয়েছিল আক্ষরিক অর্থেই। আর ছিল লখিন্দরের লোহার বাসরঘরে লিক। যা দিয়ে কালনাগিনীর প্রবেশ আর সেই সূত্রে লৌকিক সাবঅল্টার্ন মনসা মেনস্ট্রিমে ঢুকল। লাস্ট সাপারের পরে গেথসেমানি বাগানে শিষ্য জুডাসের চুমু, লিক করে দিয়েছিল যিশুর পরিচয়।
শাইলক অ্যান্টোনিও-র সঙ্গে চুক্তি করেছিল, সময়ে টাকা ফেরত না দিতে পারলে এক পাউন্ড শরীরের মাংস দিতে হবে। কিন্তু চুক্তির মধ্যে লিক ছিল। যাকে বলে আইনের ফাঁক। রক্তের কথা বলা ছিল না। তাই কেস ডিসমিস।
আমাদের শৈশব-কৈশোরের বেড়ে ওঠা ছিল লিক-কণ্টকিত। খেলা বলতে ফুটবল। রংচটা টি-বল নিয়ে ধাঁই ধপাধপ পেটানো। তবে তার আগে ঢের যত্ন থাকত। টি-বল ছিল ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মতো চামড়ার টুকরো জুড়ে ফুটবল। তার ব্লাডার আলাদা ছিল। সেই ব্লাডার বলের মধ্য দিয়ে তাতে সাইকেল সারাইয়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে পাম্প দিয়ে লেসিং কল দিয়ে ফুটবলের মুখ লেস দিয়ে বেঁধে ভেসলিন মাখিয়ে রেডি করতেই অর্ধেক বিকেল কাবার। এবার বলে দুটো লাথি মারতেই বল গিয়ে পড়ল কাঁটা ঝোপে। ব্যস। কাঁটা লাগা কেস। লিক! আবার বল খুলে ব্লাডার বের করো রে। সেই ব্লাডার সাইকেল সারাইয়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে ফুলিয়ে জলে ডুবিয়ে লিক শনাক্ত করো রে। এবার পুরনো ব্লাডারের টুকরো কেটে সলিউশন লাগিয়ে সেই লিক সারাও রে। ততক্ষণে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। বাবা গম্ভীর মুখে ‘রেন অ্যান্ড মার্টিন’ খুলে বসে আছে।
একটু লায়েক হতে ফুটবলের চেয়ে ইশকুলের প্রতি আগ্রহ বাড়ল, মানে স্থানীয় গার্লস স্কুলের প্রতি। টিফিন ও ছুটির সময় গার্লস স্কুলের আসে পাশে থাকাটা অবশ্য কর্তব্য ছিল। তা টেরি বাগিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরব, পিছনের চাকায় পাম্প নেই। আবার সেই সাইকেলের দোকান। সেই টিউব বালতিতে ডুবিয়ে লিক খুঁজে বের করা, সলিউশন দিয়ে লিক সারানো। ততক্ষণে নাইন এ-র পনি টেল, টেন বি-র স্টিল ফ্রেম সব হাওয়া। ওই হাওয়া দিতে গিয়ে।
পরে রাশিয়ান ফুটবল হাতে পেয়ে ভাবলাম আর পায় কে? পাঁচ কোনা খোপ খোপ ঘর কাটা, কেতই আলাদা। ও বাবা, লিক হলে সর্বনাশ! ও সারানো আমাদের কম্ম নয়। জুতো সারাইয়ের দোকানে দিয়ে তিন-চার দিনের ধাক্কা। তখন চুরি করা বাতাবি লেবু দিয়ে বলের স্বাদ ফলে মেটাতাম।
আরেকটা কেলেঙ্কারিয়াস লিক ছিল, পেট রোগা কেউ পেন্টুল হলুদ করে ফেলত। সে বেচারা কাঁচুমাচু মুখে পেন্টুল চেপে বাড়ির দিকে দৌড়ত, আর আমরা সবাই মিলে তাকে তেড়ে দুয়ো দিতাম। সেটা বেশ কিছু দিন চলতে ধরেই চলতে থাকত, যতক্ষণ না আমাদেরই কেউ ওই কম্মোটি ঘটায়। তখন আবার নতুন মুরগি। না, তখন এত শেমিং-টেমিং নিয়ে ধার ধারত না কেউ। এখন দেখি ইংরেজিতে ওটার আবার একটা জোড়কলম স্ল্যাং আছে, Shart, ওর চেয়ে আমাদের অমল শৈশবের ‘পাছা গলানো’ অনেক ভালো।
একটু লায়েক হতে ফুটবলের চেয়ে ইশকুলের প্রতি আগ্রহ বাড়ল, মানে স্থানীয় গার্লস স্কুলের প্রতি। টিফিন ও ছুটির সময় গার্লস স্কুলের আসে পাশে থাকাটা অবশ্য কর্তব্য ছিল। তা টেরি বাগিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরব, পিছনের চাকায় পাম্প নেই। আবার সেই সাইকেলের দোকান। সেই টিউব বালতিতে ডুবিয়ে লিক খুঁজে বের করা, সলিউশন দিয়ে লিক সারানো। ততক্ষণে নাইন এ-র পনি টেল, টেন বি-র স্টিল ফ্রেম সব হাওয়া। ওই হাওয়া দিতে গিয়ে।
পাড়ায় বাচ্চাদের জন্মদিনে নেমন্তন্ন থাকলে খেলনা নিয়ে আগে আগে যেতাম। অবধারিতভাবে দায়িত্ব পড়ত বেলুন ফোলানোর। চোরা লিকওলা বেলুন ফোলাতে গিয়ে চোয়াল ব্যথা করে ফেলতাম।
পাড়ায় এক স্বাস্থ্যকর্মী ছিলেন। ভদ্রলোকের ডিউটি ছিল বাড়ি বাড়ি গিয়ে ‘হাম দো হামারা দো’-র মাহাত্ম্য প্রচার ও সরকারি কন্ডোম বিলি করা। এদিকে ভদ্রলোকের নিজের বাড়িতেই বছর বছর সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। নিন্দুকেরা বলত, অমুক বাবুর জিনিস ভুলেও নিও না। ওগুলো সব লিক মাল।
মন্দার বোস রাস্তায় বোতল ভেঙে ফেলুদার যাত্রাভঙ্গ করতে চেয়েছিল, কিন্তু টেলিপ্যাথির জোরে ফেলুদা সে যাত্রা রক্ষা পায়।
কিন্তু এখন যে দেশভর লিকি সিচুয়েশন চলছে, তা দেখে বিস্ময় বাঁধ মানছে না। দনাদ্দন প্রশ্নপত্র লিক। নেট লিক, নিট লিক। পরীক্ষার্থী দেখছে, পাশের কম্পিউটারে অটোমেটিক ঠিক উত্তরগুলো টিক পড়ে যাচ্ছে। ভূতুড়ে কাণ্ড! লাখ লাখ টাকা গার্জিয়ানরা অসৎ কাজের জন্য দিচ্ছে, যাতে ছেলেমেয়েরা মানুষের মতো মানুষ হতে পারে! মেধাবী ক্লাস আর গাধা বি-ক্লাস এক দর হয়ে যাচ্ছে! আর নগরে আগুন লাগলে দেবালয় কি রক্ষা পায়? ঘটা করে কয়েক মাস আগে উদ্বোধন হল রামমন্দির, মনসুন শুরু হতে না হতেই ছাদ লিক করে জল পড়ছে। পুরনো বাবরি মসজিদের ছাদের ছবি দিয়ে মিম হচ্ছে, এটা চারশো বছর টেকসই ছিল। এত যে হিসেব করে বিজ্ঞানীরা রামলালার মুখে সূর্যালোকসম্পাতের হিসেব কষলেন, বেসিক মন্দির নির্মাণেই গলদ!
কাঠবেড়ালির গায়ে ডোরাকাটা দাগ কেন আমরা সবাই জানি। বীর হনুমানের দল সেতুবন্ধনে বড় বড় পাথর বইলেও কাঠবিড়ালি তার ছোট্ট পিঠে বালি বয়েছিল ওই সেতুবন্ধনে কাজে লাগবে বলে। রামচন্দ্র পরম মমতায় কাঠবিড়ালির পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। ওটা সেই ভালোবাসার দাগ। অর্থাৎ, জগতে আনন্দ যজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণ। কেউ খাটো নয়। সদর্থে সবার সঙ্গে সবার উন্নয়ন। টাকার জোরে কেউ অশ্লীল অন্যায় সুযোগ পাবে না, ধর্মপরিচয়ের জন্য কাউকে খাটো করা যাবে না, বিরুদ্ধমত পোষণ করলেই তাকে দমন করা যাবে না। অন্য মতকে, অপরকে সমান সম্মান ও সুযোগ দিতে হবে। কর্তৃপক্ষ কি সে কথা মনে রাখে?
আমাদের ছবি আঁকার জায়গা হিসেবে জুটল কলকাতা আর্ট কলেজের বারান্দা
হঠাৎ একদিন সকালে গান্ধী মেমোরিয়ালের হোস্টেলে এলেন বিখ্যাত গণসংগীত শিল্পী জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। আমাদের জন্য নতুন একটা গান লিখে দিলেন এবং সুর করে শিখিয়ে দিলেন।